মন্ত্রিত্বে অদলবদল ও একটি টকঝালমিষ্টি বয়ান

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 13 July 2015, 02:27 PM
Updated : 13 July 2015, 02:27 PM

সবুর করছিলাম, সৈয়দ আশরাফ কী বলেন শোনার জন্য। আমরা মানি বা না মানি নিয়ম হচ্ছে, আগে শোনা-জানা, তারপর মন্তব্য করা। খবর এক বিষয় আর আলোচনা ভিন্ন বিষয়। আজকাল কেউ আর সবুরের তোয়াক্কা করে না। কিছু একটা ঘটলেই পড়ি কী মরি নিজের বক্তব্য বা মতামত দেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

আওয়ামী লীগে বা যে কোনো সরকারে মন্ত্রিত্বের পরিবর্তন সাধারণ বিষয়। দুনিয়ার সব দেশে সব সরকারেই তা ঘটে থাকে। কিন্তু আমরা যে রঙ্গভরা বঙ্গদেশের মানুষ। এদেশের রাজনীতিতে সাধারণ ঘটনা বলে কিছু নেই। যা কিছু ঘটে বা ঘটছে তার পেছনে বা সামনে, দেখা-অদেখায় রুপালী পর্দার মতো রহস্য আর সন্দেহ। সৈয়দ আশরাফের দপ্তর হারানোর ঘটনাটিও ব্যতিক্রম নয়।

এর আগে পদত্যাগের একমাত্র ঘটনাটি মনে করব। যে দেশে না তাড়ানো পর্যন্ত কেউ পদ থেকে যেতে চায় না, যে জাতিতে ত্যাগ আর পদবি থেকে সরে দাঁড়ানো মানে সর্বস্ব হারানো, সেখানে একজন জ্বলজ্যান্ত মানুষ পদত্যাগের পর মানুষ থেকে বেড়ালে পরিণত হয়ে গেলেন। বেশিরভাগ মানুষের কাছে সে মানুষটির পরিচয় এখন কালো বিড়াল। সে দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, সৈয়দ আশরাফ অনেক ভাগ্যবান। তাঁর বিরুদ্ধে কোনো কালো বা কালচে অভিযোগ আনা যায়নি। আনা যায়নি বলেই তিনি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। সাদা মানুষও যখন রোষ বা অবহেলার শিকার হয়ে মন্ত্রিত্ব থেকে বিদায় নেন তখন ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকানোর বিকল্প থাকে না।

সৈয়দ আশরাফকে ব্যক্তিগতভাবে চেনাজানার কোনো সুযোগ নেই। যেটুকু জানি তার ভিত্তিতে এটুকু নিশ্চিত, তিনি আর দশজন আওয়ামী লীগারের মতো নন। মনে পড়ে কিছু নেতা সংস্কারবাদী হিসেবে কালো খাতায় নাম লিখিয়েছিলেন। কেউ ভয়ে কেউ আপোষে কেউ বা ষড়যন্ত্রে শীর্ষনেতার পরিবর্তন ও দলের ভেতর সংস্কার চেয়ে বিপদে পড়েছিলেন। এ-ও এক অদ্ভুত বাস্তবতা। দল মানে নেতা আর নেতার প্রতি আনুগত্য।

উপমহাদেশের পারিবারিক রাজনীতির এই চেহারা পুরনো। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ভোটের মাধ্যমে সরকার ও শাসক দল পরিবর্তনে অগ্রগামী ভারতেও তাই। কংগ্রেসে এখনও পরিবারভিত্তিক রাজনীতি কায়েম রয়েছে বলেই হয়তো এখন তাদের দুরবস্থা কাটছে না। তাদের দেশের মানুষের ভরসা এই বিকল্প মিলে গেছে। এখন যে বাম ধারা বিজেপি বা অন্য রাজনীতি, সেখানে কেউ পরিবার থেকে আসেনি। আর আমাদের দুর্ভাগ্য, বড় ছোট এমনকি এরশাদের এক নেতাভিত্তিক দলেও পরিবার-প্রথা চালু রয়েছে।

যে সময়ের কথা বলছিলাম, ওয়ান ইলেভেনের সময় সে জায়গাটা নড়েচড়ে উঠেছিল। অন্যায়ভাবে যদিও, তবু তখনকার পরিবর্তনের পেছনে সক্রিয়রা চেয়েছিলেন পথ পরিস্কার করতে। তাদের ধারণা ছিল, দু নেত্রীকে মাইনাস করতে পারলেই তা সম্ভব। সে অন্যায় লড়াইয়ে আওয়ামী লীগও ছিল বিপাকে। দলের অনেক নেতাই যখন মুখ ও মুখোশের দ্বন্দ্বে ব্যস্ত, তখন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান আর সৈয়দ আশরাফদের ভূমিকা ছিল প্রশ্নাতীত। ঐ যে ইতিহাসের কথা বলছিলাম, আশরাফের পিতা সৈয়দ নজরুলের মতো তিনিও তাঁর দলের নেত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে দলকে উদ্ধার করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।

এরপর তিনি সম্পাদক পদে আসেন। মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করেন। তবে কখনও তেমন সরব বা আলোচনার মাঠে ঝড় তুলতে পারতেন না। যে দুএকবার সামান্য বুদবুদ তুলেছিলেন সেগুলোও আওয়ামী লীগের নেতাদের তুলনায় নস্যি। মার্কিন মন্ত্রীকে 'দুআনার মন্ত্রী' বলার ভেতর আমজনতার জোশ বাড়ে না। এখন আমাদের দেশের যে অবস্থা তাতে শ শ কোটি টাকার দুর্নীতি, ইচ্ছে করে বা ভুলবশত ভবন ধসিয়ে দেওয়া, একসঙ্গে ডজন খানেক মানুষ গুম বা খুন করা, তারপর হেলিকপ্টারে করে উড়ে আসার বাইরে উত্তেজনা তৈরির জায়গা নেই।

সেখানে সৈয়দ আশরাফ নিরামিষ টাইপের। খবরে দেখতাম, তিনি নাকি ফোন ধরেন না। কার্যালয়ে যেতেন না। তদ্বির পছন্দ করেন না। এমনও পড়েছি, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তাঁকে বলেছিলেন, 'আমার ফোনটা তো ধরবেন'। এগুলোর সত্যতা যাচাই করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব। তবে এর আলোকে এটা নিশ্চিত যে, তিনি আর দশটা নেতার মতো সুবিধাবাদী তোয়াজকারী আর সুযোগসন্ধানী ছিলেন না।

যে দেশে দলের ভূমিকা দিন দিন গৌণ হয়ে পড়ছে, দলের অফিসে বা দপ্তরে আসলে রাজনীতি বলে কিছু নেই, সেখানে অফিসের নামে দলবাজি করার ইচ্ছে জাগ্রত না থাকাটা কি অমঙ্গলের কিছু? তদ্বির পছন্দ না করা, ফোন আর যোগাযোগে পলিটিক্স নামের নোংরামি না করা সৈয়দ আশরাফ মানুষের মনে এমন একটা জায়গা নিয়েছেন যা হয়তো আওয়ামী লীগের সাধারণ ও পরিচিত চেহারার সঙ্গে যায় না। তবে এর পজেটিভ দিকটা অনেককে আকৃষ্ট করেছিল। ফলে দপ্তর হারানোর কারণ যদি তাই হয়ে থাকে, আমরা ধরে নিতে পারি যে, উত্তেজনা আর বিতর্ক তৈরিতে পারঙ্গম না হলে এদেশে আর কোনোদিন কোনো দৃঢ়চিত্তের মানুষের নেতা হবার যোগ্যতা থাকবে না।

আওয়ামী লীগের রাজনীতি স্বয়ং ঈশ্বরও ভালো বোঝেন না। তাদের দু চেহারা। আন্দোলনে বা রাজপথে থাকলে এদের চেয়ে বড় মিত্র আর কেউ নন। তখন আমাদের মতো সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা আর চেতনার প্রতীক হয়ে ওঠেন তারা। আর যখনই তারা শাসনে, তখন আমাদের মতো মানুষদের চোখের সামনে খুলতে থাকে একের পর এক নতুন জগত। এর কোনো কোনোটা এমন যে চোখে শর্ষে ফুল দেখার বিকল্প থাকে না। সে দলে তাঁর মতো মানুষ যে অ্যাদ্দিন এভাবে এ পদে টিকে ছিলেন, সেটাই আশ্চর্যের।

ষড়যন্ত্র বা বিদ্বেষ যে কেবল দলের ভেতরে বা বাইরে সেটা কিন্তু নয়। বেশ কিছুদিন আগে আমরা একটা ফোনালাপ শোনার সুযোগ পেয়েছিলাম। বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রচারিত বলে দাবিদার বাংলা দৈনিকের সস্পাদক যিনি মনে করেন সবকিছু নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব তাদের, তিনি ও আমার এক পরম বন্ধুর সে কথোপকথন ফলস বা মিথ্যা ভাবার কারণ নেই। দুজনের কণ্ঠস্বর আমার পরিচিত। সে আলাপে রেগে যাওয়া সম্পাদক সৈয়দ আশরাফের বিরুদ্ধে এক হাত নেওয়ার পাশাপাশি তাঁকে ছাড় না দেবার কথাও বলছিলেন। যতদূর মনে পড়ে তিনি বলেছিলেন, ''অনেক ছাড় দিয়েছি, আর না। এবার তাঁকে সাইজ করতে হবে।''

এ জাতীয় কথাবার্তা শুনেই প্রমাদ গুণছিলাম। কারণ আওয়ামী লীগে ষড়যন্ত্রকারী মুশতাকের সংখ্যা কম নয়। তারা সব সময় শীর্ষনেতাদের আশপাশে ঘোরাফেরা করেন। আস্থাভাজনও বটে। আর যারা এসব বলছিলেন বা করার চিন্তা করছিলেন তাদের নেটওয়ার্ক কতটা শক্তিশালী সেটা নিশ্চয়ই বলে বোঝানোর প্রয়োজন পড়ে না। সে ঘটনাও খুব বেশি দিনের নয়। কে জানে এই ঘটনার পেছনে কাদের ইন্ধন বা প্ররোচনা আছে। তবে ইতিহাসের মুশতাক বলে, সে কখনও একা আসে না। তার সঙ্গে মীরজাফর, উমচাঁদরাও থাকে। তেমন কিছুর শিকার হলেন কি সৈয়দ আশরাফ?

যেভাবে যাই হোক, তাঁর ব্যক্তিগত লাভ-লোকসানের দিকটা এখানে বড় নয়। তিনি তার সে দিকটা কখনও সামনে আনেননি। আমি খুব বিস্ময়ের সঙ্গে দেখতাম, দেশ ও জাতির ঘনীভূত সমস্যার কালেও তিনি প্রগলভ ছিলেন না। দলীয় সাধারণ সম্পাদক হবার পরও উস্কানিমূলক কথাবার্তা বা আগুন জ্বালানোর পরিবর্তে শান্ত সৌম্য; আচরণে, কথায় পরিমিত। এতে দলের এক শ্রেণির মানুষের হয়তো খায়েশ মেটেনি, তবে সাধারণ মানুষ ও আমাদের মতো রাজনীতির ফন্দিফিকির না বোঝা মানুষদের মনে হয়েছে যে, অন্তত একজন হলেও আছেন যিনি ইনু বা হানিফের মতো উস্কে দিতে চান না।

হাছান মাহমুদরা যখন কথায় কথায় আন্দোলনের হুমকি আর মানুষকে বিপদের মুখে ঠেলে নিজেরা দূরে থাকেন, এই ভদ্রলোক তখনও মুখ খোলেন না। খুললেও একবারও মনে হয়নি যে, তা যুদ্ধংদেহী টাইপের কিছু। কঠিন সময়ে সংবাদ সম্মেলনে তাঁর আচার-আচরণ দেখে মনে হত ইনি কি আসলে আওয়ামী লীগের কেউ? বিএনপি আর আওয়ামী লীগ মানেই তো উত্তেজনা আর হাতাহাতি; চড়া গলায় কথা বলা। আজকাল মিডিয়াতেও তারা লাগামহীন। টকশোতে তেড়ে যাওয়া কথাবার্তা পছন্দ না হলে হাত ওঠানোর ঘটনাও দেখছি আমরা। সেদিক থেকে মাটির মানুষ সৈয়দ আশরাফকে রাজনীতি যে অ্যাদ্দিন সহ্য করেছে সেটাও বড় ব্যাপার।

যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। দপ্তরবিহীন মন্ত্রী হবার পর তাঁকে নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনার পর ঢাকা অফিসার্স ক্লাবের ইফতার মাহফিলে তিনি বলেছেন, তাঁর রক্তে বিশ্বাসঘাতকতা নেই। যারা অপ্রগলভ বা কম কথা বলেন তাদের এই এক সুবিধা। ঠিক সময়ে লাগসই কথাটা বলতে পারেন তাঁরা। এ কথার দাম আওয়ামী লীগের জন্য লাখ টাকা। আজ যারা এ দলের বেনিফিসিয়ারি বা কথায় কথায় খালেদা জিয়ার মুণ্ডুপাত করে নেত্রীর মন ভজান, তারা এ দলের কেউ নন। উড়ে এসে জুড়ে বসা বা ঘটনাচক্রে আওয়ামী লীগার বনে যাওয়া অতিউৎসাহী। তাদের কথা শুনলে মনে হয়, তারা কোমরে তলোয়ার বেঁধে বিএনপি-জামায়াত মোকাবেলায় প্রস্তুত। আসলে কি তাই?

তথ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব কি প্রতিদিন একবার খালেদা জিয়াকে ভৎর্সনা করা বা তাঁর ভবিষ্যৎ কী হবে সে বিষয়ে বাতচিত করা? আইন মন্ত্রীর কথা বলেন তিনি। বিচার বিভাগের কথা বলেন সুরঞ্জিত। পুলিশের ভাষায় কথা বলেন অন্য নেতারা। অথচ এদের অতীত আর অতীতের কর্মকাণ্ডে আওয়ামী-বিরোধিতা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। গদি হারালে এরা কিছুদিন নির্বাসনে যাবার পর আবার কোন আদলে কোন চেহারায় ফিরে আসবেন সেটাও অজানা নয়।

অন্যদিকে সৈয়দ আশরাফ বা সোহেল তাজদের অতীত বিশ্বাস আর রক্তপাতে শুদ্ধতার অতীত। তাঁদের ধমনীতে সে প্রবাহ আছে বলে তাঁরা দল-অনুগামী। সময় সময় বিপদে পড়লেও কোনো দিন আওয়ামী-বিরোধী চক্করে পা দেননি।

অকৃতজ্ঞতার সমাজে অকৃতজ্ঞ জাতিতে হয়তো এগুলো এখন মূল্যহীন। মূল্যহীন বলেই আওয়ামী ইতিহাসে চার নেতার অবদান সেভাবে স্বীকার্য নয়। এক সূর্যের আলোতেও দীপ্ত চার তারকা আঁধারে পথ দেখান। তাঁদের ভূমিকা আমাদের মর্যাদা আর গৌরব বাড়ায়। কিন্তু কেউ তা মুখ খুলে বলে না। সৈয়দ আশরাফ যা বলেছেন সেটাই সত্য। বিশ্বাসভাজন হলে স্বয়ং ঈশ্বরও জেনে যান এ যখন আমার অনুগত, আর দল ছাড়বে না, একে ইচ্ছেমতো ওঠ-বস করালেই বা কী। আর যে গরু গোয়াল মানে না তাকেই বরং দুধ দিয়ে আদর দিয়ে গোয়ালে আনতে ছোটেন দেবদূত।

ভোগের সমাজে ত্যাগ মূল্যহীন না হলেও পেছনে পড়ে থাকে। অতিকথনের সমাজে হামবড়া ভাব আর আমি সবকিছু জানি বুঝি বা করতে পারার রাজনীতিতে কাজের চেয়ে শো-আপের কদর বেশি। হয়তো সেখানেই থমকে গেছে সৈয়দ আশরাফের যাত্রা।

তবে এটাই শেষ কথা নয়। আওয়ামী লীগের কুল বা ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখতে হলে সৈয়দ বংশের দরকার পড়বে। আর যদি না পড়ে তবে হয়তো বুঝে নিতে হবে তিনিই ছিলেন কৌলিন্যের শেষ প্রতীক, সৈয়দ বংশের শেষ আওয়ামী ফুল। যেটাই হোক দপ্তরবিহীন মন্ত্রী তাঁকে মানায় না; এই তকমাটা খুলে ফেলাই হবে কাজের কাজ।

সিডনি