ক্ষমা কর রাজন

জায়েদুল আহসান পিন্টু
Published : 13 July 2015, 04:54 AM
Updated : 13 July 2015, 04:54 AM

আমি এক মায়ের মুখচ্ছবি দেখতে পাচ্ছি। অনুধাবন করার চেষ্টা করছি তার ভেতরটা। যেন গগনবিদীর্ণ চিৎকারে বলছেন, 'আমার ছেলে চোর না।' সারাদিন এসব ভেবেই মাথায় একদল পোকা ঝি ঝি করেছে। শুনতে পাচ্ছি শিশুসন্তান হারানো ওই মায়ের আর্তনাদ। আমাকে চোখের পানি ফেলতে বাধ্য করছে ওই কান্না। আমি আসলে আমাকেই ফাঁকি দিচ্ছি। কারণ সামাজিক মাধ্যমগুলোর কল্যাণে চোখের সামনে ওই ছেলেটি। মায়া মায়া মুখ। আমি সিলেটের কুমারগাঁওয়ের সেই দেবশিশুর কথা বলছি। তের বছরের সামিউল আলম রাজন। তার নির্মম মৃত্যুর দৃশ্যটা আমি ভুলে থাকতে চাচ্ছি। ঘুরেফিরে একটা চিন্তাই কুরে কুরে খাচ্ছে, আমরা কি সভ্য?

না, আমরা সভ্য নই। আমরা এখনও ধর্মের নামে মানুষ হত্যা করি। আমরা বাসে আগুন দিয়ে নিরীহ মানুষকে আটকে রেখে হত্যা করি। আমরা রাস্তাঘাট বাস টার্মিনাল এমনকি চলন্ত বাসে ধর্ষণ করি। আমরা বিনা বিচারে মানুষ হত্যা করি। আমরা সভ্য নই। তাহলে আমরা কি বর্বর? হ্যাঁ, আমরা বর্বর। এতে সন্দেহ নেই। না হলে কি অতটুকু শিশুকে হত্যার উৎসব করি?

পাঠক, দৃশ্যটা একটু কল্পনা করুন। আপনার তের বছরের সন্তানটিকে টানা ১৬ মিনিট লাঠি দিয়ে পেটানো হচ্ছে। কষ্টে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার সময় একটু পানি চায় ছেলেটি। তাকে পানি না দিয়ে মেরে শরীর থেকে যে ঘাম বের করেছে সেই 'ঘাম খা' বলে মাটিতে ফেলে রাখে একদল নরপিশাচ। আপনার শিশুসন্তানটির আর্তচিৎকার মিলিয়ে যায় নির্যাতনকারীদের অট্টহাসিতে। শিশুটির নখ, মাথা ও পেটে রোল দিয়ে একের পর এক আঘাত করা হয়। নাহ, এখানেই শেষ নয়, খুঁটির সঙ্গে বেঁধে আরেক দফা পেটানো হয় শিশুটিকে। এরপর ধীরে ধীরে দেবশিশুটি…

ওহ, আর কল্পনা করা যাচ্ছে না, এবার থামুন– তাই তো বলবেন পাঠক।

এটা কল্পনা নয়, বাস্তব। বাস্তবতা। আমরা বর্বরের দলেরা এভাবেই রাজনকে হত্যা করেছি। এর আগেও আমরা এমন অনেক শিশুকে হত্যা করেছি। আর এবার শুধু হত্যাই করিনি, হত্যার দৃশ্য ধারণ করে তা সামাজিক মাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে দিয়েছি। বিন্দুমাত্র বিকার নেই আমাদের।

একটু পানিই চেয়েছিল শিশুটি। অপরাধীরা তাও দেয়নি। মেরে আহত করে তারই ঘাম খেতে বলেছে। তারা মানুষ নয় আমি নিশ্চিত। মানুষ এ কাজ করতে পারে না। আমি তাকে ভুলে থাকার চেষ্টা করছি। মরুভূমির মতো ফেটে চৌচির হয়ে যায় আমার বুক। আমরা কতটা বর্বর। কতটা ভাবলেশহীন। কতটা নির্বিকার। মনের ভেতর এক অপরাধীকে লালন করি আমরা। ধিক জানাই নিজেকে। এই ঢাকা শহরে বসে কী-ই-বা করতে পারি।

সাংবাদিক হিসেবে রিপোর্ট করানোর কথা ভুলে যাই। খোঁজ নিই সিলেট শহরে পরিচিত বড় কর্তা পুলিশ কে আছেন। তাৎক্ষণিকভাবে মনে পড়ে না। তাই সিলেট বিভাগের অতিরিক্ত ডিআইজি আমার বন্ধু ডক্টর আক্কাসউদ্দিন ভুঁইয়াকে ফোন দিই। যদিও ঘটনাটি তার এলাকার নয়, পুলিশের তো আবার এলাকা ভাগ করা থাকে, সেই নিয়ে কত টানাপড়েনের ঘটনায় অপরাধীরাও পার পেয়ে যায়। তবু তাকে অনুরোধ করি। তিনি কথা রেখেছেন। ফোন করেছেন পুলিশ কমিশনার থেকে থানার ওসি পর্যন্ত সবাইকে। সন্ধ্যায় ফোন করে জানালেন, সিলেট পুলিশ প্রশাসন তাকে জানিয়েছে একজন আসামিও পার পাবে না। পুলিশের অবস্থান কঠোর। শুধু মেডিকেল রিপোর্ট হাতে পেলেই অভিযোগপত্র দিয়ে দেওয়া হবে।

তারপরও আমার ভরসা হয় না। এ দেশে তো চোর-বাটপাড়রা পার পেয়ে যায় টাকার জোরে। আর ওই যে রাজন, যে কিনা শুধু খেয়ে বাঁচার জন্য এ দেশের লাখ লাখ শিশুর মতো পড়ালেখা ছেড়ে সবজি বিক্রি শুরু করেছে, আমরা যাকে চোর বলে অপবাদ দিচ্ছি, সেই রাজনের তো কেউ নেই। বাবা মাইক্রোবাস চালক। থানা পুলিশ কতটুকুই-বা করতে পারবেন তিনি?

আবারও ফোন দিই বন্ধু আক্কাসকে। এবার সে জানায়, 'ব্যাপারটি সিরিয়াসলি নেওয়া হয়েছে। তোমাদের কথা পুলিশ কমিশনারকে জানিয়েছি। এই মুহূর্তে পুলিশ কমিশনার, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার, ডেপুটি কমিশনার, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সবাই ঘটনাস্থলে গিয়েছেন।' এবার একটু আশ্বস্ত হই। ওই বর্বরেরা হয়তো শাস্তি পাবে। যদিও বাংলাদেশের আদালতে ৩০ লাখ মামলা এখন বিচারাধীন, এই মামলার চুড়ান্ত শাস্তি কবে হবে তা কেউ বলতে পারবে না। শান্তি এটুকুই যে, আসামিরা ধরা পড়ছে। পলাতকদের ধরার চেষ্টা হচ্ছে। তারপরও উদ্বেগ তো থেকেই যায়।

একবিংশ শতাব্দীর সভ্য মানুষ আমরা। কেবল সভ্যতা নয়, প্রযুক্তির উৎকর্ষতা ছড়িয়ে দিয়েছি ঘরে ঘরে। আর তাই আমাদের সভ্যতার নজির নথিবন্দি করতে ধারণ করি আমাদেরই পৈশাচিক তাণ্ডব। জানান দিই সামাজিক মাধ্যমে: আমরা চিরকাল ছিলাম-আছি-থাকব। কী নৃশংস বর্বর উম্মাদনা! এই মানুষরুপী পিশাচরা উল্লাস করে মানুষ বধ করে। কাপালিকদের গলায় নরখুলির সংখ্যা বেড়েই যায় দিন দিন আর সভ্যতার আইনি ঘরে জন্ম নেয় একের পর এক মামলা। মায়েদের ডুকরে কান্নার আওয়াজ আর অসহায় সমাজের গোঙানিতে বাতাস ভারি হয়ে উঠে।

আমরা তো কানে শুনতে পাই না। তাই রাজনরা যখন জীবনের শেষ শক্তিটুকু দিয়ে চিৎকার করে ওঠে বাঁচার আকুতিতে, আমরা শুনতে পাই না। আমরা অন্ধও বটে। প্রকাশ্যে দিনের আলোয় যখন খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাজনকে নির্যাতন করা হয় আমরা কেউ যেন তা দেখতেই পাই না। নাকি আমরা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী, অথর্ব? তাই মস্তিস্কে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ঘটে না।

রাজনকে অনুভূতিশূন্য নিথর দেহে পরিণত করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে নরপশুদের। আর আমরা কিন্তু প্রকৃত অর্থে মানববেশী জড় বৈ কিছু নই। তাই তো কুমারগাঁওয়ের একটি আওয়াজও রাজনকে বাঁচার আশ্বাস দিতে পারেনি। গ্রামের সকলেই যেন কুমারদের গড়া নিখুঁত মানুষরুপী পুতুল!

প্রতিদিন কত শত রাজনরা বলি হচ্ছে কাপালিকদের পৈশাচিক উন্মাদনার। আর আমরা কিনা সভ্যতার দোহাই দিয়ে প্রতি বছরের অক্টোবরের প্রথম সোমবার অতি আড়ম্বরে পালন করছি আন্তর্জাতিক শিশু দিবস। কত না আইন করেছি আমরা শিশুদের রক্ষার জন্য। ১৯৯১ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদটি কার্যকর করা হয়। চব্বিশ বছর ধরে সে সনদ এদেশে অনুশীলন করা হচ্ছে। আমরা কি এখনও শিশুবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে পেরেছি?

আর যেন একটি শিশুর গায়ে কেউ হাত না দিতে না পারে, সে আমার আপনার যার ঘরের শিশুই হোক না কেন। সেই হাত ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য আমাদের সামাজিক আন্দোলন দরকার। শুরুটা হতে হবে ঘর থেকে।

চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র রাজন জীবনের তাগিদে সবজি বিক্রেতার পরিচিতি নিয়েছিল। তৃতীয় শ্রেণিতে শিখে আসা শিশুর অধিকার কী দিল রাজনকে? কেবল চতুর্থ শ্রেণিতে ওঠার অনুমতি আর মৃত্যূকে আলিঙ্গন করার অনুভূতি?

প্রায় সাত দশক আগে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছিলেন, 'চলে যাব— তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ/প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল, এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি।'

আজও সেই অঙ্গীকার রাখতে পারিনি আমরা। ক্ষমা কর রাজন।

১২ জুলাই ২০১৫

জায়েদুল আহসান পিণ্টু: প্রধান বার্তা সম্পাদক, দেশ টিভি।