জামায়াত নিষিদ্ধকরণ ও মৃত সাপের পুরনো গল্প

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 18 June 2015, 12:58 PM
Updated : 18 June 2015, 12:58 PM

যারা মনে করেন, জামায়াত নিষিদ্ধ করলেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে অসাম্প্রদায়িকতা নিজ থেকে বলবৎ হতে শুরু করবে, তারা ভুল ভাবছেন। যে সময় তাদের বিস্তার ও সংগঠনের কার্যক্রম ডানা মেলছিল, আমরা তখন যৌবনে। আমাদের সঙ্গে মুখোমুখি হতে থাকা জামায়াতের ছাত্র শিবির বা তাদের যুবশক্তির মোকবেলা করতে গিয়ে জেনেছি, তারা 'নরম' কিছু নয়। তাছাড়া একটা সত্য তো মানতেই হবে যে, মুক্তিযুদ্ধের ধারা ও তার চেতনা এরা যতটা নষ্ট করেছে তার ঢের বেশি করেছি আমরা, নিজেদের হাতে। স্বাধীন দেশে জিয়ার মতো একজন জেনারেল, যিনি মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার হয়েও বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বেনিফিসিয়ারি, এটা কি আমরা কখনও ভেবেছিলাম? মোশতাকের কথা এড়িয়ে গেলে চলবে? কর্নেল ওসমানী বা ব্যর্থ সেনানায়ক শফিউল্লাহর ভূমিকা মনে আছে? কেউ কোনো দায় নেননি সেদিন। এটা নিশ্চিত যে, জিয়ার গদিলাভ আর বাংলাদেশকে ধীরে ধীরে পাকিকরণের কাজটির পেছনে ছিল দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। আজ যারা আওয়ামী লীগের মিনিস্টার, তাদের মধ্যে সেই সব বামদের কী ভূমিকা ছিল সেদিন? মেজর জলিল, রব, সিরাজরা কি ধোয়া তুলসী পাতা?

বড় বিপদ আমাদের। সত্যও বলা যায় না। কেন এক সময় বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে যৌবনের দূতরা জাসদে মজেছিলেন এখনও তারা সেটি নিয়ে সমালোচনা শুনতে নারাজ। এই তো সেদিন, সিডনির এক ঘরোয়া সভায় জাসদবিরোধী আলোচনা চলতে চলতে মারমুখো হবে ওঠা কিছু বয়স্ক মানুষের আচরণে মনে হয়েছে, এদেশের পটপরিবর্তনে তাদের ভূমিকা ছিল সঠিক। হতেও পারে। না হলে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর ঢাকার রাস্তায় বেরিয়ে আসা 'অন-অথারাইজড' ট্যাংকের ডগায় উঠে নাচতে থাকা মানুষ কেন থাকবেন আওয়ামী লীগের গুডবুকে? কেন তাদের মুখে শুনতে হবে বিএনপি-বিরোধিতা বা জাতীয় ইতিহাস মূল্যায়নের নামে নতুন যত কাহিনি?

বলছিলাম জামায়াতের কথা। ওরা অনেক হঁশিয়ার আর সংগঠিত দল। এর কারণ না বোঝার মানে নেই। আজ ভারতে বিজেপির যে প্রতাপ বা প্রভাব সেটা কি প্রমাণ করে না যে, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির মরণ হয়নি? যে দেশ নেহেরু-গাঁধীর, যে দেশে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত, সেখানেও বিজেপি আছে পরমানন্দে।

আমাদের দেশে জামায়াত থাকবে কি থাকবে না এই প্রশ্ন সে দৃষ্টিকোণ থেকে অযৌক্তিক বা অন্য কিছু হলেও এখন তা মাঠে এসেছে। শুধু মাঠ নয়, আলোচনার টেবিল পেরিয়ে সংসদেও জায়গা করে নিয়েছে। বিজেপির সঙ্গে জামায়াতের মৌলিক তফাৎ দেখুন। বিজেপির রাজনীতি ঘোরতর গাঁধীবিরোধী। বাপুজীর আদর্শ আর অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিরুদ্ধে কড়া অবস্থানে থাকা বিজেপি কিন্তু সরকার পরিচালনায় নমনীয়। তখন তাদের সামনে কোনো ব্যক্তির ইমেজ বা আদর্শের চেয়ে বড় রাজনীতি। সে কারণে আমরা মোদিকে দেখি মহাত্মার মূর্তির সামনে করজোড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। হিমালয় থেকে কন্যাকুমারিকা, এই বিশাল প্রান্তের জনগণের নেতা হতে হলে যে ধৈর্য আর মেনে নেওয়ার গুণ ধাকতে হয়ে সেটা তারা জানেন এবং মানেন।

অন্যদিকে জামায়াত এখন অব্দি বাংলাদেশের অস্তিত্ব, পতাকা, সঙ্গীত আর জাতির জনকের মতো মৌল বিষয়ে একরোখা ও বিরোধী অবস্থানে। এটা যে তাদের তাদের রাজনীতির জন্য কত বড় ভুল ছিল, মাশুল দিয়েও তা বুঝতে না পারার কারণেই জামায়াত আজ দাঁড়িয়ে আছে নিষিদ্ধ হবার মতো কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি।

এটা জানি এবং ভুক্তভোগী হিসেবে বলতে পারি যে, তারা প্রতিক্রিয়াশীলতার পতাকা বহনকারী। যাবতীয় শুভবোধ, সংস্কৃতি আর আচরণের ব্যাপারে তাদের একটা বিগ 'নো নো' মনোভাব কাজ করে। পথ ঠিক করতে না পারলে তাদের অস্তিত্ব আপনা থেকেই ছোট হয়ে আসবে। যেটা হয়েও আসছে। তারা ভেবেছিল, এদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অসম্ভব, শাস্তি দেওয়া তো নয়ই। তাদের ধারণা ছিল, অর্থ লবিং আর বিএনপির বদৌলতে বদলে যাওয়া দেশ ও সমাজে মানুষ একাত্তর ভুলে গিয়েছে। সেগুলো এখন নিছক ইতিহাস বা কাগুজে বিষয়। কিন্তু যেটা তারা বুঝতে পারেনি তা হল, সময়ের একটা বিচার আছে। যে যত বড়মাপের পাওয়ারের কাছেপিঠে থাকুক না কেন, মহাকালের হাতে খেলার পুতুল মাত্র।

জামায়াতের সংগঠিত হবার সময়কাল থেকে এই গতকাল অব্দি জনগণের কাছে পৌঁছানোর বাহন বিএনপি। কারণ বিএনপি কথিত মুক্তিযুদ্ধের দল। জামায়াতের ভ্রান্ত বা কিছুকালের জন্য এফেক্টিভ ধারণায় হয়তো এটাই কাজ করেছিল যে, যতটা সম্ভব বিএনপির কাঁধে বন্দুক রেখে শিকার করতে করতেই নিজেদের আসল চেহারায় বেরিয়ে আসার সময় হবে। একটা পর্যায়ে সে ধরনের অবস্থাও প্রায় তৈরি হয়ে গিয়েছিল। জামায়াতের নেতারা মন্ত্রী হবার পাশাপাশি মিডিয়ার নেতৃত্বে আসার কারণে তাদের মনোবল চাঙ্গা হওয়া ছিল স্বাভাবিক।

পাঠক, এদেশে মুসলিম লীগ আছে কী নেই আমাদের তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই। কোথায় গেল নেজামে ইসলাম বা সে জাতীয় দলগুলো? সময়ের ভিড়ে তারা তাদের অস্তিত্ব হারিয়ে বিএনপিতে বিলীন হয়ে গেছে। জামায়াতের বেলায় তা হয়নি। এর বাহ্যিক ও ভেতরের দিকটা না বুঝে আদর্শের পতাকা উড়ালে চলবে?

এর মানে, জামায়াতের একটা স্বতন্ত্র আইডেনটিটি আছে। তাদের সমর্থক বা ফলোয়ারদের সংখ্যাও কম নয়। তবে তাদের বড় ভুল হচ্ছে, স্বাধীনতার অসম্মান ও মুক্তিযুদ্ধের বীরদের স্বীকার না করে দেশি-বিদেশি চক্রান্তে জড়িয়ে পড়া। পাকি কানেকশনেও প্রভূত লোকসান বয়ে বেড়াচ্ছে তারা। জামায়াত যদি বিজেপি বা এ জাতীয় দলের মতো বাংলাদেশের ধারা ও মূল আদর্শগুলো মেনে নিয়ে রাজনীতি করত তাদের এই দশা হবার কথা ছিল না।

যতদূর মনে পড়ে, ক্ষমতায় থাকার সময় বা সুসময়ে নিজামী একবার মন্তব্য করেছিলেন, বঙ্গবন্ধু হচ্ছেন এ দেশের স্থপতি। এ জাতীয় কোনো কথা আমরা বিএনপির মুখ থেকে কখনও শুনিনি। তাছাড়া, আমাকে ভুল বুঝলেও এটা বলতেই হবে যে, জামায়াতের নেতারা যত ফতোয়া দিয়েছেন বা সামাজিক সমস্যা নিয়ে পানি ঘোলা করেছেন তার চেয়ে অনেক বেশি প্রগলভ হুজুর নামের ধর্মীয় নেতারা। এরা কেউ জামায়াতের রাজনীতি করেন না। কিন্তু এরা সামাজিক প্রগতি ও নারীস্বাধীনতার ঘোর বিরোধী।

এ জায়গাটায় জামায়াতের নিরবতাও খেয়াল করার মতো। তারপরও সবচেয়ে বেশি যে দিকটা তাদের প্রশ্ন ও হুমকির মুখে ফেলেছে তা হল, মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের বয়সী নেতাদের ভূমিকা ও বিচারপর্বের পর আগ্রাসী মনোভাব। সে জায়গায় তারা কিন্তু বিএনপির সমর্থন সেভাবে পায়নি। দোদুল্যমান সুবিধাবাদী বিএনপি নেতারা বিচার নিয়ে উচ্চকণ্ঠ নন। এমনকি ফাঁসি হয়ে যাবার পরও তারা জামায়াতের পক্ষে ভূমিকা রাখেননি।

সব মিলিয়ে বিএনপি ও জামায়াতের সন্ধি এখন এক সন্ধিসময়ে। আদর্শ যাই হোক, জামায়াতের নিষ্ঠা ও ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতির ফায়দা লোটা বিএনপি সময় হলেই তাদের ছুঁড়ে ফেলেছে। এখন তাদের নিষিদ্ধ করার ভাবনা চলছে। তখন যে পথ খোলা থাকে তা হল, আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাওয়া। জামায়াতকে যারা চেনেন তারা স্বীকার করবেন, তারা বিলুপ্ত হবার মতো দল নয়। তাদের নেটওয়ার্ক আর লবি ভেতরে ভেতরে কাজ করবেই। আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেলে তাদের হিংসাত্মক কার্যকলাপ আরও বাড়বে। সরকারে যারাই থাকুক না কেন, তাদের কাজের ভাণ্ডারে যোগ হবে নতুন ঝামেলা।

এমনিতেই আমাদের দেশে সমস্যার অন্ত নাই। নানা চেহারায় জঙ্গিবাদও সব সময় সক্রিয়। যাতে আছে অনেক দেশের ইন্ধন ও যোগাযোগ। এ কারণে বহু দেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কও অম্লমধুর। জামায়াত নিষিদ্ধ করার বিষয়টি তাই একদিকে যেমন প্রায় অনিবার্য, তেমনি ভাবনারও বটে। সরকার বা প্রশাসনের জন্য একটি জ্বলন্ত 'মাথাব্যথা' তৈরি করে আমরা কাগজকলমের আনন্দে আসলে কি উদ্ধার পাব?

জামায়াতের তাদের জবাব দিতে হবে এদেশের নারীদের বেলায় তাদের আসল ভূমিকা কী। এরপর আসবে মুক্তিযুদ্ধের ইমেজ বা প্রতীকগুলোর প্রতি আস্থা ও সম্মানের কথা। বিএনপিকে ছেড়ে নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর রাজনীতি আর পরিষ্কার ভূমিকা প্রকাশের ভেতর দিয়ে জামায়াতকে জবাবদিহিতার পথে আসতে হবে। বিএনপির কাঁধে এক সময় তারা সওয়ার হলেও এখন বিএনপিই তাদের কাঁধের ভূত। আধুনিকতা আর সময়ের সঙ্গে চলে বিজেপির মতো দলগুলো অস্তিত্ব বাঁচিয়ে এখন শক্ত অবস্থানে আছে। জামায়াতের সামনে এমন নমুনা থাকার পরও তারা ধ্বংস ও সর্বনাশের রাজনীতি বেছে নিয়েছে।

যারা ভাবছেন আমি জামায়াতের সাফাই গাইছি বা তাদের পথ বাতলে দিচ্ছি তা কিন্তু নয়। আমি বলতে চাইছি, এ কাজগুলো করতে পারলে তারা এদেশে রাজনীতি করে হয়তো টিকে থাকতে পারত। কিন্তু সে সম্ভাবনার পথ চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে বিগত এক বছরে তাদের বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডে। গোড়া থেকেই তারা এ জাতির হৃৎস্পন্দন বুঝতে ব্যর্থ। না পেরেছে ইতিহাসের সঙ্গে চলতে, না পেরেছে যুব ও নাগরিক সমাজকে পথ দেখাতে। উল্টো তারা যে ভয়ানক রাজনীতির পথে হাঁটছে, তার সঙ্গে আন্তর্জাতিক সহিংসতার যোগটাও ফেলনা নয়।

তাদের রাজনীতির বর্তমান ধারা দেখলে একটি গল্প মনে পড়ে। সাপ আর ব্যাঙে ছিল দারুণ বন্ধুত্ব। ব্যাঙ সব সময় সাপকে বলত: ''বন্ধু, তোর আঁকাবাঁকা চলার স্বভাব বদলা। এই যে দিনরাত বিষ বয়ে ফোঁস ফোঁস করে বেড়াস, একদিন এ জন্যে তোর জান যাবে।''

সাপ মানতেই চায় না। বলে: ''আমি কি তোর মতো? আমার বিষের ভয়েই সবাই আমকে সমীহ করে।''

এরপর একদিন ব্যাঙ ফিরছিল আত্মীয়বাড়ি থেকে। সপ্তাহ খানেক বন্ধুর সঙ্গে দেখা নেই। গিয়ে দেখে সাপ সোজা হয়ে শুয়ে আছে। দেখে খুব খুশি হয়ে বলল: ''এই তো বন্ধু, কথা শুনলে। এখন দেখি একেবারে সোজা।''

বন্ধুর কোনো সাড়া নেই। কাছে গিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে, সাপ মরে পড়ে আছে। তখন ব্যাঙ কাঁদতে কাঁদতে বলল: ''সোজা হলি তো হলি, তাও মরার পর। জীবনে আর সোজা হতে পারলি না।''

জামায়াতের পথও যেন তাই। এদেশে নিষিদ্ধ হবার বা মরার আগে তাদের জন্য আর কোনো পথ খোলা আছে কি?

সিডনি; ১৬ জুন, ২০১৫