বিএনপি এখন কী করবে

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 5 May 2015, 10:50 AM
Updated : 5 May 2015, 10:50 AM

আমাদের দেশের রাজনীতি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এই শিবিরে বিভক্ত। অনেকে আবার বলেন, আওয়ামী লীগ ও অ্যান্টি-আওয়ামী লীগ এই দুই পক্ষ। এই দুই পক্ষ নিজেরা জন্য যতটা না রাজনীতি করে নিজেরা জেতার জন্য– প্রতিপক্ষকে হারানো বা জব্দ করার জন্য করে তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। সদ্যসমাপ্ত তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ভূমিকা দেখে তাই মনে হয়েছে। বিএনপি মেয়র পদে হেরেছে, কিন্তু রাজনীতি বা কৌশলের খেলায় জিতেছে। পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগ এই নির্বাচন থেকে শুধু তিন মেয়রই পেয়েছে। হারিয়েছে অনেক কিছু।

লাগাতার হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিতে চরমভাবে ব্যর্থ এবং আন্দোলনের নামে পেট্রোল বোমায় মানুষ পুড়িয়ে মারার অভিযোগে অভিযুক্ত বিএনপির জন্য একটা 'এক্সিট রুট' ছিল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণ। বিএনপি চেয়েছে এই নির্বাচন থেকে সর্বোচ্চ লাভ উঠিয়ে নিতে। ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করা যে সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল এবং এই সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচন যে অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হতে পারে না, সেটা প্রমাণ করাই ছিল বিএনপির প্রধান কৌশল। মূলত এই কৌশলের খেলায় জিততে বিএনপি নির্বাচনী মাঠে নেমেছে। মেয়র পদে জেতা তাদের মূল লক্ষ্য ছিল বলে মনে হয় না।

মেয়র পদে তারা যে জিততে চায়নি, তার প্রথম প্রমাণ প্রার্থী নির্বাচন। চট্টগ্রামে মেয়র হিসেবে চরমভাবে ব্যর্থ ও সমালোচিত মনজুর আলমকে তারা সমর্থন দিয়েছে। ঢাকা দক্ষিণে তারা প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করেছে প্রায় দুই ডজন মামলা নিয়ে যিনি 'ফেরার' জীবনযাপন করছেন সেই মির্জা আব্বাসকে। আর উত্তরে আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট প্রার্থী বিজিইএমএ নেতা ও জনপ্রিয় টিভি উপস্থাপক হিসেবে সারাদেশে পরিচিত আনিসুল হকের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড় করিয়েছে তরুণ তাবিথ আউয়ালকে। প্রার্থী নির্বাচনেই মনে হয়েছে, বিএনপি এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের 'অন্য শিক্ষা' দিতে চায়, জিততে চায় না।

বিএনপি নেতাদের কথোপকথনের যে টেলিফোন রেকর্ড প্রকাশ পেয়েছে সংবাদমাধ্যমে, তাতে প্রমাণিত হয় ২৭ এপ্রিল বিএনপি যে নির্বাচন বর্জন করবে, এ সিদ্ধান্ত তারা আগেই নিয়ে রেখেছিল। নির্বাচনের দিন তা বাস্তবায়ন করেছে। তারা আসলে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল একটা ইস্যু সৃষ্টির জন্য। তাদের প্রার্থী নির্বাচন, প্রচার-প্রচারণা, প্রত্যেক কেন্দ্রের জন্য এজেন্ট ঠিক করতে না পারা বা ঠিক না করা, শুধু মেয়রদের নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেওয়া– এসব তাদের কৌশলের খেলাই ফুটিয়ে তুলেছে। নির্বাচন যদি বর্জন করতে হয়, তবে বিএনপিসমর্থিত মেয়রপ্রার্থীরাই কেবল কেন তা করবেন? তাদের সমর্থিত কাউন্সিলরপ্রার্থীদের কেন একই নির্দেশ দেওয়া হল না? এ ক্ষেত্রে তাদের দ্বৈত ভূমিকা তাদের নির্বাচন বর্জনের উদ্দেশ্য পরিষ্কার করে তুলে।

চট্টগ্রামে বিএনপিসমর্থিত মেয়রপ্রার্থী মনজুর আলম নির্বাচন বর্জনই শুধু করেননি, রাজনীতি থেকেই অবসর নিয়েছেন। এটা তার নিজের দলের প্রতি ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ। কারণ রাজনীতিবিদ হিসেবে নির্বাচনে কারচুপির জন্য তার আন্দোলন করার কথা, পদত্যাগ নয়।

তবে এই নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে আওয়ামী লীগের। এই দলের প্রার্থীরা হয়তো এমনিতেই জিততেন। কিন্তু তারা শেষ পর্যন্ত জনমতের উপর আস্থাশীল ছিলেন না। তাই তো তারা অনেক কেন্দ্রেই প্রভাব খাটিয়েছেন। জাল ভোট দিয়েছেন। প্রিসাইডিং অফিসারসহ নির্বাচনী কর্মকর্তাদের জিম্মি করে কোনো কোনো কেন্দ্রে ব্যালটে সিল মেরেছেন। গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছেন। আর নির্বাচন কমিশন অনিয়মের ঘটনাগুলো আমলে না নিয়ে আওয়ামী লীগের আজ্ঞাবহ হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। বিএনপি এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে ঠিক এই আচরণই আশা করেছিল। এ ক্ষেত্রে বিএনপির পাতা ফাঁদে আওয়ামী লীগ আনাড়ীর মতো ধরা খেয়েছে!

তবে বিএনপি নেতৃত্বের মধ্যে একটা 'নিরব ভোট বিপ্লবের স্বপ্ন' ছিল বললেও অমূলক হবে না। খালেদা জিয়া স্বয়ং ভোটের আগে এমন একটা আহবান একাধিকবার জানিয়েছেন। এর আগে গেল বছরের শেষে কুমিল্লা ও রাজশাহীর বিএনপির মেয়রপ্রার্থীরা অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগে এনে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিল। পরে ভোটের ফলাফলে দেখা যায়, বিএনপির প্রার্থীরাই জয়ী হয়। এরপর তারা শপথও নেয়, মেয়রের দায়িত্বও পালন করে যায়। বেগম জিয়াসহ বিএনপি নেতৃত্ব হয়তো ভেবেছিলেন, এবারও তেমন কিছু ঘটে যাবে। এজেন্ট না থাকলেও, নির্বাচন থেকে সরে আসার ঘোষণা দিলেও বিএনপিসমর্থিত প্রার্থীরাই হয়তো জিতে যাবে। মানুষ একটুখানি সুযোগ পেলেই 'ভোট বিপ্লব ঘটিয়ে' 'অত্যাচারের বদলা' নেবে, উপযুক্ত জবাব দেবে। যদিও তা বাস্তবে ঘটেনি। আওয়ামী লীগও তা ঘটতে দেয়নি।

কৌশলের খেলায় বিএনপি জিতলেও দলটির সাংগঠনিক দুর্বলতা প্রকটভাবে প্রকাশ পেয়েছে। নির্বাচনী প্রচারে নেমে খালেদা জিয়া নগরবাসীকে সকাল সকাল ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেওয়ার জন্য ভোটারদের প্রতি আহবান জানানোর পাশাপাশি দলের নেতাকর্মীদের ভোটকেন্দ্র পাহারা দেওয়ার জন্য বলেছিলেন। কিন্তু হয়েছে তার উল্টো। বিএনপির বেশিরভাগ কেন্দ্রে এজেন্টই ছিল না। অনেক জায়গা থেকে বিএনপিসমর্থিত প্রার্থীদের এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে এটাও সত্য। তবে এ ক্ষেত্রে তাদের পক্ষে কথা বলার জন্যও কোনো লোক পাওয়া যায়নি। দলীয় সমর্থকদের ভোটার স্লিপ দেওয়া তো দূরের কথা।

বাস্তবতা হচ্ছে, নির্বাচনী কেন্দ্রগুলোতে গিয়ে বিএনপিসমর্থিত প্রার্থীদের কোনো লোকজন দেখা যায়নি। নির্বাচনী কেন্দ্রে বিএনপির এই দুর্দশা দলটির সাংগঠনিক দুর্বলতারই বহিঃপ্রকাশ। তাদের সমর্থকদের উপস্থিতি না থাকায় দৃশ্যত ভোট একতরফা হয়ে গেছে।

এত কিছুর পরও বাস্তবতা হল, বিএনপি যদি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকত, তাহলে একাধিক আসনে তাদের জয়লাভের সম্ভাবনা ছিল। শুধু শুধু দলের 'কৌশলের খেলা'র কাছে বলি হতে হয়েছে মনজুর আলম ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে আকস্মিক 'বদলি খেলোয়ার' হিসেবে খেলতে নামা তরুণ তাবিথকে।

তবে নির্বাচন নিয়ে কৌশলের খেলায় বিএনপিই জিতেছে। কারণ এটি নিয়ে নাগরিকমহল থেকে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। এতে মধ্যবিত্ত নাগরিকদের কাছে সমর্থন হারানো ক্ষমতাসীনদের 'নৈতিক ভিত্তি' আরও দুর্বল হয়ে পড়বে। নির্বাচনের পর বিএনপি হরতাল বা অবরোধ জাতীয় কিছু না ডাকার বিষয়কে বিএনপির 'শুভবুদ্ধি' হিসেবে না দেখে অনেকে 'রাজনীতি' হিসেবে দেখছেন। কারণ তাদের এখন সহানুভূতি আর সমর্থন দরকার। দরকার ব্যাপক সরকারবিরোধী জনমত।

বিএনপির সামনে এখন দল হিসেবে টিকে থাকাই বড় চ্যালেঞ্জ। কোনো দাবি আদায় ছাড়াই প্রায় তিন মাস হরতাল-অবরোধ-নৈরাজ্য চালিয়ে রণেভঙ্গ দিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ঘরে ফিরলেও রেখে গেছেন বেশ কিছু প্রশ্ন। দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সকল মানুষের প্রশ্ন, এত মানুষের জীবনহানি ঘটিয়ে কী অর্জন হল বিএনপি-জামায়াত জোটের? এত ক্ষয়-ক্ষতিরই বা কী জবাব দেবেন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া? পেট্রোল বোমা মেরে মানুষকে দগ্ধ করে পৈশাচিক কায়দায় হত্যার সংস্কৃতি আমদানি করে স্বাভাবিক ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক চর্চা ধ্বংসের প্রচেষ্টার দায় এখন কে নেবে?

তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিয়ে আপাতত বিএনপি সহিংসতার পথ পরিহার করলেও দলটির জন্য বিপদ কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি। প্রায় দেড়শ মানুষ হত্যার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাগুলো আরও সচল এবং হত্যাকারী-নাশকতাকারীদের সাঁড়াশি অভিযানের মাধ্যমে গ্রেফতার করে দ্রুত বিচারের উদ্যোগ গ্রহণের পথেই হাঁটছে ক্ষমতাসীনরা। প্রক্রিয়াটি জোরেশোরে চালু হলে নিঃসন্দেহে পুরো দলকেই ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হবে।

জামাত-শিবিরের পেট্রোল বোমার উপর ভর করে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর থাকার ভুল ও আত্মঘাতী সিদ্ধান্তটির জন্য বিএনপিকে মাশুল গুণতেই হবে। অতিমাত্রায় জামাতনির্ভরতা, নীতি এবং কমিটমেন্টবিহীন মহাসুবিধাবাদী রাজনীতি থেকে সরে না এলে বিএনপি সংসদে, নগর ভবনে এমনকি রাজপথেও স্থান খুঁজে পাবে না।

মানুষ যতই অ্যান্টি-আওয়ামী লীগ হোক, বিএনপি এই সাংগাঠনিক শক্তি দিয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে পারবে এটা বিশ্বাস করা কঠিন। তাদের নিজেদেরও এ ব্যাপারে আস্থা থাকার কথা নয়। অবরোধ, ককটেল, পেট্রোল বোমা মারলেই সরকারের পতন সম্ভবপর নয়, এটা তারা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। সময় এসেছে সব কিছু পর্যালোচনা করে দেখার। সরকারপক্ষ কী করেছে, তা এখন সবাই কমবেশি জানে। কিন্তু বিএনপি কোথায় ও কীভাবে ব্যর্থ হল, সেটা তাদের বুঝতে হবে। আত্মসমালোচনা করতে হবে। বিএনপি যে রাজনীতির পথ থেকেই বিচ্যুত হয়েছিল, এটা কি বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব অনুধাবন করতে পারেন?

বাস্তব অভিজ্ঞতাহীন প্রতিহিংসাপরায়ণ প্রবাসী নেতৃত্ব আর অতিউৎসাহী বিভিন্ন পেশাজীবী গ্রুপ এ জন্য প্রধানত দায়ী বলে অনেকে মনে করেন। প্রশ্ন হল, নিকট অতীতের ভূমিকার মূল্যায়ন, পুনর্বিবেচনা এবং আগামী দিনে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথে ফিরে আসার হিম্মত কি খালেদা জিয়া দেখাতে পারবেন বিশাল জনসমর্থনপুষ্ট দলটির দিকে তাকিয়ে?

চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট।