বিএনপির রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক আনুকূল্য

বিজন সরকার
Published : 1 June 2015, 08:54 PM
Updated : 1 June 2015, 08:54 PM

বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপির জন্মই হয়েছিল দেশে বিদ্যমান ডানপন্থা বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ভূমিকা পালনের উদ্দেশ্যে। এই বৃত্তের মধ্যে বিএনপির বহু সম-আদর্শিক রাজনৈতিক দল রয়েছে। তদুপরি, বিএনপির সাংগঠনিক সক্ষমতা এবং ভূ-রাজনৈতিক কারণেই ডানপন্থা বৃত্তের বিভিন্ন সংগঠন এবং ছোট ছোট দল নিয়ে গঠিত কনসোর্টিয়ামের প্রধান হিসেবে গত প্রায় আড়াই দশক বিএনপি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে।

রাজনীতিতে দীর্ঘদিন একটি রমরমা ভোটের বাজার নিরাপদে ভোগ করে আসছিল এই দল। যত বারই ক্ষমতায় গিয়েছে, খুব সহজভাবেই। পঁচাত্তর-উত্তর বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে প্রতিটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত যতটা গবেষণামাফিক নিতে হয়েছে, বিএনপির ক্ষেত্রে ঘটেছে তার উল্টো। বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক মেরুকরণ বাংলাদেশে বিএনপির জনপ্রিয়তা বাড়ায়। আফগান-সোভিয়েত ইউনিয়ন যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যের তেলসম্পদ এবং বিশ্বব্যাপী মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি গালফ নেশনের অলিখিত কর্তৃত্ব, মার্কিনিদের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মীয় জঙ্গিবাদের প্রয়োজনীয়তা এবং ভারত-বিরোধিতার মতো বিষয়গুলো বিএনপির রাজনীতিকে খুব সহজেই ক্যান্টনমেন্ট থেকে পল্টনে নিয়ে যায়।

১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এলেও আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধের মতো গুরুতর অপরাধের বিচারের অঙ্গীকার করতে সাহস করেনি। কারণ, তখনও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে সাধারণ মানুষের সুপ্ত আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণের সংযোগটি খুব নির্ভরশীল হয়ে উঠেনি। অন্যদিকে, বিএনপি স্রেফ ক্ষমতায় আরোহণের জন্য ২০০১ সালে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে গাঁটছাড়া বেধেছিল। এই গাঁটছাড়ার বহুমাত্রিক কুপ্রভাবের দিকটি না ভেবেই, খালেদা জিয়া ২০০১ সালে তাঁর প্রয়াত স্বামী জিয়াউর রহমানের মতো জামায়াতকে শাসনক্ষমতার ভাগীদার করেন। এর কুফল ওরা আজ অব্দি পেয়ে আসছে।

তখন থেকেই বিএনপি প্রচণ্ডভাবে আত্মহননমনস্ক হয়ে উঠে। সেবারের জাতীয় নির্বাচনের ফলাফলে বেগম জিয়ার আত্মবিশ্বাস বহুগুণ বেড়ে যায়। তাঁর ধারণা ছিল, বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপির জনপ্রিয়তার উৎসগুলি আগের চেয়ে আরও বেশি ফলদায়ক হয়ে উঠছে। দলের সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ কাণ্ডারী তারেক তখন জামায়াতের বিশস্ত বন্ধু হয়ে ওঠেন। ভোটের রাজনীতি, সমগোত্রীয় আদর্শ, ঐতিহাসিক লিগেসি এবং সাংঘর্ষিক রাজনীতিপ্রিয়তা তাকে এদিকে দ্রুত ধাবিত করে। জামায়াতও সেই সুযোগের অপচয় করেনি। স্বাধীনতাবিরোধী এ্ দলের রাজনৈতিক হিসাব ছিল এ রকম, ক্ষমতার চূড়ান্ত রাজনীতিতে বিএনপিই তাদের প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বী। কারণ, ওরা প্রায় একই আদর্শে বিশ্বাসী জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে। তাই বিএনপির এই তরুণ নেতাকে ২০০১-২০০৬ সাল অব্দি জামায়াত নানা কৌশলে বিতর্কিত করে তুলে। জামায়াতের এ কৌশল এখনও পুরোমাত্রায় চলমান। বিএনপির ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব যে তারেক-কেন্দ্রিক, জামায়াত তা বুঝে যায়। খালেদা জিয়ার কনিষ্ঠ তনয়, প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোকে নিয়ে তাদের তেমন কোনো পরিকল্পনা ছিল না। কারণ রাজনীতি করার মতো উপাদান তার মধ্যে কখনও দৃশ্যমান হয়নি।

বাংলাদেশকে জঙ্গি গোষ্ঠীর আরেকটি স্বর্গরাজ্য বানানোর প্রকল্পে জামায়াত তারেক রহমানের ভূমিকাটি ব্যবহার করতে সমর্থ হয়। শুধু তাই না, খালেদাপুত্রের মনোভাব বুঝতে পেরেই বিএনপির তরুণ নেতৃত্বের একটি বড় অংশ জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডে গডফাদারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। ফলে তারেকের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু হওয়ার আগেই 'শেষের শুরু' হয়ে যায়।

জামায়াত-বিএনপি জোট ক্ষমতায় থাকার সময় জামায়াত চিন্তাও করতে পারেনি যে, আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধ বিচারের আওতায় নিয়ে আসবে। বিএনপিও ভাবেনি যে, তাদের ক্ষমতায় থাকা না-থাকার ক্ষেত্রে যুদ্ধাপরাধের বিচার ভূমিকা রাখবে। উভয় দলের রাজনৈতিক হিসাব ছিল এই যে, বাংলাদেশের সামাজিক কাঠামো একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ বিচারে সায় দিবে না। তবু দেশের মানুষ পরিস্কারভাবে বুঝতে পারেন যে, ২০০১-২০০৬ সালের জঙ্গি উত্থানের পেছনের কারিগর জামায়াত। এতে বিএনপির প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক সমর্থন ছিল। ২০০৮ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবির গণআকাঙ্ক্ষা বড় একটি রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে ওঠে। তাই আওয়ামী লীগ বেশ সহজেই যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে জনগণের ম্যান্ডেট পেয়ে যায়।

বিশেষভাবে বিবেচনাযোগ্য যে, বাংলাদেশে বর্তমান ক্ষমতার রাজনীতিতে যুদ্ধাপরাধের বিচার একমাত্র ইস্যু না হলেও কয়েকটি মৌলিক ইস্যুর অন্যতম।

২০০৮ সালের পর থেকেই বাংলাদেশের ক্ষমতায় আরোহণের পদ্ধতিগুলিতে সুস্পষ্ট পরিবর্তন আসে মূলত দুটি দিক থেকে; অভ্যন্তরীন ও আন্তর্জাতিক। অভ্যন্তরীন ক্ষেত্রে দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মানের তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন, প্রযুক্তি-বিপ্লব ও আর্থসামাজিক উন্নয়ন দেশের ভিতরকার রাজনীতি প্রভাবিত করছে। ঠিক তেমনি বিশ্বব্যাপী জঙ্গিবাদ, অর্থনৈতিক মন্দা, পরাশক্তি আমেরিকার ক্ষয়িষ্ণু দাপট, চীন ও ভারতের উত্থানও আমাদের রাজনীতিতে প্রভাব রাখছে।

অভ্যন্তরীন ও বৈশ্বিক বাস্তবতায় বিএনপি ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। নির্লিপ্ততা ও ঝিমুনি পেয়ে বসেছে দেশের অন্যতম জনপ্রিয় দলটির। কয়েক দশকের রাজনৈতিক ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে প্রতিনিয়ত হেরে যাচ্ছে ওরা। ফলে বাধ্য হয়ে ঝুঁকছে মিথ্যাচার, গুজব ও নিয়তিনির্ভর রাজনীতির দিকে।

সরকারবিরোধী আন্দোলনের রূপরেখা প্রণয়নের জন্য যে গবেষণালব্ধ ও বিশ্লেষণমাফিক সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার ছিল, তা নিতে বিএনপি-জামায়াত জোট সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। ভবিষ্যতে কতটুকু করতে পারবে, সে সংশয়ও জনমনে বেশ প্রবল।

ওয়ান ইলেভেনের পর থেকেই বিএনপি সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। গত আট বছরেও মূল দল ও অঙ্গ সংগঠনগুলির কমিটি গঠন করে গোছাতে পারেনি। অনেক জেলায় আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে বছরের পর বছর চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সাংগঠনিক স্থবিরতা দলটির উপর জেঁকে বসেছে।

ওদিকে ছাত্রদের সংগঠন ছাত্রদল পরিণত হয়েছে বাবা-চাচাদের সংগঠনে। পদধারী প্রায় সকল নেতাই বিবাহিত ও বিভিন্ন ব্যবসায় জড়িত। যাদের বয়স ত্রিশ ও চল্লিশের কোঠায়। এই নেতারা নিজেদের সংসার ও ব্যবসার মায়া ছেড়ে করে দলের জন্য কতটুকু আত্মত্যাগ করতে পারবেন সে সত্য বুঝতে না পারাও দলটির নীতিনির্ধারকের চরম ব্যর্থতা।

সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, কয়েক বছরেও একজন মহাসচিব নির্বাচন করতে শতভাগ ব্যর্থ হয়েছে ওরা। খন্দকার দেলোয়ার হোসেন মারা যাওয়ার পর থেকেই ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বহু বার জেলে গেলেও (বর্তমানেও জেলে রয়েছেন) বহুদিন জেলে যাওয়ার ভয়ে আত্মগোপনে ছিলেন। এমন একটি বড় দলের মহাসচিব যখন পালিয়ে বেড়ান, তখন এর আদর্শিক ও সাংগঠনিক শক্তি ও নৈতিকতার বিষয়টি সামনে চলে আসে।

দলের ভিতর পারস্পরিক বিশ্বাসের জায়গা নড়বড়ে। খালেদা জিয়া সংস্কারপন্থীদের দলে নিলেও বিশ্বাস-অবিশ্বাসের শ্রেণিবিভাজনে দল বহুধাবিভক্ত। তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন সংস্কারপন্থীরা, এমন একটি বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ রয়েছে। তাই অনেকে এখন দল থেকে সংস্কারপন্থীদের বের করে দেওয়ার আওয়াজ তুলছেন। খালেদা জিয়াও তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীদের বিশ্বাস করতে পারছেন না। নীতিনির্ধারকের মধ্যে এই মাত্রার আস্থা নিয়ে আওয়ামী লীগের মতো একটি অভিজ্ঞ দলের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার সামর্থ্য না থাকারই কথা।

অতিসম্প্রতি তারেক রহমানের আস্থাভাজন বেগম জিয়ার অফিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও দলটির স্থায়ী কমিটির নেতাদের দূরত্বের বিষয়টি গণমাধ্যমে চলে আসে। তারেকের নির্দেশে বিএনপির গুলশান অফিস থেকে মিথ্যাচারের বিপক্ষে গণমাধ্যমে মতামত তুলে ধরার কারণে স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমেদকে গুলশান অফিসে না যেতে সরাসরি বলে দেওয়া হয়েছে বলে শোনা যায়।

বিএনপির জামায়াত-তোষণ নীতি ও যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়ে কৌশলী হওয়ার বিষয়টি দেশের জনগণ ভালোভাবে নেয়নি। সরকারবিরোধী বিভিন্ন বিতর্কিত ইস্যুগুলিতে জনগণকে যে সব কারণে সম্পৃক্ত করা যায়নি, তার অন্যতম কারণ এটি। ক্ষমতায় গিয়ে বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া অব্যাহত রাখবে, জনগণ তা বিশ্বাস করতে পারেনি। দেলাওয়ার হোসেন সাইদির বিরুদ্ধে রায়ের পর বিএনপির পরীক্ষিত মিত্র জামায়াত মধ্যযুগীয় তাণ্ডব চালিয়েছিল। এ বিষয়ে বিএনপির নিরবতা সাধারণ মানুষের মনে ভীতি সঞ্চার করে। মূলত বিএনপি সরকারের ফাঁদে পা দিয়েছিল। আর সরকার এর রাজনৈতিক ফলাফল নিজেদের কোষাগারে জমা করে।

হেফাজত ইসলামের ৫ মের সমাবেশটি ছিল বিএনপি জোটের জন্য শাঁখের করাত। এর ফলে দেশে দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক ইসলামকরণের কুফলটি আলোচনায় চলে আসে। হেফাজতের তাণ্ডব দেখে যে সমস্ত শক্তি বিএনপির পক্ষে ছিল তারাও দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে। সরকার তার বাহিনী দিয়ে হেফাজতকে মতিঝিল এলাকা থেকে বেশ দক্ষতায় সঙ্গে সরিয়ে দেয়। ৫ মে সমাবেশের বিষয়ে দেশের উন্নয়ন সহযোগী, দাতা গোষ্ঠী ও দেশগুলি সরাসরি কিছু বলেনি। তবে উগ্রতা ও চরমবাদ সমর্থনযোগ্য নয়, তা স্পষ্ট করেই বলেছিলেন জার্মান রাষ্ট্রদূত। এ ঘটনার পরে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার বিএনপিপন্থী অবস্থান নিয়ে কূটনীতিকদের মধ্যে বিভক্তি লক্ষ্য করা গেছে। তাতে, দৃশ্যত মজিনা একা হয়ে পড়েছিলেন।

এ বছরের শুরুর দিকে বিশ দলীয় জোটের ডাকা তিন মাসব্যাপী অবরোধ ও হরতাল কর্মসূচির নামে তালেবানি কায়দায় পেট্রোল বোমা মেরে সাধারণ মানুষ হত্যার সিদ্বান্তটি বিএনপি-জামায়াত জোটের কফিনে আরেকটি বড় পেরেক ঠুকে দেয়। পথহারা বিএনপি ও উগ্র ফ্যাসিস্ট জামায়াতের সন্ত্রাসবান্ধব চরিত্র আবারও উন্মোচিত হয়।

মহাজোট সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের জন্য ইস্যু নির্বাচন করে অগ্রাধিকার দেওয়ার ক্ষেত্রেও বিএনপি ততটা মেধার পরিচয় দেয়নি। জিয়া পরিবারের ব্যক্তিগত ইস্যুগুলিতে হরতালের মতো কর্মসূচি দেওয়ায় তাদের কেয়ারটেকার ইস্যুটি আড়ালে চলে যায়।

অধিকন্তু, জামায়াতের দলীয় হরতালসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে বিএনপি পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে সমর্থন দিয়ে যাওয়ায় আওয়ামী লীগের জন্য রাজনৈতিক সুবিধা হয়। বিএনপি জোটের কেয়ারটেকার ইস্যুটি দেশবাসীর সামনে গ্রহণযোগ্যভাবে প্রতীয়মান হয়নি, বরং দলটি এ ইস্যু সামনে রেখে যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করছে, প্রগতিশীল জোট এ ধারণাই প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। দেশের অধিকাংশ সাধারণ মানুষও তাই মনে করে।

২০১৩ সালের নির্বাচন-পূর্ববর্তী সময়ে বিএনপির প্রস্তাবিত কেয়ারটেকার সরকারের উপদেষ্টা নির্বাচন পদ্ধতি ছিল ত্রুটিপূর্ণ। দলটির এ বিষয়ে হোমওয়ার্ক ছিল না। দশজন উপদেষ্টার নাম দিতেও দলটির নেতৃত্ব ব্যর্থ হয়। ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার বিষয়গুলি যে খুবই দুর্বল এবং খামখেয়ালিপূর্ণ, তা দেশবাসীর কাছে প্রকাশ পায়।

বিগত মহাজোট সরকারের নেওয়া কিছু সিদ্ধান্তে জনগণের সম্পৃক্ততা না থাকায় সরকার দক্ষতার সঙ্গে সে সকল সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। মুন্সিগঞ্জে প্রস্তাবিত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর স্থাপন বিষয়টি উল্লেখ করার মতো। বিমানবন্দর স্থাপনাবিরোধী আন্দোলনে সাধারণ জনগণ অংশগ্রহণ করলেও বিএনপি জোটের সম্পৃক্ততা লক্ষ্য করা যায়নি। তাছাড়া অনেক জনসম্পৃক্ত ইস্যু, যেমন, শেয়ার বাজার ও ব্যাংক কেলেঙ্কারিতে ওই জোট কৌশলে এড়িয়ে গেছে।

বিএনপির ভিতরে যে অংশটি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়াদি দেখভালের দায়িত্বে আছে, তারা ব্যর্থতার ষোলকলা পূর্ণ করেছে। বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিশ্বদরবারে ভারতের ভূমিকা, ভারত-চীনের মধ্যে দ্রুত বর্ধনশীল বাণিজ্য, মার্কিন সাম্রাজ্যের সূর্য যে অস্তগামী, সে সব বাস্তবতা অনুধাবন জরুরি ছিল। পরিবর্তনশীল ভূ-রাজনৈতিক মেরুকরণে এ অঞ্চলে আমেরিকা ভারতের উপর নির্ভরশীল। ভারত ও চীনের মধ্যেকার বিশ্বের সবচেয়ে বড় দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যটি বাংলাদেশে আমেরিকা ও চীনের স্বার্থের তুলনায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ সত্য বিএনপি কোনোভাবেই বুঝতে পারেনি।

৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে ড্যান মজিনাসহ মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগের কিছু কর্মকর্তা ও জাতিসংঘের কিছু বিবৃতি লক্ষ্য করা যায়। তারা চেয়েছিল ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করতে। তবে ওবামা প্রশাসনের উপরের স্তরের নীতিনির্ধারকরা ভারতের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে নির্বাচন নিয়ে বেশি সোচ্চার হতে আগ্রহী ছিলেন না বলেই মনে হয়েছিল।

বিএনপি আশা করেছিল যে, আমেরিকার মতো চীনও নির্বাচনের বিরোধিতা করবে। কোনো দেশের নির্বাচন নিয়ে কথা বলার নৈতিক শক্তি যে চীনের নেই, তা বিএনপির বিবেচনায় ছিল না। বরং আমেরিকার চতুর্মুখী চাপ উপেক্ষা করে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার সিদ্বান্তটি চীনের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে খাপ খেয়ে যায়। বিএনপি-জামায়াত জোটের নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতার আড়ালে জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থানের সম্ভাবনায় চীন উদ্বিগ্ন ছিল। কারণ তাতে এ অঞ্চলে আমেরিকার প্রবেশ সহজতর হয়ে যাবে। চীন ভুলে যায়নি যে,জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থানের উসিলায় ২০০৪ সালের দিকে কীভাবে বাংলাদেশে তাইওয়ানের কূটনৈতিক অফিস খুলতে আমেরিকা ওই দেশকে সহযোগিতা করেছিল।

২০০৮ সালের পর থেকেই ভারতের সাউথ ব্লক বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা চালিয়ে আসছিল। এ লক্ষ্যে গৃহীত পদক্ষেপের মধ্যে খালেদা জিয়ার ভারত সফরটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সম্পর্কের বেশ উন্নয়নও হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশে সফররত ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে দেখা না করে বেগম জিয়া তথা বিএনপির নেতৃত্ব সুদূরপ্রসারী ও সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।

বিএনপির ব্যর্থতার খতিয়ান এক লেখায় শেষ করা যাবে না। বর্তমান বাস্তবতায়, দলটির মূল নেতৃত্ব তারেকের চিন্তা-চেতনা যতক্ষণ প্রমোট করবে, ওদের ব্যর্থতার খতিয়ান তত দীর্ঘ হবে।