প্রসঙ্গ কানাডা-প্রবাসী খুনি নূর চৌধুরীর হস্তান্তর

মোজাম্মেল খানমোজাম্মেল খান
Published : 11 Sept 2015, 07:32 PM
Updated : 11 Sept 2015, 07:32 PM

জাতীয় শোক দিবসের বিভিন্ন আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধু হত্যার অন্যতম আসামী, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত নূর চৌধুরীকে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে বিভিন্ন জন বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে কানাডায় প্রচলিত আইন সম্পর্কে ধারণা দিতেই এ লেখার আয়োজন।

কয়েক বছর আগে ঢাকার একটি ইংরেজি দৈনিকের কয়েকটি সংখ্যায় কানাডা থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত খুনিদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। পরবর্তীতে বাংলাদেশের তদানীন্তন আইনমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কানাডা সফরের পর এদেশের কয়েকটি পত্রিকায় টরন্টোতে পালিয়ে থাকা আত্মস্বীকৃত খুনি নূর চৌধুরীকে বাংলাদেশ সরকারের কাছে হস্তান্তরের আইনি জটিলতা নিয়ে কয়েকটা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।

একইভাবে বছর খানেক আগে ঢাকাস্থ কানাডিয় হাইকমিশনার বাংলাদেশের তদানীন্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে এক বৈঠকে যে দেশে মৃত্যুদণ্ড প্রচলিত আছে সেখানে মৃত্যদণ্ডপ্রাপ্ত কোনো অপরাধীকে ফেরত পাঠনোর অনুরোধ নাকচ করে দিয়েছেন।

নিবন্ধগুলোতে যে দেশে মৃত্যুদণ্ডের প্রচলন আছে, কানাডা থেকে কোনো ফেরারিকে সে দেশে ফেরত পাঠানোর আইনগত জটিলতা নিয়ে বিশদ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সেখানে মূলত দুটো প্রতিবন্ধকতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথমত, কানাডা ইমিগ্রেশন ও রিফ্যুজি বোর্ডের একটা আদেশের কথা রয়েছে যেটাতে বলা হয়, 'যে সমস্ত দেশে বিচারে সম্ভাব্য মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতে পারে সে সমস্ত দেশে কোনো অভিযুক্তকে ফেরত পাঠানোর পূর্বে ঐ সরকারের কাছ থেকে আশ্বাস নিতে হবে যে, বিচারে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলেও সেটা কার্যকরী করা হবে না।'

দ্বিতীয়ত, ২০০১ সালে দেওয়া কানাডার সুপ্রিম কোর্টের একটা আদেশের উল্লেখ করা হয়েছে, যেটাতে 'সরকারকে, বিশেষ ব্যতিক্রম ছাড়া, কোনো সন্দেহভাজন খুনিকে যে সমস্ত দেশে মৃত্যুদণ্ডের আইনি ব্যবস্থা বিদ্যমান সে সমস্ত দেশে ফেরত না পাঠানো।'

বর্তমান নিবন্ধ উপরোক্ত দুটো আদেশের আওতা ও প্রেক্ষিত এবং সেগুলো কতটুকু সংশ্লিষ্ট ফেরারির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য সেটা বিশ্লেষণেরই এক প্রচেষ্টা।

প্রথমত, ইমিগ্রেশন ও রিফ্যুজি বোর্ড একটা স্বাধীন প্রশাসনিক ট্রাইবুন্যাল। ইমিগ্রেশন ও রিফ্যুজি সংক্রান্ত ব্যাপারে এই বোর্ড সাধারণত যুক্তিনির্ভর সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। এই বোর্ডে রিফ্যুজি মর্যাদার জন্য নূর চৌধুরীর আবেদন পরপর চার বার প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। এ দিক দিয়ে বিচার করলে, ইমিগ্রেশন ও রিফ্যুজি বোর্ডের নূরকে ফেরত না পাঠানোর আদেশ অনেকটা স্ববিরোধী, যেহেতু আইনগত বৈধতা ছাড়া এদেশে কারও বাস করার অধিকার নেই।

উপরন্তু, ইমিগ্রেশন ও রিফ্যুজি বোর্ড কোনো বিচারিক আদালত নয়; তাই এর দেওয়া আদেশ বা পর্যবেক্ষণ সরকারের জন্য অবশ্য পালনীয় নয়। এর যে কোনো সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ইমিগ্রেশন মন্ত্রী, জননিরাপত্তা মন্ত্রী বা আবেদনকারী ফেডারেল কোর্টে বিচারিক পুনঃর্বিবেচনার আবেদন করতে পারবেন।

দ্বিতীয়ত, ২০০১ সালের ফেব্রয়ারিতে দেওয়া কানাডিয়ান সুপ্রিম কোর্ট আদেশ (এস সি আর ২৮৩) কোনো নিঃশর্ত আদেশ নয়; এটা প্রকৃত অবস্থার প্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ করতে হবে। এ মামলার একদিকে ছিলেন কানাডার বিচার মন্ত্রী এবং অন্যদিকে ছিলেন বার্নস এবং রাফে, যাদের সঙ্গে ইন্টারভেনর হিসেবে ছিল অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। ঐ দুই ব্যক্তিকেই থ্রি কাউন্টস অব এগ্রিভেটেড ফার্স্ট ডিগ্রি মার্ডারের অভিযোগে বিচার করার জন্য ওয়াশিংটন স্টেটে ফেরত দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছিল। বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলে এদের মৃত্যুদণ্ড বা প্যারোল ছাড়া যাবজ্জীবন সাজা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। ওরা দুজনই ছিল কানাডার নাগরিক এবং তাদের বিরুদ্ধে রাফের নিজের বাবা মা এবং বোনকে তাদের নিজস্ব বাড়িতে হত্যা করার অভিযোগ আনা হয়েছিল।

১৯৯৪ সালের জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্র সরকার এদেরকে ওয়াশিংটন স্টেটে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে। কানাডার বিচার মন্ত্রী অভিযুক্তদের বিশেষ অবস্থা এবং ক্রাইমের গুরুত্ব বিবেচনায় এনে প্রত্যাবর্তন আইনের ২৫ অধ্যায়ে দেওয়া ক্ষমতাবলে আমেরিকার সঙ্গে কানাডার প্রত্যাবর্তন চুক্তির ৬ নম্বর ধারা– যাতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যাবে না কিংবা দেওয়া হলেও সেটা কার্যকরী করা হবে না ধরনের আশ্বাসের কথা বলা হয়েছে– উপেক্ষা করে দুই অভিযুক্তকে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরের আদেশ দেন।

প্রত্যাবর্তন আইনের ২৫ অধ্যায়ে বিচার মন্ত্রীর নিজস্ব বিচার-বিবেচনায় বিরাট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে– তিনি কীভাবে বা কোন শর্তে কোনো ফেরারিকে সমর্পণ করতে পারবেন। প্রত্যাবর্তন চুক্তির ৬ নম্বর ধারা মোতাবেক আশ্বাস চাওয়া বা না-চাওয়ার ব্যাপারে বিচার মন্ত্রীর অবস্থানের ব্যাখ্যা হল: নিয়মিতভাবে সব ক্ষেত্রেই মৃত্যুদণ্ড রহিত করার আশ্বাস চাওয়ার প্রয়োজন নেই, শুধুমাত্র বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রেই সেটা করা উচিত এবং কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে সেটা করা উচিৎ সেটা নির্ধারণের এখতিয়ার রয়েছে বিচার মন্ত্রীর।

সুপ্রিম কোর্টের মতানুসারে যদিও এটা সাধারণভাবে মন্ত্রীর আওতায়, আদালতের নয়, প্রত্যাবর্তন চুক্তির বিবদমান কোন্ বিবেচনার গুরুত্ব কতটুকু, সম্ভাব্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান এক নূতন দিগন্তের উম্মোচন করেছে। যার ফলে সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ হল, 'মৃত্যুদণ্ড একটা বিচারিক ইস্যু, এটা খুব কমই চলিঞ্চুতা আধিকারিক ব্যাপার'। চার্টার অব রাইটস অ্যান্ড ফ্রিডমসএর ৬ নম্বর অধ্যায়ের উল্লেখ টেনে সুপ্রিম কোর্টের অভিমত হল, 'বিশেষ ব্যতিক্রম' ব্যতীত, নিঃশর্ত হস্তান্তরে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর না করার আশ্বাস নেওয়া সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা।

অবশ্য 'বিশেষ ব্যতিক্রম' বলতে কোন অবস্থা বোঝায় সেটার ব্যাখা সুপ্রিম কোর্ট প্রদান করেননি। সংবিধান ও আইন বিশেষঞ্জদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী একে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বোঝানো হয়েছে। অধিকন্তু চার্টারের ৬(১) নম্বর ধারা অবশ্য শুধুমাত্র কানাডার নাগরিকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যেটাতে পরিস্কারভাবে বলা হয়েছে, 'কানাডার প্রত্যেক নাগরিকের কানাডাতে প্রবেশের, অবস্থানের এবং ত্যাগের অধিকার রয়েছে'।

সম্ভবত সে বিধান বিবেচনায় রেখে ১৯৯১ সালে সুপ্রিম কোর্ট মৃত্যুদণ্ড মওকুফের আশ্বাস ছাড়াই দুজন নন-কানাডিয়ান, কাইন্ডলার এবং উঁ নামক দুজন অভিযুক্তের হস্তান্তর বৈধ ঘোষণা করেন (এস সি আর ৭৭৯ এবং এস সি আর ৮৫৮)। সে ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের অভিমত ছিল, 'যদিও কানাডা নিজে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রহিত করেছে, কিন্তু অন্য সমস্ত দেশের বিধান কানাডার অবশ্যই সম্মান করা উচিৎ'।

বিচার মন্ত্রীকে প্রত্যাবর্তন আইনের ২৫ অধ্যায়ে নিজস্ব বিচার-বিবেচনা অনুসারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার যে অবাধ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সেটা শুধু প্রত্যাবর্তন চুক্তির বিদ্যমানতার উপরই নির্ভর করে এবং সে ধরনের চুক্তি এ মুহূর্তে বাংলাদেশের সঙ্গে কানাডার নেই। তাই প্রত্যাবর্তন তরান্বিত করার জন্য বাংলাদেশ কোনো দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা বা ব্যক্তি-নিদির্ষ্ট কোনো চুক্তি করতে পারে যেটা ১৯৯৯ সালে কানাডার প্রত্যাবর্তন আইনের সংশোধনীতে সন্নিবেশিত হয়েছে। উপরোক্ত চুক্তিতে 'আশ্বাসের ধারা' সন্নিবেশিত করার বাধ্যবাধকতা নেই যেহেতু ১৯৯১ সালের দুটি পৃথক সুপ্রিম কোর্ট আদেশে নন-কানাডিয়ান ফেরারিদের প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে একে পরোক্ষভাবে অপ্রয়োজনীয় হিসেবেই স্বীকার করা হয়েছে।

উপরন্তু, কানাডিয়ান ফেডারেল কোর্ট নূর চৌধুরীর আপিল প্রত্যাখ্যান করে যে রায় দিয়েছে সেটাতে সুস্পষ্টভাবে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের শিশু ও নারী সদস্যদের নৃশংস হত্যার ঘটনা 'মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ' হিসেবে লিপিবদ্ধ করেছে। ২০০১ সালের সুপ্রিম কোর্ট আদেশে যাকে 'বিশেষ ব্যতিক্রম' হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

পরিশেষে, এটা সম্পূর্ণভাবে বিচার মন্ত্রীর বিচার-বিবেচনা-সিদ্ধান্তের উপরই বেশিরভাগ নির্ভরশীল। সেটি আবার সাধারণত রাজনীতিনির্ভর, সুপ্রিম কোর্টের নূতন কোনো আদেশের উপর নয়। বিচার মন্ত্রীর বিচার-বিবেচনা-সিদ্ধান্ত এই মহান অনুকরণীয় গণতন্ত্রের নাগরিকেরা, বিশেষ করে যারা বাংলাদেশ বংশোদ্ভূত, বহুলাংশে প্রভাবান্বিত করার ক্ষমতা রাখেন।

দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশের যে সমস্ত কর্মকর্তা এ উদ্দেশ্যে কানাডাতে এসেছেন তারা কেউ কোনো বাংলাদেশি কানাডিয়ানের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। অথচ এই বাংলাদেশি কানাডিয়ানরাই ২০০৭ সালে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মহিউদ্দিনের এদেশে আশ্রয় পাওয়ার প্রচেষ্টা নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন; কোনো সরকারি প্রচেষ্টার সেখানে দরকার হয়নি। আমি নিজে নূর চৌধুরীকে হস্তান্তরে আইনি সহায়তা দেওয়ার জন্য যে ল'ফার্ম নিয়োগে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছি। সফরকালে কোনো কর্তাব্যক্তি যোগাযোগ করেননি আমার সঙ্গেও।

এ কর্তাব্যক্তিরা দেশে বসে যে সমস্ত বক্তব্য দিয়ে চলেছেন তার সঙ্গে বাস্তবতার সম্পর্ক নেই। আইনি প্রক্রিয়া চালু করার জন্য যে প্রাসঙ্গিক পূর্ব-অবস্থার প্রয়োজন (যেটা আমি সবিস্তারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বিশ্বস্ত চ্যানেলে জানিয়েছিলাম এবং আরেক জন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীকে গত বছরের জুলাই মাসে তাঁরই অনুরোধে সাক্ষাৎ করে উপস্থাপন করেছিলাম) সে অবস্থার সৃষ্টিও করা হয়নি, অগ্রসর তো দূরের কথা।

এ প্রেক্ষিতেই বলব, নূর চৌধুরীকে ফেরত পাবার বিষয়ে আমাদের সঠিক কোনো পদক্ষেপের অভাবে আমরা ক্রমশই লক্ষ্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছি।