মুক্তার মালা ও মোদিনীতি

জায়েদুল আহসান পিন্টু
Published : 20 June 2015, 06:27 AM
Updated : 20 June 2015, 06:27 AM

ঢাকায় মোদি, হামলা মিয়ানমারে, উত্তেজনা পাক-ভারত সীমান্তে, দুশ্চিন্তা চীনের, সংলাপের উদ্যোগ নিতে যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শ। এই হল সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের পরবর্তী ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। শেষ পর্যন্ত মুক্তার মালা গলায় দিয়ে ফেরত গেলেন মোদি।

ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এই সফর নিয়ে শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় নয়, আলোচনা চলছে বিশ্বজুড়ে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশারদরা বিশ্লেষণ করছেন নানা দৃষ্টিকোণ থেকে। মোদি যে কথা বলেছেন, যে উদ্দেশ্যে এসেছেন, যে ধরনের বার্তা দিয়েছেন, তাতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রকেও ভাবতে হচ্ছে।

ঢাকায় বসেই মোদি এক ঢিলে তিন পাখি মেরে গেছেন। প্রথমে পাকিস্তানকে এক হাত নেন। মিয়ানমারে অভিযান চালিয়ে বার্তা পাঠান চীনের অন্দরমহলে। যুক্তরাষ্ট্রকেও বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন এই অঞ্চলে ভারতই সেরা– জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদের দাবিদার একমাত্র তারাই। মোদির সফরের আগে ভারতীয় বিশ্লেষকরা বলেছিলেন, এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব কমাতেই মোদি ঢাকা সফর করছেন। ঢাকায় বসে মিয়ানমারের ভেতরে অভিযান চালানোর অনুমতি দিয়ে মোদি চীনকে বার্তা দিয়েছেন, 'তোমরা জঙ্গিদের আর রসদ জুগিও না, হাত গুঁড়িয়ে দিব।' দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ রয়েছে, ভারতের উত্তরাঞ্চলের রাজ্যগুলোর জঙ্গি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা চীনের সহায়তা পাচ্ছে। ভারতীয় গোয়েন্দাদের খবর হল, উলফার প্রধান পরেশ বড়ুয়া শেখ হাসিনা সরকারের তাড়া খেয়ে এখন চীনে অবস্থান করছেন।

ঢাকা ত্যাগ করার দুঘণ্টা আগে দেওয়া বক্তৃতায় মোদি পাকিস্তানকে সরাসরি আক্রমণ করেন। বলেন, পাকিস্তান সব সময় ভারতকে সমস্যায় রাখে আর জঙ্গিবাদে উৎসাহ যোগায়। অবশ্যই এটা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ। মোদি যে ভঙ্গিতে কথা বলেছেন তাতে পাকিস্তানের পিত্তি জ্বলে যাওয়ারই কথা। শুধু এখানেই থেমে থাকেননি তিনি, পাকিস্তানের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটাও দিয়েছেন। একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্যকে হাতে পেয়েও যে ভারত তাদের ছেড়ে দিয়েছিল সেই খোঁচা মারতে ভুলেননি তিনি। মূলত মোদির এই বক্তব্য ঘিরেই নতুন করে শুরু হয় পাক-ভারত উত্তেজনা। আর এই উত্তেজনা সরাসরি হুমকি হয়ে দাঁড়ায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর সীমানা অতিক্রম করে মিয়ানমারে অভিযান চালিয়ে জঙ্গিদমনের পরবর্তী প্রতিক্রিয়া প্রকাশের মধ্য দিয়ে।

মোদি ঢাকায় আসার আগের দিন ভারতের মনিপুর রাজ্যে জঙ্গিরা হামলা চালিয়ে ১৮ জন ভারতীয় সেনা সদস্যকে হত্যা করে। এর প্রতিশোধ নিতেই মিয়ানমারে হামলা চালায় ভারত। তাতে মিয়ানমারের সীমানার মধ্যে বেশ কজন জঙ্গি নিহত হয়েছে। এই অভিযান মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী হয়েছে। তাই একে বেআইনি বলা যাচ্ছে না। কিন্তু সেনা অভিযানের পর ভারতের মন্ত্রীরা যা বলছেন তাতে পাকিস্তানের চুপ মেরে বসে থাকার কারণ নেই। শুরু হয়ে যায় বাকযুদ্ধ। দুদেশের নেতারাই নিজ নিজ জনপ্রিয়তা বাড়াতে বা ধরে রাখতে রীতিমতো যুদ্ধের হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন।

ভারতের তথ্য ও সম্প্রচার বিষয়ক মন্ত্রী রাজ্যবর্ধন সিং রাথোরি প্রথমে মৌখিক আক্রমণটা করেন। সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, 'জঙ্গি হুমকি থাকলে ভারত যে কোনো দেশের যে কোনো স্থানে অভিযান চালাতে পারে।' তিনি পাকিস্তানকে ইঙ্গিত করে বলেন, 'পশ্চিম থেকে বিশৃঙ্খলা করা হলে তার সমুচিত জবাব দেওয়া হবে।'

পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিসার আলি খানও পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, পাকিস্তান মিয়ানমারের নয়। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যারা ষড়যন্ত্র করছে তাদের জানিয়ে দিতে চাই, এর জবাব দিতেও আমরা প্রস্তুত। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ গণমাধ্যমকে একই কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ভারত যদি পাকিস্তানকে শিক্ষা দেওয়ার কথা বলে তাহলে নয়াদিল্লিরও মনে করা উচিত যে, পাকিস্তানও ভারতকে যথাযথ শিক্ষা দেওয়ার সক্ষমতা রাখে।

জবাব দেন ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পরীকর। বলেন, 'ভারতের নতুন পদক্ষেপে যারা ভীত, তারাই সাড়াশব্দ করতে শুরু করেছে।' আর পরিবেশমন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকরের মন্তব্য, 'সব জঙ্গি গোষ্ঠীকে এটা বুঝিয়ে দেওয়া গেল যে, তাদের নিকেশ করার জন্য ভারত নিজের সীমান্ত পার হয়ে আঘাত হানতে দ্বিধা করবে না।'

এই বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন খোদ পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ। মিয়ানমারের মতো তাদের দেশে ঢুকে ভারত যেন এমনটা করতে না যায় তা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, দেশের স্বার্থ লঙ্ঘিত হলে আমরা পাল্টা আক্রমণ করবই। সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশারফ এক ধাপ এগিয়ে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি দিলেন। বললেন, 'শবে বরাতের জন্য পাকিস্তান পরমাণু বোমা বানায়নি৷ নিরাপত্তা ও আত্মরক্ষার খাতিরে বানিয়েছে৷' পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল রাহিল শরীফ বলেন, 'ভারতের রাজনীতিকরা যেন কুদৃষ্টিতে না তাকান। যে কোনো মূল্যে পাকিস্তান ভারতীয় নেতাদের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করবে এবং নিজের অখণ্ডতা রক্ষা করবে।'

এই হল পাক-ভারত বাকযুদ্ধের নমুনা। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? বছর খানেক আগে নির্বাচনে জয়লাভ করার পর সরকার গঠন করার আগেই মোদি শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে সার্কভুক্ত দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধানদের আমন্ত্রণ জানিয়ে এমন বার্তা দিয়েছিলেন যে, ভারত সার্কভুক্তদেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে একসঙ্গে চলতে চায়। কিন্তু মোদির পরবর্তী কার্যক্রম বলছে, তিনি কোনোভাবেই পাকিস্তানকে সঙ্গে নিয়ে এগুবেন না। এর আগে সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসেননি তিনি। গত বছর সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের সময় দুদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্ধারিত বৈঠক বাতিল করে দেন তিনি। এবার সরাসরি জঙ্গিবাদে উৎসাহ দেওয়ার আভিযোগ আনেন মোদি।

গত বছর মে মাসে মোদির শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ বলেছিলেন, তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদে নরেন্দ্র মোদির শপথ অনুষ্ঠানে শান্তির বারতা নিয়ে এসেছেন। এক বছরের মধ্যেই বোঝা গেল এই অঞ্ঝলে শান্তি প্রতিষ্ঠা এত সহজ নয়। বিশেষ করে পাক-ভারত উত্তেজনা সহসাই দমছে না।

পাকিস্তান যে বিশ্বব্যাপী জঙ্গি রফতানিকারক একটি দেশ হয়ে উঠেছে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রতিদিন ওই দেশটিতে জঙ্গিবাদ ছোবল হানছে। ওখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে দুনিয়ায়। বাংলাদেশেও এরা আস্তানা গাড়তে চায়। বেশ কজন পাকিস্তানি জঙ্গি এদেশে ধরাও পড়েছে। তাদের জবানবন্দি থেকেই জানা যায়, তারা এদেশের মাটি জঙ্গিবাদের জন্য বেছে নিতে চায়।

তাই ভারতের প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন, পাকিস্তান জঙ্গিবাদে উৎসাহ দিচ্ছে, তথ্যের দিক থেকে এটা ভুল নয়। কিন্তু এই সমস্যা থেকে উত্তরণে একযোগে কাজ না করলে সমস্যা বাড়বে বৈ কমবে না। কারণ দুটি দেশই সন্ত্রাসীদের হুমকির মুখে রয়েছে। সন্ত্রাস বা জঙ্গিবাদ মোকাবেলা তাদের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ। এ অবস্থায় পরস্পরকে অভিযুক্ত না করে একযোগে কাজ না করলে নিকট ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। কারণ আইএসএর মতো জঙ্গি গোষ্ঠী ও আল কায়েদা এই অঞ্চলও হুমকির মধ্যে রেখেছে।

২০০৮ সালে মুম্বাইয়ের হোটেলে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা বলে দিয়েছে, ভারতের নিরাপত্তা পাকিস্তানের দিক থেকে যতটা না হুমকির মুখে তার চাইতে বেশি রয়েছে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর পক্ষ থেকে। জঙ্গিরা দুদেশের বৈরী সম্পর্ক কাজে লাগাচ্ছে। তাই সন্ত্রাসবাদ দমনে দুদেশের একযোগেই কাজ করে যেতে হবে। যে কথা মোদি ঢাকায় বলে গেছেন– সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গি মোকাবেলা কীভাবে হবে তা কিন্তু আমরা বুঝতে পারছি না। কোনো রাস্তা পাওয়া যাচ্ছে না। জাতিসংঘও কোনো পথ দেখাতে পারছে না। মোদি বলেছেন, সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে আপস নয়। সন্ত্রাসবাদের কোনো সীমা নেই, অঞ্চল নেই। ভারত গত চল্লিশ বছর ধরে এ জন্য সমস্যায় রয়েছে। যারা মানবতাবাদে বিশ্বাস করেন, সে সমস্ত দেশের একেজোট হওয়া খুব প্রয়োজন। আমরা জঙ্গিবাদ শেষ করে দেব।

কিন্তু মোদিনীতি সে কথা বলছে না। সব দেশ একজোট হওয়া দরকার বললেও সেটা পাকিস্তানকে বাদ দিয়েই করতে চাচ্ছে ভারত। মিয়ানমারে অপারেশনের মাধ্যমে পাকিস্তানকে সে কঠিন বার্তাই দিয়েছে তারা। বুঝিয়ে দিয়েছে, পাক সীমান্তে জঙ্গিবাদ সন্ত্রাসীদের রুখতে সীমান্ত পেরুলেও ভারতীয় সেনারা পিছপা হবে না। মিয়ানমারে ভারতের এই অভিযান যতটা না সামরিক তার বেশি রাজনৈতিক। নয়তো জঙ্গিদমনে একটা সামরিক অভিযান ঘিরে ভারতের মন্ত্রীরা এত হুঙ্কার দিয়ে কথা বলতেন না।

এ প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য দেশ দুটির প্রতি বিশেষ উদ্যোগ ও সংলাপের আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র জেফ রাতকে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তারা উত্তেজনা কমাতে ভারত-পাকিস্তানকে সংলাপের উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। এই সংলাপে পাকিস্তান রাজি হলেও মোদির ভারত যে হবে না এটা তাঁর আচরণই বলে দিচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে এর নেতিবাচক প্রভাবও হয়তো আমাদের দেখতে হবে।

বাংলাদেশে সফরে এসে পাকিস্তানকে হুমকি, তাদের পুরানো ক্ষত জাগিয়ে দেওয়া এবং মিয়ানমারে অভিযান চালিয়ে শুধু পাকিস্তানকেই বার্তা দেননি মোদি– চীনকেও দিয়েছেন। কারণ দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তানের মিত্র চীনের অর্থনৈতিক আধিপত্য ঠেকাতে পারছে না ভারত। বাংলাদেশ যত অস্ত্র কেনে তার প্রায় পুরোটাই চীন থেকে আমদানি করা। এছাড়া নানা অবকাঠামোগত সহায়তা তো দিচ্ছেই চীন। শুধু বাংলাদেশ নয়, নেপালে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, মালদ্বীপে আবাসন প্রকল্প ও পাকিস্তানে ইকোনমিক করিডোর গড়ে দিচ্ছে চীন। কম খরচে নানা প্রকল্প করে দেওয়ায় চীনের প্রতি নির্ভরতা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বাড়ছেই।

এ নিয়ে ভারত উদ্বিগ্ন আগে থেকেই। এটা তারা লুকিয়ে রাখে না। কংগ্রেসের আমলে সংসদেও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, বাংলাদেশসহ ভারতের প্রতিবেশি দেশগুলোতে চীন যে সব অবকাঠামো প্রকল্প তৈরি করছে, তার দিকে ভারত সতর্ক নজর রাখছে এবং এগুলো ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকি কি না, সেটাও নিয়মিত খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এর মধ্যে পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের অর্থনৈতিক করিডোর স্থাপনে সহযোগিতা চুক্তি ভারতের জন্য দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নরেন্দ্র মোদি নিজে চীন সফরে গিয়ে ওই করিডোর নিয়ে আপত্তি ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। চীন মোদির কথা শুনেনি। শ্রীলঙ্কা আর নেপালেও চীন প্রভাব বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে।

মোদির ঢাকা সফরের আগ মুহূর্তে ঢাকা সফর করে গেছেন চীনের একজন মন্ত্রী। ১৫ জুন রাতেও তিন দিনের সফরে এসেছে আরেকটি প্রতিনিধিদল। এরই মধ্যে তারা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এসব বৈঠকে যে মোদির ঢাকা সফর নিয়ে কথা হয়েছে তা পরিষ্কার। আওয়ামী লীগের সঙ্গে বৈঠক শেষে চীনের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশ-ভারত সুসম্পর্ক বজায় থাকলে গোটা অঞ্চলই লাভবান হবে। তার এ প্রতিক্রিয়ায় বোঝা যায়, মোদির সঙ্গে শেখ হাসিনার চুক্তি এবং পরবতী কার্যক্রম খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ এ মুহূর্তে ভারতের সবচেয়ে বিশ্বস্ত মিত্র। এই জায়গায় চীনও ধীরে ধীরে স্থান করে নিতে চাইবে। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর উন্নয়নের কাজ করেছে চীন। বঙ্গোপসাগরে কক্সবাজার উপকূলে সোনাদিয়া সমুদ্রবন্দর নির্মাণের ঠিকাদারিও চাইছে চীনা কোম্পানি। ভারতের আদানি গ্রুপও প্রকল্পের কাজ চাইছে। বাংলাদেশের সঙ্গে চীন তাদের সম্পর্ক কোথায় নিয়ে যায় তার ওপর রয়েছে ভারতেরও তীক্ষ্ণ নজর। রয়েছে উদ্বেগও। আবার চীনও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে নজর রাখছে।

এদিকে চীনের সহায়তায় নির্মিত গোয়াদর বন্দরের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পাকিস্তান চল্লিশ বছরের জন্য চীনের হাতে ছেড়ে দিয়েছে,যার মানে এই বন্দরের মাধ্যমে চীন আরব সাগরে ঢোকার সুযোগ পাচ্ছে। চীনের সহায়তায় শ্রীলঙ্কায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পর পাকিস্তানের এই গভীর সমুদ্রবন্দর এশিয়ার সমুদ্র অঞ্চলে চীনের আধিপত্য আরও শক্তিশালী করছে। পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের বন্দর উন্নয়ন করে ভারত মহাসাগর জুড়ে চীন যে 'স্ট্রিং অব পার্লস' বা মুক্তার মালা তৈরি করছে, সেটা নিয়েও গত দশ বছর ধরে দুশ্চিন্তায় ভারত।

চীনের ভূখণ্ড থেকে পোর্ট সুদান পর্যন্ত বিস্তৃত সমুদ্রপথে চীনের সামরিক ও বাণিজ্যিক স্থাপনা গড়ে তোলার পরিকল্পনাটি 'স্ট্রিং অব পার্লস' বা মুক্তোর মালা নামে ডাকা হয়। আর চট্রগ্রাম বন্দর হল এই মালারই একটা মুক্তা। স্যাটেলাইটের ছবি বা 'বার্ডস আই ভিউ' দিয়ে দেখলে পোর্ট সুদান হতে শুরু করে হংকং পর্যন্ত ঘাঁটিগুলো মুক্তার মালার মতোই দেখা যায়। সমুদ্রে চীনা প্রভাব বিস্তারের পাশাপাশি ভারতকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলাও এই কৌশলের লক্ষ্য। ভারত মনে করে আসছে, চীন চট্রগ্রাম বন্দরটি নিজেদের কৌশলগত উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য ব্যবহার করতে পারে। চীন যখন থেকে কক্সবাজারের সোনাদিয়া দ্বীপে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করতে চাইছে তখন থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে চীনের প্রবেশাধিকার নিয়ে শঙ্কায় পড়ে যায় ভারত। এবার চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরে প্রবেশাধিকার পাওয়ার মধ্য দিয়ে চীনের 'স্ট্রিং অব পার্লস'-এ ভারতের প্রবেশাধিকারও সম্ভব হচ্ছে।

এবার বাংলাদেশ চট্রগ্রাম বন্দর ব্যবহারের সুযোগ দিয়ে ভারতের সেই দুশ্চিন্তা অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে। তাই এটা বলাই যায়, মোদি মুক্তার মালা গলায় দিয়েই ঢাকা থেকে নিজ দেশে ফেরত গেলেন। বাংলাদেশ মুক্তার বিনিময়ে হিরা, সোনা, রুপা না তামার মালা পেল সেই বিশ্লেষণ আরেক দিন করা যাবে।

জায়েদুল আহসান পিণ্টু: প্রধান বার্তা সম্পাদক, দেশ টিভি।