বাংলাদেশের কি কোনো বাজেটের প্রয়োজন রয়েছে

এ এফ মুজতাহিদ
Published : 30 May 2015, 08:04 AM
Updated : 30 May 2015, 08:04 AM

আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়ন ও পেশ নিয়ে সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় খুবই ব্যস্ত রয়েছে। আর এই কাজে সবচাইতে বেশি ব্যস্ত রয়েছেন আমাদের সর্বজনশ্রদ্ধেয় অর্থমন্ত্রী মহোদয় মুহিত সাহেব।

বেচারা মুহিত সাহেবকে প্রায় সবার সঙ্গে, বাজেটে উৎসাহী সকল গোষ্ঠীর সঙ্গে ভিন্ন ভিন্নভাবে কথা বলতে হয়েছে বললে হয়তো কথাটা সঠিক হবে না; বলা ভালো, শুনতে হয়েছে। সদাহাসিমুখ মুহিত সাহেবের ধৈর্যও আছে বলিহারি। ওনার জন্য আমার কষ্ট হয়।

বর্তমান যে বাংলাদেশ, এই বাংলাদেশের জন্য কি কোনো বাজেট প্রণয়নের দরকার রয়েছে? ভুল বোঝাবুঝির ঝুঁকি নিয়েই বলছি, বাজেট প্রণয়নের জন্য শ্রদ্ধেয় মুহিত সাহেব যে অপরিসীম ধৈর্য নিয়ে সবার কথা শুনেছেন, সে বাজেট দরকার বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের মাননীয় সংসদ সদস্যদের জন্য। কারণ তাঁরা সবাই জাতির কল্যাণকামনায় অহোরাত্র নিয়োজিত রয়েছেন। আর তাই তাদের জনহিতৈষণার প্রমাণস্বরূপ এই বাজেট দরকার। এই বাজেট দরকার দেশ ও মানুষের কল্যাণে তাঁরা কতটুকু নিয়োজিত রয়েছেন সেটা প্রমাণ করার জন্য।

জাতীয় সংসদের মাননীয় সংসদ সদস্যরা এই বাজেটের মাধ্যমেই সংসদের ভিতরে সংঘবদ্ধভাবে এবং সংসদের বাইরে বিস্তৃত পরিসরে তাদের নানা কার্যক্রমের বিষয়গুলো জাতির স্বার্থে আরও লাভজনক করে তুলবার জন্য কী কী সুবিধা প্রয়োজন সেটা আদায় করেন। আমাদের এই মাননীয় সংসদ সদস্যরা জাতির নানা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত রয়েছেন। সংসদ সদস্য হিসেবে তাঁরা যেমন বাজেটের মাধ্যমে নিজেদের সুবিধাগুলো ধ্বনি ভোটে পাশ করিয়ে নেবার মতো সম্মানজনক ভূমিকা অবলম্বন করে থাকেন, অন্যদিকে তাঁরাই আবার সংসদের বাইরে তাদের নানা রকম সংগঠনের মাধ্যমে দলবদ্ধভাবে কী কী সুবিধা জাতির স্বার্থে বাজেটের মাধ্যমে পাওয়া উচিত তার জন্য দেনদরবার করেন।

দেনদরবার করেন বললে হয়তো ভুল হবে। তাঁরা মোটা দাগে তাদের সেই সব প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে মাননীয় অর্থমন্ত্রীকে একটা লিখিত 'চার্টার অব ডিমান্ড' হাতে ধরিয়ে দেন।

এই মাননীয় সদস্যরা কীভাবে সেটা করেন? তাঁরা সর্বভূতেষু। তাঁরা সর্বত্র বিরাজমান, দৃশ্যমান। সংসদের সেই সব মাননীয় সদস্যের মধ্যে (সম্মানিত হাতেগোনা কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া) বিপুল সংখ্যক সদস্য নানা ধরনের ব্যবসায়ের সঙ্গে যুক্ত। কোথায় তাঁরা নেই?

তাঁরা গার্মেন্টসের মালিক হিসেবে বিজিএমইএতে আছেন, ডেভলপার হিসেবে রিহ্যাবের অন্তর্ভুক্ত সদস্য তাঁরা। কোল্ড রোল মিলের মালিক হিসেবে ইস্পাতসংক্রান্ত সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত আছেন। আছেন হরেক রকম আমদানি রপ্তানি কারবারের সঙ্গে। তাঁরা সকলে নানা ব্যবসায়ী সংগঠনের সদস্য হিসেবে সর্বদা দেদীপ্যমান। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, চট্টগ্রাম চেম্বারসহ আরও বহু চেম্বারের সদস্য তাঁরা। এই সব চেম্বারের সদস্যরা আবার নানা রকম ব্যবসায়ের সঙ্গে যুক্ত থেকে সেই সব ব্যবসায়ী গ্রুপ বা সংঘের মাধ্যমে সরকারের সঙ্গে দেনদরবার করেন।

এই সকল চেম্বারের মাথার উপরে রয়েছে এফবিসিসিআই (ফেডারেশন অব চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ)– সব ধরনের ব্যবসায়ীদের, নানা রকমের চেম্বারের শিরোমনি বা আম মোক্তার। এই আম মোক্তারের সঙ্গে যুক্ত আছেন স্বনামে-বেনামে আমাদের মাননীয় সংসদ সদস্যরা।

এই সব নানা বর্নের, নানা কর্মের, নানা ব্যবসায়ের চেম্বারের নেতাদের কথা অর্থমন্ত্রীকে হাসিমুখে শুনতে হয়। তাদের দেওয়া দাবিনামা সানন্দে গ্রহণ করতে হয়। তরুণ সাংবাদিকদের কর্মকুশীলতার কারণে দেশবাসী আবার বাজেট সম্পর্কে, এর আকার ও অন্যান্য বিষয়ে আগেভাগে অবগত হয়ে যান। আমদানি রপ্তানি পণ্যের কোনটার ওপর শুল্ক কমবে, কোনটার ওপর বাড়বে সে সম্পর্কে কমবেশি সবার জানার সুযোগ তৈরি হয়। কাজেই আমাদের যে বাজেট সংসদে মাননীয় অর্থমন্ত্রী পাঠ করেন সেটা কতটুকু সরকারের প্রণীত বাজেট বা কতটুকু হাজারো রকমের সংঘবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের দাবিনামার সমাহার সেটা বলা মুশকিল।

একটা সময় ছিল– আমাদের কালে, ১৯৬০এর সময়কালে– তখন বলা হত, Budget Reflects Government Character, সরল বাংলায় বললে বোঝায়, বাজেট সরকারি চরিত্রেরই প্রকাশ বা প্রতিফলন। এ কথা বলার মধ্যে একটা দর্শনের ভাব বিরাজমান ছিল। কারণ তখন বাজেট প্রণীত হত একটা অর্থনৈতিক দর্শনের মৌলিক চিন্তা সামনে রেখে; পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার বিঘোষিত নীতি বাস্তবায়নের পদ্ধতি হিসেবে; সমাজ-কাঠামোর বা শিক্ষা-স্বাস্থ্য, যাতায়াত ব্যবস্থা, দারিদ্র-নিরসনসহ পরনির্ভরতার অর্থনীতি থেকে দেশের অর্থনীতি বের করে নিয়ে আসার প্রয়াস হিসেবে।

১৯৯০এর দশক থেকে বিশ্বায়নের যে উপপ্লব সমগ্র বিশ্বে, বিশ্বের নানা প্রতিষ্ঠিত ধারণা ওলটে পালটে নতুন এক বিশ্ববীক্ষার জন্ম দিয়েছে, সেই বিশ্বায়নের যুগে আমাদের মতো দেশ, যার না আছে দৃঢ় কোনো রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দর্শন (আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে যাই ঘোষিত হয়ে থাকুক না কেন) এবং যা চলছে, 'আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে' ধ্রুব ভেবে সেখানে বাজেট নামক একটা তামাশা কি আমাদের হরেক রকম নিত্যনৈমিত্তিক তামাশার দেশে প্রয়োজন আছে?

আমরা জানি 'সংঘবদ্ধ শক্তির' ইচ্ছানুযায়ী এই বাজেট প্রণীত হয়ে থাকে কিন্তু সেই শক্তি ১৭ কোটি মানুষের কত শতাংশ? দুই-তিন শতাংশের বেশি কি হবে? অথচ তাদের হাতেই রয়েছে সমস্ত অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ। তারাই বাজেট তৈরি করে, তাদের জন্য ও তাদের কল্যাণে। অর্থমন্ত্রী মহোদয় সেটা প্রথানুযায়ী সংসদে পাঠ করেন মাত্র। নানা খাতে আয়-ব্যয়ের একটা ধারণা দেবার জন্য গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সেটাকে 'ফাইন্যান্স অ্যাক্ট' নামে অবহিত করা হয়ে থাকে।

ওই যে বললাম ২-৩ শতাংশ 'ঈশ্বরের আশীর্বাদপ্রাপ্ত' মানুষ, তাদের বাইরে যে ৯৭ ভাগ মানুষ রয়েছেন, তারা তো সংঘবদ্ধ নন। তাঁরা কারা? কৃষিতে নিযুক্ত মানুষ, কারখানার শ্রমিক, গার্মেন্টস কারখানার লক্ষ লক্ষ নারীশ্রমিক, ফুটপাতের দোকানি-মুটে-মজুর, লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রী, বাস-ট্রাক-নৌযানসহ বিভিন্ন মাধ্যমে কর্মরত শ্রমজীবী মানুষ এবং মধ্যবিত্ত নামধারী বিপুল অসংগঠিত জনগোষ্ঠী। এই লোকগুলোর জন্য না আছে পর্যাপ্ত পানির জোগান, না টয়লেটের ব্যবস্থা, না বাসস্থানের, না স্বাস্থ্যপরিসেবার সুযোগ, না তাদের সন্তানদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ওই অসংঘবদ্ধ মানুষরা মারী-মড়ক-মন্বন্তর আর ঘন-ঘন বন্যার আঘাতে পর্যুদস্ত-বিপর্যস্ত-বিপন্ন। এই মানুষদের জন্যই এই রাষ্ট্র– তাদের নামে এবং তাদের জন্যই এই দেশটার জন্ম দিয়েছিলেন টুঙ্গিপাড়ার এক অসমসাহসী মানুষ, শেখ মুজিবুর রহমান।

দেশের উন্নয়ের নামে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করা হয় এবং তার অনুষঙ্গ হিসেবে আসে নানা ব্রান্ডের বাহারি গাড়ি, প্রকল্প। এই সবের সঙ্গে যারা যুক্ত তারা আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়। আর যে মানুষদের নামে এবং কল্যাণের জন্য এই সব স্বপ্নের প্রকল্প নেওয়া হয় সেই মানুষগুলোর রাত্রির অবসান হয়ে নবপ্রভাতের সূত্রপাত হয় না।

এই অসংঘটিত হতদরিদ্র মানুষের বাইরে আরও একটা শ্রেণি আছেন যারা একদা এই রাষ্ট্রের নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত ছিলেন। কিন্তু পারিবারিক শিক্ষার কারণেই হোক অথবা নিজেদের নির্বুদ্ধিতার (?) কারণে– তারা দেশটার সেবা করে গেছেন। তাদের না আছে নিজস্ব কোনো জায়গা, না ফ্ল্যাট-বাড়ি। তারা এমন ভাগ্যবান ছিলেন না যে, ছলেবলেকৌশলে নিজেদের পাদপ্রদীপের সামনে নিয়ে আসবেন।

সিনিয়র সিটিজেন অথবা প্রবীণ এই জনগোষ্ঠীর নির্ভর করার মতো কেউ নেই। নিজেরা তাঁরা অসংগঠিত বিধায়, কিছুটা নীতি-নৈতিকতা এবং শৃঙ্খলাবোধের কারণে গার্মেন্টস শ্রমিকদের মতো রাস্তায় নেমে ভাঙচুর করে একটা দক্ষযজ্ঞ কাণ্ড ঘটিয়ে তুলতে পারেন না। তারা পেনশনভোগীও নন। পারিবারিক শিক্ষা ও আত্মসম্মানবোধের কারণে তারা কখনও সরকারের নানা দরজার গিয়ে হাত পাততেও জানেন না। তারা ধুঁকে ধুঁকে মরেন। প্রবীণ বয়েসে তাদের রোগ-শোকের কারণ ঘটলে তারা জানেন না সরকারি কোন হাসপাতালে— ঢাকা মেডিকেলে, বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে না অন্য কোথাও তারা রাষ্ট্রীয় খরচে অন্তত স্বাস্থ্যসেবাটুকু পাবেন কি না। অথচ রাষ্ট্র সিএসআরএর নামে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করছে। সেই অর্থের কতটুক মানবকল্যাণে ব্যয়িত হচ্ছে? এই ভাগ্যবিড়ম্বিত মধ্যবিত্ত প্রবীণ নাগরিকদের প্রতি তাদের কল্যাণের জন্য সরকারের কি কোনো দায়িত্ব নেই?

একদা ধানমণ্ডিতে সেই ১৯৫০এর দশকে যে সমস্ত সরকারি কর্মকর্তাদের জমি দেওয়া হয়েছিল, তাদের চতুর সন্তান-সন্ততিরা নানা কৌশলে সব সরকারের কালে নিজেদের আরও সমৃদ্ধ করেছে। তাদের বাবার জায়গা থাকার পরও নিজেরা নানা নামে সরকারি জমির মালিক হয়েছে। কিন্তু কেউ সে সব অনাচার দেখবার জন্য নেই। আমাদের সদাশয় সরকার এ ব্যাপারে একটা সার্ভে বা তদন্ত তো অন্তত করতে পারে যে, কত জন সিভিলিয়ান নিজেদের পৈত্রিক আবাসন থাকার পরও অসত্য হলফনামা দিয়ে নিজেরা, নিজেদের স্ত্রীরা, সন্তান-সন্ততিরা সমৃদ্ধ হয়েছে, জায়গা-জমির মালিক হয়েছে?

ট্র্যাজেডি হল, শুধুমাত্র একজন মানুষই সমগ্র দোষে দোষী হচ্ছেন। যেন সব দোষ একমাত্র তারই। অন্য কারও দোষ নেই। মানুষটির অপরাধ তিনি শেখ মুজিবর রহমানের কন্যা; আর তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনা কি পারবেন তাঁর সরকারের নামে যে বাজেট সংসদে উপস্থাপিত হচ্ছে, সেটা ২-৩ শতাংশ মানুষের কল্যাণে না হয়ে ৯৭ শতাংশ মানুষের কল্যাণে প্রণীত হোক সে ব্যবস্থা করতে? তিনি নিজেকে প্রশ্ন করুন না কেন যে, আমাদের কি এমন কোনো বাজেটের প্রয়োজন আছে যে বাজেট আসলে মাত্র ২-৩ শতাংশ মানুষের জন্য তৈরি হয়?

কী হবে এই বাজেট প্রণয়ন না করলে, কতিপয় 'চাটার দল'কে (বঙ্গবন্ধুর বহুল উচ্চারিত শব্দবন্ধ) আরও মোটাতাজা হবার সুযোগ না দিলে? তাহলে অন্তত হতদরিদ্র মানুষ নিজেরাই নিজেদের গরজে সংঘবদ্ধভাবে নিজেদের অধিকার আদায় করবার জন্য পথে নামতে বাধ্য হবেন।

এ এফ মুজতাহিদ: ভাইস প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি।