নগর পুড়লে দেবালয় এড়ায় না

সঞ্জয় দে
Published : 14 July 2015, 12:21 PM
Updated : 14 July 2015, 12:21 PM

বছর খানেক আগের কথা। রাত দেড়টার দিকে অফিস শেষে বাসায় ফিরব; তখনই খবর এল রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের সামনের রাস্তায় অজ্ঞাতপরিচয় একজনের মৃতদেহ পড়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের প্রতিবেদক রওনা হলেন, আমরা কয়েকজন অফিস-ফেরত মানুষও গেলাম সেখানে। এর ঘণ্টাখানেক আগেই ঢাকার প্রায় সব জায়গায় প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি হয়েছে। ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখি, পুলিশের কিছু সদস্য ফুটপাতে দাঁড়িয়ে, খানিকটা দূরে র‌্যাবের একটি গাড়িও রয়েছে। কয়েক জন সংবাদকর্মী জটলা করে দাঁড়িয়ে।

মৃতদেহ কোথায় জানতে চাইলে একজন খোলা রাস্তায় ইশারা করলেন। মুহূর্তে আঁতকে উঠতে হয়েছিল, সামনের বেশ কিছু অংশ জুড়ে ইতস্তত ছড়ানো-ছিটানো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হাড়গোড়, কোথাও-বা কিছুটা মাংসের পিণ্ড, আমার পায়ের নিচেই মগজজাতীয় কোনো কিছু। মোটামুটিভাবে ৫০ গজ রাস্তাজুড়ে ছড়িয়ে কোনো এক বেওয়ারিশ মানবশরীর। ঝামেলা এড়াতে পুলিশের তাৎক্ষণিক দাবি, ঝড়ের মধ্যে রাস্তা পার হতে গিয়ে হয়তো বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছেন এক দুর্ভাগা পথচারী। এরপর একের পর এক গাড়ি তাকে পিষে দিয়ে যাওয়ায় রাস্তার এই বেহাল!

এই দাবির বস্তুনিষ্ঠতা সম্পর্কে আমরা কেউই নিঃসংশয় হতে পারিনি, বরং সবার মধ্যে সংশয়ের দোলাচল ছিল। রাস্তা পার হতে গিয়ে প্রাণ হারানো কোনো ব্যক্তির দেহ মাত্র এক ঘণ্টার ব্যবধানে প্রায় অণুকণায় বিলীন হয়ে ৫০ গজ জুড়ে ছড়িয়ে যেতে পারে কিনা সে প্রশ্ন ছিল সবার। তাছাড়া ঠিক ওই জায়গায় যে প্রকট দুর্গন্ধ ছড়িয়ে ছিল তা সদ্যমৃত কারও হতে পারে কিনা সে প্রশ্নও উঠেছিল। কারও কারও সন্দেহ ছিল, অন্য কোথাও কাউকে খুন করার পর ঝড়-বৃষ্টি-অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে তার দেহের টুকরাগুলো ছড়িয়ে দেওয়া হয়নি তো রাস্তায়!

এ নিয়ে আমরা কেউ খুব বেশি সময় 'নষ্ট' করে ঝামেলা বাড়াতে চাইনি। পুলিশেরও তাগাদা ছিল দ্রুত 'জঞ্জাল' সাফসুতরো করে থানায় ফিরে নিজেদের জমে থাকা কাজে মন দেওয়ার। তাই ডেকে আনা হয় কয়েকজন ঝাড়ুদারকে, তারা পেশাদারি ভঙ্গিতে রাস্তা ঝাঁট দেন। মৃতের অণুকণাগুলো জমা হয় ছোট পলিথিনের পোটলায়। খবর সংগ্রহের দায়িত্বপালন শেষ সংবাদকর্মীরা ফিরতে থাকেন অফিসের দিকে। আর ঘুমাব বলে আমরাও রওনা হই বাসার পথে।

মৃত সেই ব্যক্তির পরিচয় পাওয়া গেছে এমন কোনো তথ্য আমার অন্তত জানা নেই। ঘটনাটি সত্যিই সড়ক দুর্ঘটনা ছিল কিনা সে ব্যাপারেও আর হয়তো খোঁজখবর হয়নি। দিনের পর দিন এ ধরনের কত ঘটনাই তো ঘটে চলছে। বিলে-ঝিলে পড়ে থাকা বেওয়ারিশ লাশের খবর মাঝে-মধ্যেই তো পাই। সংবাদমূল্য কমে যাওয়ায় পত্রিকার ভেতরের পাতায় সে সব খবরের জায়গা হয়তো হয় সিঙ্গেল কলামে। আর টেলিভিশনে জায়গার অভাব বেশি হওয়ায় ঘণ্টা তিনেকের জন্য স্ক্রলে ঠাঁই পাওয়াই যথেষ্ট।

শুধু সংবাদমাধ্যম নয়, এ সব খবর এখন দেশের প্রতিটি নাগরিকের গা-সওয়া হয়ে যাচ্ছে। 'ছোটখাটো' ঘটনাগুলো এখন আমাদের আর 'টানে' না। তাছাড়া সম্ভবত আমরা সবাই নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনার 'যৌক্তিকতা' নির্ধারণ করায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। এমনকি অপরাধের 'নৈতিকতা'ও আমাদের মনের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে। সে জন্যই সম্ভবত খুন হওয়া ব্যক্তির সম্ভাব্য পরিচয় আমাদের কোনো না কোনোভাবে 'স্বস্তি' যোগায়। আমরা নিহত ব্যক্তির রাজনৈতিক পরিচয় জেনে তৃপ্তি পাই। তিনি নাস্তিক নাকি আস্তিক, সে খবরও আমাদের আশ্বস্ত করে। এভাবে কখনও লিঙ্গ-পরিচয়, কখনও জাতিগত পরিচয়, কখনও ধর্মীয় পরিচয় আমাদের কাছে অপরাধের মাত্রা লঘু করে দেয়। আর কিছু না পেলে 'সন্দেহভাজন'-এর তকমা তো আছেই।

আমরা সবাই যখন বছরের পর বছর, মাসের পর মাস, দিনের পর দিন খুনের পরিবেশ উৎসাহিত করছি তখন শিশু রাজনের মৃত্যু আমাদের কাঁদায় কেন?

রাজনকে যেভাবে পিটিয়ে মারা হয়েছে তার চার দিনের মধ্যে দেশের বিভিন্ন জায়গায় আরও অন্তত পাঁচ জনকে একইভাবে মারা হয়েছে। বরিশালের হিজলা উপজেলায় ডাকাত সন্দেহে পিটিয়ে মারা হয়েছে তিন জনকে। মোবাইল ফোন চুরির অভিযোগে নারায়ণগঞ্জে এক যুবককে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। নোয়াখালীর কোম্পানিগঞ্জে বিয়েবাড়িতে গান গাইতে যাওয়ায় মরতে হয়েছে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ লাকি আক্তার জাহাঙ্গীরকে। এই পাঁচ জনের পিটুনির ঘটনা আমরা হয়তো কোনো না কোনো 'নৈতিকতা'র মানদণ্ডে ফেলতে পেরেছি বলেই আমাদের চোখ সজল হতে বাধা পায়।

এখন প্রকাশ্য রাস্তায় চাপতির আঘাতে মগজ-বিচ্ছিন্ন মৃতদেহ দেখেও আমরা সোচ্চার হতে বাধা পাই। পেট্রোল বোমায় মানুষ পোড়া দেখে আমরা রাজনীতির হিসাব-নিকাশে মশগুল হই। ঈদের বাজারে সন্ত্রাসী-ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য কমানোর প্রয়োজনে এ সময়ে দু-চারজন পুলিশের গুলিতে মরলে আমরা আপত্তি করি না। বিচারবহির্ভূত হত্যায় নানান তকমা দিয়ে সমর্থন করার পদ্ধতিও আমরা শিখে গেছি। এমনকি যারা রাজন হত্যার নিন্দা জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরব তাদেরই কেউ কেউ আবার দাবি তুলছেন হত্যাকারীদের 'বিচার করতে হবে' বিচার ছাড়াই।

সাধারণ মানুষ-পেশাজীবী-বুদ্ধিজীবী-রাজনীতিক সবার এই অনিয়ন্ত্রিত প্রবণতা এবং অপরাধ ঠেকানোর নাম করে অপরাধে প্রশ্রয় দেওয়ার অস্বস্তিকর মানসিকতাই হয়তো সিলেটে রাজনের মৃত্যু অনিবার্য করে তুলেছিল। আর সিলেট থেকে এই 'অনিবার্যতা' আপনার আমার ঘরে পৌঁছাতেই-বা কতক্ষণ!

একটা কথা তো আমরা নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি, 'নগর পুড়লে দেবালয় এড়ায় না'।


সঞ্জয় দে:
ডেপুটি নিউজ এডিটর, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন।