মানুষ আপনার কাছেই, আপনি কেন দূরে থাকবেন

Published : 15 May 2015, 11:25 AM
Updated : 15 May 2015, 11:25 AM

২০০৬ সালে টাইম ম্যগাজিন 'পারসন অব দ্য ইয়ার'এ কোনো বিশেষ ব্যক্তির নাম ঘোষণা করেনি। বলেছিল, এ বছরের 'পারসন অব দ্য ইয়ার' হচ্ছেন 'আপনি'। এই 'আপনি'টা কে? এই আপনিটা হচ্ছেন তারা, যারা প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন।

টাইম ম্যাগাজিন ভুল কিছু বলেনি ৯ বছর আগে। 'পারসন অব দ্য ইয়ার'এর সেই 'আপনি'রাই এখন বিশ্বরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন।

২০১২ সালের কথা। এক গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, আমেরিকার ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ৬৬ শতাংশই বেশ ভালোভাবে রাজনীতির খবরাখবর রাখেন। এই সংখ্যা আমেরিকার মোট প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার ৩৯ শতাংশ। এ কারণেই ২০১২ সালের নির্বাচনে বারাক ওবামা অনলাইন প্রচারণায় খরচ করেছিলেন ৫২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, সেখানে মিট রমনি খরচ করেছিলেন মাত্র ২৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ওবামা যে টিমকে অনলাইনে প্রচারণার দায়িত্ব দিয়েছিলেন তাদেরকে একদম হাতেকলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল দীর্ঘদিন। টুইটার, ফেইসবুক, ইউটিউবসহ সব মাধ্যমে এ কারণে প্রতিদ্বন্দ্বী রমনির চেয়ে যোজন-যোজন এগিয়ে ছিলেন ওবামা। ফলাফলও শেষ পর্যন্ত গিয়েছিল ওবামার পক্ষে।

পাশের দেশে আসি। জেতার পরপরই টুইট করেছিলেন মোদী– 'জয় হয়েছে ভারতের, সুদিন সমাগত'। সেই টুইটার পোস্টটি রেকর্ড করেছিল। ভারতে সবচেয়ে বেশি বার 'রিটুইট' করা হয়েছিল মোদীর এই পোস্ট; ৭০ হাজার বার!

মোদী তার ব্যক্তিগত ব্লগে লিখেছিলেন: ''এটা (ভারতের) প্রথম নির্বাচন, যেখানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম খুব বড় ভূমিকা রাখল। যত দিন আসবে, তত এর গুরুত্ব বাড়বে। এটা তথ্য আদানপ্রদান ও জনগণের পালস বোঝার সরাসরি মাধ্যম।''

মোদীর কথা না মেনে উপায় নেই। শুধু আমেরিকা বা ভারত নয়, পৃথিবীর যে কোনো দেশের জন্যই এটা সত্য।

আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন তথ্য পাওয়ার একমাত্র উপায় ছিল পত্রিকা। বড় কোনো ঘটনা ঘটলে পত্রিকা মারফত খবর পেতে পেতে ২৪ ঘণ্টা কেটে যেত। পত্রিকা পড়ে শেষ করতে সময় লাগত বড়জোর ১ ঘণ্টা। তারপর আবার অপেক্ষা। কোনো ঘটনার ফলোআপ জানতে আবার পড়তে হত পরের দিনের পত্রিকা।

এখন হাতে হাতে মোবাইল, ল্যাপটপ। মানুষ বাসে বসে বা বিছানায় শুয়েই জানতে পারছে অমুক মন্ত্রী এখন কী করছেন, কোথায় আছেন। মানুষ ইচ্ছা করলে মন্ত্রীর পোস্টে গিয়ে গালি অথবা তালি দিয়ে আসতে পারছেন। মন্ত্রীরাও জানতে পারছেন মানুষ কী বলছে, কী চাচ্ছে। সেই সময়টা এখন অতীত। অসংখ্য অনলাইন পত্রিকা পাঠকের জন্য খবর, খবরের পেছনের খবর নিয়ে ডালা সাজিয়ে বসে আছে। জানাটা এক ক্লিকের ব্যাপার মাত্র। খবর নিয়ে আলোচনা করার জন্য ব্লগ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তো রয়েছেই!

ভিডিও শেয়ারিংএর জনপ্রিয় সাইট ইউটিউবের স্লোগান হচ্ছে, 'ব্রডকাস্ট ইউরসেলফ'। আমি মনে করি, অন্তর্জাল তার ব্যবহারকারীদের নিজেদের 'ব্রডকাস্ট করার' যে সুযোগটি দিয়েছে সেটির ব্যবহার সবারই করা উচিত। বিভিন্ন উদাহরণ বলে, রাজনীতিবিদদের এই সুযোগ নেওয়া উচিত সবার আগে।

ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। লক্ষ্যের দিকে অনেকটাই এগিয়ে গেছি আমরা। ইন্টারনেট এখন খুবই সহজলভ্য। গ্রামের মানুষের কাছেও পৌছে গেছে ফেইসবুক। যার ফলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অন্তর্জাল ভালো প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে, ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দুদিক থেকেই। পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে যে, বিএনপি জামায়াতের সহিংসতার সময় ফেইসবুকে আশ্রয় নিয়েছিল। এমনও হয়েছে, তারা ফেসবুক পেইজ থেকে ককটেল, বোমা ইত্যাদি বানানোর কৌশল শিখিয়ে দিত। ইতিহাসবিকৃতি, মিথ্যা সংবাদ প্রচার এসব তো আছেই।

সুখের ব্যাপার হচ্ছে, এ সবকিছুর জবাব আপনি অনলাইনেই আবার দিতে পারছেন। মিথ্যার বিপক্ষে যুক্তি দেখাতে পারছেন, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাচ্ছেন একই প্লাটফর্মে।

কয়েক বছর আগে মূলধারার গণমাধ্যমে কী প্রকাশ হচ্ছে, সেটা নিয়ে আলোচনা হত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এখন উলটোটা ঘটতে শুরু করেছে। এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কী হচ্ছে সেটা নিয়ে খবর হয় মূলধারার গণমাধ্যমে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় বছরখানেক আগে একটা ছবি পোস্ট করেছিলেন ফেইসবুকে। ছবিতে দেখা যাচ্ছিল প্রধানমন্ত্রী রান্না করছেন। সে ছবি নিয়ে আলোড়ন তৈরি হয়েছিলো রীতিমতো। মূলধারার গণমাধ্যম প্রথম পাতায় ছাপিয়েছিল সে ছবি। সজীব ওয়াজেদ জয়ের ফেইসবুক স্ট্যাটাস নিয়ে নিয়মিতই খবর প্রকাশ হয়ে মূলধারার গণমাধ্যমে।

আমার একটা ফেইসবুক পেইজ আছে। সে পেইজ থেকে প্রতিদিন আমি শিখি। প্রতিটি কমেন্ট, ইনবক্স আমি মনযোগ দিয়ে পড়ি। গালিও পড়ি, তালিও পড়ি।

আমাদের দেশে টুইটার এখনও সেভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি। এখানে জনপ্রিয়তার শীর্ষে রয়েছে ফেইসবুক। তাই আমার মনে হয় যারা এখনও অনলাইনে সক্রিয় হননি তাদের জন্য এটাই সবচেয়ে ভালো সময়। তাদের জন্য ফেইসবুক হতে পারে জনগণের কাছে যাবার একটি ভালো মাধ্যম।

আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলতে পারি। দেশ বিদেশের রাজনৈতিক ঘটনা নিয়ে আমার নিজস্ব মতামত থাকে। তা তাৎক্ষণিকভাবে জানানোর উপায় হচ্ছে ফেইসবুক। আমি সব সময় চেষ্টা করি খুব সহজ কথায় সহজভাবে নিজের ভাবনা লিখতে। একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় খেয়াল করা যায়, আন্তর্জাতিক রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও অনলাইনে তাদের মতামত প্রকাশের জন্য খুব কঠিন ভাষা ব্যবহার করেন না। খুব দীর্ঘ কোনো লেখাও তারা লেখেন না। টুইটারে কয়েকটা মাত্র বাক্য লিখেই তারা শেষ করেন।

লেখার সঙ্গে ছবি প্রকাশ নজর কাড়তে সাহায্য করে। আমি কী করছি, কোথায় আছি সেটা জানানোর জন্য ছবি খুব ভালো মাধ্যম। গত সিটি নির্বাচনে আমাদের মেয়রপ্রার্থীরা নিয়মিত ছবি পোস্ট করেছেন ফেইসবুকে। অনেকেরই হয়তো মনে আছে, পাশের দেশের মোদী তার মায়ের সঙ্গে একটি সেলফি তুলে আপলোড করেছিলেন টুইটারে। খুব সাড়া জাগিয়েছিল ছবিটি। মাঝে মাঝে আসলে লেখারই প্রয়োজন পড়ে না। ছবি দিয়েই বুঝিয়ে দেওয়া যায় অনেক কিছু। আমাদের প্রিয় তথ্য প্রতিমন্ত্রী প্রায়ই শুধু ছবি পোস্ট করেন। খুব আড়ম্বর করে তোলা ছবি নয়, কিন্তু চোখে পড়তে বাধ্য।

বাংলাদেশে ভিডিও বার্তা দেওয়াটা এখনও সেভাবে জনপ্রিয় হয়নি। দেশের নেট স্পিড এবং খরচের কারণে এতদিন অনলাইনে ভিডিও দেখা খুব একটা জনপ্রিয় ছিল না। এখন ইন্টারনেট সহজলভ্য ও সুলভ। হাতে হাতে স্মার্টফোন। এখন ভিডিও মাধ্যমে পাঠকের সঙ্গে যোগাযোগ করার নতুন এক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এটি নেওয়া যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে একটি ব্যক্তিগত ইউটিউব চ্যানেল বেশ কাজে লাগবে। ফেইসবুকেও এখন ভিডিও আপলোড করার সুযোগ আগের চেয়ে ভালো।

পাঠকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখাটাও গুরুত্বপূর্ণ। আমার ফেইসবুক পেইজে আমি প্রচুর মেসেজ পাই। চেষ্টা করি উত্তর দেওয়ার। পরামর্শও পাই প্রচুর। ব্যক্তিগত নোটবুকে আমি টুকে রাখার চেষ্টা করি সেগুলো।

ফেইসবুকে অনেককে দেখেছি পেইজ আছে কিন্তু অ্যাকটিভিটি নেই। থাকলেও খুব কম। অ্যাকটিভিটি না থাকলে মানুষ পেইজ ফলো করবে কেন? প্রতিদিন দুএকলাইন লেখা মনে হয় না খুব কঠিন একটা কাজ। ব্যস্ততার মাঝেও কয়েক লাইন লিখে রাখা যায়। ফেইসবুকে এখন পোস্ট শিডিউল করে রাখা যায়। আমি প্রায়ই এটা করি। আগে পোস্ট লিখে শিডিউল করে রেখে দিই। কোনো কারণে ভুলে গেলেও ফেইসবুক সয়ংক্রিয়ভাবে সেটা পোস্ট হয়ে যায়।

একটু আগে বলেছি, পাঠকের মতামত খেয়াল করাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার। তবে তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে অপ্রয়োজনীয় মতামত এড়িয়ে যাওয়ার ধৈর্য্য। এটি অর্জন করতে সময় লাগে যদিও, কিন্তু বেশ জরুরি।

সবার কথার উত্তর দিতে গেলে আপনি পথ পেরুবেন কী করে?

সুশান্ত দাস গুপ্ত: সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকটিভিস্ট।