বাঙালি মুসলিম বনাম মুসলিম বাঙালি

বিজন সরকার
Published : 14 June 2015, 07:01 AM
Updated : 14 June 2015, 07:01 AM

বাংলাদেশ একটি ভয়ানক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। একটি গাঢ় অন্ধকারের আসন্ন আগমনের ভয়ে আমরা প্রায়ই শঙ্কিত হয়ে পড়ছি। দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির নানান সূচক বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা হওয়ার দিকে এগুলেও সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টিতে বড় ধরনের সমস্যা দেখা দিয়েছে। এ আশঙ্কার প্রভাব বিভিন্নভাবে সমাজে ছড়িয়ে পড়ছে। সামাজিক নিরাপত্তার খোঁজে দেশান্তরী মানুষের সংখ্যাও তাই ক্রমশ বাড়ছে।

সমসাময়িককালে পূর্বের যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীরা যে দেশ ছেড়ে আসছেন, তা ভালো করে আঁচ করা যাচ্ছে। বছর দুয়েক আগে কোরিয়াতে যে সংখ্যক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ছিলেন, বর্তমানে তার কয়েকগুণ বেশি। দুবছর আগে কোরিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এ লেখকসহ সব মিলিয়ে দশ জন থাকলেও বর্তমানে এ সংখ্যা চল্লিশ। উল্লেখ্য যে, বিভিন্ন স্কলারশিপ ও গবেষণা ফান্ডের পরিমাণ আগের মতোই রয়েছে। এই চিত্র বিশ্বের অন্যান্য দেশেও একই হবার সম্ভবনা। বিশেষ করে, বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত সাবজেক্টে যারা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করছেন, তাদের বেশিরভাগ বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষায়িত বিভাগের একটি ব্যাচে ত্রিশ জন শিক্ষার্থী ছিলেন। যদ্দুর জানি, তাদের ছাব্বিশ জনই বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। এদের একজনেরও দেশে ফেরার ইচ্ছা নেই। না ফেরার কারণ হিসেবে তারা আগে চাকরির অজুহাত দেখাতেন; এখন অগ্রাধিকারে চলে এসেছে নিরাপত্তা।

সামাজিক সন্ত্রাসের চরিত্রও পাল্টে গেছে। আগে বৈষয়িক বিষয় এবং দলীয় আদর্শগত কারণে সন্ত্রাস হত। এখন এর সঙ্গে আরেকটি সংবেদনশীল বিষয় যুক্ত হয়েছে। সেটি হল, বিশ্বাসের কারণে মানুষকে হত্যা করা। যেটি আগে তেমন একটা শোনা যায়নি।

বিশ্বাসের কারণে হত্যার বিষয়টি যতটা না, তার চেয়ে বেশি আতঙ্কের হল, এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে রাষ্ট্র, সমাজ, সরকার ও সর্বোপরি মানুষের মানবিক আচরণের নির্লিপ্ততার প্রবণতা। হত্যাকাণ্ডের পর সামাজিক প্রতিক্রিয়ার চরিত্রটি আমাদের অসহায় করে তুলছে। কোনোভাবেই লুকিয়ে রাখা যাচ্ছে না দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক কৌশলের নিউক্লিয়াস হিসেবে ধর্মের অপব্যবহারের ফল। তাই ধর্মের নামে রাজনীতি এখন দেশের মূল রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সামাজিক বাস্তবতার নিরিখে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে প্রগতিশীল মোর্চাকেও ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে হত্যার ঘটনায় কৌশলী হতে হচ্ছে। বলা যায়, নিরব ভূমিকা পালন করতে বাধ্য হচ্ছে তারা। হত্যার মতো পৈশাচিক ঘটনা ঘটার পরও মহাজোট সরকার স্পষ্ট অবস্থান নিতে দ্বিধান্বিত।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোতে আমূল পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। পরিবর্তিত এই কাঠামোতে নানান অস্বাভাবিক উপসর্গ ক্রমশ দৃশ্যমান হচ্ছে। কাঠামোগুলো বহুমাত্রিক; এর পজিটিভ নেগেটিভ উভয় দিক রয়েছে। প্রাসঙ্গিক সীমাবদ্ধতার কারণে এখানে পজিটিভ বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না।

অস্বাভাবিক পরিবর্তনটি আমাদের সমাজে সর্বব্যাপী। কারণ সমাজের পরিবর্তন নির্দিষ্ট কোনো পকেটে হয় না। পরিবর্তন যখনই সমাজে ছড়িয়ে পড়ে, তখনই নানান লক্ষণ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে প্রকাশ পায়। রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রশাসনসহ অন্যান্য অঙ্গে এই পরিবর্তনের প্রভাব তাৎপর্যপূর্ণভাবে পড়েছে কি না, তা বলার সময় এখনও আসেনি। তবে হাওয়া যে লেগেছে, তা অনুভব করা যায়। এমনকি সরকারি দলের মধ্যম সারির অনেক নেতার মধ্যেও উগ্রবাদী রাজনীতির সঙ্গে আপোস করে চলার ইচ্ছা ভালোভাবেই আঁচ করা যায়। উগ্রবাদের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার দৃঢ় অবস্থানের কারণে কেবল আওয়ামী লীগের ভিতর থেকে লক্ষণগুলি প্রকাশ পাচ্ছে না।

সমাজের মনস্তাত্ত্বিক কাঠামো পরিবর্তন করার উদ্দেশ্যে দুটি পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। একটি হচ্ছে 'টপ ডাউন' পদ্ধতি। রাষ্ট্রের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত পরিবর্তনের চেষ্টা। এখানে ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি মানুষের বিশ্বাস পুঁজি করে উগ্রবাদিতার আগ্রাসন বাড়ানোর চেষ্টা লক্ষ্যণীয়। এ ক্ষেত্রে আপনি সমাজের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি হলেও কিছু যায় আসে না। তাছাড়া বাংলাদেশের উগ্রবাদী রাজনীতির একটি বড় অর্থনৈতিক ভিত্তি রয়েছে। অপ্রদর্শিত অর্থের পাশাপাশি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে উপার্জিত অর্থ উগ্রবাদী রাজনীতিতে ব্যয় করা হচ্ছে। আবার বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্যাকেজের মাধ্যমেও উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডের জন্য খরিদ করা হচ্ছে সমাজের অনেক প্রভাবশালী মানুষের সমর্থন।

আরেকটি হচ্ছে 'বটম আপ' পদ্ধতি। মানে সমাজের তৃণমূল পর্যায় থেকে সাংস্কৃতিক বিবর্তনের মাধ্যমে আস্তে আস্তে উপরে উঠে আসা। সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসটি ধর্মীয় বিদ্বেষ ও উগ্রবাদে পরিবর্তিত হওয়ার ঘটনা ব্যাপক আকারে ঘটছে। এই উগ্রবাদিতা চরমবাদে রূপ নিচ্ছে। উল্লেখ্য, এশিয়ার সমাজের বহু দেশেই কথিত 'ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী চেতনা' বাজারজাতকরণের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ার রেকর্ড রয়েছে। সে সব ক্ষেত্রে 'বটম আপ' পদ্ধতিটি বেশি কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পরিবর্তিত সামাজিক অনুষঙ্গগুলির শেষ ঠিকানা যথার্থভাবে নির্ধারণ করা হয়তো দুরুহ। তবে প্রভাবগুলি অনুমানযোগ্য। গত তিন চার দশক ধরেই এ ধরনের পরিবর্তন এশিয়ার বহু দেশে ঘটেছে এবং তা চূড়ান্ত পর্যায়ে সামাজিক অস্থিরতা এবং অস্থিতিশীলতায় রূপ নিয়েছে। যে কটি দেশে এখনও ঘটেনি, বাংলাদেশ তার একটি। ২০১৩ সালে দেশের শাসনক্ষমতায় বিএনপি জোট আসতে ব্যর্থ হওয়ার ফলে সামাজিক অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। ক্ষীণ দৃষ্টিসম্পন্ন বিএনপির নেতৃত্বে বিশ দলীয় জোটের রাজনৈতিক ব্যর্থতায় প্রতিনিধিত্বশীলতার অভাব দেখা যায়। এটি সরাসরি ভূমিকা রাখছে সমাজের বিভিন্ন স্তরে উগ্রবাদ প্রসারণে।

৫ জানুয়ারির নির্বাচনের প্রভাবের ফলেই নেগেটিভ পরিবর্তনগুলি ঘটছে, বিষয়টি তা নয়। সাংবিধানিকভাবে বাধ্যতামূলক এই নির্বাচন সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের ক্ষেত্রে শক্তিশালী অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে মাত্র। এই সঙ্কটের উৎসমূল যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া। যার শুরুর মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ বড় ধরনের সামাজিক মেরুকরণে পড়ে যায়।

মেরুকরণ আগেও ছিল, তবে আজকের মতো এত স্পষ্টভাবে নয়। আগে নিরাপদ দূরত্ব থেকে কৌশলে রাজনীতিতে উগ্রবাদ ব্যবহার করা হত। এখন খোলামেলাভাবে করা হচ্ছে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিপক্ষে কথিত জাতীয়তাবাদিতার পরিবর্তে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি প্রমোট করা হচ্ছে। অসাম্প্রদায়িকতা বনাম কথিত জাতীয়তাবাদ প্যারামিটারটি দীর্ঘদিন রাজনীতিতে দুটি শিবির গঠনের ক্ষেত্রে প্রধান নিয়ামকের ভূমিকা নিয়েছিল। অদূর ভবিষ্যতে সাম্প্রদায়িক বনাম অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আদর্শিক প্যারামিটারটি প্রধান নিয়ামক হয়ে উঠবে; আর সেটি হবে দেশের জন্য অশুভ।

ক্ষমতার রাজনৈতিক হিসাবনিকাশের কারণেই দেশের জনগণ যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে বড় দুটি শিবিরে ভাগ হয়ে পড়ে। বাংলাদেশকে আগামী দুয়েক দশক এই মেরুকরণ-ভিত্তিক সংঘাত মেনে নিতে হবে। যুদ্ধাপরাধ ইস্যুটির কারণেই ধর্মের উছিলায় নানান নন-ইস্যু ইস্যু বানিয়ে তোলা সহজ। এভাবে সরকারকে অযৌক্তিক চাপে রাখা যাচ্ছে; জনগণকে অন্যায়ভাবে আতঙ্কিত করা হচ্ছে; ভোগ করা হচ্ছে সরকারপ্রদত্ত বিভিন্ন ব্যক্তিগত অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের সরকার সেই সকল চাপ হয়তো সফলভাবেই মোকাবেলা করে শ্বাস ফেলার জায়গা পেয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে কতটুকু পারবে, সেই বিষয়ে জনমনে প্রবল সংশয় রয়েছে। কারণ দিনশেষে এই দ্বিদলীয় মেরুকরণে অধিকাংশ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীগুলি প্রগতিশীল মোর্চার বিপক্ষে অবস্থান নিবে, সেটাই প্রত্যাশিত। তাই দ্বিধাহীনভাবে বলা যায়, একটি গাঢ় অন্ধকার আমাদের চোখের সামনে ভালোভাবেই হৃষ্টপুষ্ট হচ্ছে।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সমাজদর্শনে এই ধরনের অন্ধকার রাজনীতি প্রায়ই দেখা গেছে। সামরিক শাসকগণ ও পশ্চিমা পুঁজিবাদী মোড়লরা নিজেদের স্বার্থে সমাজের শিরায় শিরায় সন্নিবেশ করেছে অন্ধকারের রাজনীতি, নানান রূপে। নিরাপদ দূরত্ব থেকে কথিত জাতীয়তাবাদী চেতনার ব্যানারের বিএনপি দীর্ঘদিন অন্ধকারের রাজনীতি থেকে ক্যাশ করে আসছিল।

বর্তমানে বিএনপির ব্যর্থতার কারণেই ধর্মীয় রাজনৈতিক শক্তিগুলি হতাশ হয়ে পড়েছে। তারাও বুঝেছে, 'জাতীয়তাবাদী সুগার কোডেড পিল'টির কার্যকারিতা আগের মতো নেই। ফলে চেতনার জায়গাটি বিশ্বাসবান্ধব করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। কথিত জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক আদর্শের সঙ্গে যদি ধর্ম যোগ করা যায়, তবেই দেশে অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে মোকাবেলা করা যাবে। জাতীয়তাবাদের স্লোগান তুলে মানুষকে আর উজ্জীবিত করা যাচ্ছে না। তাই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে প্রগতিশীল মোর্চাকে ক্ষমতা থেকে হটানোও সম্ভব নয়। দরকার আরও বেগবান অস্ত্র।

সে উদ্দেশ্যেই আরেকটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনায় একটি আত্নঘাতী ইস্যুর সামাজিকীকরণ করা হচ্ছে। ইস্যুটি আমাদের সমষ্টিগত পরিচয় ঘিরে। মৌলিক একটি বিষয় আমাদের সামনে খুব চতুরতার সঙ্গে আনা হচ্ছে। বিষয়টি হল, 'বাঙালি মুসলিম বনাম মুসলিম বাঙালি'। আমাদের রাজনৈতিক পরিসরে পরিচয়-সংঘাত ইস্যুটি এখনও সরাসরি স্থান পায়নি; তবে এই ডিসকোর্স সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। তার বিভিন্ন সিগনেচার সমাজের নানাবিধ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হচ্ছে। আদর্শহীন জাতীয়তাবাদী চেতনার রাজনীতির ধারাবাহিক ব্যর্থতার ফলে প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক গোষ্ঠীর নির্ভরশীল হাতিয়ার হিসেবে পরিচয়-সংঘাতের বিষয়টি সামাজিক আচার-আচরণের মধ্য দিয়ে সামনে আনা হচ্ছে।

'বাঙালি মুসলিম বনাম মুসলিম বাঙালি' বিষয়টি আমাদের সামাজিক জীবনের প্রাত্যহিক মনোজগতে ফাঁসিকাষ্ঠের (scaffolding) ভূমিকা পালন করছে। যে সকল গোষ্ঠী ফাঁসিকাষ্ঠের ন্যায় বিষয়টি নিজেদের রাজনৈতিক সুবিধার্থে আমাদের চিন্তার প্রক্রিয়ায় সন্নিবেশ করছে, তারাই সুবিধাজনক সময়ে ও প্রেক্ষাপটে এই পরিচয়-সংঘাতের ইস্যুও সামাজিক ডিসকোর্স থেকে উধাও করে দিবে। হাজার হাজার বছরের জাতিসত্তার সঙ্গে ধর্মীয় পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষার যে সংঘাত, তাতে ক্ষমতায় পালাবদল হওয়ার বহু ইতিহাস এই আধুনিক বিশ্বেই রয়েছে। তবে সেই সকল পরিবর্তিত সমাজ ব্যবস্থার চিত্র যে কত অমানবিক, ভয়ানক এবং আধুনিক জীবনব্যবস্থার সাপেক্ষে কতটা পশ্চাদগামী, তা আমরা আফগানিস্তান, পাকিস্তান, মিশর, ইয়েমেন, সিরিয়া এমনকি ইরানসহ মধ্যপ্রাচ্যের বহু দেশেই পর্যবেক্ষণ করছি।

কয়েক বছর আগেও কেবল ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলি এই পরিচয়-সংঘাতের বিষয়টি মূলনীতি ধরে রাজনীতি করত। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে সে ডেমোগ্রাফিক চি্ত্রে পরিবর্তন বেশ দ্রুতই দৃশ্যমান হচ্ছে। আমাদের মনস্তত্ত্ব থেকে ধীরে ধীরে, তবে নিশ্চিতভাবে কয়েক হাজার বছরের বাঙালি জাতিসত্তার আলোকে পরিচিত হওয়ার ঐতিহ্য হটিয়ে হাজার বছরের ধর্মীয় পরিচয় স্থান দেওয়ার কাজটি ক্রমশ বেগবান হচ্ছে। আমরা বুঝে না বুঝে এই ফাঁদে পা দিচ্ছি। দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী, এমন অনেকেই প্রতিনিধিত্বশীল ভূমিকা পালনে ব্যর্থ অথবা বঞ্চিত হওয়ার ফলে জ্ঞাত কিংবা অজ্ঞাতসারে ক্রমশই 'বাঙালি মুসলিম বনাম মুসলিম বাঙালি' বিষয়টি সমাজের মূলনীতি হিসেবে মেনে নিচ্ছে।

'বাঙালি মুসলিম বনাব মুসলিম বাঙালি' বিষয়টির উপর আমাদের সমাজের প্রতিক্রিয়াও দ্বিখণ্ডিত। বিষয়টি বর্তমান অস্থির সমাজের দার্শনিক পথ নির্বাচনের ক্ষেত্রেও ভারসাম্যহীনভাবে ক্রিয়াশীল রয়েছে। আমাদের নিত্য মনোজগতের চিত্র প্রতি মুহূর্তে নিরবে সাংঘর্ষিক করে তুলছে। পরিস্কারভাবে বললে, আমাদের সামাজিক অনুষঙ্গে, প্রাত্যহিক জীবন ব্যবস্থায় এই দ্বন্দ্ব ব্যক্তিজীবনের বিভিন্ন সামাজিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া প্রবলভাবে প্রভাবিত করছে। হয়তো পরিচয়-সংঘাতের প্রভাবের আকৃতির পরিমাণ নির্ণয় করতে আমাদের গবেষণামূলক পরীক্ষা চালাতে হবে। তবে এটি অনুধাবনযোগ্য যে, আমরা বাঙালি মুসলিম হিসেবে পরিচিত হওয়ার চেয়ে মুসলিম বাঙালি হিসেবে পরিচিত হতে স্বাছন্দ্য অনুভব করতে শুরু করেছি।

এই পরিচয়ভিত্তিক সংঘাতটি হঠাৎ করেই আসেনি। এটি কেবল রাজনৈতিক কারণেই আমাদের মননে নির্মাণ করা হয়েছে। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার পর উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারাবাহিকতায় এই বিভেদ আস্তে আস্তে আমাদের সমাজের গভীরে সন্নিবেশ করা হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের উপর চালানো সকল অন্যায় জায়েজ করা ও একে বৈধতা দেওয়ার লক্ষ্যে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে ধর্ম। এ কাজ বেলুচিস্তানেও করছে এখন ওরা।

আমরা পাকিস্তানিদের কাছ থেকে মুক্ত, তবে তাদের উত্তরসূরী ধর্মীয় ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে নয়। স্বাধীনতার পর থেকেই এই ধর্মীয় ফেরিওয়ালারা কথিত জাতীয়তাবাদী স্লোগানের পিছনে একাত্মতা ঘোষণা করে আসছে। বিএনপির নেতৃত্বে কথিত জাতীয়তাবাদী চেতনা পণ্যটির বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়ার ত্রুটির ফলে শিবিরভুক্তরা হতাশ। বিএনপির ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতার কারণেই নতুন মোড়কে মুসলিম লীগের রাজনীতির আবারও রূপদানের চেষ্টা চলছে। কারণ ডানপন্থায় বিশ্বাসী রাজনীতির কাছে বিকল্প নেই।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানকে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত না করার জন্য তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি 'পাকিস্তান ন্যাশনাল লীগ' নামক একটি দল গঠন করার জন্য জোর প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন যাতে সেটিতে দলমত ও ধর্মবর্ণনির্বিশেষে সকলের জন্য প্রবেশ উন্মুক্ত থাকে। কিন্তু মুসলিম লীগের বাধার কারণে ব্যর্থ হন তিনি। উল্লেখ্য, ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা মুসলিম লীগের রাজনীতিতে নিষিদ্ধ ছিল।

ভবিষ্যতে ক্ষমতায় আরোহণের উদ্দেশ্যে যে প্রক্রিয়ায় উগ্রবাদী চেতনা ও ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে, সেটি কি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব বুঝতে পারছে না? উত্তর হল, বুঝতে পারছে। আরেকটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করা যায়, তাহলে কেন তারা সম্ভাব্য অন্ধকার মোকাবেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে না? এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর নেই। অনেকেই হয়তো বলবেন, দেশ থেকে সম্ভাব্য উগ্রবাদী রাজনীতি ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে হলে দরকার দেশের উন্নয়ন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের সরকার তাই করেছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেরও বিশ্বাস, মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হলেই মানুষ উগ্রবাদের দিকে যাবে না।

ধারণাটি একবারেই ভুল। মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটিয়ে ধর্মীয় উগ্রবাদ মোকাবেলা করার ধারণা ইতোমধ্যে ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে ধনী দেশগুলির নাগরিকই, অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের প্রশাসনও বিশ্বব্যাপী উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদের প্রসারে অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখছে। এমনকি বাংলাদেশেই সমাজের উচ্চ পর্যায়ের পরিবারের তরুণরা ধর্মীয় উগ্রবাদে বিশ্বাসী হয়ে উঠছে। জঙ্গিবাদের জন্য আগে কেবল ধর্মীয় স্কুলগুলিকে দায়ী করা হত। এখন মূলধারার শিক্ষা ব্যবস্থাতেই উগ্রবাদ ক্যান্সারটির প্রসার ঘটছে। ফলে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে উন্নয়নের চেষ্টা করে ধর্মীয় উগ্রবাদ মোকাবেলার স্লোগানটিতে সততার অভাব রয়েছে। দরকার একটি সমন্বিত সাংস্কৃতিক বিপ্লব।

দেশে যত বেশি উগ্রবাদ এবং ধর্মীয় বিদ্বেষ প্রসারিত হবে, ততই জামায়াতে ইসলামীর মতো দলগুলির রাজনীতির বাজার সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা পাবে। আপাতত বিএনপিকে আওয়ামী লীগের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী মনে হলেও অদূর ভবিষ্যতে জামায়াতে ইসলামীর মতো দলগুলির রাজনীতিই আওয়ামী লীগের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে। আজ যারা জামায়াত থেকে আওয়ামী লীগে যোগদান করছে, তারাও আওয়ামী লীগের ভিতরে জামায়াতের প্রতিনিধি হিসেবে আজীবন কাজ করে যাবে। জামায়াত কৌশলে এই কাজ করছে। আরেকটি পদ্ধতিও তারা বেশ দক্ষতার সঙ্গে করছে। সরকারের বিভিন্ন প্রশাসনিক বিভাগে ইসলামী ছাত্র শিবিরের নেতাকর্মী এবং সমর্থকদের চাকরি পাইয়ে দিচ্ছে।

এই পরিবর্তন অদূর ভবিষ্যতে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির জন্য বড় বাধা হয়ে আসবে। মনে রাখা দরকার, ধর্মের নামে যারা রাজনীতি করে তাদের আদর্শিক সংহতি গণতন্ত্রে বিশ্বাসীদের চেয়ে বহুগুণে বেশি থাকে। কোনো গোষ্ঠীর আদর্শিক সংহতি যখন প্রকট থাকে, তখন তারা সংখ্যায় কত সেই প্রশ্ন নিয়ে ভাবাও বোকামি। নাৎসি বাহিনীতে সকল জার্মান অংশগ্রহণ করেনি। কিন্তু অধিকাংশ তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস দেখায়নি। পলাশীর মাঠে সিরাজউদ্দৌল্লা বাহিনীর প্রায় পঞ্চাশ হাজার সৈন্য ইংরেজ বাহিনীর তিন হাজার সৈন্যের কাছে পরাজয় মেনে নিয়েছিল।

আওয়ামী লীগকে দেশের উগ্রবাদ ও ধর্মীয় বিদ্বেষ বিষয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে। গবেষণামাফিক এখনই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। স্বীকার করে নিতে হবে যে, আমরা একটি সরু রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। যদি আওয়ামী লীগ ব্যর্থ হয়, তাহলে আমরা ক্রমশই কালো গহ্বরে বিলীন হয়ে যাব।