পারিবারিক নির্যাতন: নষ্টনীড়ের নষ্ট উপাখ্যান

Published : 27 July 2011, 10:25 AM
Updated : 1 July 2015, 11:10 PM

সম্প্রতি একটি পারিবারিক নির্যাতনের মামলা নিয়ে পত্রপত্রিকায় একাধিক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এক সাংবাদিক তার স্বামীর বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ করে মামলাটি করেছেন। এখন এটি টক অব দ্য টাউন। ওই সাংবাদিকের ন্যায়বিচার নিশ্চিতের দাবি জানিয়ে বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রসহ বেশ কয়েকটি সংগঠন মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে। প্রতিবাদ জানিয়ছেন অনেকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে পক্ষে-বিপক্ষে চলছে বাদানুবাদ। বিষয়টি এখন বিচারাধীন। তাই এ নিয়ে মন্তব্য করা নিষ্প্রয়োজন। এই নিবন্ধে পারিবারিক সহিংসতার চিত্র এবং এ বিষয়ে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি প্রসঙ্গে আলোকপাত করা হবে।

পারিবারিক সহিংসতা আমাদের সমাজে নতুন বিষয় নয়। দক্ষিণ এশিয়ার সবকটি দেশেই নারীরা বিভিন্ন রকম পারিবারিক নির্যাতনের শিকার। আর শুধু দক্ষিণ এশিয়ার কথাই-বা বলি কেন, এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ও আফ্রিকা মহাদেশজুড়ে এটি প্রবল প্রতাপে বিরাজমান রয়েছে। ল্যাটিন আমেরিকা, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপেও যে নারীরা এ থেকে পুরোপুরি মুক্ত রয়েছে তা বলা যাবে না। যেখানেই পুরুষের আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণকামিতা রয়েছে সেখানে পরিবারের অভ্যন্তরে নারীর উপর নির্যাতন চলে– হতে পারে তা শারীরিক, মানসিক, যৌন কিংবা অর্থনৈতিক।

দক্ষিণ এশিয়ায় অনার কিলিং বা পরিবারের সম্মান রক্ষার নামে নারীহত্যা, বাট্টা-সাট্টা (দুই শত্রু পরিবারের বিরোধ মেটাতে জোর করে নারীকে শত্রু পরিবারের কোনো সদস্যকে বিয়ে করতে বাধ্য করা), কন্যাভ্রূণ হত্যা, যৌতুকের জন্য নারীনির্যাতন, নারীর খতনা, যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার ইত্যাদি অসংখ্য উপায়ে নারীর জীবন দুর্বিষহ করে তোলা হয় বা তার মৃত্যু ঘটনো হয়। আর বিবাহিত স্ত্রীকে মানসিক নির্যাতন, যৌননির্যাতন, স্ত্রীর সম্পত্তি আত্মসাতে বিশ্বের কোনো দেশের পুরুষ যে পিছিয়ে আছে তা বলা মুশকিল।

পাশাপাশি, বিভিন্ন দেশে পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধে বিভিন্ন আইন রয়েছে। আমাদের দেশেও পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধে আইন রয়েছে। আইনটির নাম, 'ডমেসটিক ভায়োলেন্স (প্রিভেনশন অ্যান্ড প্রোটেকশন) অ্যাক্ট, ২০১০' বা পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০। আইন তো রয়েছে, কিন্তু কাজীর গরু কেতাবে থাকার মতোই তা অর্থহীন। বরং অনেক ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করতে আইনটির অপপ্রয়োগ হচ্ছে। অন্যদিকে, দুর্বলতর সামাজিক অবস্থানে যে নারী রয়েছেন তিনি স্বামীর মানসিক ও যৌননির্যাতন নিরবেই সহ্য করে চলেন। আইনের আশ্রয নেওয়ার মতো সাহস বা সঙ্গতি তার হয় না।

সুবিচার পাওয়ার প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণে প্রথম অন্তরায় রয়ে গেছে নারী ও সমাজের মনোজগতে। সাধারণভাবে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হওয়াই অসম্মানের বলে মনে করা হয়। স্বামীর দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এমনটি প্রকাশ পেলে সমাজে নারীর হেয় হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে। তাই নির্যাতন সহ্য করেও আপাত সুখি চেহারা ধরে রাখেন অনেক নারী। তিনি মনে করেন, নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এ কথা প্রকাশ পেলে সমাজে তার মানসম্মান থাকবে না। ফলে প্রহারের কালশিটে ফেস পাউডারে ঢেকে চলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন অনেক নারী।

মানসিক ও যৌননির্যাতনের কথা তো অপ্রকাশিতই রয়ে যায়। এসব নির্যাতন নারীকে তিলে তিলে ক্ষয় করে ফেলে, তার মানসিক মৃত্যু ঘটায়। তবু স্বামীর হাতে যৌননির্যাতনের শিকার হওয়ার কথা নিকট আত্মীয়দের কাছেও লজ্জায় বলতে পারেন না অধিকাংশ নারী্। এই দুর্বলতা ব্যবহার করেই নির্যাতন চালিয়ে যায় এক শ্রেণির পুরুষ। তারা মনে করে, যতই নির্যাতন করা হোক না কেন, মেয়েটি তো কোনোদিনই মুখ খুলবে না।

নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের বেলায় অর্থনৈতিক বাধাও একটি বড় সমস্যা সন্দেহ নেই। টাকা যার হাতে ক্ষমতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারই হাতে। স্বামী বা পরিবারের অন্য সদস্যদের উপর যতদিন একজন নারী অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল থাকবেন ততদিন তিনি নিজের মুক্তির পথ খুঁজে নিতে পারবেন না এ কথা বলা বাহুল্য। নির্যাতনকারী স্বামীর ঘর ছেড়ে বের হয়ে যেতে হলে তার নিজের ও সন্তানের বেঁচে থাকার সংস্থানটুকু অন্তত থাকতে হয়। পাশাপাশি দরকার ভিকটিম নারীর সামাজিক নিরাপত্তা। ঘর ছেড়ে যিনি বের হবেন তার মাথার উপর নিরাপদ ছাদ না থাকলে ঘর ছেড়ে পথের দুর্বৃত্তের হাতে গিয়ে পড়তে কে রাজি হবেন! জ্বলন্ত উনুনের তুলনায় তপ্ত কড়াই বেশি সহনীয় বলেই মনে হবে ভিকটিমের কাছে।

এই সামাজিক নিরাপত্তাটুকুর জন্যই স্বামীর শত অত্যাচার সহ্য করেও পথে বের হতে সাহসী হন না অনেক অসহায় নারী। পারিবারিক নির্যাতনের শিকার নারীর জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক শেলটার হোম যদি থাকত তাহলে অনেক নারী নির্যাতনকারী স্বামীর ঘর ছেড়ে মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে পারতেন।

প্রশ্ন উঠতে পারে, যে নারী অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী, তিনিও কেন স্বামীর অত্যাচার সহ্য করে অপমানের জীবন যাপন করেন? কেন তিনি বিবাহ-বিচ্ছেদের পথ বেছে নিতে সাহসী হন না? নাজনীন আখতার তন্বীর কথাই ধরা যাক। তিনি দৈনিক জনকণ্ঠের সিনিয়র রিপোর্টার। সাহসী প্রতিবেদনের জন্য অনেক পুরস্কারও পেয়েছেন। তিনিও দীর্ঘদিন ধরে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সহ্য করছিলেন। এ ক্ষেত্রে একটা কথা না বললেই নয়। অনেকেই বলবেন, বিবাহিত জীবনে একজন মানুষের অধিকার আছে তার স্ত্রী বা স্বামীকে ত্যাগ করার। নাজনীনকে মুকুলের যদি ভালো না লাগে তবে তাকে ত্যাগ করার অধিকার তার অবশ্যই ছিল এবং আছে। কিন্তু কোনো মানুষেরই অধিকার নেই অপর মানুষকে শারীরিক ও মানসিভাবে নির্যাতন করার।

নাজনীনের অভিযোগ অনুসারে তাকে প্রহার করে তার চিৎকার প্রেমিকাকে শুনাতেন মুকুল। ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের কাছে নাজনীন এ কথাও বলেছেন যে, প্রেমিকার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ের তুলনা করে তাকে ভয়াবহভাবে অপমান করতেন মুকুল। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় তার পেটে লাথিও মেরেছেন তার স্বামী। স্বামীর প্রহারে রক্তাক্ত হওয়ার পর এর আগেও তাকে উদ্ধার করেছেন তার বন্ধুরা। এত কিছুর পরও কেন নাজনীনের মতো সচেতন নারী অপমান সহ্য করে পড়ে থাকেন, কেন বিবাহ-বিচ্ছেদের পথ অবলম্বন করেন না সে প্রশ্ন জাগতেই পারে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রুমানা মঞ্জুরের কথা মনে আসতে বাধ্য। মেধাবী ও স্বাবলম্বী নারী রুমানা দীর্ঘদিন ধরে তার বেকার স্বামীর নির্যাতন সহ্য করছিলেন। এই নির্যাতন যদি তিনি সহ্য না করে বিবাহবিচ্ছেদ করতেন তাহলে শেষ পর্যন্ত স্বামীর নির্যাতনে তাকে দৃষ্টিশক্তি হারাতে হত না। অন্তিম পরিণতি পর্যন্ত নারীরা এই সহ্যটি করেন শুধুমাত্র 'ঘর-সংসার' নামে এক 'প্রতিষ্ঠান' টিকিয়ে রাখতে। যে ঘরে নির্যাতনের শিকার হতে হয় সেটি যে আসলে 'ঘর' নয়, 'কারাগার' তা বুঝতে তাদের যে দেরি হয় সেটির মাসুল কখনও কখনও দিতে হয় জীবন দিয়ে। যে স্বামী নির্যাতন করে, সে যে আসলে মানুষরূপী অমানুষ এবং তার সঙ্গে বাস করার চেয়ে একা থাকা শতগুণে শ্রেয় এ কথা বুঝতে সহনশীল বাঙালি নারীর অনেক দেরি হয়ে যায়।

এ সবের পিছনে ক্রিয়াশীল থাকে কিছু অচল ও ভ্রান্ত বিশ্বাস এবং তালাকপ্রাপ্ত নারীর প্রতি সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। তালাকপ্রাপ্ত নারীকে এখনও মুখে যিনি সহানুভূতি জানান তিনিও আড়ালে 'স্বামীর ঘর করতে পারেনি' বলে মন্তব্য করতে ছাড়েন না। আবার এই নারীদের চরিত্র সম্পর্কে কটাক্ষ করেন অনেক 'ছদ্মবেশী' স্বজনও। এ কথা ঠিক যে, সমাজের এসব নেতিবাচক ধারণা কিছুটা হলেও বদলে যাচ্ছে এখন। পরিবর্তনটা আরও দ্রুত হওয়া প্রয়োজন। আমাদের সবাইকে নিয়েই তো সমাজ। যে সমাজ নারীর স্বামীর হাতে নির্যাতিত হওয়া ঠেকাতে পারছে না, বরং 'ওদের ব্যক্তিগত বিষয়' বলে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে, সে সমাজের কোনো অধিকার নেই নির্যাতনকারী স্বামীর ঘর ছেড়ে আসা সাহসী নারীকে কটাক্ষ করার। তাছাড়া সমাজ যদি কটাক্ষ করেও তবে স্বাবলম্বী নারীর উচিত হবে সেই কটাক্ষকারীদের মন্তব্য তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া।

নির্যাতনের প্রতিবাদকারী সাহসী নারীদের পাশে দাঁড়ানো প্রয়োজন সমাজের সর্বস্তরের মানুষের। আর কিছু নয়, নৈতিক সমর্থনও তার যুদ্ধ অনেক সহজ করে দিতে পারে। নারীকেও বুঝতে হবে, শুধু কোনোক্রমে 'ঘর টিকিয়ে রাখা'র মধ্যে বিবাহিত জীবনের গৌরব তো নেই-ই বরং তা নিদারুণভাবে অবমাননাকর। আত্মমর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকতে হলে স্বাবলম্বী তো হতেই হবে, সেই সঙ্গে যদি নষ্টনীড় ছেড়ে আকাশে ডানা মেলতে হয়, তা-ও করতে হবে।

পারিবারিক সহিংসতা সম্পর্কে যারা ভাবেন এগুলো 'অশিক্ষিত' ও 'দরিদ্র' মানুষের পরিবারেই ঘটে, তাদেরও চোখ খোলার সময় হয়েছে বৈকি। সমাজের সচেতন ও অগ্রসর বলে পরিচিত পেশাধারীদের মধ্যেও রয়ে গেছে অনেক 'বউ-পেটানো' ও 'বিকৃত রুচি'র মানুষ। তাদের মুখোশ উন্মোচনের সময় এসেছে। পারিবারিক সহিংসতা 'স্বামী-স্ত্রীর ব্যক্তিগত বিষয়' বলে উড়িয়ে না দিয়ে এই সামাজিক ক্যান্সারের চিকিৎসা প্রয়োজন অতি দ্রুত ও কার্যকরভাবে।