পণ্যবাজারে চাই এ সময়কার অভিজ্ঞতার পর্যালোচনা

হাসান মামুনহাসান মামুন
Published : 3 July 2015, 12:15 PM
Updated : 3 July 2015, 12:15 PM

রমজান মাসের সূচনা হয়েছে এবার শুক্রবারে। এমনিতেও আমরা ছুটির দিনে দল বেঁধে হাজির হই কাঁচাবাজারে। তাতে চাহিদার পাল্লা ভারি হয়ে যায় আর ঘটে দামবৃদ্ধি। এক শ্রেণির মানুষ আজকাল অবশ্য শপিং মলে যায়। 'নির্দিষ্ট দামে' কিনতে তারা পছন্দ করে, এমনকি ভ্যাট দিয়ে। একটু বেশি দাম দিতেও তারা প্রস্তুত। এর বিনিময়ে এরা চায় নির্ভরযোগ্য পণ্য। কেনাকাটার পরিবেশটাও তাদের আকর্ষণ করে।

এখন কথা হল, এর বাইরেও শহর-বন্দরে রয়েছে বিরাট ক্রেতাগোষ্ঠী। তারা এখনও মূলধারা। চিরাচরিত বাজারে দরাদরি করে কিনতে তারা ভালোবাসে। এর মধ্যে হার-জিতের ব্যাপারটাও হয়তো আকর্ষণ করে এদের। কিন্তু সমস্যা হল, শুক্র-শনিবারে একসঙ্গে গিয়ে হাজির হলে পণ্যবাজারে প্রতিযোগিতাটা হয় আসলে ক্রেতাদের মধ্যে। তাতে বিক্রেতার দর-কষাকষির ক্ষমতা বাড়ে এবং বাড়ে তার জেতার সম্ভাবনা। বিশেষত শুক্রবারে কাঁচা জিনিস তথা মাছ-মাংস ও সবজির দাম গড়পড়তা ১০-১৫ শতাংশ হলেও বেশি থাকে।

শনি, রবি ও সোমবার পেরিয়ে মঙ্গলবারে গিয়ে আবার 'মার্কেট কারেকশন' হয়। চাহিদা তথা ক্রেতা উপস্থিতি কমে আসার কারণেই মূলত ঘটে এটা। সমস্যা হল, মিডিয়াও বাজারদর জানাতে বেছে নেয় শুক্রবারটা। ইলেকট্রনিক মিডিয়াও দেখি এ রীতি অনুসরণ করছে। তারা আসলে একটি তেতে-ওঠা বাজারের খবর দেন, যেটা সপ্তাহের মধ্যভাগে 'স্বাভাবিক অবস্থায়' পৌঁছে। সে ক্ষেত্রে তাদের কর্তব্য হল, মঙ্গলবারের কাঁচাবাজার পরিস্থিতিও তুলে ধরা। তাহলে বাজার সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ চিত্রটা হয়তো পাওয়া যাবে। সরকারও মিডিয়া সূত্রে সত্যের কাছাকাছি একটা ধারণা পাবে বাজারের হালচাল সম্পর্কে। ব্যবস্থা নেওয়ার থাকলে নিতে পারবে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অবশ্য টিসিবির মাধ্যমে খোঁজ নেয় বাজারদর সম্পর্কে। ট্যারিফ কমিশনের ভূমিকাও আমরা দেখতে পাই। রমজানে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের তৎপরতাও চোখে পড়ে কিছুটা। প্রশ্ন হল, তারাও কি সক্রিয় হওয়ার জন্য শুক্র-শনিবারটা বেছে নেন?

পণ্যবাজারের গতিবিধি বুঝতে হলে আন্তর্জাতিক বাজার, আমদানি-পরিস্থিতি, সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সক্রিয়তা, বন্দর থেকে নিয়ে পণ্যের সাপ্লাই-চেইন, পাইকারি বাজার, মজুদ পরিস্থিতি, দেশে উৎপাদন, উৎপাদন-ব্যয়, পরিবহন-ব্যয়, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি (চাঁদাবাজি), বিভিন্ন পর্যায়ে বিক্রেতার মতিগতি প্রভৃতির দিকে দৃষ্টি রাখতে হয়। এ সমস্ত দিকে তাকিয়ে বিশ্লেষকরা বলেছিলেন, এবার রমজানে পণ্যবাজার খুব একটা অশান্ত হবে না। সরকার ও ব্যবসায়ীদের তরফ থেকেও এমনটা বলে বিশেষত নিম্নআয়ের বিপুল সংখ্যক মানুষকে আশ্বস্ত করা হয়েছিল। প্রধান প্রধান নিত্যপণ্যের একটা তালিকা রয়েছে সরকারের কাছে। সরকার চেষ্টা করছে এমন রাজস্বনীতি অনুসরণ করতে, যাতে পণ্যবাজার অশান্ত না হয়; এমনকি রমজানেও।

বাজেট ঘোষণার সময় চিনির ওপর আরোপিত শুল্ক নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হলেও সরকার দ্রুত সেটার নিরসন করে। চিনির দাম অনেকদিন ধরেই কম। সরকারি মিলে উৎপাদিত চিনি অবিক্রিত রয়েছে। পরিশোধিত ও অপরিশোধিত চিনির শুল্কহার নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। এখন এ ক্ষেত্রে 'সঙ্গতিপূর্ণ' পদক্ষেপ নিলেও তা নিতে হবে রমজান ও ঈদ শেষ হওয়ার পর। প্রসঙ্গটা তোলা হল সরকারের স্পর্শকাতরতা বোঝাতে।

এ সময়ে সয়াবিন তেল ও পাম অয়েলের দাম 'যৌক্তিককরণের' দাবি উঠেছে মিডিয়া থেকে। দাম নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ না হলেও ট্যারিফ কমিশন বিষয়টা দেখছে। রমজানে অতিরিক্ত চাহিদার চাপে ভোজ্যতেলের দাম লিটারপ্রতি ২-৩ টাকা করে বেড়ে যাওয়ার একটা প্রবণতা রয়েছে। দেশে পাম অয়েলই সবচেয়ে বেশি আমদানি ও পরিভোগ হয়ে থাকে। এটিসহ সব ধরনের ভোজ্যতেলের দাম কমছে আন্তর্জাতিক বাজারে। সে তুলনায় দেশে দাম কমে আসার প্রক্রিয়াটি ধীর বটে। আবার রমজানে এটি বাড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা লক্ষণীয়। এ সময়ে চাহিদা অনেক বাড়লেও ভোজ্যতেল সরবরাহে কিন্তু ঘাটতি নেই।

দেশে রাইস ব্রান অয়েলও কম উৎপাদিত হচ্ছে না। এরও দাম কমে আসছে এবং চাহিদা বাড়ছে। এ খাত উৎসাহিত করা হলে তারা নাকি মোট চাহিদার এক-চতুর্থাংশই পূরণ করতে সক্ষম। সরকার এ বিষয়ে নীতিগত সহায়তা দেবে সে আশা কি করতে পারি? ধান-চাল উৎপাদনে বড় সাফল্য অর্জনের পর এর কুঁড়া দিয়ে উৎকৃষ্টমানের ভোজ্যতেল উৎপাদনেও আমরা তাহলে সাফল্য দেখাতে পারব। আর এটা হবে শতভাগ দেশী। রাইস ব্রান অয়েল উল্টো রপ্তানিও করা যাবে। সে ক্ষেত্রে বেশি দাম পাবেন উৎপাদকরা।

রমজানে চালের দাম স্থিতিশীল থাকাটাও একটা বড় খবর, বিশেষত দরিদ্র জনগোষ্ঠীতে। কোনো কোনো রমজানে চালের বাজারে অস্থিরতা দেখতে হয়েছে আমাদের। ওএমএস কার্যক্রম চালাতে হয়েছে সরকারকে। তখন আমরা আবার প্রশ্ন তুলেছি, গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কী করছেন? জমিজমা নেই বলে তাদেরও তো কিনে খেতে হয়। রমজানে এবার সুগন্ধি চালের বাজারেও অস্থিরতা নেই। মজুদ পরিস্থিতি বলছে, ঈদেও এটা উত্তপ্ত হবে না।

এ সময়ে আটা-ময়দার দাম বরং কমে আসার কথা। সেটি ঘটছে না কেন, রেগুলেটররা অস্তিত্বশীল থাকলে সেদিকে যেন দৃষ্টি দেন। চাহিদা কম বলে মুরগির ডিমের দাম কমে এসেছে এর মধ্যে। এটি আরও কমলে এ সময়ে দরিদ্রদের পুষ্টির চাহিদা পূরণে তা সহায়ক হত। মিডিয়ায় যে ইফতারি বাজারের ওপর বর্ণাঢ্য প্রতিবেদন থাকে, সে সব তাদের না পড়লেও চলে। সেহেরি ও ইফতার তারা করে থাকে নিয়মিত খাদ্যসামগ্রী দিয়েই। এ ক্ষেত্রেও ভাত-তরকারি পাওয়াটা তাদের জন্য জরুরি।

চালের বাজার শান্ত থাকায় এবার মুড়ির দাম নিয়েও হৈচৈ নেই। দাম যদি বেড়েও থাকে, তা চাহিদার বিপুল বৃদ্ধির তুলনায় কম।

ভারত থেকে যে উপায়েই হোক, বিপুলসংখ্যক গরু এনে কসাইখানায় নিয়ে যাওয়াতেই দীর্ঘদিন এখানে মাংসের বাজার স্থিতিশীল ছিল। এ সাপ্লাই-চেইনে বড় রকম বিঘ্ন ঘটায় আমরা টের পাচ্ছি, প্রতিবেশি দেশটির ওপর এ ক্ষেত্রে কতটা নির্ভরশীল ছিলাম। গোমাংসের এখন যে দাম, সেটা কিছুদিন আগেও এ রকমই ছিল। কেজিপ্রতি ৩৮০-৪০০ টাকার নিচে এটা মিলছিল না। ঈদের আগে-আগে দাম বেড়ে ৪০০ টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে। পরে হয়তো আবার ৩৮০-৪০০ টাকায় এসে স্থিত হবে। কোরবানি ঈদের কিন্তু বেশি দেরি নেই। ওই সময়ের জন্য যারা গরু তৈরি করছেন, তারা কম দামে এটা দেবেন না। তাহলে এত গোমাংসের চাহিদা আমরা কীভাবে মেটাব, সে প্রশ্ন ওঠা উচিত। এ ক্ষেত্রে নিজেদেরকে সত্যিই এখন মনে হচ্ছে এক অপ্রস্তুত জাতি।

সবজি, মাছ, মুরগি, এমনকি ডিম-দুধের চাহিদা পরিপূরণের ব্যাপারটা কিন্তু এক রকম 'অ্যাড্রেস' করেছি আমরা। এ সবের সরবরাহ ও দামে তার কিছু সুফল ভোগ করছি। ঈদের সময়ও দুধের সঙ্কট দেখা দেয় না এখন। দূরবর্তী অঞ্চল থেকে সবজি আনতে হয় না। রাজধানীর আশপাশের কয়েকটি পয়েন্টের সরবরাহই এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট। সময়ে-সময়ে কিছু টমেটো শুধু আনতে হয় ভারত থেকে। এ সময়ে মাত্রাতিরিক্ত চাহিদার জন্য বেগুনও আনতে হচ্ছে কিনা, সে খবর অবশ্য পাইনি। দলেবলে বেগুনি খাওয়ার যে কালচারে আছি, তাতে কিছু বেগুন 'আমদানি' হলেও অবাক হব না। রমজানে সবজি রপ্তানিতে অবশ্য নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে। একটা সময় থেকে সরকারকে যেতে হয়েছে এ প্র্যাকটিসে।

এ সময়ে মাছের আমদানি কিছুটা বেগবান হওয়া প্রয়োজন। স্বল্পআয়ের মানুষ অবশ্য চাষের মাছ নিয়ে সন্তুষ্ট আছে। দাম নয়, এর মান নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। এ রমজানে ব্রয়লারের দামও বেশি বাড়েনি। অনেকে অবশ্য অতিরিক্ত দামে 'দেশি মুরগি' খেতে এখনও অভ্যস্ত। 'পাকিস্তানি জাতের' মুরগির উৎপাদনও এ ক্ষেত্রে ছোটখাটো বিপ্লব ঘটিয়েছে।

আন্তর্জাতিক বাজারে ডাল ও ছোলার দাম কম, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা নিম্নমুখী। তাই 'কারসাজি' হলেও এ সবের দাম খুব একটা বাড়ানো যাবে না। ভাজাপোড়া ইফতার সামগ্রী তৈরিতে বেশি করে মসলা ব্যবহৃত হয় বলে আদা-রসুনের দাম এখন ঊর্ধ্বমুখী। এ ক্ষেত্রে আমরা আবার আমদানিকৃত আদা-রসুন পছন্দ করি। বড় সাইজের পেঁয়াজও আমাদের পছন্দ। সার্বিকভাবে সচ্ছলতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পছন্দে এ বদল এসেছে। চাহিদা অনেক বাড়লেও পেঁয়াজের দাম অবশ্য সেভাবে বাড়েনি। বেশি মুনাফার আশায় কেউ বেশি আমদানি করে থাকলে বিপাকে পড়বেন বলে মনে হচ্ছে।

উৎসবের সময় অনেকে বেশি মসলা আমদানি করে বিপাকে পড়ে। চোরাপথে তথা বিনাশুল্কে এ সব আসার কারণেও তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ বিষয়ে অভিযোগ করলে সরকারের তা অবশ্যই দেখা উচিত। ন্যায়সঙ্গত ব্যবসা করে লোকে ক্ষতিগ্রস্ত হলে অন্যায় ব্যবসায় পুঁজির স্থানান্তর ঘটবে, যেমন দেশ থেকে টাকাপয়সা উড়ে চলে যাচ্ছে বিদেশে।

সরকার, বিশেষত কেন্দ্রীয় ব্যাংক মসলার উৎপাদন বৃদ্ধিতে নীতিগত সহায়তা জুগিয়েছিল। রমজান কিংবা কোরবানি ঈদের সময়টায় জানতে চাইব, এর সুফল আদৌ আমরা পেতে শুরু করেছি কিনা। করপোরেট হাউসগুলো মসলার ব্যবসায় এসে ঢুকছে। জীবনযাত্রা সহজ করে তুলছে তারা; কিন্তু মুনাফাও কম করছে না। চুক্তিবদ্ধ চাষীর কাছ থেকে কাঁচামাল কিনছে তারা। ক্রমবর্ধমান মসলার বাজারে এর প্রভাবও বিবেচ্য।

ভালো হত বিশেষত ইফতার সামগ্রী পরিভোগের প্যাটার্ন বদলানোর প্রক্রিয়াটি এগিয়ে নেওয়া গেলে। ভাজাপোড়া খাদ্যদ্রব্য পরিহারের লক্ষ্যে একটা সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা গেলে কবছরে হয়তো সুফল মিলত। তাহলে রমজানে নির্দিষ্ট কিছু পণ্যসামগ্রীতে চাহিদার অতিরিক্ত চাপ এবং সেটা পরিপূরণে আমাদের হিমশিম অবস্থাটাও আসত সহনীয় হয়ে। ব্যবসায়ীরা কারসাজি যদি কিছু করেও থাকে, সেটা কিন্তু করছে এমনতরো পরিস্থিতির সুবাদে। সঙ্গত কোনো কারণ ছাড়া ভোজ্যতেলের দামবৃদ্ধির চলতি প্রবণতাটি তার প্রমাণ দিচ্ছে। শেষমেষ এর পক্ষে অজুহাত দাঁড় করিয়ে বলা হচ্ছে, 'পরিবহন-ব্যয়' বৃদ্ধির কথা।

অন্যান্য পণ্যের দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এখন হয়তো অজুহাত হবে বৃষ্টিপাত। বৃষ্টি ও স্থানীয় বন্যার কারণে সাপ্লাই-চেইন অবশ্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তার প্রভাব পড়বে পণ্যবাজারে। দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে এটা অজুহাতও হয়ে উঠতে পারে। চাহিদার চাপ অব্যাহত থাকলে সন্দেহ নেই, এ সুযোগ বেশি করে মিলবে। রমজানের মধ্যভাগে অবশ্য বিশেষ বিশেষ খাদ্যপণ্যের চাহিদা কমে আসবে– অন্য ধরনের কেনাকাটা বাড়বে বলে। বেতন-বোনাস মিলে গেলে সে প্রক্রিয়া বেগবান হবে বৈকি।

রমজানে নিত্যপণ্যের বাজারে সর্বসাধারণের অভিজ্ঞতার পর্যালোচনা অবশ্য করতে হবে সরকারকে। বেসরকারি খাত এতে শামিল হতে পারে। মিডিয়াও এ জায়গাটায় ভূমিকা রাখতে পারে যথাযথ বিজনেস নিউজ প্রকাশ ও মানসম্মত মতামত তুলে ধরে।

হাসান মামুন: সাংবাদিক, কলামিস্ট।