নিরামিষ খাবার নিয়ে দুটি কথা

রেইনার এবার্ট
Published : 23 May 2015, 06:41 AM
Updated : 23 May 2015, 06:41 AM

আপনি কজন বাঙালিকে চেনেন যে সর্ষে ইলিশ ভালোবাসে না? কাচ্চি বিরিয়ানি অথবা গরুর রেজালা ছাড়া কোনো বাংলাদেশি বিয়ে কল্পনা করতে পারেন?

অনুমান করতে পারি আপনার উত্তর হবে, 'খুব বেশি না' অথবা 'একেবারেই না'। যদিও বাংলাদেশ সম্পর্কে আমার জ্ঞান সীমিত, আমি এটুকু জানি, বাঙালি মাংস ভালোবাসে, মুসলমানেরা হিন্দুদের থেকে বেশি; আর সব বাঙালি মাছ ভালোবাসে। সে জন্য মনে হতে পারে বাংলাদেশে প্রাণিদের অধিকার নিয়ে কথা বলা বাতুলতা। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ বিপরীত।

আমি ২০০৯ সালে প্রথম বাংলাদেশ যাই, আর সেই থেকে প্রতি বছর একবার বা দুবার সেখানে যাওয়া হয়। আমার মনে হয় বাংলাদেশের সেরা সম্ভাবনা তার প্রাণোচ্ছ্বল শিক্ষার্থী সম্প্রদায়। আমাকে আন্তরিকভাবে তারা নিজেদের মাঝে গ্রহণ করেছে এবং আমার কাজ আর দর্শন আমাকে ঢাকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থাপন করার সুযোগ দিয়েছে; এ জন্য আমি কৃতজ্ঞ। শুরুতে আমার মনোযোগ ছিল জ্ঞানের বিজ্ঞান, মানবাধিকার আর মূল্যবোধের দর্শন বিষয়ে।

সাম্প্রতিককালে যে বিষয়ে আমার সবচেয়ে বেশি ভাবনাচিন্তা তা নিয়ে কথা বলা শুরু করেছি; বিষয়টি হল প্রাণিদের অধিকার ও নীতিমালা। আমি ভেবেছিলাম, যে দেশে আমিষ সবার এত প্রিয় খাবার, সেখানে মানুষ আর প্রাণির সম্পর্ক নিয়ে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করার আগ্রহ থাকবে সীমিত। আমি ভুল ভেবেছিলাম। বাংলাদেশে ছাত্র-শিক্ষক উভয়ই এই আলোচনায় আগ্রহী, আর আমরা যেভাবে প্রাণিদের রক্ষণাবেক্ষণ করি তার নৈতিক সমস্যা নিয়ে অবগত। জীবজগতের আর সব প্রাণির মতোই মানুষ এক বিশেষ সম্প্রদায়, যদিও কথাটি আমরা মনে রাখি না। আসলে তর্কের শুরুটা হয়তো এখান থেকেই।

আমরা যে সমস্ত প্রাণিদের খাবার হিসেবে বা অন্য যে কোনো ভাবে ব্যবহার করি তারা যে শুধু আমাদের মতো তাই নয় বরং আমরাও তাদেরই মতো এক বিশেষ শ্রেণির প্রাণি। এটা প্রাণিবিদ্যার শ্রেণিকরণ এবং নীতিগত দিক থেকে অত্যন্ত জরুরি এক তথ্য। প্রাণিজগতের সব সদস্য কষ্ট আর আনন্দ অনুভব করে, আর এই পৃথিবীতে এদের বিশেষ উপস্থিতি বিদ্যমান। তাদের সঙ্গে কেমন আচরণ করা হয়, সে সম্পর্কে তারা সজাগ। তাদের বিশ্বাস ও ইচ্ছা আছে। অনেক প্রাণিই আত্মসচেতন, ভাষার ব্যবহারে সক্ষম। অনেক প্রাণির বোধশক্তি মানবশিশু আর অপরিণত বুদ্ধির মানুষ থেকে পরিপক্ক।

মানবজাতি আর প্রাণিজগতের অন্যান্য প্রাণির মাঝে স্বকীয় পার্থক্য আসলে খুবই কম, আমরা আমাদের নৈতিক অবস্থানের উচ্চতা জাহির করার সুবিধার্থে যে পার্থক্যে বিশ্বাস করি। যদি সকল মানুষকে সমানভাবে সম্মান করা মানবধর্ম হয় তবে সকল প্রাণিকেও শ্রদ্ধা করা উচিত। আমি বিশ্বাস করি, প্রাণিকে খাবার ও বস্ত্রের প্রয়োজনে অথবা বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ব্যবহার করা অন্যায়।

এ কারণে আঠার বছর আগে আমি মাংস খাওয়া ছেড়ে দিই এবং নয় বছর আগে পরিপূর্ণ নিরামিষাশী হয়ে যাই– সমস্ত প্রাণিজ খাদ্য, যেমন মাংস, মাছ, ডিম, দুধ বর্জন করে। যেসব খামারে কারখানার মতো পশুপাখি প্রতিপালন হয়, সেই নিদারুণ দুঃখের জীবন আর ভয়াবহ মৃত্যু কারও কাম্য নয়। তবে আমাদের মতো প্রাণিদের এ রকম জীবনে ঠেলে দেবার প্রয়োজন কী? এক সময় আমিষ ছাড়া মানুষ বেঁচে থাকতে পারত না, সেই অবস্থার আজ পরিবর্তন হয়েছে। বাঙালি রান্নায় আছে নিরামিষের অনেক রকম পদ– সবজির তরকারি, ডাল, ভর্তার সমাহার।

প্রাণিঅধিকার বিষয়ে এটা নিতান্তই প্রাথমিক যুক্তি, আর এর সমর্থনে আরও বহু কথা বলার অবকাশ রয়েছে। কিন্তু আশা করি বিষয়টির গুরুত্ব অন্তত পরিষ্কার হয়েছে। আমাদের সঙ্গে প্রাণিদের সম্পর্ক নিয়ে নতুন ভাবনার প্রয়োজন আছে কিনা সেই তর্কের আজ সময় এসেছে, আর এ ব্যাপারটি পণ্ডিতদের উপর ছেড়ে না দিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা করাই ভালো। যে বিষয় সবচাইতে মনোযোগের দাবি রাখে তা হচ্ছে, প্রাণিজ কৃষি। কেননা এতে অনেক বেশি সংখ্যক প্রাণি জড়িত, আর এই প্রাণির ব্যবহারও অন্য যেভাবে আমরা সাধারণত করে থাকি তা থেকে ভিন্ন।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা অনুযায়ী মানুষ খাদ্যের জন্য প্রতি সেকেন্ডে দুই হাজার প্রাণি হত্যা করে, মাছ ও সামুদ্রিক প্রাণি বাদ দিয়ে। যদি প্রাণির অধিকার থাকে, তাহলে প্রাণিজ কৃষিবিদ্যা নৈতিক বিপর্যয় এবং এর সমাপ্তি অতি জরুরি। এছাড়াও আমিষ বর্জনের আরও অনেক যুক্তিযুক্ত কারণ আছে। আমি চারজন বাংলাদেশির সঙ্গে কথা বলেছি যারা আমিষ বর্জন করেছেন। এই বর্জনের কারণগুলো তাঁদের কথাতেই শুনে নিই।

একান্ন বছর বয়সী তাপস নিরামিষাশী হবার সিদ্ধান্ত নিলেন; কারণ তিনি প্রাণিদের প্রতি নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে। তিনি একটি প্রামাণ্য চিত্র দেখেছিলেন, 'আর্থলিংস', যা সবার দেখা জরুরি। এই প্রামাণ্য চিত্র উনাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় মাংস, মাছ, ডিম, দুধের উৎপাদনে কতখানি নিষ্ঠুরতা জড়িত। ঊনি আমাকে বললেন যে, নিজের স্বাস্থ্য আর পৃথিবীর কল্যাণের কথা বিবেচনা করে উনি প্রাণিজ দ্রব্য ব্যবহার থেকে বিরত রয়েছেন। একটি সুষম উদ্ভিজ খাদ্যতালিকা ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, স্ট্রোক, কর্কট ইত্যাদি বিভিন্ন রোগের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়। তাপস আর তার স্ত্রী বিয়াল্লিশ বছরের তনুশ্রী, দুজনেই নিরামিষাশী। তাঁরা দাবি করেন যে, তাঁরা শারীরিক, মানসিক আর আধ্যাত্মিকভাবে সুস্থ আছেন।

পঁয়তাল্লিশ বছরের মিল্টন একমত হলেন যে, ''শারীরিকভাবে আমি অনেক ভালো আছি আর আমার শারীরিক অসুবিধাগুলো আমিষ ছেড়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গে দূর হয়ে গেছে।''

মিল্টন ছয় বছর নিরামিষাশী ছিলেন কিন্তু পরিবারের চাপে সম্প্রতি মাছ খাওয়া শুরু করেছেন। অন্য অনেকের মতো মিল্টনের পরিবারের সদস্যরাও ভুলভাবে বিশ্বাস করেন যে, নিরামিষ আহার হিন্দু আচার, যদিও ইসলাম অন্যান্য ধর্মের মতো সকল প্রাণির প্রতি সদয় হতে নির্দেশ দিয়েছে। বলিউডের নায়ক আমির খান, যিনি মুসলিম, সম্প্রতি তাঁর ভক্তদের অবাক করে নিরামিষাশী হয়েছেন। তাঁর প্রেরণায় তাঁর স্ত্রী যিনি বহুদিন ধরেই নিরামিষাশী, তাঁকে উদ্ভিজ খাবারের স্বাস্থ্যগত উপকারিতার উপর একটি প্রামাণ্য চিত্র দেখান। আমির বলেন, "প্রামাণ্য চিত্রটি আমাকে একটি সুস্থ জীবনের উপায় দেখিয়েছে। একমাত্র দইবড়া ছাড়া আমি ভালো সময় পার করছি। ওজনের কথা চিন্তা না করে আমি সব কিছুই খেতে পারি।"

"আমি যে কোনো প্রাণি বা পাখির প্রাণ হরণ না করেও যে বেঁচে থাকতে পারি, এটা মানসিকভাবে অত্যন্ত তৃপ্তিদায়ক''– বললেন পঞ্চান্ন বছরের দীপেন যিনি মাছ ছাড়া আর কোনো প্রাণি আহার করেন না। তাপসের মতো উনি পরিবেশজনিত উপকারের কথা উল্লেখ করে জানালেন, মাংস উৎপাদনের জন্য প্রাণির খাদ্যের দাবি মেটাতে ভূমির ব্যবহার করতে হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি বিশেষ চিন্তার বিষয় যেহেতু দেশের ভূমিসম্পদ সীমিত। দুধ, ডিম, মাংসের, বিশেষ করে গরুর মাংসের উৎপাদন ভূমি ব্যবহারের দিক থেকে ভীষণ অদক্ষ। সয়াবিন, চাল, ভুট্টা, বিভিন্ন রকমের ডাল, গম প্রতি একর ভূমিতে অনেক বেশি প্রোটিন উৎপন্ন করে।

প্রাণির খাদ্যের জন্য কৃষিকাজ পানিদূষণের আর পানির অপচয়ের গুরুত্বপূর্ণ কারণ। এক বেলা খাবারের জন্য গরুর মাংস উৎপাদনে ৪,৬৬৪ লিটার পানির প্রয়োজন কিন্তু মাত্র ৩৭১ লিটার পানি ব্যবহার করে একবেলার নিরামিষ আহার উৎপাদন সম্ভব। প্রাণির জন্য কৃষি যে পরিমাণ গ্রিনহাঊজ গ্যাস উৎপাদন করে পরিবেশ দূষণ করে তা পরিবহন ক্ষেত্রে উৎপন্ন গ্যাস থেকে বেশি, আর বিশ্বে ক্ষুধার পরিমাণ বৃদ্ধি করে। কেননা যে পরিমাণ ক্যালরি প্রাণিদের খাওয়ানো হয়, তার অতি অল্পপরিমাণ মাংস, ডিম বা দুধজাতীয় খাবাররূপে ফেরত আসে। এ পরিমাণ ক্যালরি সরাসরি পেলে মানুষ বহুগুণ উপকৃত হত।

প্রাণিজ কৃষি, যা কিনা বাংলাদেশে বেড়েই চলেছে (যেহেতু আরও বেশি মানুষ এখন মাংস কেনার সামর্থ্য রাখেন), আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য, পরিবেশের জন্য, প্রাণিদের জন্য চরম ক্ষতিকর। এই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করার সময় এসে গেছে।

আশা করি এই লেখা থেকে নিরামিষভোজী আর আমিষভোজী উভয় পক্ষই চিন্তার রসদ পেয়েছেন।

রেইনার এবার্ট: রাইস ইউনিভার্সিটির দর্শন বিভাগের পিএইচডি পদপ্রার্থী এবং অক্সফোর্ড প্রাণিনীতিশাস্ত্র সেন্টারের সহযোগী ফেলো।

অনুবাদ: মেহনাজ মোমেন।