‘সংবিধান’: ছেঁড়া ত্যানা রিফু করার কুতর্ক

ফরহাদ মজহার
Published : 6 May 2011, 06:15 AM
Updated : 6 May 2011, 06:15 AM

বাংলাদেশের 'সংবিধান' নিয়ে বিস্তর কথাবার্তা আজকাল পত্রপত্রিকায় দেখছি। টেলিভিশনেও শুনছি, সংবাদে এবং টক শোতে। প্রস্তাব ও পরামর্শ আসছে সংবিধানের কোথায় কোন অনুচ্ছেদ বাদ বা বদলাতে হবে কিম্বা কোথায় নতুন বিধি বিধানের সংযোজনের দরকার। সংবিধান সংশোধনের জন্য বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা অনেকের সঙ্গে কথা বলছেন। পত্রিকায় দেখলাম বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকদের সঙ্গেও তাঁরা কথা বলছেন। শ্রমিক, কৃষক বা গতর খেটে খায় এঁরাই বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ। যারা আড়িয়ল বিল, ফুলবাড়ীয়া, কানসাটসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় জীবন ও জীবিকা, প্রাণ ও পরিবেশ এবং জ্বালানিসম্পদ সহ প্রকৃতি ও প্রাণবৈচিত্র রক্ষার জন্য লড়ছেন সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ এই আলোচনার বাইরে। তারা বাইরে থাকতে বাধ্য। কেন? কারণ তাদেরকে শাসন ও শোষণ করবার জন্য যে সংবিধান সেই সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে তাদের আবার কী ভূমিকা থাকবে! ইংরেজি Constitution শব্দটির আক্ষরিক অনুবাদ হচ্ছে রাষ্ট্রের 'গঠনতন্ত্র'। জনগণের ইচ্ছা ও সংকল্পের ভিত্তিতে রাষ্ট্র কীভাবে গঠন করা হবে বা হয়েছে তার দলিল। রাজনৈতিক ধারণার দিক থেকেও এই অনুবাদ 'সংবিধান" মার্কা আইনী ধারণার চেয়েও সঠিক, আরো বিস্তৃত ও রাজনৈতিক দ্যোতনায় সমৃদ্ধ। বাংলাদেশের শাসক শ্রেণীর কাছে সংবিধান হচ্ছে শাসন করবার 'সর্বোচ্চ আইন' মাত্র। এই আইন দিয়ে শাসক শ্রেণী জনগণকে শাসন করে – এটা হচ্ছে সংবিধানের আইনী মার্কা ব্যাখা। অথচ গণতন্ত্রের মূল কথা হচ্ছে জনগণই 'শাসক', রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎপত্তি জনগণের ইচ্ছা ও সংকল্পের মধ্যে। সংবিধানের আইনী মার্কা ধারণার নীচে রাজনৈতিক গঠন্তন্ত্রের ধারণা চাপা পড়ে যায়। জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক দাঁড়ায় নিছকই শাসক এবং শাসিতের। এখন বলা হচ্ছে এতদিন যেভাবে জনগণকে শাসন করা হোত, তাতে আর চলছে না। এখন তার সংশোধন দরকার। শাসক আর শাসিতের এই সম্পর্ককে আরো নিখুঁত করবার জন্য শাসক শ্রেণীর নানা অংশের মধ্যে এই কারনেই এত হুলস্থুল, এত কথাবার্তা, এত দেন দরবার।

দেখা যাচ্ছে সমাজের ক্ষমতাবান শ্রেণীর মধ্যে তর্কটা চলছে কয়েকটি মাত্র বিষয় নিয়ে। প্রথম বিষয় হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা রাখা হবে কি হবে না, যদি রাখা হয় তাহলে কোথায় তার সংস্কার করা দরকার যাতে এক এগারোর মত পরিস্থিতি তৈরি না হয়। নব্বই দিনের বেশি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় রাখার কেউই বোধহয় পক্ষপাতি নয়। ক্ষমতাসীন দল চাইছে যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার নব্বই দিনের মধ্যে নির্বাচন দিতে না পারে তাহলে পুরানা সরকারই ক্ষমতায় থাকবে। তার মানে আগামী নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্বাচন দিতে না পারলে মহাজোটই ক্ষমতায় থাকুক এটাই তারা চান। ভাল আবদার। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করেই বলা হচ্ছে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী অনুযায়ী অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিদের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা রাষ্ট্রপতির দ্বারা 'নিয়োগ' করবার বিধান থাকায় বিচারপতিদের কেউ কেউ এই পদের জন্য প্রলুব্ধ হতে পারেন; প্রলুব্ধ হবার অভিযোগও আছে। বিচারবিভাগের ভূমিকা তুমুল প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার অনেক কারণের মধ্যে একে প্রধান একটি কারন বলে বলা হচ্ছে। বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে 'আলাদা' হয়েও ক্ষমতাসীন দলের নির্দেশের অধীনতা অতিক্রম করবার হিম্মত প্রায় ক্ষেত্রেই দেখাতে পারে না। অন্যদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে বিচারপতি নিয়োগের বিধান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে এবং করেছে। এমন বিচারপতিকেই প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ দেবার সুযোগ আছে যিনি এমন সময় অবসর নেবেন যাতে প্রধান উপদেষ্টার নিয়োগ পান আর নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থ দেখেন। চারদলীয় জোট ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ের অভিজ্ঞতা বিচার বিভাগ ও রাজনীতি উভয় দিক থেকেই তিক্ত স্মৃতি হয়ে রয়েছে।

দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট ও সংসদের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য নিয়ে তর্ক। এই পরিপ্রেক্ষিতেই প্রশ্ন উঠেছে বাংলাদেশের সংবিধানকে আমরা কী ধরণের সংবিধান বলব? সংসদীয় পদ্ধতির নাকি প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির, নাকি জগাখিচুড়ি গোছের ভিন্ন কিছু। বাংলাদেশের সংবিধান চরিত্রের দিক থেকেই যে 'সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্র' কায়েম করবার দলিল এই সংবাদ নতুন কিছু নয়। শুধু প্রধান মন্ত্রীর হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনই একমাত্র বিষয় নয়। জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা – যা গণতন্ত্রের গোড়ার কথা – তার বিপরীতে তথাকথিত 'সার্বভৌম সংসদ' সংক্রান্ত ধারণারও বিপদ রয়েছে, যদি জনগণের কাছে সংসদকে জবাবদিহি করবার কোন ব্যবস্থা না থাকে। জবাবদিহির ব্যবস্থা কীভাবে নিশ্চিত করা যায়? গণতান্ত্রিক সংবিধান জাতীয় সংসদকে জনগণের মৌলিক নাগরিক ও মানবিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করে এমন আইন পাশ করতে দিতে পারে না। সংসদকে যদি আমরা এই ক্ষমতা না দেই তাহলে কীভাবে সংসদ সার্বভৌম হয়? সম্প্রতি আমরা আরেক মুশকিলে পড়েছি। প্রধান বিচারপতির বেশ কিছু বক্তব্য থেকে আমরা বুঝেছি বিচারবিভাগ সংসদের কাছে জবাবদিহি করতে চায় না। প্রশ্ন উঠেছে কে 'সার্বভৌম, বিচার বিভাগ, নাকি সংসদ? সংসদকে যদি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এই ক্ষমতা না দেয় তাহলে বিচার বিভাগকে দেবে কোন দুঃখে?

নির্বাচিত হলেই সেই সরকার গণতান্ত্রিক হয় না। নির্বাচিত সরকারের মধ্য দিয়ে সাংবিধানিকভাবেই একনায়কতন্ত্র কায়েমের বিধান আমাদের সংবিধানেই রয়েছে। এই প্রসঙ্গে সত্তর অনুচ্ছেদের কথা মনে করতে পারি। নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা এবং বাংলাদেশের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ মিলে বাংলাদেশে যে সংবিধান রয়েছে তাকে সরল বাংলায় বলা যায় 'সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্র'। এর সমালোচনা বহু আগে থেকেই হয়ে আসছে। সংশোধনের উপায় কী? প্রস্তাব হিসাবে দেখছি, প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট ও জাতীয় সংসদের মধ্যে 'ক্ষমতা বন্টন" করবার সুপারিশ। 'ক্ষমতা' কি তাহলে হাতের মোয়া বা রুটির মতো যে ভাগ করে দেওয়া যায়? তর্কগুলো নিছকই সংবিধান বা আইনশাস্ত্রীয় বিষয় নয়। বিষয়গুলো রাজনৈতিক এবং সে কারণে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর ক্ষমতার লড়াইয়ের প্রশ্ন। সংবিধান বিষয়ে সমাজের অধিপতি শ্রেণীগুলো আসলে তাদের মতাদর্শিক অবস্থান থেকেই তর্কগুলো করছে। তারা ক্ষমতার ভাগ বাঁটোয়ারা চায়।

তৃতীয় বিষয় হচ্ছে সংবিধানে বিসমিল্লাহির-রহমানির রহিম এবং রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকবে কিনা। প্রশ্ন হচ্ছে যদি সংবিধান ৭(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী 'জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি' হয়ে থাকে এবং জনগণ যদি এটা তাদের সংবিধানে চায় তাহলে তা বাদ দেওয়া যায় কীভাবে? বাহাত্তরে আওয়ামী লীগ একাই বাংলাদেশের জন্য সংবিধান দিয়েছে, তখন তারা এই সব বাদ রাখতে পেরেছে। এখন ২০১১ সালে শেখ হাসিনা যদি ভাবেন সংবিধানে বিসমিল্লাহির-রহমানির রহিম এবং রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রাখা 'জনগণেরই অভিপ্রায়' তখন এটাই প্রমাণ হয় যে বাহাত্তর সালের সংবিধান 'জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি" ছিল না। সেটা ছিল, আওয়ামী লীগের দলীয় অভিব্যক্তি। প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এখন দোষ দেওয়া যায় কি? কিন্তু তাঁর দলের ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদী বুদ্ধিজীবীরা এতে খুব গোস্বা করেছেন। তবে প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ জানিয়ে দিয়েছে সংবিধানের সংশোধন যাই হোক এই দুটো থাকবে। আওয়ামী বুদ্ধিজীবীদের বড় একটি অংশ – যারা তাদের মতামত সংবিধান বিষয়ে সংসদীয় কমিটিতে জানাতে গিয়েছিল তাদের মূল দাবি ছিল এই দুইয়ের অপসারণ।

বলাবাহুল্য আমাদের সমাজের প্রধান রাজনৈতিক বিভাজন হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী বনাম ইসলামপন্থীদের মধ্যে বিরোধ। বিভাজনের তীব্রতা আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেয় রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিশাবে আমরা বিভক্ত। ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদীরা ইসলাম ও ইসলাম ভাবাপন্ন রাজনীতির শত্রু । ঠিক তেমনি ইসলামপন্থীরা ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদীদের রাজনৈতিক শত্রু মনে করে । গণতন্ত্র যদি রাষ্ট্র গঠনের নীতি হয় তাহলে সেই রাষ্ট্র চরিত্রের দিক থেকে ধর্মবাদী বা ধর্মতাত্ত্বিক হতে পারে না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র মাত্রই ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। তাহলে আলাদা করে 'ধর্ম নিরপেক্ষতা' রাষ্ট্রের নীতি হিসাবে রাখার কারন কী? এটা বাড়তি। এর একমাত্র কারন ধর্মের প্রতি ভীতি, বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামের বিরোধিতা ও ইসলাম বিদ্বেষ। এরই প্রতিক্রিয়ায় বিসমিল্লাহির-রহমানির রহিম এবং রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানে ঢুকে পড়েছে এবং এখন স্থায়ী আসন চাইছে। যদি সেটা সামরিক শাসনের হাত ধরে ঢুকেছে বলে দাবি করা হয় তাহলে বিপুল ভোটে বিজয়ী মহাজোট সরকার তা বহাল রাখতে চাইছে কেন? যদি রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে চায় তাহলে ধর্ম ভীতি বা ইসলাম বিদ্বেষ যেমন বাদ দিতে হবে, তেমনি সংবিধানকে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের সংবিধানে পরিণত করার বিপদ সম্পর্কেও জনগণকে বোঝাতে হবে।

সাম্প্রদায়িকতা অবশ্যই একটা আপদ। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্রের মূল কথাই হচ্ছে রক্ত, বর্ণ, গোষ্ঠী, ভাষা, জাতি, লিঙ্গ – যার যাই থাকুক রাষ্ট্রের চোখে সে নাগরিক। অতএব গণতন্ত্র মাত্রই ঘোরতরভাবে যে কোন ধরণের সাম্প্রদায়িক পরিচয়ের বিরোধী, অতএব সাম্প্রদায়িকতারও বিরোধী। কিন্তু এই আপদ ভাষা ও সংস্কৃতিকে রাজনৈতিক আত্মপরিচয় নির্মাণে ব্যবহার করলে যেমন ঘটে তেমনি ধর্মকে করলেও ঘটে। শুধু ধর্মীয় সংখ্যালঘু নয়, পাহাড়ি জনগোষ্ঠী ও অন্যান্য সংখ্যালঘু জাতিসত্তাগুলোর বিরুদ্ধে 'বাঙালি' ও 'বাংলাদেশী' উভয়েরই সাম্প্রদায়িক চেহারা আমরা দেখছি। আসলে শাসক শ্রেণী গণতন্ত্র বলতে যা বোঝাচ্ছে তা গণতান্ত্রিক ধ্যান ধারণার সঙ্গে একদমই সঙ্গতিপূর্ণ নয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র মাত্রই যেমন ধর্ম নিরপেক্ষ, ঠিক তেমনি অসাম্প্রদায়িক। নিজেকে অসাম্প্রদায়িক প্রমাণ করবার জন্য গণতান্ত্রিক সংবিধানে বাড়তি ধর্ম নিরপেক্ষতা রাখার প্রয়োজনীয়তা নাই। আমরা সমাজে বিভক্ত হয়ে আছি। কিন্তু সমাধানের জন্য যে রাজনৈতিক তর্ক করা দরকার সেই দিকে না গিয়ে জবরদস্তি সংবিধান সংশোধন করে যে যার অবস্থানে দাঁড়িয়ে হাঙ্গামা সৃষ্টির বাহানা খুঁজছি।

তাহলে মূল কথা হোল রাষ্ট্র যদি গণতান্ত্রিক হয় তাহলে আলাদা করে আবার ধর্ম নিরপেক্ষতা সংবিধানে রাখার প্রয়োজন পড়ে না। সত্যি কথা হোল সংবিধানে 'ধর্ম নিরপেক্ষতা' রাখার প্রতিক্রিয়া হিসাবেই বিসমিল্লাহির-রহমানির রহিম এবং রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রাখার দাবি সমাজে তীব্র হয়েছে। ধর্ম নিরপেক্ষতার প্রশ্ন থেকে আলাদা করে এর সমাধান হবে না। একটি রাখব আর আরেকটি রাখব না বললে কোন সমাধান হবে না। দুটোকেই বাদ দিতে হবে।

ইসলাম পন্থীদের একটা বড় অংশ গণতন্ত্র নয়, ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করতে চাইছেন। যাঁরা দাবি করেন তাঁরা গণতন্ত্র চাইছেন তাঁরা সংবিধানে বিসমিল্লাহির-রহমানির রহিম এবং রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম চাইছেন কেন? রাষ্ট্রের কি ধর্ম আছে বা থাকে? রাষ্ট্র কি ধর্ম পালন করে, নাকি করতে পারে? নাগরিকরা যে যার ধর্ম অনুযায়ী সংবিধানের শুরুতে যে নাম নেবার সে নাম নেবেন। শুধু সংবিধান কেন, যে কোন ভাল কাজ করবার আগে, বিশেষভাবে যে কোন গ্রন্থ পাঠের আগে কি বিসমিল্লাহির-রহমানির রহিম বলা ধর্মের বিধান নয়? সেটা লিখিত থাকতে হবে কেন? সংবিধান পড়ার সময় পড়তে আমরা বাধ্য, কিন্তু অন্য বই পড়ার সময় কি আমরা পড়ব না?
আমরা কুতর্কে উৎসাহী। মানুষের ইহলৌকিক যেসকল অধিকার ইসলাম কায়েম করতে বদ্ধপরিকর সেই দিকে ইসলামপন্থীদের মনোযোগ আমরা দেখি না। যেমন, পরিবার, গোত্র, বর্ণ, জাত, পাত, রক্ত, সম্প্রদায় ইত্যাদি সকল কিছুর উর্ধে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কর্তব্য, রাষ্ট্র ও সমাজের সকল ক্ষেত্রে 'ইনসাফ' কায়েম, কিম্বা রিজিক বা জীবিকার নিশ্চয়তা বিধান, ইত্যাদি। গণতান্ত্রিক সংবিধানেতো এইসব থাকার কথা, থাকতে হবে। ইসলামের নীতি ও আদর্শের চর্চা সার্বজনীন ভাষায় সকলের জন্য সকলের স্বার্থে কিভাবে এবং কতোটা হাজির করা সম্ভব, সেই তর্কে ইসলামপন্থীদের নামতে হবে। ওর মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য সার্বজনীন নীতি প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় ইসলামের ইতিবাচক ভূমিকা সুস্পষ্ট করে তোলা সম্ভব। পাশ্চাত্যের আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার তত্ত্ব হিসাবে 'গণতন্ত্র' নামে যা আমরা অনুকরণ করি তার চেয়ে বিকশিত ব্যবস্থা নির্মাণের শর্ত তৈরি করবার পথ সন্ধান করতে হবে আমাদের। এই কাজগুলো বাদ রেখে অনেকে মুখে গণতন্ত্রের কথা বলেন, কিন্তু সেটা তাঁদের মনের কথা কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া কঠিন। ইসলামের ব্যাখ্যা একেক ইসলামপন্থী দল বা গোষ্ঠীর কাছে একেকরকম। পবিত্র কোরান শরিফ তো নিজের ব্যাখ্যা নিজে হাজির করতে পারে না। কোন না কোন জীবিত মানুষকেই তা করতে হয়। মূল প্রশ্ন হচ্ছে ইসলামের সঙ্গে গণতন্ত্রের সম্পর্ক কি সাংঘর্ষিক নাকি সঙ্গতিপূর্ণ? এই ব্যাপারে আমদের সমাজে তর্ক অমীমাংসিত। এর জের রাজনীতিতে পড়তে বাধ্য। সংবিধান সংক্রান্ত তর্ক এই বিষয়গুলো এড়িয়ে যেতে পারবে না। সারকথা হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী বা ধর্মবাদী উভয়ের কোন পক্ষই গণতন্ত্রের সদর মহলের কেউ নন, এটা তারা উভয়েই প্রমাণ করেছেন। তারা বাইরের কারবারী। সেই কারনে উভয় পক্ষ শুধু হাঙ্গামায় আগ্রহী, রাষ্ট্র গঠনের বাস্তব সমস্যা সমাধানে আগ্রহী নয়।

আরো অনেক বিষয় নিয়ে কথা বলা যায়, কিন্তু যে দিকে মনোযোগ দেওয়া দরকার সেটা হচ্ছে জনগণের ইচ্ছা ও সংকল্প বা তাদের অভিপ্রায় ধারণ করবার প্রক্রিয়াটা কী হবে? প্রক্রিয়ার প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে খন্ড খন্ড অনুচ্ছেদ নিয়ে আলোচনা আমাদের কোথাও নিয়ে যাবে না। 'সংবিধান' নামক বস্তু নিয়ে আমি বিস্তর লিখেছি। বেশ কিছু লেখা 'সংবিধান ও গণতন্ত্র' নামে প্রকাশিত হয়েছে। নিজের লেখালিখি বা বইয়ের বিজ্ঞাপন দিয়ে অপরাধ করছি নাকি জানি না। তবে মার্জনা ভিখারী। সংবিধান সংস্কার আর সংশোধন নিয়ে যেসব তর্ক চলছে তা যে গণতন্ত্রের গোড়ার প্রশ্নগুলো উহ্য রাখছে তা বুঝবার জন্য পুরানা লেখাগুলো পাঠকের কাজে আসতে পারে। গণতন্ত্র মানে একটি সংবিধান লিখে তাকে সর্বোচ্চ আইন দাবি করে জনগণের ওপর একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতার চর্চা হতে পারে না। সেই দিক থেকে বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী 'সাংবিধানিক শাসন' আর 'সামরিক শাসন'-এর মধ্যে জের জবরের ফারাক খুব সামান্যই। দুটোই একনায়কতান্ত্রিক শাসন। আমাদের বুঝতে হবে যারা গণতন্ত্রের মৌলিক বা গোড়ার প্রশ্নগুলো উহ্য রাখে তাদের আমরা সহজেই অগণতান্ত্রিক শক্তি ও শ্রেণী হিসাবে চিনতে পারি। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার লড়াইয়ে শত্রু মিত্র বিভাজন এখান থেকেই শুরু হয়। জনগণের সার্বভৌম শক্তির উন্মেষ, বিজয় এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়ার প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে গণবিরোধী ও অগণতান্ত্রিক শ্রেণীগুলো যে-সংবিধান ছেঁড়া ত্যানার মত এতোকাল ব্যবহার করে এসেছে, সেই ছেঁড়া ত্যানাকেই আবার রিফু বা রিপেয়ার করবার বাতচিত চলছে এখন। এক ধরনের মরিয়া ভাব দেখছি। নতুন দেখছি সুশীল সমাজের প্রতিনিধিকদেরও। তারাও জোর গলায় রিপেয়ারের দাবি করছেন। এই পথে আমরা সামনে এগিয়ে যেতে পারব না। এটা গণতন্ত্রের পথ নয়।

সংবিধান নিয়ে তর্ক বিতর্কে বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ ও নাগরিকদের অবশ্যই হুঁশিয়ার হয়ে উঠতে হবে। এই বিষয়ে সতর্ক করে তোলাই আমাদের প্রথম রাজনৈতিক কাজ। গণবিরোধী অগণতান্ত্রিক শ্রেণী ও শক্তির বিরুদ্ধে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক শক্তি ও শ্রেণীগুলোর লড়াই সংবিধানকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হতে বাধ্য। মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের জনগণকে শুরু থেকেই নিজেদের সংবিধান নিজেদের প্রণয়ন করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। যাদের পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়ণের জন্য পাকিস্তানী আমলে নির্বাচিত করা হয়েছিল তারাই দলীয় ক্ষমতার জোরে নিজেদের বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতার ভূমিকায় নেমেছিলেন। হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ও রক্তক্ষয়ী লড়াই এবং জনগণের বিজয়ী গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আবার বাংলাদেশের জন্য একটি গণতান্ত্রিক 'গঠনতন্ত্র' প্রণয়নের জন্য'রাষ্ট্র গঠনসভা' বা গণপরিষদ ডাকার সম্ভাবনা বাংলাদেশে তৈরি হয়েছিল। তাকে নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে। এইসব ইতিহাস আমরা ভুলে যেতে পারি না। বিদ্যমান সংবিধান ও তথাকথিত 'ত্রিদলীয় জোটের রূপরেখা'-র অধীনে ক্ষমতার হাত বদল হয়েছিল মাত্র। মনে আছে কি যে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের দশ দফা ও শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের পাঁচদফাসহ সমাজের অন্যান্য নিপীড়িত ও শোষিত শ্রেণীর দাবি দাওয়াকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে পর্যবসিত করা হয়েছিল এক দফায়। কী ছিল সেই এক দফায়? 'এক দফা এক দাবি/এরশাদ তুই কবে যাবি?' ভুলে গিয়েছি কি আমরা? গণবিরোধী অগণতান্ত্রিক শ্রেণী ও শক্তিগুলো তখন দাবি করেছিল শুধু এরশাদকে ক্ষমতা থেকে হঠাতে পারলেই আমরা গণতন্ত্র পেয়ে যাব। সেই এরশাদ এখন আবার মহাজোটের সঙ্গে ক্ষমতার ভাগিদার।

এরশাদের সামরিকতন্ত্র ও স্বৈরশাসনের ইতিহাস সকলকে মনে করিয়ে দিতে চাই। যে অগণতান্ত্রিক শ্রেণী ও শক্তিগুলো তখন 'সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা'-র কথা তুলেছিল, আজ তারাই আবার সংবিধান সংশোধনের তর্কে মাতোয়ারা। 'সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা'-র নামে বিদ্যমান রাষ্ট্র ক্ষমতার চরিত্র ও কাঠামো অবিকল রেখে দিয়ে শুধু এরশাদকে ক্ষমতা থেকে সরাবার জন্য তথাকথিত 'ত্রিদলীয় জোটের রূপরেখা' প্রণয়ন করা হয়েছিল। ভুলে যাবার কথা নয় যে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তথাকথিত 'বামপন্থী'-দের জোটও। যা ছিল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে চরম বিশ্বাসঘাতকতা এবং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের সমূহ সম্ভাবনার পিঠে ছুরি মারা। মনে রাখতে হবে ছেঁড়া ত্যানার মত পুরানা সংবিধান ও রাষ্ট্র কাঠামো টিকিয়ে রাখার জন্যই ত্রিদলীয় জোটের রূপরেখা প্রণীত হয়েছিল। প্রাক্তন বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদের চাকুরি রক্ষা এবং জামায়াতে ইসলামির প্রস্তাব অনুযায়ী কেয়ারটেকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রবর্তন করবার জন্য আবারও সংবিধান সংশোধন করা হয়েছিল। এখন সংবিধান নিয়ে গুরুগম্ভীর কায়দায় যেসব রংতামাশার তর্ক তোলা হচ্ছে দেখা যাচ্ছে অতীতের সব কথাই বেমালুম গায়েব হয়ে গিয়েছে।

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির কাজ হচ্ছে তাকে বারবার মনে করিয়ে দেওয়া। এখনও সংবিধান সংশোধনের মূল কথা হচ্ছে গণবিরোধী রাষ্ট্রের দুই এক জায়গায় সংশোধন করে এক মাস্তানের হাত থেকে আরেক মাস্তানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করা।

এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের শুরু থেকেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উত্থানের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক এইসকল মৌলিক প্রশ্নগুলো নিয়ে কথা উঠেছিল। আন্দোলনের ভেতর থেকে ওঠা সেইসব দাবিকে চাপা দিয়ে দেওয়া হয়েছিল 'সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা'-র কথা বলে। সেই সময় বলা হয়েছিল বাহাত্তর সালের পর থেকে সংবিধানের যে সংশোধন, পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা হয়েছে তার 'ধারাবাহিকতা' রক্ষা করতে হবে। পঞ্চম বা সপ্তম সংশোধনী নিয়ে তখন কোন টুঁ শব্দও শোনা যায় নি। এমনকি এখন সংবিধানের যেসব নাটবল্টু সারানোর কথা উঠছে এবং নতুন সংযোজনের আবদার তোলা হচ্ছে — সেইসব নিয়েও কোন কথাই ওঠে নি। অগণতান্ত্রিক শ্রেণী ও শক্তিগুলো তাদের পরস্পরের মধ্যে মতাদর্শিক ও দলীয় কোন্দলের পরেও বহুবার কাঁটাছেড়া করা সংবিধান তাদের সুবিধামত আবার কাঁটাছেঁড়া করে রাষ্ট্রের পুরানা কাঠামোই অক্ষত রাখবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল ঐ 'সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা'-র নামেই। মরিয়া হয়ে ওঠার কারন তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি। গণ আন্দোলন তখন এমন তুঙ্গে পৌঁছেছিল যে জনগণের বিজয়ী গণঅভ্যুত্থান ঘটা, তার সুফল হিসাবে নতুন রাষ্ট্র গঠনসভা (Constituent Assembly) বা গণপরিষদ গঠন এবং বাংলাদেশের জন্য একটি গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র (Constitution) প্রণয়নের সম্ভাবনা এরশাদের সামরিক স্বৈরশাসন বিরোধী তীব্র আন্দোলনের ফলে তৈরি হয়েছিল। তাকে নস্যাৎ করে দেবার জন্যই 'সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা'-র ধূয়া ও আওয়াজ। জনগণের গণতান্ত্রিক শক্তির উন্মেষে ভীত হয়ে ক্ষমতাসীন শ্রেণীগুলোকে এক জোট হয়ে জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো ছাড়া উপায় ছিল না। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রক্রিয়া নস্যাৎ করে দেবার জন্য তখন অগণতান্ত্রিক গণবিরোধী শ্রেণী ও শক্তিগুলো যে-পদক্ষেপগুলো নিয়েছিল সেই সব মনে রাখলে তাদের এখনকার তৎপরতা আমরা ঠিকভাবে বুঝতে পারব। শুধু এদের কাতারে নতুন যে অংশকে আমরা দেখছি তারা নিজগুণে এখন 'সুশীল' নামে চিহ্নিত।

'সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা'-র প্রসঙ্গ না টানলে গণবিরোধী অগণতান্ত্রিক শ্রেণী ও শক্তির তৎপরতা এবং বিভিন্ন মতাদর্শিক বয়ানের মাজেজা ধরা যাবে না। যেমন, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা যদি একসময় এতোই গুরুত্বপুর্ণ ছিল তাহলে এখন আদি বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়া বা প্রত্যাবর্তনের দাবি ওঠে কীভাবে? সেই ক্ষেত্রে কীভাবে সাংবিধানিক ধারবাহিকতা হেফাজতের ব্যবস্থা হবে? বাহাত্তরের সংবিধান তো সাহিত্যের বই নয়, কিম্বা রূপকথাও নয়। বাহাত্তরে উকিল-মোক্তারদের করা মুসাবিদায় যা লেখা হয়েছিল তার মধ্যে ক্ষমতার লড়াই যেমন খচিত, ঠিক তেমনি খচিত সংবিধান প্রণয়নের প্রক্রিয়া থেকে জনগণকে খারিজ করে রাখার মধ্যেও। এখনও সংবিধান সংক্রান্ত কমিটি জনগণকে বাদ দিয়েই সংবিধান সংশোধন বা পরিবর্তনের কথা বলছে। বলছে এমন সময় যখন আওয়ামী লীগ সংসদে নিরংকুশ বিজয়ী। বাহাত্তরেরই যেন পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।

এখন প্রত্যাবর্তনের বা ফিরে যাবার রূপকথা শোনানো হচ্ছে আদালতের কাঁধে বন্দুক রেখে। বাহাত্তরের সংবিধান ভালো কি মন্দ সে তর্কেরও বহু আগের বা আগাম অনেক বিষয় আছে যা জনগণের পক্ষ থেকে তোলা জরুরী। গণশক্তির পরিগঠন, উন্মেষ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের দিক থেকে বহু বিষয় রয়েছে জনগণকে যা পরিষ্কার বুঝতে হবে। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার তর্ক মনে রেখে প্রশ্ন তোলা যায় এজলাসে রায় দিয়ে সংবিধান বদলানো বা সংশোধনের ফলে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার এখন কী হবে? তার চেয়েও আরো গুরুতর প্রশ্ন হচ্ছে বিচারপতিদের রায়ে সংবিধান বদলাবার বা সংশোধনের নির্দেশ দেবার সাংবিধানিক ক্ষমতা ও এখতিয়ার কি আদৌ আদালতের আছে? যদি থাকে তাহলে সেটা থাকা উচিত কিনা? সেই ক্ষমতা ও এখতিয়ারের সীমা কতটুকু? আদালত কি এতোই সার্বভৌম যে সংবিধানের কিছু অনুচ্ছেদ বাতিল করবার ক্ষমতা ও এখতিয়ার বিচারপতিরা রাখেন? আদালত গঠিত হয়েছে সব সংশোধনী – পঞ্চম কি সপ্তম – সবসহ বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে। এর অধীনেই আদালতের সাংবিধানিক বৈধতা। পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনীসহ সব সংশোধনী নিয়েই এখন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান। 'সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা' মেনে। এই সংবিধান রক্ষার কোন দায় কি আদালতের নাই? আবার আদালত এই সংবিধানের কিছু অংশকে অবৈধ আবার কিছু অংশ 'অবৈধ'ভাবে সংযোজিত হয়েছে বলার পরেও 'মার্জনা' করে দিতে পারে? আদালতের এই সিদ্ধান্ত গ্রহনের ন্যায্যতা কি সংবিধান মধ্যে, নাকি তার উৎস সংবিধানের বাইরের রাজনৈতিক ক্ষমতা? আরো গোড়ার প্রশ্ন হচ্ছে আদালত এখন যে ক্ষমতার বলে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করেছে সেই ক্ষমতা আদালত কোথায় পেল? সেই ক্ষমতা তো আদালতের কাছ থেকে চতুর্থ সংশোধনী হরণ করে নিয়েছিল। আদালত তো তা ফিরে পেয়েছে পঞ্চম সংশোধনীর জোরে। অথচ আদালত সেই পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করেছে। এই সকল জট না খুলে সংবিধান সংশোধনের চেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য।

আসলে জনগণের কাছে গণতান্ত্রিক অর্থে 'সার্বভৌম' কথাটার মানে কী? পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের এই কালে? আদালত, জাতীয় সংসদ বা নির্বাহী বিভাগের মধ্যে কে 'সার্বভৌম' বা কে কাকে জবাবদিহি করবে তা নিয়ে যে তর্ক চলছে সেই সকল তর্ক কি আসলে সাংবিধানিক তর্ক নাকি সমাজের ক্ষমতাবান বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে কে কতো ক্ষমতাবান তার তর্ক? যে দিকটা আমরা বুঝতে পারছি সেটা হোল গণবিরোধী অগণতান্ত্রিক শ্রেণীগুলো তাদের পরস্পরের মধ্যে ক্ষমতার লড়াইকে হাজির করছে সাংবিধানিক কিম্বা আইনী প্রশ্ন হিশাবে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দিক থেকে কাজ হচ্ছে ঘোমটার নিচে লুকিয়ে থাকা ক্ষমতার দ্বন্দ্বের চরিত্রটা উদাম করে দেওয়া। এই তর্কগুলো মোটেও সাংবিধানিক বা আইনশাস্ত্রীয় ব্যাপার মাত্র নয়, বরং তাদের চরিত্র রাজনৈতিক। তর্ক, প্রস্তাব, সুপারিশ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে নানান আইনী মতাদর্শ আমাদের সামনে হাজির হচ্ছে। তাদের অন্তর্নিহিত রাজনীতির দিকে আমাদের নজর রাখতে হবে।

খেয়াল করলেই আমরা দেখব যে গণবিরোধী ও অগণতান্ত্রিক শ্রেণীগুলো মূলত তর্ক করছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে কেন্দ্র করে। তর্কটা পুরানা জায়গায়। রাষ্ট্র যেমন আছে তেমনি রেখে কীভাবে গণবিরোধী শ্রেণী ও শক্তিগুলো এক পক্ষের কাছ থেকে আরেক পক্ষের কাছে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ছাড়া নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার হাত বদল ঘটাতে পারে। অগণতান্ত্রিক গণবিরোধী শ্রেণী নির্বাচনকেই গণতন্ত্র বলে হাজির করে, তর্কটা সেই গণবিরোধী মতাদর্শের জায়গাতে ক্রমাগত খাবি খাচ্ছে। কে আমাদের পাঁচ বছর ধরে শোষণ লুন্ঠন করবে তার কার্যকর ফর্মুলা বের করার তর্ক। এক এগারোর ঘটনার মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কুৎসিত দিকটা বেরিয়ে পড়েছিল। এখন একে শালীন করে তোলা দরকার। দেখা গিয়েছিল রাষ্ট্রপতি এই ধরণের সরকারের অধীনে অতিমাত্রায় ক্ষমতাবান হয়ে ওঠেন। তিনি সহজেই 'জরুরী অবস্থা' জারী করবার মত অঘটন ঘটাতে পারেন। সুশীল সমাজের দাবি হচ্ছে রাষ্ট্রপতিকে নিয়ন্ত্রন করা দরকার। উপদেষ্টামন্ডলীর সঙ্গে পরামর্শ করে কাজ করতে তাকে বাধ্য করার প্রস্তাব এসেছে। উপদেষ্টামন্ডলীর অধিকাংশই যেহেতু সুশীল সমাজ থেকে আসে, সেই কারনে এই প্রস্তাব।

গণবিরোধী অগণতান্ত্রিক শ্রেণী ও শক্তিগুলো তাদের স্বেচ্ছাচারিতার চরম নিদর্শন এমন জায়গায় এনে ঠেকিয়েছে যাতে আমরা জানিনা আমাদের আদৌ কোন সংবিধান আছে কিনা। এখন সংবিধান দুইটা। প্রচলিত সংবিধান আর আদালতের নির্দেশের বরাত দিয়ে মূদ্রিত খসড়া সংবিধান। কোন সংবিধান সংশোধন করছি আমরা? সংসদে সংখ্যা গরিষ্ঠতার জোরে, সামরিক শাসনের জোরে কিম্বা আদালতের ঘাড়ে চেপে নানাভাবে সংবিধানের ওপর যে কারিগরী হয়েছে সেই সংবিধান দিয়ে আর যাই হোক জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার কায়েম হবে না। জনগণকে অবশ্যই তাদের নতুন করে রাষ্ট্র গঠন করতে হবে। দরকার নতুন 'গঠনতন্ত্র'। তার জন্য নতুন রাষ্ট্র গঠনসভা (Constituent Assembly) বা নতুন গণপরিষদ ডাকা ছাড়া আর কোন পথ খোলা নেই। বলাবাহুল্য গণবিরোধী অগণতান্ত্রিক শ্রেণীগুলোর হাতে ক্ষমতা রেখে সেই কাজ সম্ভব নয়। এদের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক শক্তির উন্মেষ, বিকাশ ও বিজয়ের পথে বাংলাদেশকে অগ্রসর হতে হবে।

সেই লক্ষ্যেই নতুন রাষ্ট্র গঠনসভা বা গণপরিষদের কথা বলে যেতে হবে আমাদের, বলে যেতে হবে নতুন 'গঠনতন্ত্র' প্রণয়ণের প্রয়োজনীয়তার কথা।

২২ বৈশাখ ১৪১৮/ ৫ মে ২০১১। শ্যামলী