প্রসঙ্গ: সাগরপথে মরণযাত্রা

ফরহাদ আল করিম
Published : 19 May 2015, 06:58 AM
Updated : 19 May 2015, 06:58 AM

মালয়েশিয়ার সীমান্ত সংলগ্ন থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলের দ্বীপ শংখলা প্রদেশের জঙ্গলে বেশ কিছু গণকবরের সন্ধান মিলেছে যা সম্প্রতি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করা হচ্ছে। এই ঘটনায় জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা উদ্বেগ প্রকাশ করে মানবপাচারের বিরুদ্ধে থাই সরকারকে দ্রুত কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেছে। আন্তর্জাতিক সমালোচনা ছাড়াও অবস্থার ভয়াবহতা দেখে দেশটির জান্তা সরকারের টনক নড়েছে। থাই পুলিশের চেষ্টায় বন্দিদশা থেকে বেশ কজনকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। দুঃসংবাদ হল, গণকবরগুলোতে শায়িত হতভাগ্য মানুষজনের মধ্যে আমাদের দেশের নাগরিকও রয়েছেন বলে জানা যায়।

পাচারকারীদের খপ্পর থেকে রেহাই পাওয়া ভুক্তভোগীরা সবাই প্রতারণার শিকার। তারা জানিয়েছেন, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার সীমান্ত সংলগ্ন জঙ্গলে পাচারকারীদের বেশ কিছু ক্যাম্প রয়েছে। সেখানে বর্তমানে কয়েক হাজার অভিবাসনপ্রত্যাশী শ্রমিক বন্দি অবস্থায় রয়েছেন। এলাকাগুলোর আশেপাশে আরও কিছু গণকবরের অস্তিত্ব মিলেছে।

মূলত বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের দরিদ্র নাগরিকদের প্রলোভন দেখিয়ে সাগরপথে মালয়েশিয়া পাঠানোর নাম করে প্রথমে থাইল্যান্ডের দ্বীপে এনে জড়ো করা হয়। পরে পাচারকারীরা কৌশলে তাদের ক্যাম্পে আটকে রেখে পরিবারের কাছ থেকে ফোনে মুক্তিপণ আদায় করে গন্তব্যে পৌছে দেয়। যারা মুক্তিপণ দিতে পারে না তাদের ক্যাম্পে আটকে রাখা হয়। পাচারকারীদের হাতে আটকে পড়া বন্দিদের কিছু অংশ খাবার ও চিকিৎসার অভাবে মারা গেলেও যারা মুক্তিপণ দিতে ব্যর্থ হন তাদের বেশিরভাগকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এটি যেমন মানবাধিকারের স্বার্থে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক, তেমনি শ্রমঅভিবাসনের জন্য অশনিসংকেত।

আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে হোক কিংবা বর্তমান ঘটনার তীব্রতা আঁচ করেই, থাই সরকার পাচারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রেখেছে। এর ফলে পাচারকারীরা ক্যাম্প পরিবর্তন করছে। কখনও কখনও স্থলবন্দরে না ভিড়ে সাগরে ভাসার কৌশল নিয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা আইওএম ধারণা করছে, থাই সরকারের কঠোর অভিযানের ফলে পাচারকারীদের দোসররা প্রায় ৮ হাজার অভিবাসীকে নিয়ে নদীতে ভাসছে; সুবিধাজনক সময়ে তারা তীরে ভিড়তে পারে। আইওএমএর আশঙ্কা অমুলক ছিল না। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার উপকূলীয় সীমান্তে থেকে প্রায় ৩ হাজার অভিবাসীকে সাগর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে যেখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশিও ছিলেন।

মিয়ানমারের গত বছরের জাতিগত দাঙ্গার কারণে সংখ্যালঘুরা নিরুপায় হয়ে বাংলাদেশ সীমান্ত ছাড়াও অন্যান্য দেশে পাড়ি জমানোর চেষ্টা করছেন। তবে গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ থেকেও বেশ কিছুসংখ্যক অসচেতন মানুষ উন্নত জীবনের আশায় সাগরপথে বিদেশে যেতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। এই পথে বিদেশে যেতে গিয়ে কেউ দালালের হাতে প্রতারিত হয়ে অর্থসম্পদ খোয়াচ্ছেন কেউ কেউ; কেউ-বা প্রাণ দিচ্ছেন। ঝুঁকিপূর্ণ পথ জেনেও থামছে না এই মরণযাত্রা।

২০১২ সালে সম্পাদিত চুক্তি অনুসারে সরকারিভাবে কম খরচে ৫ লাখ শ্রমিক মালয়েশিয়ায় পাঠানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও বাংলাদেশ থেকে এ পর্যন্ত সর্বসাকুল্যে ৮ হাজার শ্রমিক যেতে পেরেছেন। অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের মতে, একদিকে এজেন্সির মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার প্রক্রিয়াটি সাময়িক বন্ধ থাকায় এবং সরকারি উদ্যোগে ধীরগতির সুযোগ কাজে লাগিয়ে কতিপয় অসাধু মানবপাচারকারী আগ্রহীদের সাগরপথে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার নতুন ব্যবসা চালু করেছে।

মানবপাচারকারীর ফাঁদে পড়ে কক্সবাজার জেলার ৬০টি পয়েন্ট থেকে নিয়মিতভাবে ট্রলারে করে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন কেউ কেউ। ফিটনেস সার্টিফিকেটবিহীন ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ধারণক্ষমতার চেয়ে অধিক লোক নিয়ে এই যাত্রায় নৌকাডুবি, নৌকার জ্বালানি সংকট, খাবার সংকট, জলদস্যুর আক্রমণ ও ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা ঘটছে। ঝুঁকিপূর্ণ এ পথে মালয়েশিয়া যাত্রা করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত নৌকাডুবিতে কত মানুষের সলিলসমাধি ঘটছে, তার হিসাব আমাদের কারও কাছে নেই।

গত বছর এভাবে কিছু শ্রমিকের মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টাকালে নদীপথে খাবার সংকটে পড়লে সকলের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। পাচারকারীরা তখন তাদের উপর নির্বিচারে গুলি চালায়। তাতে ৫ জন মারা যায়। আহত হয় অন্তত ৪০ জন। কোস্টগার্ডদের বিভিন্ন সময় নৌকাসহ পাচারকারীদের আটক করতে দেখা যায়। তবে এসব প্রতারকদের এ পর্যন্ত আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। ফলে এই চক্রটি ক্রমশ আরও সক্রিয় হয়ে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের প্রভাবিত করছে। থাই জঙ্গলে আবিস্কৃত গণকবরগুলো আজ তারই সাক্ষ্য দিচ্ছে।

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার মতে, এ বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত প্রায় ২৫ হাজার বাংলাদেশি ও মিয়ানমান সাগরপথে বিদেশে গেছেন যা গত বছরের একই সময়ের দ্বিগুণ। এদের অন্তত ৩০০ জনের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু ঘটেছে। সংস্থাটির প্রকাশিত 'ইরেগুলার মেরিটাইম মুভমেন্ট ইন সাউথ ইস্ট এশিয়া' শিরোনামের এক প্রতিবেদন মতে, শুধুমাত্র ২০১৪ সালে প্রায় ৫৪ হাজার মানুষ উন্নত জীবিকার খোঁজে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ অন্যান্য দেশে গেছেন, যাদের বেশিরভাগ বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের নাগরিক।

বর্তমানে সরকারিভাবে মালয়েশিয়া যেতে সর্বসাকুল্যে ৩২ হাজার টাকা খরচ হলেও নাম রেজিস্ট্রেশন, পাসপোর্ট ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের দরকার হয়। কিন্তু দালালের মাধ্যমে সাগরপথে যেতে চাইলে টাকার অংক বেশি লাগলেও পাসপোর্ট ও অন্যান্য কাগজপত্রের তেমন ঝামেলা থাকে না। সহজ-সরল দরিদ্র মানুষজন তাই ভাগ্যের অন্বেষণে দেনা করে জীবনবাজি রেখে দ্রুত সময়ের মধ্যে বিদেশে পাড়ি দিতে আগ্রহী হন। বাস্তবতা হল, এভাবে মাত্র সামান্য সংখ্যক অভিবাসপ্রত্যাশী গন্তব্যে পৌঁছাতে পারলেও বেশিরভাগের কপালে বিদেশভাগ্য জোটে না।

শ্রমঅভিবাসন নিয়ে কর্মরত একটি দেশীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান গত বছর একটি সমীক্ষা পরিচালনা করে দেখে যে, সারা দেশের প্রায় সবকটি জেলা থেকে মানুষ সাগরপথে বিদেশে যাওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছেন। তবে সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, যশোর, নরসিংদি ও নারায়ণগঞ্জের অধিবাসীরা এ পথে বিদেশে যেতে বেশি আগ্রহী। সংস্থাটির গবেষণায় দেখানো হয়, উল্লিখিত এলাকাগুলোতে দালালদের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। তাদের মনভোলানো কথায় এলাকার উঠতি বেকার যুবকদের মধ্যে সাগরপথে বিদেশে যাওয়ার হিড়িক পড়ে যায়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এসব জেলার বিপুল সংখ্যক তরুণ পরিবারেরর কাউকে না জানিয়ে সাগরপথে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করে অনেকে এখন নিখোঁজ।

এই মরণযাত্রা বন্ধে অভিবাসীদের অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে কিছু সচেতনমূলক কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। তবে অভিবাসন বিশ্লেষকদের মতে, অনিরাপদ উপায়ে সাগরপথে বিদেশ যাওয়া ঠেকাতে দেশের এনজিওগুলোকে আরও কার্যকরী উদ্যোগ নিতে হবে। এ জন্য চাই আইনের সঠিক প্রয়োগ এবং সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সমন্বয়ে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টি।

মানবপাচারের শীর্ষ রুট হিসেবে বঙ্গোপসাগর ইতোমধ্যে বেশ পরিচিতি লাভ করেছে। শীতকালে সাগরের পানি কিছুটা শান্ত থাকায় প্রতি বছর অক্টোবর থেকে জানুয়ারি মাসের মধ্যে এ পথে সবচেয়ে বেশি মানুষ বিদেশে যাচ্ছেন। টেকনাফ ও কক্সবাজারের কিছু এলাকায় মানবপাচারকারীদের বেশ কিছু গোপন ঘাঁটি রয়েছে। এদের একটি অংশ বাংলাদেশ ছাড়াও মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় থাকে। পাচারকারী ও তাদের এজেন্টরা সারাদেশ থেকে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সংগ্রহ করে ঘাঁটিতে এনে জড়ো করে সুবিধাজনক সময়ে নৌকায় তুলে দেয়। স্থানীয় প্রশাসন ঘটনার কিছু অংশ জানতে পারলেও প্রায়শই নিরব থাকেন বলে জানান সাগর থেকে ফিরে আসা ভুক্তভোগীদের একটি অংশ।

সাম্প্রতিক ঘটনাটির গুরুত্ব অনুধাবন করে আমাদের সরকার ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশের দূতাবাস পর্যায়ে যোগাযোগ করেছে। দেশের অভ্যন্তরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও পাচারকারীদের গ্রেফতার শুরু করেছে। আবার ক্ষেত্রবিশেষে পাচারকারীদের ক্রসফায়ারে দেওয়া হচ্ছে। তবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা বেশি জরুরি। দরকার আইনের সঠিক প্রয়োগ ও সর্বমহলে সচেতনতা সৃষ্টি। পাচার বন্ধে স্থানীয় প্রশাসন, কোস্টগার্ড ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে নিয়মিত কার্যকরী উদ্যোগ নিলে সুফল পাওয়া যেতে পারে।

এ মুহূর্তে জ্বলন্ত সমস্যা হল, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া কর্তৃপক্ষ অভিবাসপ্রত্যাশীদের বহনকারী নৌকাগুলো তাদের নিজ নিজ দেশের তীরে ভিড়তে দিচ্ছে না। দালালরা তাই এসব মানুষকে অসহায় অবস্থায় সাগরে রেখে সটকে পড়ছে। জাতিসংঘের মহাসচিব সাগরে আটকেপড়াদের করুণ দশা বিবেচনা করে তিন দেশের সরকারকে অসহায় মানুষজনের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। তারপরও পুশব্যাক কিন্তু থামছে না।

সার্বিক ঘটনা বিবেচনায় এনে এ অঞ্চলের ১৫ দেশ নিয়ে ২৯ মে, ২০১৫ ব্যাংককে এক জরুরি সভা বসছে। আমরা আশা করব, এ সভায় বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশিদের মানবাধিকারের বিষয়টি তুলে ধরবে। এছাড়া, সরকারের উচিত, বর্তমানে যারা ভুল পথে পা বাড়িয়ে বিদেশের জঙ্গলে, জেলে আটকে আছেন বা জলে ভাসছেন তাদের উদ্ধারের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা। এই অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনবোধে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর দ্বারস্থ হতে হলেও পিছু হটা যাবে না।

বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী কল্যাণ আইন, ২০১৩ মতে, বাংলাদেশ থেকে সাগরপথে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার সরকার অনুমোদিত কোনো রুট নেই। কেউ এ পথে কাউকে বিদেশে পাঠানোর চেষ্টা করলে এটি হবে মানবপাচারের শামিল ও দণ্ডনীয় অপরাধ। বাস্তবতা হচ্ছে, সরকারের নতুন এই আইনে মানবপাচারকারীদের কঠোর শাস্তির বিধান থাকলেও দেশের কোথাও পাচারকারীদের বিরুদ্ধে এর অধীনে এ পর্যন্ত কোনো মামলা দায়ের করা হয়নি। আইন থাকলেও তার প্রয়োগ না থাকার কারণে মানবপাচারকারীর তৎপরতা যেমন দিন দিন বাড়ছে, তেমনি সচেতনতার অভাবে প্রতিদিনই বহু মানুষ বিদেশে যেতে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞের মতে, সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি সরকার প্রণীত নতুন আইন অনুযায়ী পাচারকারীদের পাকড়াও করে উপযুক্ত শাস্তিবিধান জরুরি।

বিদেশে কর্মসংস্থান আমাদের দেশের বেকার সমস্যার সমাধানে ভূমিকা রাখে। নানা দেশ থেকে অভিবাসীদের প্রেরিত রেমিটেন্স নিঃসন্দেহে অর্থনীতির ধারা সচল রাখছে। তবে কোনো অমানবিক উপায়ে কাউকে বিদেশ পাঠানোর উদ্যোগ কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে প্রতিদিন আমাদের স্বজনদের এমন অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু আর গণকবরের তালিকা দীর্ঘ হতেই থাকবে।