সমৃদ্ধির সোপানের স্বপ্ন নিয়ে বাজেট

ধীরাজ কুমার নাথ
Published : 7 June 2015, 03:29 PM
Updated : 7 June 2015, 03:29 PM

এবারের বাজেট উপস্থাপনায় একটি চমক দিয়ে শুরু করেছেন অর্থমন্ত্রী মহোদয়। 'সমৃদ্ধির সোপানে বাংলাদেশ' বলে একে আখ্যায়িত করেছেন তিনি। বাজেট প্রস্তাব ২০১৫-২০১৬ বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে উপস্থাপনকালে মনে হয়েছে, প্রচুর সাফল্যের কথা তিনি বলবেন। বলেছেনও অনেক আশার কথা; তা পূরণ করতে পারবেন কিনা এই হচ্ছে প্রশ্ন।

অতীতের সাফল্য ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনা, প্রচুর প্রতিশ্রুতি ও প্রত্যয়, ব্যাপক উন্মেষণ ও উজ্জীবন নিয়ে উপস্থাপিত হয়েছে বাজেট প্রস্তাবসমূহ। অর্থনৈতিক অঙ্গনের ক্রমবর্ধমান সাফল্যের সূচকসমুহ নিজেদের দক্ষতা হিসেবে চিহ্নিত করে আগামী দিনে অধিকতর প্রস্ফুটনের প্রত্যয় প্রকাশ করা হয়েছে বাজেট বক্তৃতায়, জোরালোভাবে।

তবে অন্যবারের তুলনায় এবারের সুবিধা হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে; টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল; সুদের হার নিম্নগামী; দ্রব্যমূল্য মোটামুটি; বৈদেশিক লেনদেনে ভারসাম্য ইতিবাচক এবং বৈদেশিক মুদ্রার মজুত উৎসাহজনক। কিন্তু জনগণের প্রত্যাশার সঙ্গে এ বাজেট কতটা সঙ্গতিপূর্ণ, তা নিয়ে বিতর্ক হবে সামনের দিনগুলিতে। বড় কথা হচ্ছে, বাজেট বক্তৃতায় 'সমৃদ্ধির সোপানে বাংলাদেশ: উচ্চপ্রবৃদ্ধির পথরচনা' এমন শিরোনাম দিয়ে এবার বাজেট রচিত হল; এখন অনেকের প্রশ্ন এর সাফল্য কেমন হবে?

তবে এটিও উচ্চাভিলাষী বাজেট, যার আকার ২ লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা। চলতি আর্থিক বছরের তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ বেশি। এবারেও ঘাটতি বাজেট ৮৬ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা, যা মোট দেশজ উৎপাদনের প্রায় (জিডিপি) ৫ শতাংশ। অভ্যন্তরীন সম্পদ আহরণে সাফল্য আসেনি এখনও। ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকিং খাত এবং সঞ্চয়পত্র খাত থেকে অর্থ সংগ্রহ করা হবে। তবে প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ৭ শতাংশ। মুদ্রাষ্ফীতি ৬.২ শতাংশের অধিক হবে না বলে আশ্বাস দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। প্রবৃদ্ধির হার ৭/৮ শতাংশ অর্জিত না হলে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যআয়ের দেশ হতে পারবে না। এ জন্যে প্রয়োজন প্রচুর বিনিয়োগ। কিন্তু বিনিয়োগ আসছে না, পুঁজিপতিরা নিরুৎসাহিত।

সপ্তম বারের মতো বাজেট পেশ করছেন অভিজ্ঞ অর্থমন্ত্রী। তাঁর কাছে জনগণের প্রত্যাশা অনেক। কারণ তিনি প্রাক্কলন ও বাস্তবায়নের মধ্যে ফারাকের দৃশ্য দেখেছেন। যদিও বিশেষ চমক নেই, তবে বলা যায় আকর্ষণ হারায়নি এই বাজেট। 'শিশুদের জন্যে বাজেট', সরকারি কর্মচারিদের জন্যে 'সমৃদ্ধি সোপান ব্যাংক' এবং শেয়ার বাজারের জন্যে আলাদা প্রণোদনা হচ্ছে নতুন ভাবনা।

বাস্তবতা হল, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রাণসঞ্চার হয়েছে, গতি এসেছে প্রবৃদ্ধির হারে। এখন একে টেকসই করতে হবে। প্রায় ৭ বছর ধরে প্রতি বছর কমপক্ষে ৬ শতাংশ হারে দেশজ উৎপাদন বেড়ে চলেছে ধারাবাহিকভাবে। মাথাপিছু আয় বর্তমানে ১৩৪০ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে এবং ২৭৮০ মার্কিন ডলার পিপিপি (purchasing power parity) অর্জন অবশ্যই অহঙ্কার করার মতো অবস্থান।

উল্লেখযোগ্য অর্জন হচ্ছে নিম্ন মুদ্রাষ্ফীতি। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বেড়ে হয়েছে প্রায় ২৪ বিলিয়ন ইউএস ডলার। বার্ষিক রপ্তানি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ইউএস ডলার ৩০ বিলিয়ন। রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝে এমন অর্জন অবশ্যই সাফল্য। তবে বৈপরীত্য হচ্ছে, বিদেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আসছে, কিন্তু দেশীয় পুঁজিপতিরা দেশে বিনিয়োগ করছে না।

শুধু আর্থিক প্রবৃদ্ধি নয়, বাংলাদেশে অর্জন এসেছে সামাজিক অঙ্গনে। মানুষের গড় আয়ু বেড়ে হয়েছে ৭১ বছর। মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস পেয়েছে দ্রুতগতিতে এবং মোট প্রজনন হার নারী প্রতি ২.২এ হ্রাস পেয়েছে শহরে ও গ্রামে সমানভাবে। বাংলাদেশ এখন নিম্ন জন্মহারের দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী জনগণের সংখ্যা হ্রাস পেয়ে উন্নীত হয়েছে ২৪ শতাংশে। প্রাথমিক শিক্ষায় প্রায় শতভাগ তালিকাভুক্ত হয়েছে; ঝরে পড়ার হার নেমে এসেছে ৩৪ শতাংশের নিচে। অর্থনৈতিক অঙ্গনে নারীদের অংশীদারিত্ব প্রায় ৩৩.৫০ শতাংশে উপনীত। রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সমাজের সকল ক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়ন দৃশ্যমান এবং প্রমাণিত সত্য, যা ১৫ বছর আগেও ছিল অকল্পনীয়।

কূটনীতিতে বিজয় এসেছে শুধু জলসীমার অধিকার অর্জনে নয়, নীল অর্থনীতির পরিমণ্ডলে, ছিটমহলের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এবং বৃহৎ প্রতিবেশি ও উদীয়মান অর্থনীতির পুরোধা গণচীন, ভারত, জাপানের সঙ্গে সমমর্যাদা নিয়ে পথচলার এবং কূটনৈতিক দক্ষতা অর্জনের মাঝে। সামাজিক নিরাপত্তা বিধান করে গণতান্ত্রিক ভাবনা বিকশিত করার ক্ষেত্রে অনেকে মনে করেন বাংলাদেশ হচ্ছে এখন একটি মডেল।

অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, দেশে ১৬ কোটি জনগণের মধ্যে মাত্র ১১ লাখ লোক সরকারের করের আওতায় আছে; মানে যাদের ট্যাক্স আইডেটিফিকেশন নম্বর আছে। কর ফাঁকির প্রবণতার এমন ভয়াবহতা অন্য কোনো দেশে আছে কিনা জানা নেই। কমপক্ষে ১৮ লাখ লোককে করের আওতায় আনা সম্ভব এবং এ জন্য স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু করার আশ্বাস দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।

বাজেট বক্তৃতায় সরকারি কর্মচারি ও কর্মর্তাদের বেতন ভাতা বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তাদের দক্ষতা, জবাবদিহিতা এবং কাজকর্মে স্বচ্ছতার বৃদ্ধির কথা নেই। সরকার ২০১২ সালে 'জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলপত্র' প্রণয়ন করেছেন। কিন্তু কোনো কর্মকর্তা তার কর্মে ব্যত্যয়ের জন্যে শাস্তি পেয়েছেন কি? বরঞ্চ তাদের বাক্যে ও আচরণে জনগণ খুশি নয়। দক্ষতা প্রদর্শনে দিন দিন পিছিয়ে যাচ্ছে আমলাতন্ত্র। সকল ক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে বিনিয়োগ অর্থহীন হয়ে যাবে।

তবে বাজেট প্রস্তাব নিয়ে বির্তক হবে অনেক। উদার অর্থনীতির সুয়োগ নিয়ে, সমাজে বৈষম্য বিলোপের প্রশ্নে, ভূমিদস্যুদের দৌরাত্ম্য নিবারণের লক্ষ্যে ব্যাপক বির্তকের সুযোগ রয়েছে। সংখ্যালঘুদের বিশ্বাসের স্থানে হামলা বা অর্পিত সম্পত্তির নামে দেশছাড়া করার প্রবণতা প্রতিরোধের প্রশ্নে বিতর্ক হতে পারে। বাজেট বিতর্কে অবশ্যই উঠে আসবে সমাজের সকল স্তরের আর্থিক ও সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণের সুপারিশমালা।

অনেকের মতে, এ হচ্ছে স্বপ্নছড়ানো আশাবাদের বাজেট। আবার কারও মতে, এ হচ্ছে অসম বাজেট এবং দুর্বল কাঠামোয় বিলাসী বাজেট। বাজেট আকারে বড়, তবে গরিবের জন্য কতটা সুফল বয়ে আনবে তা প্রশ্নসাপেক্ষ। সময় তার উত্তর দিবে।

জনগণ চায় দেশে একটি টেকসই অর্থনীতি গড়ে উঠুক, রাষ্ট্রীয় জীবনে সুশাসন প্রতিষ্ঠা হোক এবং আমরা সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে সকল দ্বন্দ্বের অবসান করে ঐক্যবদ্ধ এবং এক দেশ এক জাতি হিসেবে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর উষালগে আমরা যেন আত্মপ্রকাশ করতে পারি।

ধীরাজ কুমার নাথ: সাবেক সচিব।