রাজনের মতো ঘটনা আরও আছে, কেবল ভিডিও নেই

হাসান মামুনহাসান মামুন
Published : 15 July 2015, 03:35 AM
Updated : 15 July 2015, 03:35 AM

চোর সন্দেহে পেটানো বা পিটিয়ে হত্যার ঘটনা কি এ দেশে কম? শিশু-কিশোরদের ওপরও কি এমনটি কম ঘটে থাকে? কিংবা অতীতে কম ঘটেছে? তথ্য-পরিসংখ্যান নেই, তবে মনে হয় অতীতে এসব আরও বেশি করে ঘটত। কথা হল, আমরা জানতে পারতাম কম। এখন চট করেই জানতে পারি, বিশেষত ইন্টারনেটের যুগে। তারও আগে মিডিয়ার প্রসারের কারণে আমরা ঘটনাগুলো দ্রুত জানতে পেরেছি।

দেশে এক সময় ফতোয়াবাজি, বিশেষত এর মাধ্যমে নারীর ওপর জুলুম খুব বেড়ে গিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালে নূরজাহানকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা আমাদের নাড়া দিয়েছিল খুব। দ্রুত সেটা সংবাদপত্রে এসে গিয়েছিল বলেই। মনে পড়ে, দৈনিক 'সংবাদে' এ বিষয়ে একটি প্রতিবাদমুখর নিবন্ধ লিখেছিলাম। এক সময় তো এ নিয়ে রিট হয় এবং ফতোয়াবাজির বিষয়ে হাইকোর্টের একটি বহুল আলোচিত রায়ও রয়েছে।

এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা ফেসবুক-টুইটারের যুগ। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার পর অনলাইন সংবাদপত্রগুলোও দ্রুত কোথায় কী ঘটছে, তার খবর তুলে দিচ্ছে। এরও আগে ইউটিউব বা ফেসবুকে আপ করা কোনো ছবি বা ঘটনার বিবরণে আলোড়ন সৃষ্টি হচ্ছে দেশে। এমনকি বিদেশে। সিলেটে চুরির অভিযোগে নির্যাতিত হয়ে মৃত্যুবরণকারী শিশু সামিউল আলম রাজনের ঘটনাটিও তেমনি। এ ধরনের ঘটনা বিরল না হলেও নির্যাতনকারীরা ওটার ভিডিওচিত্র ধারণ করে নিজেরাই তা নেটে ছড়িয়ে দেওয়ায় বিষয়টি অনেক বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।

ভিডিওটি দেখার সাহস আমার হয়নি। ফেসবুকেও যথাসম্ভব এড়িয়ে গেছি রাজনের ওপর নির্যাতনের দৃশ্যবাহী স্থিরচিত্রগুলো। সেখানে তার চোখভরা বিস্ময় আর বাঁচার আকুতি আমার বুক চিরে ঢুকে পড়েছে ভেতরে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্থির থাকতে দেয়নি। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল দারুণ এক জয় পেল শক্তিশালী দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। সে আনন্দের মাঝেও এসে হানা দিয়েছে অজানা-অচেনা ওই শিশুর মুখ।

স্থির হওয়ার পর ভাবছি, নির্যাতনকারীরা ছেলেটিকে পেটানোর সময় ভিডিও ধারণ না করলে কিংবা সেটি করার পরও নেটে না দিলে–একটা সময়ে এসে ঘটনা জানলেও আমরা কি এতটা আলোড়িত হতাম? এটা মানি, রাজন শিশু না হয়ে বয়স্ক কেউ হলে ভিডিওচিত্রটি দেখেও এতটা আলোড়িত হতাম না। শিশু নির্যাতনের ঘটনা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কেউই সহজে নিতে পারে না। যাদের নিজের সন্তান নেই, তারাও।

মাঝে শিশু অপহরণের ঘটনা বেড়ে গিয়েছিল রাজধানীতে। তখন ফেসবুকে এক নারীবন্ধু জানালেন তার স্কুলের একটি ছেলে অপহৃত হওয়ার খবর। অপহরণকারীরা মুক্তিপণ চাইছিল। আর তিনি তার পরিবারের হয়ে আমাদের মতো লোকদের কাছে চাইছিলেন বুদ্ধি-পরামর্শ ও সহায়তা। পুলিশে খবর দেবেন কী দেবেন না, এ-ই করতে করতে তার মাটিচাপা দেওয়া লাশ মিলল নারায়ণগঞ্জে।

ওই শিশুকে কীভাবে মারা হয়েছে, তা কিন্তু কেউ জানি না। মরদেহ পরীক্ষা করে চিকিৎসক বলেছেন, শ্বাসরোধ করে আগেই মারা হয় তাকে। মিষ্টি ওই শিশুর শেয়ার করা ছবি এখন ঝুলছে আমার ফেসবুক ওয়ালে। স্কুলের একটি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে সবুজ গেঞ্জি পরে যে নেচেছিল; তার ছবি। ওই ঘটনায় দুএকজন ধরা পড়েছিল বলে খবর পাই। কিন্তু ফলো-আপ জানি না। অপহরণকারীরা তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা ও দেহটি মাটিচাপা দেওয়ার দৃশ্য যদি ভিডিও করে নেটে ছড়িয়ে দিত, তাহলে ওই ঘটনাও কম আলোড়ন সৃষ্টি করতো না।

আমাদের সবার নিশ্চয়ই মনে আছে নারায়ণগঞ্জে ত্বকী হত্যার ঘটনা। ভয়ানক নির্যাতন করে নিরীহ ওই কিশোরকে মারা হয়। তার মায়াভরা চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছিল। মনে নিশ্চয়ই আছে চট্টগ্রামে এক তরুণকে ক্ষেপা কুকুর দিয়ে কামড়িয়ে হত্যার ঘটনা। ভাগ্য ভালো যে, এসবের কোনো ভিডিওচিত্র নেই।

রাজন হত্যাকারীরা কেন ভিডিওচিত্র ধারণ ও তা প্রচার করতে গেল, বোধগম্য নয়। ঘটনাটি তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করায় প্রশাসন স্বভাবতই নড়েচড়ে বসেছে। ধরপাকড় শুরু করেছেন তারা। এমনকি ধরা হচ্ছে প্রত্যক্ষদর্শীদের। রাজনের এক হত্যাকারী কীভাবে যেন দ্রুত চলে গিয়েছিল সৌদি আরব। তাকে ওখানে ধরা হয়েছে। এ জন্য আমাদের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দিতে হবে। সৌদিপ্রবাসী ওই লোককে পাকড়াও করতে তিনি ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগী হন। ওখানকার দূতাবাসও সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। এখন বিচারে সোপর্দ করার জন্য তাকে দেশে আনাটা জটিলতার আবর্তে পড়ে কিনা, সেটা দেখার বিষয়।

দেশেও রাজন হত্যায় অংশ নেওয়া তার বড় ভাইকে আটক করে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। অন্যরাও হয়তো ধরা পড়ে যাবে। পুলিশ প্রশাসন তৎপর হলে এ জাতীয় অপরাধীদের ধরা কঠিন কিছু নয়। এটা অতীতেও দেখেছি। সমস্যা দেখা দেয় অপরাধীরা ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িত হলে। এর তস্য লোকজনকে ধরে বিচারে সোপর্দ করাটাও দেখি কঠিন হয়ে পড়ে মাঝে মাঝে। তখন বুঝতে পারি, কত সুন্দর আইনের শাসনে আমরা আছি! কপাল ভালো বলতে হবে, রাজন হত্যাকাণ্ডে জড়িতরা রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। তারা বড়জোর স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী।

প্রভাবশালী, নৃশংস ও বিকারগ্রস্ত এবং মাথামোটা। প্রভাবশালী বলেই স্থানীয়ভাবে তারা বাধার মুখে পড়েনি ওই রকম কাজ করতে গিয়ে। আর সব শেষে মাথামোটা বলছি এ জন্য যে, অপরাধের প্রমাণ নিজেরা সংরক্ষণ করে তা আবার সবার হাতে তুলে দিয়েছে এরা। এমনটা ইতোপূর্বে ঘটেছে বলে মনে পড়ে না। তবে নারীনিগ্রহের ক্ষেত্রে এটা ঘটে থাকে। এ ধরনের ঘটনা ভিডিও করে যারা নেটে ছড়িয়ে দেয়, তারা নিজেরাও থাকে ওইসব চিত্রে। জানি না, এসব ক্ষেত্রে বিচারে কতটা কী অগ্রগতি হচ্ছে।

রাজন হত্যাকারীদের ধরে 'ক্রসফায়ারে' দিলে বিক্ষুব্ধ লোকজনের অধিকাংশই খুশি হত। সে রকম প্রতিক্রিয়াই তারা ইতোমধ্যে জানিয়েছে ফেসবুকে। ফেসবুক না থাকলেও আমরা বুঝতে পারতাম, সাধারণ লোকজন এমনটাই ভাবছে। কিন্তু আইনকে তার নিজস্ব পথে চলতে দিতে হবে। বর্বরদের বিচারের সুযোগ আইনে রয়েছে বৈকি। দ্রুত বিচারে তাদের উপযুক্ত শাস্তি বিধানের সুযোগও রয়েছে।

রাজন হত্যাকারীদের পক্ষে কোনো আইনজীবীকে আদালতে না দাঁড়ানোর অনুরোধ জানানো হয়েছে। তারপরও কেউ দাঁড়ালে কিছু বলার থাকবে না। কিন্তু ঘটনা যে মাত্রায় স্পষ্ট, তাতে ওই বর্বরোচিত কাণ্ডে জড়িতদের বাঁচানো বোধহয় সম্ভব নয়। ফেসবুক শান্ত হয়ে এলেও এর বিচারপ্রক্রিয়া এগিয়ে যাবে বলে আশা করব। ঘটনাটি সর্বস্তরের মানুষের বিবেকে যেভাবে নাড়া দিয়েছে, তাতে এ বিষয়ে গাফিলতির সুযোগও নেই।

রাজধানীতে হরতালের মধ্যে এক নিরীহ যুবককে কুপিয়ে হত্যা করেছিল ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র ও যুবকর্মীরা। মিডিয়ায় তার ফুটেজ রয়ে যায় বলে সেটিও কম আলোড়ন সৃষ্টি করেনি। ঘটনায় জড়িতদের ধরা ও তাদের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে জল ঘোলা করা হয়েছিল বলে মনে পড়ছে। শেষ পর্যন্ত তাদেরও বিচার কিন্তু করতে হয়েছে। সেটা নিয়ে আপত্তি থাকতে পারে; তবে বিচার এড়ানো যায়নি। শিশু রাজন হত্যার ঘটনায় বিচার এড়ানোর সুযোগ আরও নেই।

এও স্বীকার করতে হবে, চুরির অভিযোগে ধৃত ওই শিশুকে প্রহার থেকে বাঁচাতে স্থানীয় কেউ এগিয়ে আসেনি। ধরে নেওয়া যাক, গরিব ঘরের স্কুল ছেড়ে দেওয়া সবজি বিক্রেতা ছেলেটি কিছু একটা চুরি করেছিল। তাই বলে তাকে ওইভাবে প্রহার করতে হবে? দীর্ঘ সময় ধরে, দফায় দফায়, নানা কায়দায়? এ প্রশ্ন তুলে কেউ তাকে রক্ষায় এগিয়ে আসেনি বা আসার সাহস দেখায়নি। সব ক্ষেত্রেই এটা ঘটে, তা কিন্তু নয়। তবে এমনটা ঘটার প্রবণতা সমাজে বেড়েছে বলেই মনে হচ্ছে।

অপকাণ্ডটি ঠেকাতে উদ্যোগী না হয়েও পুলিশে খবর দেওয়া যেত এ সেলফোনের যুগে। ভয়াবহ পিটুনিতে রাজন মারা গেলে তার লাশ গুম করার সময় এলাকাবাসীর একাংশের সহায়তায় একজন নির্যাতনকারীকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়েই পুলিশ ঘটনাটিতে প্রবেশ করে। তারা সময়মতো এসে হাজির হলে ছেলেটি আহত হয়েও হয়তো বেঁচে যেত। সে ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নির্যাতনের ভিডিওচিত্রটি হয়তো আপ করাও হত না।

হত্যাকারীদের কে ওই কাজ করেছিল, সেটা বের করে তার মনস্তত্ত্ব জানা দরকার। তারা এর ভিডিওচিত্র ধারণই-বা করেছিল কেন? কিছুই মিলছে না। এমন বিকারগ্রস্ত অপরাধীর দেখা যে অন্য কোথাও মেলে না, তা নয়। আমাদের দেশে এ পর্যন্ত মেলেনি বলেই হয়তো অবাক হচ্ছি। আত্মধিক্কারে জর্জরিত হয়ে অনেকে নিজেদের বিষয়ে খুব নেতিবাচক কথাবার্তাও বলে ফেলছি।

আবারও বলি, চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা এ নিবন্ধ প্রকাশের আগে হয়তো আরেকটি ঘটবে। অল্পবয়সী কাজের ছেলেমেয়েকে নৃশংসভাবে নির্যাতন কি কম ঘটে? সেগুলোর ভিডিওচিত্র ধারণ আর তা প্রচার করলেও হয়তো আমরা একইভাবে উৎকণ্ঠিত হতাম। গৃহবন্দী করে দিনের পর দিন তাদের বিকৃতভাবে নির্যাতনের ঘটনা কিন্তু প্রচুর রয়েছে।

রাজন হত্যার দুএকদিন আগে হিজড়া সম্প্রদায়ের একজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। তাতে নাকি ছিল পূর্বশত্রুতা। রাজন হত্যায়ও কি তেমন কিছু ছিল? চোর সাব্যস্ত করে নির্দয়ভাবে পেটানো– যেমন, নোখ উপড়ে ফেলা, চোখ উৎপাটন আমাদের ছায়া সুনিবিড় গ্রামেও অনেক ঘটেছে। এখনও ঘটে। এ বিষয়ে প্রয়াত হূমায়ুন আহমেদের একটি অসাধারণ গল্প পড়েছিলাম বলে মনে পড়ছে।

প্রসঙ্গত বলি, এক বন্ধুর বাবা তার বাড়িতে সংঘটিত দুর্ধর্ষ চুরির ঘটনা তদন্ত করতে বললে স্থানীয় এক প্রভাবশালী ব্যক্তি একজনকে চোর সাব্যস্ত করে তার দুই হাতের আঙুল থেতলে দেন। মাফ চাওয়াতে আবার হাঁটিয়ে ওই বাড়িতে নিয়ে আসেন কথিত চোরকে। বন্ধুর বাবা হতবিহ্বল হয়ে তখন বলেছিলেন– 'হায় হায়, লোকটাকে তো আপনি পঙ্গু করে দিলেন! এ তো আমি চাইনি'।

জানি না ওই ফৌজদারি অপরাধের কী বিচার হয়েছিল। চোর সাব্যস্ত করে নির্যাতন, ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনি, গৃহকর্মী, এমনকি স্ত্রীনির্যাতন দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের জীবনধারার অংশ হয়ে রয়েছে। এসব প্রতিরোধে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন হয়ে এগিয়ে যাওয়াটাও কঠিন। তারপরও বলি, রাজন হত্যা রোধ করা যেত কোনোমতে পুলিশে খবর দেওয়া গেলে। আজকাল তো ভিক্ষুকের হাতেও সেলফোন দেখা যায়।

রাজন হত্যার ঘটনা আমাদের মধ্যে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, এটা ভালো কথা। কিন্তু এ আত্মসমালোচনা বা জিজ্ঞাসা বেশিক্ষণ স্থায়ী হবে বলে মনে হয় না। তার প্রধানতম কারণ হল, তীব্রভাবে সামনে চলে আসা ঘটনা নিয়েই আমরা আলোড়িত হই। চোখের আড়ালে নিগ্রহ, নির্যাতন ও হত্যার যেসব লোমহর্ষক ঘটনা ঘটছে, সেসব কল্পনা করতে বা তা নিয়ে ভাবতে আমরা চাই না।

সামিউল আলম রাজনের ঘটনাটি ভিডিওর মাধ্যমে চোখের সামনে চলে না এলে এ খবর সম্ভবত স্থান পেত জনপ্রিয় সংবাদপত্রের শেষের পাতায়। খবরটি অনেকে হয়তো পড়তামও না ঈদের ব্যস্ত বাজারে। রাজনের অদ্ভুত প্রকৃতির হত্যাকারীরা সেটা হতে দেয়নি। ঘটনাটি চোখ খুলে দেখতে এবং তা নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাতে তারা বাধ্য করেছে আমাদের। আমাদের ঝিমিয়ে পড়া বিবেক তারা জাগিয়ে তুলেছে!

রাজনের হৃদয়-মন দুমড়ে দেওয়া ঘটনাটি ধরে এ জাতীয় অপরাধের গোটা চিত্রটি স্পর্শ করতে চাইলাম বলে পাঠক নিশ্চয়ই আমায় ভুল বুঝবেন না।


হাসান মামুন:
সাংবাদিক, কলামিস্ট।