পুরনো আকাশে ঈদের চাঁদ

Published : 30 July 2011, 01:47 PM
Updated : 18 July 2015, 08:18 AM

চাঁনরাতে কেনাকাটা, সেলামির টাকা নিয়ে ঈদের দিনে চকের মেলায় যাওয়া, সেমাই, জর্দা, ফিরনির সুবাস, লালবাগের কেল্লার বাগানে ঘুরে বেড়ানো– পুরনো ঢাকায় ঈদের মজাই আলাদা। ঢাকার নবাব এখন আর না থাকলেও পুরনো ঢাকার নবাবি মেজাজ কিন্তু রয়ে গেছে। পুরনো ঢাকার অধিবাসীরা তাদের রীতি-রেওয়াজ-ঐতিহ্য অনুযায়ীই পালন করেন ঈদ উৎসব।

শবে বরাতের পর থেকেই রোজা আর ঈদের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। শবে বরাতের সন্ধ্যায় বাজি পটকা ফুটানো ঢাকার পুরনো রেওয়াজ। নানা রকম নকশাদার রুটি তৈরি হয়। এসব রুটিতে আয়না ও পুতি বসানো থাকে। মূলত বনরুটির উপরেই এসব কারুকার্য করা হয়। এগুলো আকারে হয় বেশ বড়। সঙ্গে থাকে নানা রকম হালুয়া ও মিষ্টি। রোজার সময় পুরনো ঢাকার ইফতারির বাজার জমজমাট হয়ে ওঠে। সে সময় ঈদের কেনাকাটাও চলতে থাকে। শেষরাতে কাসিদা বিখ্যাত। কাসিদা গেয়ে ঘুম ভাঙানো হয় রোজাদারের।

শবে বরাতে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশির বাড়িতে হালুয়া-রুটি পাঠানোর যেমন রীতি রয়েছে তেমনি রোজার মাসে প্রতিবেশির বাড়িতে ইফতারি পাঠানোও রেওয়াজ। কার রান্না কত ভালো তার অদৃশ্য প্রতিযোগিতাও চলে। রোজার সময় পুরনো ঢাকা প্রায় সারা রাতই সরগরম থাকে। হোটেল রেস্টুরেন্ট খোলা থাকে। সেহেরি পরিবেশিত হয় রেস্টুরেন্টে। ঈদ যত কাছে আসতে থাকে ততই উৎসবের আমেজ বাড়তে থাকে। কেনাকাটার ধুম লাগে।

ঈদের চাঁদ আকাশে দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় ঈদের উৎসব। বাজি পটকা ফুটিয়ে সূচনা হয় উৎসবের। বাড়ির ছাদে উঠে ঈদের চাঁদ দেখার আনন্দই আলাদা। ঈদের চাঁদ দেখার সঙ্গে সঙ্গে বাজি পটকা পুড়ানো শুরু হয়, চলে রাতভর।

শুরু হয় মেহেদি লাগানোর পালা। আজকাল অবশ্য দোকান থেকে কিনে আনা 'কোণ' মেহেদির যুগ। তবে বাটা মেহেদির আবেদন এখনও একেবারে ফুরিয়ে যায়নি। যৌথ পরিবার হলে চাচাতো মামাতো খালাতো ফুপাতো বোনেরা আর ভাবীরা একসঙ্গে মিলে বসেন মেহেদি লাগাতে। আর না হলে মহল্লার প্রতিবেশি বান্ধবীরা একসঙ্গে মিলে চলে মেহেদি নকশা আঁকার ধুম। সেই সঙ্গে চলে হাসি-তামাশা আর নানা রকম গান। কার নকশা কত ভালো হয় সেই প্রতিযোগিতাও চলে বৈকি। মেহেদির এই আসর মেয়েদের নিজস্ব। তবে কমবয়েসী ছেলেরাও কখনও কখনও বসে পড়ে এই আসরে আড্ডা আর হাসি-তামাশার আকর্ষণে।

আমি নিজে ঢাকাইয়া। শৈশব থেকে ঈদের এই চাঁনরাতের আনন্দে অংশ নিয়েছি। বাটা মেহেদি দিয়েও সূক্ষ্ম নকশা আঁকতে দেখেছি আমার চাচাতো বোনদের। আবার প্রতিবেশি বান্ধবীরাও কম যেত না মেহেদির নকশা আঁকায়। যার নকশা আঁকার হাত ভালো তাকে নিয়ে চলত কাড়াকাড়ি। ছেলেরাও মেহেদি লাগায় হাতে, তবে তা তেমন নকশাদার নয়, সামান্য একটু লাল করে নেওয়া অথবা হাতের তালুতে গোল করে চাঁদ-তারা আঁকা।

ঈদের চাঁদ দেখা যাওয়ার পর পরই জমে ওঠে চাঁনরাতের বাজার। চকবাজার, বেগম বাজার, বংশাল, উর্দুরোডে শুরু হয় ঈদের বেচাকেনা। মাংস, গরম মশলা, চাল, চিনি, সেমাইয়ের মতো জিনিসের বেচকেনার জন্য ঠাটারি বাজার আর কাপ্তান বাজার সরগরম হয়ে ওঠে। কসাইটুলিতে বিক্রি হতে থাকে গরু ও খাসির মাংস। ভেড়ার মাংসেরও রয়েছে আলাদা চাহিদা।

ঈদের কাপড় আর ইমিটেশনের গয়না, জুতো, টুপি বিক্রি হয় এ সময় বেশি। দেশের বৃহত্তম ইমিটেশনের মার্কেট হল চক মোগলটুলিতে। মোগল আমল থেকেই এখানকার বাজারে বিক্রি হয় শাড়ি, বেলোয়ারি কাঁচের চুড়ি আর নানা রকম পোশাক। শেষ মুহূর্তের কেনাকাটায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন পুরনো ঢাকাবাসী। চাঁদরাতে বন্ধুবান্ধব মিলে ঘুরে বেড়ানো ঢাকার রীতি। যদি সব কিছু আগে ভাগে কেনা হয়েও যায় তবু চাঁদরাতে শপিং না করলে ঠিক যেন মন ভরে না। কেনাকাটার জন্যও শুধু নয়, এমনি ঘুরে বেড়াতেও দেখা যায় অনেককে। বাড়িতে বাজানো হয় গান। চাঁদরাতের উৎসব জমে ওঠে। আমরা ঢাকাইয়ারা কিন্তু চাঁদরাত বলি না। আমাদের ভাষায় এটি 'চাঁনরাত'।

ঈদের ঐতিহ্যের আরেকটি বড় অনুষঙ্গ আতর। ইসলামপুরের আতরপট্টিতে চাঁদরাতে জমে ওঠে বেচাকেনা। ঈদের জামাতে যাওয়ার সময় কানে আতর মাখা তুলো গুঁজে যাওয়া ঢাকার রেওয়াজ। কত রকম আতর, কত বিচিত্র তাদের নাম আর খুশবু। গোলাপখাস, দরবারি খাস, মেশকাম্বার, শাহী দরবার, গুলবাহার। ঈদের দিন আতরদানিতে হরেক রকম আতর সাজিয়ে রাখা হয় বৈঠকখানা ঘরে। সে আতরদানি হতে পারে রূপা, কাঁসাপেতল বা কাঁচের। তাতে থাকে চিত্রবিচিত্র নকশা। অনেক পরিবারে বংশ পরম্পরায় একই আতরদান ব্যবহার করা হয়। এসব আতরদান খানদানি বংশের স্মারক।

পুরনো ঢাকায় মসজিদের অভাব নেই। ছোট বড় সব মসজিদেই অনুষ্ঠিত হয় ঈদের জামাত। যারা ভোরে ঘুম থেকে উঠতে পারেন না তাদের জন্য সবচেয়ে দেরিতে ঈদের জামাত হয় লালবাগের কেল্লার শাহী মসজিদে। সেই সুবেদার শায়েস্তা খাঁর আমল থেকেই এখানে ঈদের জামাত হচ্ছে।

মোগল আমলে ঈদ-উৎসবের রোশনাই যে রাজকীয় ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। চকবাজারের জুমা মসজিদে হয় বিশাল জামাত। এই মসজিদের নাম শাহী মসজিদ। শায়েস্তা খাঁর আমলেই ১৬৭৬ সালে নির্মিত হয়েছিল এই মসজিদ। এখানে ঢাকার নায়েবে নাজিমরা একসময় ঈদের নামাজ পড়তেন। তিন গম্বুজওয়ালা এই মসজিদটি অবশ্য ব্যাপক সংস্কারের ফলে প্রাচীন চেহারা হারিয়েছে। কিন্তু এখানে ঈদের নামাজ পড়া এখনও চকবাজারের অধিবাসীদের জন্য ঐতিহ্যের পরিচায়ক।

মোগল আমলে ঢাকার ঈদগাহ ছিল ধানমণ্ডিতে। শাহ সুজা যখন বাংলার সুবেদার হয়ে আসেন তখন তাঁর এক ওমরাহ মীর আবুল কাশেম সেটি নির্মাণ করেছিলেন ১৬৪০ সালে। এর পাশ দিয়ে তখন বয়ে যেত পাণ্ডু নদীর শাখা। সেই শাখানদী জাফরাবাদে সাতগম্বুজ মসজিদের কাছে মিলিত হত বুড়িগঙ্গার সঙ্গে। মোগল আমলে এই ঈদগাহতে সুবে বাংলার নাজিম সুবেদাররা তাদের পরিবার পরিজনদের নিয়ে ঈদের নামাজ পড়তেন।

পুুরনো ঢাকার ঈদের আরেক আকর্ষণ মেলা। ঈদের দিন সকাল থেকে মেলা বসে চকবাজারের কেন্দ্রে। সে মেলায় বিক্রি হয় হরেক রকমের খেলনা। নাগরদোলা বা চড়কি থাকে মেলায়, জেলখানার প্রাচীর ঘেঁষেই। সে নাগরদোলায় চড়ার আগ্রহ ছেলেবুড়ো কারও কম নয়। ঈদের নামাজ পড়ে এসেই সালাম করতে হয় মুরুব্বিদের। বিনিময়ে পাওয়া যায় সেলামি বা ঈদি। নতুন চকচকে টাকা হলে সেলামি পাওয়ার মজাটা বেশি জমে।

সেলামির টাকা নিয়েই যাওয়া যায় চকের মেলায়। মেলা বসে সুরিটোলার মাঠেও। মেলায় মাটির খেলনা যেমন পাওয়া যায় তেমনি একেবারে চীন থেকে সদ্য আমদানি করা খেলনারও অভাব নেই। চকের মেলার পাশেই ফ্রেন্ডশিপ মার্কেট। আমদানি করা জিনিসের জন্য বিখ্যাত। সেখান থেকেই নিত্যনতুন খেলনা আসে মেলায়। মেলায় আরও বিক্রি হয় মুরলি, কটকটি, বাদামতক্তির মতো মিষ্টি খাবার।

ঈদের মেলা সাধারণত তিনদিন থাকে। আর মহল্লার ভিতরে ছোট ছোট অস্থায়ী দোকানে খেলনা বিক্রিও চলে ঈদের তিনদিন।

ঈদের দিন ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে বেড়ানোর রীতি পুরনো ঢাকায় এখনো রয়েছে। ঈদ উপলক্ষ্যে ঘোড়ার গাড়িগুলোকে সাজানো হয় জরি আর কাগজের ফুল দিয়ে। ঘোড়ার সেই চেকনাই অবশ্য আগের মতো নেই, নেই গাড়োয়ানদের সেই নবাবি রমরমা। তবু তাদের রসিকতার ঐতিহ্যটি অক্ষুণ্ন রয়েছে।

ঈদের মিছিল বা শোভাযাত্রা ঢাকাবাসীর আরেকটি ঐতিহ্য। মোগল আমলেও ঈদের মিছিল বের হত। নবাবি আমলে ঈদের মিছিলের ছিল দারুণ শানশওকত। ইংরেজ আমলে ঢাকার নবাবদের উদ্যোগে বের হত ঈদের আনন্দ মিছিল। এখনও ঈদের মিছিল বের হয়। 'আমরা ঢাকাবাসী' নামের সংগঠনটির উদ্যোগে প্রতি বছরই ঈদের আনন্দ মিছিল শহরের অনেক এলাকা পরিভ্রমণ করে।

ঈদের প্রসঙ্গে ঈদের বিশেষ পোশাকের কথা তো বলতেই হয়। আমরা ঢাকাইয়ারা চাকচিক্যময় পোশাক ভালোবাসি। অবশ্য ব্যক্তিবিশেষে পছন্দের হেরফের ঘটতে পারে। তবে সাধারণভাবে বলা যায় শাড়ি, লেহেঙ্গা বা সালোয়ার কামিজ, পোশাক যাই হোক না কেন তা যদি চাকচিক্যময় বা উজ্জ্বল রঙের না হয়, তবে তা আমাদের পছন্দ হয় না। ছেলেরাও ভালোবাসেন জরির বা সুতোর কাজ করা সিল্কের পাঞ্জাবি বা কাবলি কুর্তা। নতুন কাপড় বান্ধবীদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখার রেওয়াজ ছিল একসময়। এখনও তা কিছুটা রয়েছে। আর পোশাকের সঙ্গে যে গয়নার ঘটা আর সাজের বাহার থাকবে তা বলা বাহুল্য।

ঈদের দিনে লালবাগ কেল্লার বাগানে, আহসান মঞ্জিলে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসেন ঢাকার তরুণতরুণীরা। আর আত্মীয়বন্ধুদের বাড়িতে বেড়ানোর রীতি তো রয়েছেই।

ঈদের প্রসঙ্গে ঢাকার খাবারদাবারের কথা না বললে কি চলে। পোলাও বা বিরিয়ানি রাঁধা হয় বিভিন্ন রকমের। যেমন, শাহী বিরিয়ানি, কাচ্চি বিরিয়ানি, তেহারি, কোপ্তা পোলাও, শাহী পোলাও, মোরগ পোলাও ইত্যাদি। কোরমা আর রেজালাও চাই। মুরগির রোস্ট, টিক্কা কাবাব,খাসীর পায়ের রোস্ট, গরুর কাবাব, হান্ডি কাবাব– যে যত রকমের পারেন। সকালে চাই ফিরনি, জর্দা, সেমাই, দুধসেমাই আর বাখরখানি। বিকেলে চটপটি, ঘুগনি, দহিবড়া। পানীয় থাকবে বোরহানি, লাচ্ছি, সরবত, পেস্তার সরবত। ঢাকার খাবারের নাম বলে শেষ করা যাবে না। কার বাড়ির খাবার কত ভালো হল সে প্রতিযোগিতাও কি নেই? খুব আছে।

সব মিলিয়ে পুরনো ঢাকার ঈদ মানেই নবাবি মেজাজের ঈদ। যতই আধুনিকতার ছোঁয়া লাগুক পুরনো ঢাকাবাসীর জীবনে, ঐতিহ্যবাহী রীতি-রেওয়াজ পালনে তারা কখনও বিমুখ নন।