শেখ হাসিনা বলুন, আমি যদি হুকুম দিতে না পারি

আকতার হোসেন
Published : 29 May 2015, 12:36 PM
Updated : 29 May 2015, 12:36 PM

২৫ মে, ২০১৫ বাংলাদেশ সরকারের এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে যে, বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যরা সরকারি খরচে আবাসস্থলসহ নিরাপত্তা পাবেন। যে আইনে এই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সেটি হল 'জাতির পিতার পরিবার-সদস্যগণের নিরাপত্তা আইন, ২০০৯'এর (২০০৯ সনের ৬৩ নং আইন) ধারা ৪এর উপধারা (৩)। দেশের অনেক ভিন্নমতের ব্যক্তি, গোষ্ঠী এবং বিশেষ ধর্মাবলম্বী মানুষ যেখানে নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন, সেখানে ক্ষমতায় থেকে পরিবার ও নিজের জন্য এমন সুযোগ নেওয়ায় ভবিষ্যতে সমালোচনার মুখোমুখি হতে পারেন শেখ হাসিনা। কিন্তু তিনি এখন বিশ্বের ক্ষমতাধর নারীদের তালিকায় অবস্থান করছেন। তাই এ সময়ে তাঁর নিরাপত্তা পাওয়ার ব্যাপারে দ্বিমত থাকার কথা নয়।

বিরোধী দলগুলো বলছে সমুচিত জবাব দিয়ে শেখ হাসিনার পতন ঘটানো হবে; একের পর এক জঙ্গি সংগঠন নিষিদ্ধ করেও লাভ হচ্ছে না; বিদেশি চর এবং আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা ছদ্মবেশে বাংলাদেশে ঢুকে অবস্থান করতে শুরু করেছে; এমন পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনাসহ জাতির পিতার পরিবারের সকল সদস্যকে নিরাপত্তা দিয়ে আইন পাশ করা দোষের নয় বলে কেউ কেউ মনে করছেন।

প্রতিরোধ আর প্রতিশোধের জন্য হত্যার মধ্যে একটা পার্থক্য রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপর আক্রমণগুলো দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, প্রতিশোধ নেবার জন্যই তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র চলছে। ষড়যন্ত্রকারীরা প্রতিশোধের আসল কারণ আড়াল করার জন্য ইতোমধ্যে নানা ঘটনার সঙ্গে তাঁকে জড়িয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। রাজনৈতিক প্রতিশোধের পরিচিত কিছু কৌশল হল, যাকে টার্গেট করা হয় প্রথমেই তাঁর জনপ্রিয়তা কমিয়ে এনে তাঁর বিরুদ্ধে জনরোষ জাগিয়ে তোলা। ক্রমাগত মিথ্যাচার এবং রাজনৈতিক ফাঁদ-ফন্দিতে পা দিতে বাধ্য করা এই পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

প্রতিশোধের এই পন্থাগুলো শেখ হাসিনার উপরও ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন, তিনি যে একজন স্বৈরাচারী শাসক এ কথা প্রমাণ করতে মাঠে নেমে পড়েছে শিক্ষিত সমাজের একটি অংশ। ঢাকার বিডিআর হত্যাকাণ্ড শেখ হাসিনার ইশারায় সংগঠিত হয়েছে সেটা নিয়ে অনলাইন-অফলাইনে প্রচারণাও চলছে। যুদ্ধাপরাধীর বিচারের নামে তিনি একটি বিশেষ দলের প্রতি বৈরিতা করছেন এ কথাও জোরেশোরে বলার চেষ্টা করেছেন উঁচু মহলের কিছু লোক। ধর্মীয় সমাবেশের উপর রাতের অন্ধকারে পুলিশ দিয়ে তাণ্ডব চালিয়েছেন শেখ হাসিনা এমন খবর অনেক বিদেশিদের বিশ্বাস করানো সম্ভব হয়েছে। বিদেশিদের কাছে শেখ হাসিনার অগণতান্ত্রিক একটা চিত্র এমন করে আঁকা হয়েছে যার ফলে ঢাকার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়েও জাতিসংঘের মহাসচিব উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন।

এসব ছাড়াও আইনশৃঙ্খলার অবনতি এবং খুনের ঘটনা বাড়ছে বলে সরকারের দিকেই আঙুল তুলছেন অনেকে। কিছু কিছু অপকর্ম ও হত্যা মামলায় প্রধানমন্ত্রী নিরব থাকাতে, বিশেষ করে রাজীব হায়দার, অভিজিৎ রায়, ওয়াসিক রহমান এবং অনন্ত বিজয় দাশের মৃত্যুতে সরকারের 'ধরি মাছ না ছুঁই পানি' অবস্থানের ফলে শিক্ষিত যুব সমাজ ফুঁসে উঠছে বলেও শোনা যায়। অতএব, যে কোনো সময় যদি তিনি প্রতিশোধপরায়ণ শক্তির আঘাতে পরাজিত হন তাহলে খুনিদের পক্ষে হত্যাকাণ্ডটি জায়েজ করায় সমস্যা হবে না।

সুবিধাটুকু নিতে গ্রাউন্ডওয়ার্ক করা হচ্ছে বুদ্ধিজীবী, মিডিয়া এবং বিদেশি শক্তির বলয় থেকে। খেপিয়ে তোলা হচ্ছে দেশের চিন্তাশীল মানুষদের। অনেক ফাঁদ এড়িয়ে যেতে সক্ষম হলেও কিছু কিছু ফাঁদে যে তিনি পা দিয়ে ফেলেছেন সেটা এখন পরিস্কার। ষড়যন্ত্রকারীরা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে শেখ হাসিনার চারিদিকে এমন জাল বিছানো শুরু করেছে যে, হয়তো ইন্দিরা গান্ধীর মতো নিজস্ব সিকিউরিটি দিয়েও তাঁকে আঘাত করা হতে পারে। ব্যাপারটি তিনি নিজেও ভালো করে জানেন এবং তাঁর দল ও সমর্থকদের মধ্যে অনেকেই এ নিয়ে চিন্তিত।

একটি বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তিনি পরিবারের প্রায় সকলকে হারিয়েছেন। সেই হত্যাকাণ্ডের শিকার আট বছরের শিশুসহ অন্তঃসত্ত্বা নারীও ছিলেন। সে ঘটনার ছ বছর পর যখন শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ফিরে আসেন, তখন থেকে তাঁকেও হত্যা করার ষড়যন্ত্র শুরু হয়। এ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য বারটি ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। ১৯৮৯ সালের ১০ আগস্ট ফ্রিডম পার্টির ১০-১২ জন কর্মী ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে তাঁদের বাড়িতে বোমা এবং পিস্তল নিয়ে আক্রমণ চালায়। ২০০০ সালে ২০ জুন ফরিদপুরের কোটালিপাড়ায় তাঁর সভাস্থলে ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুতে তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। সে বোমা বিস্ফোরিত হলে কয়েকটি গ্রাম উড়ে যেত বলে জানা গেছে। শেখ হাসিনার ভাগ্য ভালো যে, বৃষ্টির পানিতে মাটি সরে গিয়ে বোমার তার বেরিয়ে এলে ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে যায়। ২০০২ সালের ৩০ আগস্ট সাতক্ষীরাতে তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি করা হলেও তিনি প্রাণে বেঁচে যান।

শেখ হাসিনাকে হত্যার সবচেয়ে বড় পরিকল্পনা হয় ২০০৪ সালে। যে ঘটনা ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা নামে পরিচিত। সে আক্রমণে তিনি বেঁচে গেলেও গ্রেনেডের আঘাতে তাঁর দলের ২৪ জন নিহত এবং ৩০০ জনের বেশি আহত হন। পঁচাত্তরের পর এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা এটি।

এগুলো ছাড়াও ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর ঢাকায়; ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামে; ১৯৯১এর ১১ সেপ্টেম্বর ঢাকার গ্রিন রোডে; ১৯৯৪ সালে ঈশ্বরদীতে; ১৯৯৫ সালে ঢাকার পান্থপথে; ১৯৯৬এ ঢাকার কার্জন হলসহ খুলনার রূপসা ব্রিজের কাছে, বরিশালের গৌরনদীতে তাঁকে গুলি করা হয়েছে। এমনকি ২০১২ সালে সামরিক বাহিনীর ১৫-১৬ সদস্যের দ্বারা পরিকল্পিত একটি ক্যু সফল হবার আগেই জানাজানি হয়ে গেলে তিনি প্রাণে বেঁচে যান।

কেন শেখ হাসিনার উপর এত আক্রমণ? এই প্রশ্নের উত্তরে হয়তো বলা যেতে পারে যে, তাঁর শাসনমলে প্রাপ্তির খাতা এতটাই পূর্ণ যে, অনেকের কাছে এখন তিনি ঈর্ষার পাত্র। তাঁর হাত দিয়ে বহু পুরাতন কিছু জাতীয় দ্বন্দ্ব সাফল্যের মুখ দেখেছে। দলমতনির্বিশেষে সকলে এই বিজয়গুলো বলছেন ঐতিহাসিক বিজয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার জন্য সব বাধা দূর করে বিচারকাজ শুরু এবং খানিকটা কার্যকর করতে পারায় অনেকে ভাবছেন তিনি বুঝি অপ্রতিরোধ্য। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচারের বাধাও দূর করে সে বিচার সম্পূর্ণ করায় কারও কারও পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেছে।

আরও কিছু কাজ রয়েছে তাঁর। এভাবে চললে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর কিংবা মালয়েশিয়ার মতো দেশ হয়ে যেতে পারে এই 'আশঙ্কা' যারা করেন অথবা বাংলাদেশ যাতে আঞ্চলিক শক্তিতে রূপান্তরিত হতে না পারে এমন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত যারা তারাও অপেক্ষাকৃত দুর্বল নতজানু একটি সরকারের আশায় শেখ হাসিনার শত্রুদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দৃশ্যপট থেকে তাঁকে সরাবার চেষ্টা করলে অবাক হবার কিছু নেই।

প্রশ্ন হল, একজন রাজনৈতিক নেতাকে হত্যা করার বিরামহীন পরিকল্পনা কি শুধু তাঁর নেতৃত্বের সফলতা-বিফলতার উপর নির্ভর করে, না এর সঙ্গে অন্য কিছুও জড়িত? শেখ হাসিনা কি একটি দলের প্রধান হবার কারণেই এই রোষানলে পড়েছেন, নাকি তিনি এমন কিছু করেছেন যাতে তিনি বেঁচে থাকা মানেই কারও কারও জন্য অধিক বিপদ!

শেখ হাসিনার পিতাকেও কিন্তু চল্লিশ বছর আগে হত্যা করা হয়েছিল চলমান গতি ঘুরিয়ে দেবার জন্য। একজন প্রেসিডেন্ট বা রাজাকে হত্যা করে অন্যজনকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবার মতো স্বাভাবিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ঘটনা ছিল না ওটি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার সময় তাঁর স্ত্রী, আট বছরের শিশুসন্তান, সদ্যবিবাহিত দুটি পুত্রসন্তান এবং তাদের স্ত্রীদ্বয়, বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ভাই এবং ভাগ্নে-ভাগ্নিসহ এই পরিবারের অরাজনৈতিক ব্যক্তিদেরও হত্যা করা হয়েছিল। ব্যাপারটা যে ক্ষমতা দখলের খেলা ছিল না বরং ছিল প্রতিশোধ নেবার পরিকল্পনা, সেটা এখন স্পষ্ট।

তাহলে ফিরে যাওয়া যাক সেই প্রশ্নে, কীসের প্রতিশোধ? তিনি এমন কী করেছিলেন যার জন্য পরিবারসহ তাঁকে জীবন দিতে হয়েছিল? বঙ্গবন্ধুর তিন বছরের শাসনামল তো দেশকে ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করতে করতেই চলে যাবার কথা। তাহলে প্রতিশোধের কারণ কি বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের বাইরের কিছু?

শেখ হাসিনাকে হত্যার ধারাবাহিক প্রচেষ্টা প্রমাণ করে যে, তিনি পিতার অসমাপ্ত কিছু কাজই করে যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু বাঙালির মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা দৃঢ় করেছিলেন। যে চেতনার বলে কারও বশ্যতা না মেনে জাতি হিসেবে বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে বাঙালি। যেহেতু বাঙালি একটি জাতিসত্তার নাম, তাই এই সত্তার রাজনৈতিক পরিচয় দিতে হবে। এই লক্ষ্যে নিজে একটি ভূখণ্ডের জন্য সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর সবচেয়ে বড় অহংকার ছিল, তিনি বাঙালি। তাঁর জীবদ্দশায় নেতিবাচক দৃষ্টি দিয়ে বাঙালিকে হেয় করার যত চেষ্টা হয়েছে ততবারই গর্জে উঠেছেন তিনি। তাই তাঁকে হত্যা করে হত্যাকারীরা কি চেয়েছিল 'বাঙালি' জাতিসত্তা ধ্বংস করে দিতে?

শেখ হাসিনা বাঙালি জাতির চেতনা কতটুকু উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছেন সেটা বড় প্রশ্ন নয়। তবে তিনি যে জাতির বিপক্ষ শক্তির লেজে পা দিয়ে রেখেছেন সেটা তার প্রাণনাশ প্রচেষ্টার তালিকা দেখলেই বোঝা যায়। দেশ ও জাতির শত্রু এবং শত্রুদের বন্ধুদের প্রতি অনেক বেশি কঠোর তিনি। কাজেই এমনটা বলা কি খুবই মন্দ শোনাবে যে, এবার শেখ হাসিনার বলে যাওয়া উচিত, 'আমি যদি হুকুম দিতে না পারি…'?

হাজার বছর লেগে গেছে বাঙালি জাতির নিজের রাষ্ট্র পেতে। আবার যেন কেউ এসে তার বিনাশ ঘটাতে না পারে। সে জন্য সবার জানা উচিত কোথায় কোথায় দুর্গ গড়ে তুলতে হবে, কোথায় কখন কী বন্ধ করে দিতে হবে। জানতে হবে 'বাঙালিকে দাবায়ে রাখতে না-পারার' নতুন উপায়।