বিএনপির মেয়র বনাম আওয়ামী লীগের মেয়র

জায়েদুল আহসান পিন্টু
Published : 11 May 2015, 07:12 PM
Updated : 11 May 2015, 07:12 PM

ঢাকা ও চট্রগ্রামের নবনির্বাচিত তিন মেয়রের শপথ অনুষ্ঠান ও দায়িত্বগ্রহণের পাশাপাশি একটি উদ্বেগজনক খবরও গণমাধ্যমে এসেছে। সেটি হল, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলকে সরকার সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছে। যে ধরনের নির্বাচনই হোক না কেন, আইনের দৃষ্টিতে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব নিয়েছেন এই তিন মেয়র। আর যিনি বরখাস্ত হয়েছেন তিনিও জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এখানে জনগণের রায় সরকারের একটি আদেশেই বাতিল হয়ে গেল। যদিও সরকার সেটি আইনি কাঠামোর মধ্য দিয়েই করেছে। আমার আপত্তি আইনের ওই ধারাটি নিয়ে, যে ধারাবলে সরকার নির্বাচিতদের বরখাস্ত করতে পারে। কারণ এ দেশে রাজনৈতিক উদ্দেশে আইনের ব্যবহার অহরহই হচ্ছে। একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে রাজনৈতিক কারণে সরিয়ে দেওয়ার আইনি সুযোগ থাকা উচিত নয় বলেই মনে করি।

এবার দেখা যাক আইন কী বলে। সিটি করপোরেশন আইন ২০০৯এর ১২ (১) ধারা অনুযায়ী কোনো সিটি কর্পোরেশনের মেয়র অথবা কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলায় অভিযোগপত্র আদালত কর্তৃক গৃহীত হলে তাকে সরকার লিখিত আদেশের মাধ্যমে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করতে পারবে। রাজশাহীর মেয়রকে বরখাস্ত করতে সরকার আইনের ওই ধারা ব্যবহার করেছে। মেয়র বুলবুলের বিরুদ্ধে বেশ কটি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি মামলার অভিযোগপত্র আদালত গ্রহণ করেছে। সবগুলো মামলাই বিএনপি-জামায়াত জোটের হরতাল-অবরোধের সময় নাশকতার অভিযোগে দায়ের করা। অর্থাৎ এর সঙ্গে রাজনৈতিক যোগসূত্র রয়েছে।

এর আগে সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী ও গাজীপুরের মেয়র এম এ মান্নানকেও সরকার আইনের একই ধারায় সাময়িক বরখাস্ত করেছিল। তারা দুজনই এখন কারাগারে রয়েছেন। খুলনার মেয়র মনিরুজ্জামানের বিরুদ্ধে দুটি মামলা রয়েছে। তিনিও হয়তো বরখাস্তের আদেশের অপেক্ষা করছেন।

বরখাস্ত হওয়া এই তিন মেয়রই আওয়ামী লীগের আমলে বিএনপির সমর্থন নিয়ে জয়ী হয়েছেন। সুতরাং সাধারণ মানুষের মনে এই প্রশ্ন ওঠার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে যে, সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশেই তাদের বরখাস্ত করেছে। কারণ সবগুলো মামলাই রাজনৈতিক ঘটনাবলীর সঙ্গে সম্পর্কিত। সরকারের উদ্দেশ্য আরও পরিস্কার হয়ে যায় যখন একই অভিযোগে আওয়ামী লীগসমর্থিত মেয়র বা কাউন্সিলরদের বিরুদ্ধে আইনের এই ধারা ব্যবহার করতে গড়িমসি করা হয়।

লেখাটি তৈরি করার পর খবর এসেছে যে, নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি নূর হোসেনকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। তিনি শুধু আসামিই নন, দণ্ডিতও বটে। তাকে চার্জশিটভুক্ত আসামি, দণ্ডিত আসামি এবং সভায় উপস্থিত না থাকা, এই তিনটি কারণে সরানো যায়। গত অক্টোবর মাস থেকেই তাকে সরানোর প্রস্তাব উঠছিল। অবশেষে সরকার তাকে দণ্ডিত আসামি বলে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

সিটি করপোরেশন আইনের ১৩ (১) ধারা অনুযায়ী, ''মেয়র অথবা কাউন্সিলর তার স্বীয় পদ হইতে অপসারণযোগ্য হবেন, যদি তিনি, যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া সিটি কর্পোরেশনের পর পর তিনটি সভায় অনুপস্থিত থাকেন।''

নূর হোসেন এই ধারায় অনেক আগেই অপসারিত হতে পারতেন। কারণ তিনি এ রকম ১০টি বৈঠকে গরহাজির ছিলেন। সারাদেশে এমন আরও কয়েকজন নির্বাচিত প্রতিনিধি আছেন যারা সরকারের সমর্থক এবং চার্জশিটভুক্ত আসামি, যাদের বিরুদ্ধে আইনের ওই ধারা ব্যবহার করা হয়নি। এখন বিএনপি যে অভিযোগ করছে তাদের সমর্থিত মেয়রদের বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃতভাবে মামলা দেওয়া হচ্ছে, সেটি উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

মামলায় চার্জশিটভুক্ত আসামি হয়ে মেয়র পদ থেকে যদি বরখাস্ত হয়ে যান তাহলে চট্রগ্রামের মেয়র আ জ ম নাসির তো শপথ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সাময়িক বরখাস্ত হতে পারতেন। বাইশ বছর আগে দায়ের করা ছাত্রলীগ নেতা সুফিয়ান হত্যা চেষ্টা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি তিনি। এখন জামিনে রয়েছেন। সরকার কি এখন স্থানীয় সরকার আইনের ১২ (১) ধারা ব্যবহার করবে? রাজশাহী কিংবা সিলেটের মেয়রের বিরুদ্ধে এ ধারা ব্যবহার করা গেলে চট্রগামের ক্ষেত্রে কেন করা যাবে না?

আমার প্রশ্ন, সিটি করপোরেশন আইনে অমন একটি ধারা রাখা উচিত কিনা তা নিয়ে। একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে এভাবে অপসারিত করার মানে নগরবাসীকে অপমানিত করা। কারণ নগরের লাখ লাখ বাসিন্দা ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে যাকে, একটি মামলায় শুধু অভিযুক্ত দেখিয়ে তাকে সরিয়ে দেওয়া কতটা যুক্তিসঙ্গত? অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার পর অর্থাৎ দণ্ডিত হওয়ার পর যদি এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হত তাতে কিছুটা যুক্তি খুঁজে পাওয়া যেত। জনগণের ভোটের দাম কী? এই যে রাষ্ট্রের, অর্থাৎ জনগণের করের ৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন হল, তাতে নির্বাচিতরা একটি মামুলি মামলায় অভিযুক্ত হয়ে যে কোনো সময় পদ হারাতে পারেন (যদি ক্ষমতায় বৈরি সরকার থাকে)।

জাতীয় সংসদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরও এভাবে মামলায় অভিযুক্ত করে সরিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে এটা বলা যায় যে, এক দেশে দু রকমের আইন চলছে। সংবিধানের ৬৬ (ঘ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, 'একজন সংসদ সদস্যের পদ বাতিল হয় তখনই যখন তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে কমপক্ষে দুই বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তার মুক্তিলাভের পর পাঁচ বছর পার না হয়।' অর্থাৎ জাতীয় সংসদ সদস্যদের ক্ষেত্রে শুধু অভিযোগপত্রই যথেষ্ট নয়, তাকে দণ্ডিত হতে হবে। তাও কমপক্ষে দু বছর। আর মেয়রদের ক্ষেত্রে শুধু অভিযোগপত্রে নাম থাকলেই সরকার আদেশ দিয়ে তাকে বরখাস্ত করতে পারে।

এটা স্পষ্টতই মৌলিক অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক মনে হচ্ছে। সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, 'সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী'। আবার ২৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, 'মৌলিক অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো আইন থাকতে পারবে না।'

মেয়র বা কাউন্সিলরদের শুধু মামলায় আসামি দেখিয়ে সরিয়ে দেওয়ার বিধানটি ভোটারদের সঙ্গে প্রতারণামূলকই মনে হয়। তারা সরকারি কর্মচারি নন, জনপ্রতিনিধি। লাখ লাখ মানুষ তাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে। আর সরকার কোনো মামলায় আসামি করে চার্জশিট দিয়ে তাকে বহিস্কার করার সুযোগ রেখেছে। আমাদের দেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি তাতে মিথ্যা মামলা দেওয়ার উদাহরণ হরহামেশাই দেখা যাচ্ছে। আদালত রায় না দেওযা পর্যন্ত অন্তত সরকারের হাতে এই সুযোগ রাখা উচিত নয়। সরকার এর অপব্যবহার ঘটাতেই পারে এবং ঘটছে বলেও প্রতীয়মান হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের বক্তব্য থেকে এটা আরও পরিস্কার হয়ে উঠেছে যে, সরকার আইনের ওই ধারার ব্যবহার আরও করবে যদি সেখানে আওয়ামী লীগের সমর্থক কোনো জনপ্রতিনিধি না থাকে। এতে তাদের আরও একটি সুবিধা হল, বরখাস্ত মেয়রের জায়গায় নিজেদের দলীয় সমর্থক কাউন্সিলরদের প্যানেল মেয়র করা যায়। সম্প্রতি তিনি প্রথম আলো পত্রিকাকে বলেছেন, ''সবগুলোই তো ক্রিমিনাল কেস। কতগুলো তো পরিস্কার ক্রিমিনাল অ্যাকটিভিটিস। আরিফকে কিবরিয়া হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং এ ব্যাপারে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে, ওখানে কিছু করার নেই। রাজশাহীর মেয়রের বিরুদ্ধে অনেক মামলা। আর গাজীপুরের মান্নান তো পুরনো পাপী। হেফাজতের ঘটনার সময় তিনি পুলিশের ওপর আক্রমণ করেছিলেন। তাই মেয়র হন আর যা-ই হন,অন্যায় করলে বিচার হবেই।''

এইচ টি ইমাম সাহেব নারায়ণগঞ্জের নূর হোসেনের ব্যাপারে নিরব থাকেন। তাঁর কাছে দণ্ডিত নূর হোসেনকে ক্রিমিনাল বলে মনে হয় না। আর আ জ ম নাসিরের ক্ষেত্রে আইনের ওই ধারা ব্যবহারের কথা নিশ্চয়ই কল্পনাও করতে পারেন না।

সংবিধানের ৫৯(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, 'নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের উপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার দেওয়ার লক্ষ্যেই' সিটি করপোরেশন নির্বাচন আয়োজন করা হয়। সে ভার নেওয়ার পর মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তার আদেশে একজন নির্বাচিত প্রতিনিধিকে দোষী সাব্যস্ত না হয়েও বরখাস্ত হতে হয়। আইনের ওই বিধান বহাল থাকলে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাজার হাজার সদস্যের পাহারার মধ্যে, লাখ লাখ মানুষের মাসব্যাপী উৎসবের মাধ্যমে নির্বাচন আয়োজনের দরকার কী? সরকার যদি নির্বাচিতদের বরখাস্তই করার ক্ষমতা রাখে তাহলে নির্বাচন না করে কাউকে প্রশাসক বানিয়ে রাখলেই পারে।

সম্প্রতি লন্ডনের মেয়রকে বরখাস্ত করার প্রক্রিয়াটি সরকার আমলে নিতে পারে। ২০১৪ সালের মে মাসে লুৎফুর রহমান নিজের প্রতিষ্ঠিত টাওয়ার হ্যামলেটস ফার্স্ট দলের ব্যানারে নির্বাচন করে লন্ডনের মেয়র নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনে টাওয়ার হ্যামলেটস ফার্স্ট দলের প্রচারে ধর্মের ব্যবহার, পোস্টাল ভোটে জালিয়াতিসহ নানা অভিযোগ এনে নির্বাচন বাতিল চেয়ে আদালতে পিটিশন করেন সেখানকার চার বাসিন্দা। ২ ফেব্রুয়ারি এই পিটিশনের শুনানি শুরু হয়, চলে ১০ সপ্তাহ। উভয় পক্ষের অর্ধশতাধিক সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দেন। পরীক্ষা করা হয় পোস্টাল ব্যালটগুলো। ব্যালটে অসঙ্গতি ধরা পড়ে। এই সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে গত ২৩ এপ্রিল লুৎফুর রহমানকে মেয়র পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়।

বর্তমান সরকারই তো দাবি করেছিল তাদের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে। সেই নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে শপথ নিয়ে মেয়রের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন তারা। তাহলে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কেন আইনের দোহাই দিয়ে দোষী প্রমাণিত না হওয়া সত্ত্বেও কাজ করতে দেওয়া হবে না?

এই অশুভ নজির যে কোনো সময় যে তাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে এটা তারা হয়তো ভুলে গেছেন।

জায়েদুল আহসান পিণ্টু: প্রধান বার্তা সম্পাদক, দেশ টিভি।