ফেলানী হত্যাকাণ্ড ও প্রহসনের রায়

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 6 July 2015, 02:06 PM
Updated : 6 July 2015, 02:06 PM

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে আলোচিত ফেলানি খাতুন হত্যাকাণ্ডের পর ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের একটি আদালতের রায় নিয়ে বাংলাদেশে ব্যাপক সমালোচনা সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে এ নিয়ে ক্ষোভ ও সমালোচনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষকে বেকসুর খালাস দেওয়ার খবরটি বিবিসিতে প্রচারের পর মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান মন্তব্য করেছেন এভাবে যে, এ রায়ের মাধ্যমে ন্যায়বিচারের সঙ্গে তামাশা করা হয়েছে। তারা এভাবে আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছে। ড. রহমান যথার্থই মনে করছেন যে, এখন বাংলাদেশ সরকারের উচিত প্রসঙ্গটি কূটনৈতিক পর্যায়ে তোলা এবং রায়টি থেকে বাংলাদেশে যে হতাশা তৈরি হয়েছে সেটা ভারতকে জানানো।

উল্লেখ্য, ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারির ভোরে পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার অর্ন্তগত চৌধুরীহাট সীমান্ত চৌকির কাছে কাঁটাতারের বেড়া পার হওয়ার সময় বিএসএফ কনস্টেবল অমিয় ঘোষের গুলিতে মারা যায় ফেলানি। এরপর দীর্ঘক্ষণ কাঁটাতারের বেড়ার উপরেই ঝুলে থাকে হতভাগ্য মেয়েটির লাশ, যে চিত্র পরবর্তীতে বিশ্বজুড়ে গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশ পায় এবং ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়।

আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে একপর্যায়ে ভারতে বিএসএফের নিজস্ব আদালতে এই অভিযোগের বিচারকার্যক্রম শুরু হয়। বিচারশেষে ২ জুন, ২০১৫ অভিযুক্ত অমিয় ঘোষকে নির্দোষ বলে রায় দেওয়া হয়। বিএসএফ জানিয়েছে যে, এই রায়ের পরে মুক্তি দেওয়া হয়েছে তাদের ১৮১ নম্বর ব্যাটালিয়নের কনস্টেবল অমিয় ঘোষকে।

ফেলানি হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের জন্যই লজ্জাজনক একটি ঘটনা। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল ঘটনাটির সুবিচার করা। কিন্তু তারা তা করতে পারেনি। এটা ভারতের মতো একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য মোটেও গৌরবের বিষয় নয়। কুড়িগ্রামের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট আব্রাহাম লিংকন যথার্থই বলেছেন: ''বিএসএফের মতো একটা শৃঙ্খলাবদ্ধ বাহিনীর একজন সদস্যের অপকর্মের দায় গোটা বাহিনীটাই নিয়ে নিল আর সেই দায় রাষ্ট্র হিসাবে ভারতের ওপরেও বর্তাল।''

২০১৩ সালের ১৩ আগস্ট ভারতের কোচবিহারের সোনারীতে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ১৮১ ব্যাটালিয়নের সদর দপ্তরে ফেলানি হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু হয়। এ কার্যক্রম পর্যক্ষেণ করেন কুড়িগ্রামের ৪৫ বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াউল হক খালেদ এবং কুড়িগ্রামের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট আব্রাহাম লিংকন। বিএসএফএর The Border Security Force Act, 1968 আইন অনুযায়ী গঠিত হয় জেনারেল সিকিউরিটি কোর্টের বিশেষ আদালতে।

শুনানির শুরুতেই অভিযুক্ত বিএসএফ কনষ্টেবল অমিয় ঘোষের বক্তব্য শোনা হয়। বাবা নুরুল ইসলামের সামনে ফেলানিকে নিজ হাতে রাইফেলের গুলি চালিয়ে হত্যা করেন অমিয়। তবু এর দায় অস্বীকার করেন তিনি। এরপর ১৯ আগস্ট ফেলানির বাবা নুরুল ও মামা আবদুল হানিফের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্সেস কোর্ট ৬ সেপ্টেম্বর বিচারকাজ শেষ করে। সে রায়ে বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলিতে নিহত বাংলাদেশি কিশোরী ফেলানি খাতুন হত্যা মামলায় অভিযুক্ত কনস্টেবল অমিয় ঘোষকে নির্দোষ ঘোষণা করা হয়।

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্সেস কোর্টের বিচারের রায়ে গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে ন্যায়বিচার। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ফেলানির উপর যে নির্মম আচরণ করা হয়েছে তা কোনো আন্তর্জাতিক আইনেই সমর্থিত নয়। তাই এই হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার হয়নি বলে অভিযুক্ত কনস্টেবল অমিয় ঘোষের নিজ দেশ ভারতের গণমাধ্যমেও উচ্চকিত মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মানবাধিকার সংগঠন 'মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ-মাসুম' এই রায়টি বিচারের নামে অবিচার বলে মন্তব্য করেছে। সংগঠনের প্রধান কিরিটি রায় বিবিসি বাংলাকে বলেন:

''প্রথমত এটা ন্যায়বিচার নয়। বিচারের নামে অবিচার। আর দ্বিতীয়ত, ভারতের সংবিধানের ২১ নম্বর অনুচ্ছেদে বাঁচার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে, ভারতীয় ভূখণ্ডে যারাই থাকবেন, তাদের সবারই অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। ফেলানিকে তো গুলি করা হয়েছিল ভারতীয় ভূখণ্ডে; তাই তাঁর বাঁচার অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে।''

ফেলানি হত্যাকাণ্ডের মতো বহুল আলোচিত ঘটনার যে সুষ্ঠু ও সুবিচার হয়নি, তা সচেতন মানুষ মাত্রই স্বীকার করবেন। মানুষকে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করলে তেমন কিছু হয় না, এমন একটা খুনি মনোভাব সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। ফলে ধ্বংসের পথে এগুবে মানুষ, মানবতা আর নষ্ট হবে দুদেশের সম্পর্ক।

মনে রাখা দরকার যে, ফেলানি হত্যাকাণ্ডটি বাংলাদেশে ভারতবিরোধী সেন্টিমেন্ট সৃষ্টির ক্ষেত্রে সবচেয়ে স্পর্শকাতর অস্ত্র হিসেবে সামনে চলে এসেছে। ভারতবিরোধী রাজনীতির ধ্বজাধারীরা কাঁটাতারে ঝুলে থাকা কিশোরী ফেলানির লাশের ছবি খুব লাগসইভাবে ব্যবহার করেছে। তাই গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক শাসন ও দুদেশের বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্ব চাইলে ফেলানি হত্যার সুষ্ঠু বিচার খুবই জরুরি।

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত সমস্যা সমাধানের ব্যাপারেও বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। আমাদের সঙ্গে ভারতের প্রায় ৪,০৯৫ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকা রয়েছে। সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো চরম দারিদ্র্য-কবলিত। তাই সে সব এলাকার মানুষজন চোরাপথে ভারতে যায় সাময়িক ও নিম্নআয়ের কাজের খোঁজে। এই অসেচতন মানুষেরা কোনো বৈধ কাগজপত্র জোগাড় করে না। তারা বিএসএফ ও বিজিবির সঙ্গে ঘুষের সম্পর্কে জড়িত কিছু দালালের মাধ্যমে যোগাযোগ করে সামান্য কিছু টাকা দিয়ে সীমানা পাড়ি দেয়। সীমান্তরক্ষী বাহিনীগুলো অবশ্য টাকা নিলেও নিজেদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে অবৈধ মানুষদের সীমান্ত পার করিয়ে দেয় না। ফলে অসহায় এ মানুষদের সম্পূর্ণ অবৈধ পন্থায় বিপদজনকভাবে সীমানা পাড়ি দিতে হয়।

এ কথা ঠিক যে, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে হত্যার আলাদা একটা রাজনীতি আছে। ভারতীয়দের আশঙ্কা, বাংলাদেশ হয়ে পাকিস্তানি জঙ্গিরা ভারতে প্রবেশ করে নাশকতার উদ্দেশ্যে। এদের ঠেকাতে বিএসএফকে কঠোর হতে হয়। জঙ্গির ভয় দেখিয়ে ভারত সরকার দেশের জনগণের কাছে এভাবে বৈধ করে নেয় এই হত্যাগুলো। আর বাংলাদেশে এই ঘটনার ফলে ভারতকে নিয়ে যে ভয়-ক্ষোভ ও বিদ্বেষ ছিল সেটা আরেকটু বেড়ে যায়। এর সু্যোগ নেবে ভারতবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তি, যারা চোরাপথে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন বুনছে।

সীমান্তে অবৈধ অনুপ্রবেশ ঘটলে ধৃত ব্যক্তিকে তার দেশের আইনের হাতে তুলে দেওয়া এবং আদালতে বিচার ও জেল-জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। এটি যদি 'সীমান্তে অবৈধ অনুপ্রবেশ' ধরনের অপরাধ হয়, তবে এটা প্রমাণিত যে, ঘাতক বিএসএফ সদস্য, তিনি অমিয় ঘোষ হোন আর যে-ই– নিজ দেশের আইনও ভঙ্গ করেছেন। আইনের হাতে অনুপ্রবেশকারীদের তুলে না দিয়ে নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন আইন। ভারতের আইনে বড়সড় ক্রিমিনাল অপরাধ এটি।

অমিয় ঘোষ নির্দোষ হতেই পারেন, কিন্তু আমাদের কিশোরী ফেলানি যে নিহত হয়েছে সেটা তো মিথ্যে নয়। এটাও মিথ্যে নয় যে, বিএসএফএর কোনো না কোনো সদস্যের গুলিতেই ফেলানির মৃত্যু হয়েছে। তার বা তাদের নাম আমরা জানি না। এটা ভারতকেই খুঁজে বের করতে হবে।

এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের সীমান্তে অবৈধ অনুপ্রবেশ নেই এমন নজির কেউ দেখাতে পারবে না। ভাগ্যের অন্বেষণে মানুষজন বৈধ-অবৈধ পথে প্রতিবেশি দেশে পাড়ি জমায়, এটা নির্মম বাস্তবতা। এ জন্য প্রায় প্রতিটি দেশেরই সীমান্ত ভাগাভাগি নিয়ে ঝামেলা রয়েছে। এসবের জন্য রযেছে সীমান্ত আইন। চোরচালান বন্ধে অপরাধীদের ধরে এনে আইনের আওতায় নিয়ে আসার বিধানও রয়েছে। কিন্তু এভাবে নির্বিচারে সাধারণ নাগরিকদের লাশ ফেলা হবে, আর কোনো দেশের সরকার চুপ করে বসে থাকবে এটা চলতে পারে না। বিশ্বে একমাত্র বাংলাদেশই এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম।

এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচারের জন্য জোর কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারের উচিত অবৈধ অনুপ্রবেশ জরুরি ভিত্তিতে বন্ধ করতে সীমান্তে কিছু নতুন কাজের সুযোগ সৃষ্টি করা।

ফেলানির লাশ কাঁটাতারে ঝুলবে– বাংলাদেশে আর ভারতে– পূর্ব থেকে পশ্চিমে– উত্তর থেকে দক্ষিণে শক্তপোক্ত হতে থাকবে ঘৃণা-বিদ্বেষ ও প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি। এই রাজনীতি উভয় দেশের গণতন্ত্র ও স্থিতিশীলতার জন্যই হুমকি। এই সত্য দেশ দুটি যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করবে ততই মঙ্গল।

চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট।