ক্রসফায়ার নিয়ে প্রদর্শনী

শহিদুল আলম
Published : 16 March 2010, 08:13 AM
Updated : 16 March 2010, 08:13 AM

দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য নিয়ে ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ গঠন করা হয় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। পুলিশ, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের নিয়েই তৈরি হয় নতুন বাহিনীটি। বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং হেফাজতে নিয়ে নির্যাতনের জন্য র্যাবের সমালোচনা দিন দিন বাড়ছেই। বিভিন্ন মানবধিকার সংগঠন বলছে, জন্মের পর থেকে এই বাহিনী হত্যা করেছে শত শত মানুষ। এসব মৃত্যুই হয়েছে র্যাব এবং দুর্বৃত্তদের গোলাগুলির সময়। মানুষগুলো ক্রসফায়ারে পড়ে মারা যাওয়ার সময় ছিল র্যাবের হেফাজতেই। ক্রসফায়ারে অবশ্য এ যাবত কোনো র্যাব সদস্যের প্রাণহানি ঘটেনি। সম্প্রতি উচ্চতর আদালতের একটি বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত এক আদেশে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং র্যাবের কাছে একটি হত্যাকাণ্ডের ব্যাখ্যা চায়। এ বছরের ৯ জানুয়ারি এ নিয়ে সরকারের ব্যাখ্যা দেওয়ার শুনানি ছিল। কিন্তু এর আগে প্রধান বিচারপতি দৃশ্যত প্রশাসনিক কিছু কারণে বেঞ্চটিই ভেঙে দেন।

ক্রসফায়ার একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনী। প্রদর্শনীতে দেশের শীর্ষস্থানীয় আলোকচিত্রী শহিদুল আলম বহু আলোচিত সমালোচিত বিষয়টির দিকে রূপকাশ্রয়ী দৃষ্টিতে তাকিয়েছেন। মূলত প্রতীকধর্মী ছবিগুলোকে প্রকৃত ঘটনার খন্ড চিত্রের পরস্পরায় সাজানো হয়েছে।

ছবিগুলো সেইসব ঘটনাকে নতুন করে তুলে এনেছে যা সরকার বারংবার অস্বীকার করে এসেছে।


EJKS

ছিঁচকে এক ছিনতাইকারী ধরা পড়েছে একেবারে হাতেনাতে। ব্যাপার খুব বড় নয়। পুলিশ যখন সেই যুবককে ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল তখন অনুনয় ঝরছিল তার কণ্ঠে। বলছিল, বিষয়টি যেন তার পরিবারের কানে না যায়। পুলিশ তাকে কী করবে তার চেয়ে সমাজে সম্মান রক্ষাটাই তার কাছে তখন বড়। কিন্তু রাস্তার লোকেরা যখন বলাবলি করছিল তাকে ক্রসফায়ারে দেওয়া হতে পারে তখন আতঙ্ক ধরে যায় চোখে। যদিও র্যাব তাকে গ্রেপ্তার করেনি; থানাতেই নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তাকে। সে হয়তো ধারণা করছিল প্রভাবশালী কেউ তার জন্য থানায় ফোন করবে। কিংবা কিছু ঘুষ-টুষ দিয়ে শিগগিরই ছাড়া পেয়ে যাবে সে। আর পুলিশ যদি আরেকটু সহযোগিতা করে তবে পরিবারও বিষয়টি জানতে পারবে না। কিন্তু ক্রসফায়ার একেবারেই অন্য এক জিনিস। নানাভাবে করুণা ভিক্ষা করছিল সে কিন্তু আতঙ্ক তার সর্বাঙ্গ ছেয়ে ফেলে। সে জানত ক্রসফায়ার থেকে বাঁচার পথ একেবারেই সরু।

আমাদের শব্দসম্ভারে বেশ অনায়াসেই জায়গা করে নিয়েছে শব্দবন্ধটি। যথাপরিচিত সরকারি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিগুলোতে কেবল নাম আর স্থানের বদল ঘটে শুধু। ছবির দৃশ্যাবলীও অভিন্ন। উদ্বিগ্ন পরিবারগুলোর প্রাণান্ত চেষ্টা অমোঘ পরিণতি ঠেকানোর। লাশকাটা ঘরে মৃতদেহ। সরকারের বক্তব্যে সেইসব পুরোনো অভিযোগ, সন্ত্রাসী'। র্যাবের উদ্যোক্তা মওদুদ আহমদকে অস্ট্রেলীয় সাংবাদিক জন পিলজার 'ভদ্র ও সাহসী' মানুষ বলছিলেন বলে আমি খুব বিরক্ত হয়েছিলাম।

মওদুদের কথার পরতে পরতে ছিলো ন্যায় বিচার অগ্রাহ্য করার সুর।

"যদিও আপনারা টেকনিক্যালি একে বিচারবহির্ভূত বলতে পারেন। আমি কিন্তু বলবো না হত্যাকাণ্ড, বলবো বিচারবহির্ভূত মৃত্যু। মৃত্যু আর হত্যা কিন্তু এক জিনিস নয়… যাই -ই বলুন মানুষ কিন্তু খুশি।"

দুর্নীতিগ্রস্ত একটি পুলিশবাহিনী ও দুর্বল বিচার ব্যবস্থার অজুহাত দেখিয়ে আইনমন্ত্রী এরকম একটি বাহিনীকে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।

কালো পোশাক, সানগ্লাস, কালো রুমাল—কার মাথা থেকে এই সাজের ধারণা বের হয়েছিল তা ভেবে অবাক হই। একেবারে জল্লাদের পোশাক।

সংবিধানের কথা মনে পড়ে যায় আমার।

সংবিধানের ৩১ নং অনুচ্ছেদে "আইনের আশ্রয় লাভ এবং আইন অনুযায়ী ও কেবল আইন অনুযায়ী ব্যবহার লাভ" পাওয়ার কথা আছে।

অনুচ্ছেদ ৩২-এ বলা হয়েছে, "আইন অনুযায়ী ব্যক্তিগত জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা হইতে কোনো ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না।"

আইনমন্ত্রী এই বিষয়গুলো দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। তিনি এর অস্তিত্ব স্বীকার করেছিলেন অবশ্য। কার্যত দুই বছরের সামরিক বাহিনী অধিষ্ঠিত কেয়ারটেকার শাসনামলের 'ক্রসফায়ারকাল'কে 'ছদ্মবেশী সামরিক আইন' বলে অভিহিত করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।

গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তনের পর, ২০০৯ এর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলো এখন একটু বেসুরো শোনাচ্ছে। "বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ, দোষীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং মানবাধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতি" ছিল নির্বাচনী প্রচারণার বড় অংশ জুড়ে। এই প্রচারণার পরিণতিতেই বিপুল নির্বাচনী বিজয়।

নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যু সহ্য করা হবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। হত্যাকাণ্ড চলতেই থাকল। কিন্তু এইবার সরকার সরাসরি তা অস্বীকার করে বসলো। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জোরের সঙ্গেই দাবি করলেন, দেশে কোনো ক্রসফায়ার নেই। এরকম কখনো ঘটেওনি।

নিদ্রাকাতর বিচার বিভাগের ঘুম ভাঙল। স্বতঃপ্রণোদিত এক আদেশে উচ্চ আদালতের একটি বেঞ্চ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব ও র্যাবকে বিশেষ একটি হত্যাকাণ্ডের ব্যাখ্যা দিতে বললো। এর আগে নিহতদের পরিবারের সদস্যরা প্রার্থনা করেছিলেন যাতে তাদের পরিজনকে ক্রসফায়ারে দেওয়া না হয়। কিছুতেই কিছু হয়নি। আদালত উদিগ্ন হয়ে বললো, তাদের আদেশের পরও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চলছে। সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করার জন্য ঠিক করা শুনানির তারিখের ঠিক আগে প্রধান বিচারপতি বেঞ্চটিই ভেঙে দিলেন। দৃশ্যমান কারণ—প্রশাসনিক।

একজন আলোকচিত্রী হিসেবে প্রতিক্রিয়া জানানোর উপায় কী? সত্য উদঘাটন করা, কারো যুক্তিতর্ক ভালোভাবে তুলে ধরে জনগোষ্ঠীর বড় একটা অংশের কাছে তা পৌঁছানোর কাজ একজন সাংবাদিক করতে পারেন। সব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ক্রসফায়ার যখন চলতে থাকে, তখন? ক্রসফায়ারের পেছনের সত্যগুলো অজানা নয়। কোনো কোনো মানবাধিকার কর্মী, সুশীল সমাজের সদস্য যারা অন্যান্য বিষয়ে সোচ্চার, তারা এই বিষয়ে নিশ্চুপ; কিন্তু মানুষ নিজেরাই প্রতিবাদ করছে, আর এখন তো বিচার বিভাগও। আপাতদৃষ্টিতে 'স্বাধীন' বিচার বিভাগের যদি হাত-পা বেঁধে ফেলা হয় তাহলে বাকি থাকে কী?

তথ্য-প্রমাণ হাজির করা এই প্রদর্শনীর উদ্দেশ্য নয়। আমি বরং মানুষের আবেগকে স্পর্শ করতে চাই। হিমশীতল সড়ক ধরে হাঁটতে চাই। শুনতে চাই সেই আর্তনাদ; চোখ চেয়ে দেখতে চাই সেই বোবা আতঙ্ক। নিথর হয়ে পড়ে থাকা শীতল একটি লাশের স্বজনদের পাশে নিরবে বসে থাকতে চাই। এই প্রদর্শনীর প্রতিটি ছবির অন্তরালে রয়েছে গবেষণা। আছে প্রকৃত ঘটনার প্রতিফলন। যা করা হচ্ছে তথ্য প্রমাণ যাচাই সাপেক্ষে। খণ্ডচিত্রে সমগ্রচিত্র ধরা পড়ে। শ্বাসরুদ্ধ সত্যের উপমাচিত্র।

পেরুভিয়ান কিউরেটর হোরহে ভিয়াকোর্তে এবং গবেষক দলের মোমেনা জলিল, তানজিম ওয়াহাব ও ফারিহা করিম, আমরা একত্রে চেষ্টা করেছি এক ধরনের বাস্তব অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করতে। জানানোর চেয়ে জাগানোর চেষ্টাটাই প্রধান। গুগল মানচিত্র দেওয়ার কারণ মানুষ যাতে নিজেদের অভিজ্ঞতা সংযুক্ত করতে পারেন। স্থানীয় পর্যায়ের অভিজ্ঞতা সংগ্রহে তথ্য প্রবাহের গতানুগতিক পন্থার চেয়ে এটি বেশি কার্যকর। মানুষ হিসেবে আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রয়াস, এই প্রদর্শনী।

উচ্চ আদালতের এক বিচারক বলেছেন, "ফৌজদারি অপরাধে কাকে হত্যা করা উচিত তা বিবেচনার ভার আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া দেশ ও সমাজের জন্য আত্মঘাতী।"