সিটি নির্বাচন: অতঃপর শক্তির মহড়ায় কে কোথায়

আমানুল্লাহ কবীর
Published : 21 May 2015, 04:40 PM
Updated : 21 May 2015, 04:40 PM

কয়েক দিন আগের ঘটনা। সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর একটা টিভি চ্যানেলে টক শো শুরু হওয়ার আগমুহূর্তে ক্ষমতাসীন দলের মধ্যম সারির একজন সক্রিয় নেতার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। কথা প্রসঙ্গে তিনি বেশ হতাশার সুরেই বললেন, 'না, এদেশে আর রাজনীতি করা যাবে না। সমাজ Overpoliticised হয়ে গেছে।' এক পর্যায়ে আত্মসমালোচনায় সরব হয়ে উঠলেন। ক্ষমতাসীন দলের একজন নেতা হিসেবে নয়, একজন সচেতন নাগরিকের মতোই তিনি বিদ্যমান পরিস্থিতি ব্যাখ্যার চেষ্টা করলেন।

তার এই আত্মোপলব্ধিতে আশান্বিত বোধ করাই স্বাভাবিক। সমাজের অতিরাজনীতিকরণ অর্থেই তিনি Overpoliticised কথাটা ব্যবহার করেছেন। অতিরাজনীতিসচেতনতা থেকেই অতিরাজনীতিকরণ করা হয়েছে কিনা, তার কথায় এর ব্যাখ্যা না থাকলেও অতিরাজনীতিকরণ কথাটা তিনি বলেছেন অশুভ ইঙ্গিত করে। একটা সমাজ রাজনীতিসচেতন হলে দোষের কিছু নেই, কিন্তু সমাজের অতিরাজনীতিকরণ করা হলে তা নিশ্চয়ই শঙ্কার কারণ। অতিরাজনীতিকরণের মধ্যে দলীয় গন্ধ রয়েছে, তা সহজেই অনুমেয়। আমাদের রাজনীতিতে এত সংঘাত-সংঘর্ষের উৎস এই অতিরাজনীতিকরণ, যার কঠিন ও নির্মম অভিজ্ঞতা দলমতনির্বিশেষে সকলেরই রয়েছে।

আমার গত নিবন্ধে লিখেছিলাম, 'গণতন্ত্রের বিজয়ই জনগণের বিজয়'। আর সে বিজয় অর্জিত হয়েছে কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে; কেননা আমাদের সামনে গণতন্ত্রের মাপকাঠি একমাত্র দলীয় জয়-পরাজয়। অতিরাজনীতিকরণের ফলেই নির্বাচনে দলীয় জয়-পরাজয়ের বিষয়টি মূখ্য হয়ে উঠেছে, গৌণ হয়ে গেছে গণতন্ত্রের জয়-পরাজয়।

নানা রাজনৈতিক কারণেই সিটি নির্বাচন ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদিও সিটি করপোরেশনের মতো স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হয় না, কিন্তু আগামীতে রাজনীতি কোন দিকে প্রবাহিত হবে, জাতীয় নির্বাচন কীভাবে অনুষ্ঠিত হবে এবং সরকার পরিবর্তন কতটা সুষ্ঠুভাবে হবে, তা বহুলাংশেই নির্ধারিত হবে সিটি করপোরেশনের ফলাফল দ্বারা। অথচ সংবিধান অনুসারেই সিটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা নির্দলীয় ভিত্তিতে। কিন্তু তাতে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত হয়েছেন দলের সর্বোচ্চ নেতানেত্রীসহ এমপি-মন্ত্রীরা। দলের পক্ষ থেকে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বেও ছিলেন তারাই। এজেন্ট থেকে শুরু করে মাঠে নির্বাচনী প্রচারণায়ও ছিলেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা। নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে কোথাও কোথাও বহিরাগত দলীয় নেতাকর্মীরাও শরিক হয়েছেন নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে।

তিন সিটির মেয়র নির্বাচনে দুজন প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক নেতা ছাড়া আর সকলেই ছিলেন নিম-রাজনীতিক, অর্থাৎ তাদের কেউ রাজনৈতিক অ্যাকটিভিস্ট ছিলেন না। মির্জা আব্বাস, আ জ ম নাসিরউদ্দিন, মঞ্জুরে আলম ও আনিসুল হক ছাড়া আর যারা মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন তারা নবপ্রজন্মের। আনিসুল হক বয়সের কারণে নবপ্রজন্মের না হলেও মানসিক তারুণ্যের কারণে মিশে গিয়েছিলেন নবপ্রজন্মের প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে। বিশেষত ঢাকার উত্তর সিটির দৃশ্যপট ছিল উল্লেখযোগ্যভাবে ভিন্ন। শক্তির মহড়ার পরিবর্তে মহড়া হয়েছিল নতুন নতুন ধ্যান-ধারণার।

সে সব প্রতিশ্রুতি বর্তমান ব্যবস্থায় কতটুকু বাস্তবায়নযোগ্য, সেটা পরের কথা, কিন্তু আধুনিক নগরজীবনে নাগরিক সেবা প্রদানের যে ব্যাপক তাগিদ ও সম্ভাবনা রয়েছে, তা তুলে ধরে তারা নাগরিকদের অধিকারসচেতন করেছেন। এসব ধ্যান-ধারণার অনেকগুলোই ছিল welfare stateএর concept থেকে উদ্ভূত। এর আংশিক প্রতিফলন ছিল দক্ষিণ সিটিতে। চট্টগ্রামে নবপ্রজন্মের স্পর্শ পড়েনি, মেয়র প্রতিদ্বন্দ্বীদের সব প্রতিশ্রুতিই ছিল গতানুগতিক। নবপ্রজন্মের প্রতিদ্বন্দ্বীদের এসব ধ্যান-ধারণা মাঠে মারা যায় যখন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় চিরবৈরী দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে। অতিরাজনীতিকণের ফলে সমাজে যে চিড় ধরেছে তারই প্রতিফলন ঘটে ভোটের ফলাফলে।

নির্দলীয় নির্বাচন নিয়ে সরগরম হয়ে উঠেছে দলীয় রাজনীতি। প্রভাব পড়েছে জাতীয় রাজনীতিতেও। অতীত রেকর্ডের তুলনায় নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হলেও কতটুকু অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া। এর প্রধান কারণ, তিনটি সিটিতেই একতরফাভাবে জয়ী হয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থীরা। প্রতিক্রিয়া দেশের সীমান্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, ছড়িয়ে পড়েছে সীমান্তের বাইরেও, আন্তর্জাতিক মহলে। মনে হয়, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মহল, বিশেষত পশ্চিমা দেশগুলো খুব স্পর্শকাতর। তাদের মধ্যে এই স্পর্শকারতা সৃষ্টির পেছনে কি দায়ী আমাদের রাজনীতিকরা, না কোনো দুরভিসন্ধি?

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য ও দলের নেতানেত্রীরা বলছেন, নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করার উদ্দেশ্যেই বিএনপি ভোটের দিনে মাঝপথে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয় ভোট শুরু হওয়ার কয়েক ঘণ্টার (সাড়ে তিন থেকে সাড়ে চার ঘণ্টা) মধ্যে। বর্জনের ঘোষণা অনেকের কাছেই আচমকা মনে হয়েছে। অর্থাৎ এ ঘোষণার জন্য তারা মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল না। বর্জনের সিদ্ধান্তের আগে একবার প্রেস ব্রিফিং করে পুরো পরিস্থিতি দেশবাসীকে জানানোর প্রয়োজনও মনে করেননি বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। অনেকে ধারণা করেছিল, নির্বাচন বর্জন করে তারা হয়তো আন্দোলনের কর্মসূচি দেবেন। কিন্তু বর্জনের ঘোষণা দেওয়ার পর সেই যে মুখে কুলুপ এঁটেছেন, আর কোনো উচ্চবাচ্য নেই। সবাই যেন স্বেচ্ছানির্বাসনে চলে গেছেন।

এদিকে তিন সিটিতেই জয়লাভ করে তাকে defend করতে হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলকে। অর্থাৎ জিতেও তারা defensiveএ পড়ে গেছে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জিতেছে, এটা দোষের কিছু নয়, কিন্তু জয়টা অবাধ ও নিরপেক্ষ ভোটে হয়েছে কিনা, প্রশ্নটা সেখানেই। সিপিবি, বাসদ, এলডিপির মতো ছোট দলগুলো, যাদের সমর্থিত প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে তারা নিশ্চিত ছিল যে, তাদের প্রার্থীদের জয়লাভের সম্ভাবনা নেই। কিন্তু তারাও নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সমালোচনামুখর।

ভোটের দিন যে সব ঘটনা ঘটেছে, তা সংক্ষেপে এরূপ: ভোটকেন্দ্র দখল, পোলিং এজেন্ট বের করে দেওয়া, জাল ভোট প্রদান, ভোটারদের অবাধে ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দেওয়া, এসব কর্মকাণ্ডে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা (সক্রিয়ভাবে অথবা নিষ্ক্রিয় থেকে) এবং সর্বোপরি নির্বাচন কমিশনের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা।

নির্বাচনে বিএনপি প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে এজেন্ট দিতে পারেনি, এ বক্তব্য আংশিক সত্য, পেছনের পুরো সত্যটা অন্য রকম। বিএনপির অসংখ্য নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে। আবার মামলা ও গ্রেফতারের ভয়েই অনেকেই ঝুঁকি নেওয়ার সাহস করেনি। তাছাড়া সম্ভাব্য এজেন্টদের কারও কারও বাসায় ভোটের দু-তিনদিন আগ থেকে পুলিশের হানা ও ভয়ভীতি প্রদর্শন, যা আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরাও করেছে। ফলে বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীদের অনেকেই বাসাবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন অথবা ফেরারি আসামির মতো পালিয়ে বেরিয়েছেন। বিএনপির চিহ্নিত সমর্থকরাও ভয়ে ভোটকেন্দ্রে যাননি। এক ধরনের নিরব ভীতিকর পরিবেশের মধ্যে ভোট হয়েছে। যে কারণে ভোটজালিয়াতি ও কেন্দ্র দখলের বিরুদ্ধে পাল্টা প্রতিবাদ গড়ে উঠেনি।

এ ব্যাপারে ক্ষমতাসীন দল ও নির্বাচন কমিশন তাদের দায়-দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারে না। তবে বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতা তাদের এই দুষ্কর্মের পথই নিষ্কণ্টক করেছে। লক্ষ্যণীয় যে, নিজেদের সাংগঠনিক দুর্বলতা সম্পর্কে অবগত বলেই সিটি নির্বাচনের পর আনুষ্ঠানিকভাবে দলীয় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করে নির্বাক হয়ে রয়েছে, যা অস্বাভাবিক মনে হয়েছে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের কাছে।

প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, আমরাও দেখেছি, সিটি নির্বাচনে কোনো খুন-খারাবি হয়নি। এটা নিঃসন্দেহে নজিরবিহীন ও উল্লেখযোগ্য ঘটনা। যে দেশে খুন-খারাবি ছাড়া ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয় না, সেখানে একযোগে অনুষ্ঠিত তিন সিটি নির্বাচন তেমন অঘটন ছাড়াই সম্পন্ন হল, এটা কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। সুতরাং এতে আমাদের আহলাদিত হওয়ারই কথা। এর একটা প্রধান কারণ যে, প্রতিপক্ষ অত্যন্ত দুর্বল ছিল। লড়াইটা বাঘে-মহিষে হলে চিত্রটা ভিন্ন হত।

ভিন্ন না হওয়ার আরেকটা বড় কারণ, যে রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে আমরা ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত, সিটি নির্বাচনের প্রচারণায় তার অনুপস্থিতি। সম্ভবত আমাদের গতানুগতিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে এখনও অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেননি বলেই, বিশেষত তরুণ মেয়রপ্রার্থীরা পরস্পরের বিরুদ্ধে খিস্তি-খেউড়, বিষোদ্গার ও উস্কানিমূলক বক্তব্য না দিয়ে বরং বন্ধুত্বমূলক পরিবেশেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা যায়, সেই নজির স্থাপন করেছেন। আমাদের আহলাদিত হওয়ার এটাই বড় ঘটনা।

এটা যদি নবপ্রজন্মের রাজনৈতিক সংস্কৃতি হত তাহলে সংঘাতময় রাজনীতির পথপরিক্রমা দুঃস্বপ্নের মতো দীর্ঘ হত না এবং অতিরাজনীতিকরণের পথও সংক্ষিপ্ত হয়ে আসত। কিন্তু আমাদের রাজনীতিকরা যে রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিচর্যা করছেন, তা সংক্রামক ব্যাধির মতো তরুণ সমাজকে কেবল উদরপূর্তির আদর্শেই অনুপ্রাণিত করছে। তাতে বহুল প্রচলিত প্রবাদ উল্টে গিয়েছে– শিষ্টের দমন চলছে আর দুষ্টের পালন হচ্ছে। যে শিক্ষাঙ্গন এক সময় ছিল মানুষ গড়ার কারখানা, এখন তা পরিণত হয়েছে 'দুষ্টের' পালন কেন্দ্রে। এই দুষ্ট পালন কেন্দ্রের 'দুষ্ট' ছাত্রদের কখনও ভোটজালিয়াতি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, আবার কখনও যাবতীয় দুনীতির জন্য প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াত।

তাদের লালিত সংস্কৃতির আদলে তরুণ সমাজকে প্রশিক্ষিত করে তোলা হচ্ছে ছাত্রাবস্থা থেকেই। সমাজের অতিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়ার এটা প্রথম পাঠ। ফলে মেধাশক্তির পরিবর্তে সমাজ অর্চনা করছে পেশীশক্তির। নিয়োগের বেলায়ও রাজনৈতিক বিবেচনার পেশীশক্তি প্রাধান্য পাওয়ায় সরকারি আধা-সরকারি, এমনকি বিচার বিভাগও দিনে দিনে মেধাশূন্য হয়ে পড়ছে। সরকার নিজেও নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে রাষ্ট্র-নিয়োজিত পেশীশক্তির উপর। আমরা এই রাষ্ট্রীয় পেশীশক্তির মহড়াই দেখছি আজকের অতিরাজনীতিকরণে। এ পেশীশক্তির হাত পুলিশ-র‌্যাব থেকে শুরু করে বিচার বিভাগ পর্যন্ত প্রলম্বিত।

বর্তমান সরকারের অধীনে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের নজির হিসেবে প্রায়শ অতীতের পাঁচ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের উল্লেখ করা হয়ে থাকে। ওই পাঁচ সিটিতে নিঃসন্দেহে নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছিল এবং তাতে চারটিতেই বিএনপি-সমর্থিত মেয়রপ্রার্থীরা জয়ী হয়েছিলেন। নির্বাচিত প্রতিনিধি হয়েও তারা কি স্ব-স্ব চেয়ারে টিকে থাকতে পেরেছেন? ইতোমধ্যে তিনজনকে নানা অভিযোগে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে এবং তাদের দিন কাটছে কারার অন্তরালে। একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে বিএনপি-সমর্থিত অনেক উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস-চেয়ারম্যান ও কাউন্সিলরদের ক্ষেত্রে। তাদের পরিবর্তে মেয়র ও চেয়ারম্যান হিসেবে যারা দায়িত্ব করছেন তাদের প্রায় সকলেই আওয়ামী লীগ-সমর্থিত কাউন্সিলর।

সুতরাং তথাকথিত অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনই যে শেষ কথা, তা নয়। অথচ একই ধরন নয়, তার চেয়ে গুরুতর অপরাধের জন্য নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর কুখ্যাত খুনের আসামি পলাতক নূর হোসেন দীর্ঘদিন বহাল-তবিয়তেই ছিল। এ নিয়ে মিডিয়া সোচ্চার হওয়ার পরেই কেবল তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়।

আইন আছে বটে যে বিশেষ অপরাধের জন্য স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বরখাস্ত করা যাবে। কিন্তু একজন নির্বাচিত প্রতিনিধি আমলার কলমের এক খোঁচায় যখন-তখন বরখাস্ত হয়ে যাবেন, এ কেমন গণতান্ত্রিক নীতি-নৈতিকতা? এ আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষে সাফাই গাওয়ার জন্য অবশ্য যুক্তরাজ্যসহ (যেহেতু ব্রিটিশ গণতন্ত্রের কথা আমরা প্রায়ই বলে থাকি) অনেক দেশের উদাহরণই হাজির করা যাবে, কিন্তু তাতে কি নীতি-নৈতিকতার প্রশ্নটি শেষ হয়ে যাবে?

যাহোক, সিটি নির্বাচন প্রক্রিয়ার শুরুতে যা শুভ সূচনা বলে প্রতীয়মান হয়েছিল, শেষটা কি শুভ দিনের ইঙ্গিত করে? বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, সিটি নির্বাচন সরকার, নির্বাচন কমিশন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য টেস্ট কেইস। এ কথা বলে তিনি প্রকারান্তরে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতাই চ্যালেঞ্জ করেছিলন। তাঁর এই চ্যালেঞ্জ কীভাবে গৃহীত হয়েছিল, তা নির্বাচনের ফলাফলের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে। নির্বাচনের একতরফা বিজয় যে ক্ষমতাসীন জোটের সকল শরিক দলের নেতা-মন্ত্রিদের জন্য স্বস্তিদায়ক ছিল, তা নয়। প্রকাশ্যে না বললেও তাদের অনেকেই মনে করেন সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এত বাড়াবাড়ির দরকার ছিল না, বরং বিভক্ত ফলাফল সরকার ও নির্বাচন কমিশনের আস্থা ও বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনে সহায়ক হত। অবশ্য বিএনপি যখন মাঝপথে নির্বাচন বর্জন করেও তাকে ইস্যু করতে ব্যর্থ হয়েছে, তখন বিষয়টি অল্পেই চাপা পড়ে গেছে।

বিএনপির কিছু নেতা এই বলে আত্মতৃপ্তি লাভের চেষ্টা করছেন যে, সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকারের বলপ্রয়োগ ও ভোটজালিয়াতি এবং তাতে নির্বাচন কমিশনের নিস্ক্রিয়তা ও সহযোগিতা প্রমাণ করে ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন বর্জন করার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তের কারণে রাস্তায় নিক্ষিপ্ত হওয়ার পরও তাদের হুঁশ ফেরেনি। নির্বাচন বর্জন যদি বিএনপির রাজনৈতিক সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়ায় তাহলে দল গোছানোর দরকার নেই। আমাদের রাজনীতি সম্পর্কে তাদের প্রাথমিক ধারণাও নেই যে, এ দেশের জনগণ নির্বাচনমুখী; রাজনৈতিক দলগুলোও, বিশেষত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নির্বাচনমুখী। নির্বাচন তাদের প্রধান উপজীব্য। নির্বাচনে অংশগ্রহণ ছাড়া তাদের পক্ষে অস্তিত্ব টিকেয়ে রাখা সম্ভব নয়, যদিও ছোট দলগুলোর জন্য তেমন ঝুঁকি নেই।

সিটি নির্বাচনের পর বিএনপি আন্দোলনের কর্মসূচি না দিয়ে ঘর গোছানোর কথা বলছে। যাদের নিয়ে ঘর গোছাবে, দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য খোন্দকার মোশাররফ হোসেন, গয়েশ্বর রায়, যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় নেতাই কারারুদ্ধ। মাথায় গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে অনেকেই পলাতক। আবার মামলা-মোকদ্দমার ভয়ে বহু কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতা নিস্ক্রিয়।

দীর্ঘ দুমাস পরে আরেক যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমদের সন্ধান মিললেও আইনি জটিলতার কারণেই ভারত থেকে সহসা নিস্কৃতি পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। দেশেও তাকে ফিরতে হবে আসামি হয়েই এবং তার অবস্থান হবে শ্রীঘরে। মেঘালয়ে তার আকস্মিক আবির্ভাব নিয়ে নানা প্রশ্ন উত্থাপন করে জটিলতা ও রহস্য সৃষ্টি করা হয়েছে ভারত-বাংলাদেশ উভয় দেশেই। এই রহস্য উদঘাটনের প্রক্রিয়ায় দুই দেশের সরকারের হাতে তাকে যেভাবে নাজেহাল হতে হবে, তাতে তার প্রাণ হয়তো ওষ্ঠাগত হবে।

তাছাড়া খালেদা জিয়া স্বয়ং পাঁচটি মামলার আসামি এবং দুটি মামলা বর্তমানে বিচারাধীন। অবরোধ ও নাশকতার জন্য ইতোমধ্যে তাঁকে হুকুমের আসামি করে দুটি মামলার চার্জশিটও দাখিল করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের আরও কয়েকটি মামলা হতে পারে। তাঁর বিরুদ্ধে এসব মামলার প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু করার জন্য স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন।

সুতরাং ঘর গোছাতে চাইলেও বিএনপি কাদের দ্বারা, কীভাবে, কতদিনে ঘর গোছাতে পারবে তা অনিশ্চিত ব্যাপার। বিএনপির কোনো কোনো নেতা বলেছেন, ঘর গুছিয়ে আগামী নভেম্বরে তারা সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু করবেন। কিন্তু বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে তাদের এই হিসাব ধোপে টিকে না। আর এই সময়ের মধ্যে সরকার তাদের ঘর গোছানোর অবাধ সুযোগ দেবে, তা প্রত্যাশার কোনো যুক্তি নেই। বরং বিএনপির এই দুর্বল অবস্থা আরও কীভাবে দুর্বলতর করা যায়, তার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থাই গ্রহণ করবে। কেননা বিএনপিকে যত দুর্বল করা যাবে, সরকার তত সবল হবে।

বিএনপি তার শক্তি সংগঠিত ও সংহত করে আন্দোলনে নামতে না পারলে, যারা বাদলা দিনে কাঁথার নিচে শুয়ে বহিঃশক্তির সহযোগিতায় ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন, তাদের স্বপ্ন কখনও আলোর মুখ দেখবে না।

সমাজে ক্ষমতার ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার জন্যই আন্দোলন দরকার। একতরফা নির্বাচন ও শাসনের ফলে প্রশাসন থেকে শুরু করে সর্বস্তরে যে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়েছে তাতে গণতন্ত্রচর্চার বিকাশ ও স্থিতিশীলতার পথ দুই-ই বিঘ্নিত হচ্ছে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন আগে, গণতন্ত্র পরে– এ কথার সমর্থনে সরকারের নীতিনির্ধারকদের অনেকে সিঙ্গাপুর, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া ও মালয়েশিয়ার উদাহরণ হাজির করেন। তারা তখন নিজের দেশের ইতিহাসই ভুলে যান যে, এদেশের মানুষ সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রাম করেছে এবং মুক্তিযুদ্ধের তাৎক্ষণিক কারণ ছিল গণতন্ত্র। এ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা অতীতে স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব করেছেন; তারপর জিয়াউর রহমান ও জেনারেল এরশাদও করেছেন। কিন্তু তাদের কেউই সফলতার নজির স্থাপন করতে পারেননি।

নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের সাময়িক ফলাফল যা-ই হোক, প্রতিবেশি দেশসহ দাতাদেশগুলো যত সমর্থনই দিক, চূড়ান্ত বিশ্লেষণে তা শুভ হতে পারে না। সাচ্চা গণতন্ত্র অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে প্রতিবন্ধক হলে এ পদ্ধতি বিশ্বে বহুদিন পূর্বেই পরিত্যক্ত হত। তা না হয়ে বরং গণতন্ত্রে জনগণের ক্ষমতায়ন আরও কত সুচারুভাবে বৃদ্ধি করা যায়, সে পরীক্ষা-নিরীক্ষাই চলছে। ক্ষমতার স্বেচ্ছাচারী ব্যবহার বন্ধ ও সমাজে ভারসাম্য রক্ষার জন্য শক্তিশালী বিরোধী দলের প্রয়োজনীয়তা এখন আর পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যাপার নয়।

বর্তমান বিশ্বে আরেকটি বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে লক্ষ্যণীয়। গণতন্ত্রবিহীন দেশগুলোতে, বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের সমাজে সহজেই জঙ্গিয়ায়ন করার নীলনক্সা সফলতা পেয়েছে। ফলে ধর্মীয় জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। প্রাথমিক স্তরে হলেও বাংলাদেশেও অনুরূপ ঘটনা ঘটছে। মুক্তমনা লেখক ও ব্লগাররা একের পর এক উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীর হামলার শিকার হচ্ছে। সমাজ বিভক্ত রেখে ধর্মীয় জঙ্গিবাদের মতো দানবের মোকাবিলা সম্ভব নয়। এ জন্য দরকার গণতান্ত্রিক সমঝোতা ও অগ্রগতি, যা জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য অপরিহার্য।

সংকীর্ণ ক্ষমতাকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যে যা-ই বলুন, ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হলেও গণতন্ত্র রক্ষা ও প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় তারা পরস্পরের পরিপূরক বা সহায়ক শক্তি। এই দুটি প্রধান দল এই কঠিন বাস্তবতা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হলে গণতন্ত্রে বিপর্যয়ের আশংকা থেকেই যাবে।

আমানুল্লাহ কবীর: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সিনিয়র এডিটর।