রাজনৈতিক সচেতনতা ও বাংলাদেশি চলচ্চিত্র

নাদির জুনাইদ
Published : 24 June 2015, 07:42 AM
Updated : 24 June 2015, 07:42 AM

চলচ্চিত্রকে শিল্পকলার একটি শাখা হিসেবে বিবেচনা করা হলেও অনেকে মনে করেন, বিনোদন প্রদানই এর মূল কাজ; দর্শককে বিনোদনের মাধ্যমে আকৃষ্ট করতে না পারলে একটি চলচ্চিত্রের বক্তব্যের প্রতিও দর্শক মনোযোগী হবে না। এমন ধারণার সঙ্গে যৌক্তিকভাবে দ্বিমত পোষণ করা যায়। বিনোদনধর্মী চলচ্চিত্র তৈরি হওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু সব চলচ্চিত্রেই যে বিনোদনধর্মী উপাদান থাকতে হবে এমন ধারণা অগ্রহণযোগ্য। দর্শককে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে সচেতন করার জন্যও বিভিন্ন দেশে চলচ্চিত্র তৈরি করা হয়েছে। এই ধরনের চলচ্চিত্রে বর্তমান সময়ের জরুরি সমস্যাগুলির মূল কারণ তুলে ধরা হয়; সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে পরিচালক নিজের সমালোচনা প্রকাশ করেন।

এই ধরনের চলচ্চিত্রে বিনোদন দেওয়ার চেষ্টা গুরুত্ব পায় না। কারণ বিনোদনের সুখানুভূতির কারণে সামাজিক অন্যায়ের কদর্য ও অনুভূতিহীন দিকগুলি দর্শককে পীড়িত করতে পারবে না। আর সেটা না পারলে এর বিরুদ্ধে সক্রিয় বিরোধিতা তৈরি হবে বলে আশা করা যায় না। কোনো ছবিতে যদি সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যার সমালোচনা উপস্থাপন মূল উদ্দেশ্য হয়, সে ক্ষেত্রে দর্শককে গতানুগতিকভাবে বিনোদন দেওয়া হলে সেই ছবির উদ্দেশ্য ও বক্তব্য যথেষ্ট কার্যকর না হওয়াই স্বাভাবিক।

সত্যজিৎ রায়ের বহুল আলোচিত 'হীরক রাজার দেশে' (১৯৮০) ছবিটির কথা এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়। ভারতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হলেও সত্তরের দশকে সেখানে মানুষ দেখতে পেয়েছে রাজনৈতিক পীড়ন আর জরুরি অবস্থা। এই পরিস্থিতিতে নিজ ছবিতে সত্যজিৎ স্যাটায়ারের মাধ্যমে শাসকদের আচরণের অসঙ্গতি ও সমাজে টিকে থাকা অন্যায় তীব্রভাবে আক্রমণ করেছেন। এমন রাজনৈতিক সমালোচনার উদ্দেশ্য ছিল দর্শককে বর্তমান ব্যবস্থার প্রকৃত রূপ সম্পর্কে সচেতন করে তোলা।

কেউ বলতে পারেন, হাস্যরস, সঙ্গীত, ফ্যান্টাসি প্রভৃতি উপাদান ব্যবহারের কারণে 'হীরক রাজার দেশে' দর্শককে যথেষ্ট আমোদিতও করে। কিন্তু লক্ষ্য করতে হবে, জনপ্রিয় ছবির এই উপাদানগুলো সত্যজিৎ গতানুগতিকভাবে ব্যবহার করেননি। ছবির বিভিন্ন সংলাপে হাস্যরস থাকলেও নিজের দরবারে হতদরিদ্র কৃষক, শ্রমিক আর গ্রামের গায়কের প্রতি হীরক রাজার নিষ্ঠুর, অমানবিক আচরণ; রাজার আদেশে পেয়াদা নিয়ে গ্রামের পাঠশালায় শিক্ষামন্ত্রীর আগমন এবং জোর করে পাঠশালা বন্ধ করে দেওয়া; ছাত্রদের সামনে অসহায় শিক্ষকের ব্যথাতুর মুখ; শিক্ষকের বাড়িতে যেয়ে শিক্ষকের সব বই পুড়িয়ে দেওয়া প্রভৃতি দৃশ্য এবং বিভিন্ন সংলাপ দর্শকমনে তীব্র অস্বস্তি সৃষ্টি করে। গুপী-বাঘার গানও হালকা বিনোদন যোগায় না, বরং সেখানে আমরা শুনি পরিচালকের রাজনৈতিক বক্তব্য। হাস্যরসের মাধ্যমেই শেষ দৃশ্যে দেখানো হয় অত্যাচারী রাজার পতন।

তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঔপনিবেশিকতা-পরবর্তী সমস্যা-পীড়িত পরিস্থিতিতে চলচ্চিত্রকাররা নিজেদের ছবিতে সমকালীন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছেন। বর্তমানের গুরুতর সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যার সমালোচনা কখনও তাঁরা তুলে ধরেছেন সরাসরিভাবে (মৃণাল সেনের 'কলকাতা ৭১', 'পদাতিক', ঋত্বিক ঘটকের 'যুক্তি, তক্কো আর গপ্পো', ওসমান সেমবেনের 'হাল্লা'); কখনও সমালোচনা করা হয়েছে রূপকের মাধ্যমে (জহির রায়হানের 'জীবন থেকে নেয়া', সত্যজিৎ রায়ের 'হীরক রাজার দেশে', আবদার রহমান সিসাকোর 'বামাকো')।

একটি রাষ্ট্রের বিদ্যমান ব্যবস্থা এই ধরনের ছবি সহজে গ্রহণ করবে না এমন ঝুঁকি নিয়েই সমাজসচেতন চলচ্চিত্রকাররা প্রতিবাদী ছবি তৈরি করেন। আমরা জানি, 'জীবন থেকে নেয়া' (১৯৭০) নির্মাণের সময় জহির রায়হানকে বার বার পাকিস্তানি সামরিক প্রশাসনের অসন্তোষ আর ক্রোধ মোকাবেলা করতে হয়েছিল। রূপকধর্মী কাহিনির মাধ্যমে পরিচালক শাসকগোষ্ঠীর স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবের সমালোচনা তুলে ধরেন। তা সত্ত্বেও সরকারি নির্দেশে ছবি থেকে বিভিন্ন দৃশ্য তাঁকে বাদ দিতে হয়।

সেনেগালের বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার ওসমান সেমবেনের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ছবি, 'হাল্লা' (১৯৭৪) সেনেগালের স্বাধীনতা-পরবর্তী শাসকদের শঠতাপূর্ণ আচরণের নির্দয় সমালোচনা তুলে ধরে। তাই অনেক দৃশ্য বাদ দেওয়ার পরই কেবল 'হাল্লা' মুক্তি দিতে দেওয়া হয় সেমবেনকে।

তারেক মাসুদ যখন ধর্মীয় গোঁড়ামি, মৌলবাদ ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের ব্যবহারের সমালোচনা করে 'মাটির ময়না' (২০০২) নির্মাণ করেন, তখন এমন বিষয়বস্তু স্পর্শকাতর আখ্যা দিয়ে ছবিটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ছবিটতে পরিবর্তন আনতেও বলা হয় তারেককে। এরপর ছবিটির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হলেও সিনেমা হলগুলোতে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে প্রদর্শনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এই ঘটনাসমূহ নির্দেশ করে, সমাজের নেতিবাচক দিকের সমালোচনা চলচ্চিত্রে প্রকাশের কাজটি ঝুঁকিপূর্ণ ও কঠিন। তবে সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, ওসমান সেমবেন, জহির রায়হান, তারেক মাসুদ এবং বিভিন্ন দেশে আরও অনেক চলচ্চিত্রকার এমন ঝুঁকির মধ্যেই কাজ করেছেন।

বিনোদননির্ভর বাণিজ্যিক ছবিসমূহে সমাজের জটিল সমস্যাগুলি থেকে দর্শকের মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে রাখা হয়। আনন্দ প্রদানই এই ধরনের ছবির মূল লক্ষ্য, দর্শককে বিচলিত বা ক্ষুব্ধ করা নয়। সামাজিক সমস্যাসমূহ কখনও সেখানে উপস্থাপিত হলেও আনন্দদায়ক উপাদানে প্রাধান্য দেওয়ার কারণে দর্শকমনে তা যথেষ্ট অস্বস্তি তৈরি করতে পারে না। আবার কখনও শক্তিশালী কোনো নায়কের অশুভ শক্তিকে পরাজিত করার মাধ্যমে তুলে ধরা হয় সামাজিক সমস্যার অবাস্তব সমাধান।

সামাজিক সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সক্রিয় অবস্থান গ্রহণে মানুষকে আগ্রহী করে তোলা সমাজের স্বার্থেই জরুরি। এ ক্ষেত্রে শিল্পকলার প্রতিটি শাখাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম। রুশ কবি মায়াকোভস্কি যেমন বলেছিলেন, "শিল্পকলায় মানুষের ঐতিহাসিক সংগ্রামের বিবরণই শুধু প্রতিফলিত হয় না, শিল্পকলা মানুষের সংগ্রামে একটি হাতিয়ার হিসেবেও কাজ করে।" আর রুশ বিপ্লবের পর বিপ্লবী চেতনা সমুন্নত রাখতে লেনিন সেই সময়ের সাংস্কৃতিক কমিশার লুনাচারস্কিকে বলেছিলেন সব ধরনের আর্টের মধ্যে চলচ্চিত্রই তাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মানুষকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করার ব্যাপারে চলচ্চিত্রের সক্ষমতা লেনিন অনুধাবন করেছিলেন সঠিকভাবে।

পরবর্তীতে কিউবায় বামপন্থী বিপ্লব সফল হওয়ার পর নতুন সমাজে বৈপ্লবিক চিন্তা শক্তিশালী করতে দ্রুত একটি ফিল্ম ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয় যেখানে তৈরি হতে থাকে বিভিন্ন চিন্তাশীল চলচ্চিত্র।

ষটের দশকে বৈষম্য আর শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালিদের প্রতিবাদের ফলে যে রাজনৈতিক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছিল সেটি তুলে ধরার চেষ্টা তৎকালীন বাংলা চলচ্চিত্রে দেখা যায়নি। হয়তো স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের নিয়ন্ত্রণের কথা চিন্তা করেই চলচ্চিত্রকাররা এতে অনাগ্রহী ছিলেন। তখন সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের সাহসী সমালোচনা তুলে ধরা হয়েছিল একমাত্র 'জীবন থেকে নেয়া' ছবিতেই।

একটি গণযুদ্ধের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। তাই স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে প্রয়োজন ছিল পুরনো উপনিবেশী সমাজকাঠামোর চিন্তাসমূহ প্রত্যাখ্যান করা। স্বাধীন সমাজে নতুন চিন্তা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য শিল্পকলার বিভিন্ন শাখা বিশেষ করে চলচ্চিত্রও ভিন্ন পদ্ধতিতে ব্যবহার করা জরুরি ছিল। যে অল্পসংখ্যক চলচ্চিত্রে প্রথাবিরোধী চলচ্চিত্র-ভাষা ব্যবহার এবং রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদানের চেষ্টা করা হয়েছে, সেখানেও প্রায়ই সমকালীন সময় সরাসরি তুলে ধরা হয়নি। সেখানে রাজনৈতিক সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছে পরোক্ষভাবে, অতীতের কোনো সময় তুলে ধরার মধ্য দিয়ে। যেমন, স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের সমালোচনা করলেও আলমগীর কবিরের 'রূপালী সৈকতে' (১৯৭৯) ছবিটিতে কাহিনির সময়কাল ষাটের দশকের পূর্ব পাকিস্তান, ১৯৭০এর বাংলাদেশ নয়। মসিহ্উদ্দিন শাকের আর শেখ নিয়ামত আলীর 'সূর্যদীঘল বাড়ি' (১৯৮০) ছবির কাহিনির পটভূমি ভারতভাগের ঠিক আগে পূর্ব বাংলার এক গ্রামের জীবনযাত্রা।

ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের প্রবণতাটির স্পষ্ট সমালোচনা উঠে এসেছে 'মাটির ময়না' ছবিতে। এটি যখন নির্মিত হয় তখন এই সমালোচনা প্রাসঙ্গিক হলেও ছবির কাহিনিতে দেখানো হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার ঠিক আগে পূর্ব পাকিস্তানের গ্রাম ও মফস্বল শহরের পরিবেশ।

ষাটের দশকে চলচ্চিত্রে পশ্চিমবঙ্গের অস্থির রাজনৈতিক পরিবেশ তুলে না ধরার জন্য সমালোচিত হয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। ওই দশকে 'কাঞ্চনজঙ্ঘা' (১৯৬২), 'মহানগর' (১৯৬৩), 'চারুলতা' (১৯৬৪), 'গুপী গাইন বাঘা বাইন' (১৯৬৮), 'অরণ্যের দিনরাত্রি' (১৯৬৯) প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ ছবি তিনি নির্মাণ করলেও, সমালোচকরা এই গুণী পরিচালকের ছবিতে কলকাতার তখনকার পরিবেশের উপস্থাপন দেখতে চেয়েছিলেন। সেই সময় পশ্চিম বাংলায় নিয়মিত বিক্ষোভ এবং অশান্ত পরিস্থিতির প্রতি সত্যজিৎ রায়ের উদাসীনতা নির্দেশ করে চলচ্চিত্র সমালোচক চিদানন্দ দাশগুপ্ত লিখেছিলেন, কলকাতার রাস্তায় জ্বলতে থাকা ট্রামের দৃশ্য সত্যজিতের ছবিতে সব সময় অনুপস্থিত।

সমালোচকদের জবাব দেওয়ার জন্যই হয়তো সত্তরের দশকের শুরুতে সত্যজিৎ তাঁর কলকাতা বা রাজনৈতিক ত্রয়ীর ছবিসমূহে মুখোমুখি হয়েছিলেন কলকাতার পরিস্থিতির। একই সময়ে মৃণাল সেনও তৈরি করেন তাঁর কলকাতা ত্রয়ীর ছবিসমূহ যেখানে নগরীর বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতি সরাসরি তুলে ধরা হয়।

শিল্পকলার যে কোনো শাখায় উপস্থাপিত রাজনৈতিক বক্তব্য দর্শকের চিন্তা প্রখর করে তোলে; আর এই প্রখরতা সৃষ্টি করে আত্মবিশ্লেষণের আগ্রহ। সমস্যাসঙ্কুল সময়ে বিদ্যমান ব্যবস্থা মানুষের যে নির্বিকারত্ব টিকিয়ে রাখতে চায়, রাজনৈতিক উপন্যাস বা কবিতার মতো একটি রাজনৈতিক চলচ্চিত্রের সমাজ-বিশ্লেষণ এবং উপস্থাপিত প্রশ্ন মানুষের সেই নির্বিকারত্ব বা স্বস্তিতে আঘাত করে। এমন আঘাতের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় যে অপরাধবোধ বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার প্রবণতা সেই মানসিক অনুভূতি অবশ্যই বৈপ্লবিক।

কেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে সমসাময়িক জরুরি ও গুরুতর সমস্যাগুলির মুখোমুখি হওয়ার প্রচেষ্টা খুব কম চোখে পড়ে সেই প্রশ্ন বিশ্লেষণ করা দরকার। স্বাধীন বাংলাদেশেও দ্রুতই পুরনো পাকিস্তানি ব্যবস্থার মতো ফিরে এসেছিল সামরিক শাসন। পরবর্তীতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলেও সমাজে বিভিন্ন পুরনো সমস্যা টিকে থাকা নির্দেশ করে, নতুন সমাজেও মানুষের চিন্তার মুক্তি পরিপূর্ণভাবে ঘটেনি। রাজনৈতিক ও সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা তাই উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।

সমকালীন পরিস্থিতির বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা এবং মানুষকে পীড়িত করছে এমন সমস্যার যৌক্তিক সমালোচনা চলচ্চিত্রে প্রকাশের চেষ্টায় সমর্থন দেবার পরিবেশ তৈরি না হলে সমাজ-সচেতন, বক্তব্যধর্মী চলচ্চিত্র তৈরি হবে না। সেন্সরের কারণে রাজনৈতিক বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া এবং সমকালীন সমস্যার সমালোচনা সম্ভব নয় এমন আশঙ্কা চিন্তাশীল ছবি নির্মাণে আগ্রহী চলচ্চিত্রকারদের কাজ বাধাগ্রস্ত করবে। রাজনীতিমনস্ক পরিচালকদের প্রতিবাদী ছবি তৈরির সুযোগ দেওয়া প্রসঙ্গে আবারও উল্লেখ করা যায় পশ্চিম বাংলার চলচ্চিত্রের কথা।

সত্তরের দশকের শুরুতে সেখানে বিদ্যমান সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে নকশালবাদী আন্দোলন চলার সময় মৃণাল সেন তাঁর কলকাতা ত্রয়ীর ছবিসমূহে সমাজ কাঠামোর তীব্র সমালোচনা তুলে ধরেছিলেন। নকশালপন্থী তরুণদের নির্বিচারে হত্যার প্রতিবাদও তিনি চলচ্চিত্রে প্রকাশ করেছিলেন। তখন নকশালপন্থী আন্দোলন কঠোরভাবে দমন করা হলেও মৃণাল সেনের রাজনৈতিক চলচ্চিত্রসমূহের সেন্সর ছাড়পত্র পেতে সমস্যা হয়নি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একজন সচেতন চলচ্চিত্রকার যৌক্তিকভাবে বক্তব্য ও প্রতিবাদ প্রকাশের সুযোগ পাবেন সেটাই স্বাভাবিক।

আমাদের দেশে চলচ্চিত্রকারদের জন্য এমন সুযোগ কি গত চার দশকে নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে? চিন্তাশীল চলচ্চিত্র প্রয়োজনীয় বিবেচনা করে এই ধরনের ছবির প্রসারের জন্য চলচ্চিত্রকারদের কতটা উৎসাহিতই-বা করা হয়েছে? উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে এ ধরনের ছবি আমাদের দেশে হয়তো নিয়মিত নির্মিত হত। এমন ছবি নির্মাণের অনুকূল পরিবেশ যদি না পাওয়া যায় সে ক্ষেত্রে কীভাবে রাজনৈতিক বক্তব্য চলচ্চিত্রে উপস্থাপন করা যায়, রূপকধর্মী 'জীবন থেকে নেয়া' নির্মাণের মধ্য দিয়ে জহির রায়হান বহু বছর আগেই তা স্পষ্ট করেছেন। সেই উদাহরণ বর্তমান সময়ের রাজনীতিমনস্ক পরিচালকদের অনুপ্রেরণা যোগাবে এমনটাই স্বাভাবিক। তবে এমন চলচ্চিত্র নির্মাণে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকারদের যথেষ্ট আগ্রহ থাকাও দরকার।

সামনের দিনগুলিতে নবীন চলচ্চিত্রকাররা তেমন ছবি নির্মাণে কতটা সচেষ্ট হবেন তার ওপরই এই ধরনের ছবির সাফল্য ও প্রসার নির্ভর করবে।

ড. নাদির জুনাইদ: সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।