মৌসুমী প্রতিবাদ নয়, বদলাতে হবে দৃষ্টিভঙ্গি

রাহমান নাসির উদ্দিন
Published : 4 May 2015, 01:27 PM
Updated : 4 May 2015, 01:27 PM

নারীনির্যাতন, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা, যৌনহয়রানি, নারীর অধস্তনতা প্রভৃতি বিষয়াদি পারিবারিক, সামাজিক এবং জাতীয় পরিসরে ইদানিং বেশ জোরালোভাবে আলোচিত হচ্ছে যা নারীর ক্ষমতায়ন, সক্ষমতা বৃদ্ধি, সমানাধিকার, পেশাগত উন্নয়ন, নারীশিক্ষার প্রসার প্রভৃতি সামাজিক ও রাজনৈতিক ডিসকোর্স আবারও নতুন করে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। কেননা সাময়িক জিরান দিয়ে কিছু কিছু ঘটনা আমাদের সামনে এমনভাবে হাজির হয় যা আমাদের 'নারী উন্নয়ন'কেন্দ্রিক ঢেঁকুরের ভেতরে বাস্তবতার কাঁটা ঢুকিয়ে নতুন করে জানান দেয় আমাদের সমাজে নারীর অবস্থান কোথায়।

সম্প্রতি বাংলা ১৪২২ সালের নববর্ষ 'পহেলা বৈশাখ' উদ্যাপনের সময় সংঘটিত নারীনির্যাতনের ঘটনা আমাদেরকে সে রকম একটি বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এ ধরনের ঘটনা যখন ঘটে আমরা সবাই মিলে হঠাৎ বেশ উত্তপ্ত ও উত্তেজিত হয়ে উঠি। গোটা সমাজ তখন 'মৌসুমী উত্তেজনায়' ভোগে! মিডিয়া বেশ গরম-গরম খবর যোগান দেয়; আর ভোক্তা হিসেবে আমরা সেসব ফলোআপ বেসুমার গিলে থাকি। টেলিভিশনের টকশোগুলো জমজমাট হয়ে ওঠে। শহুরে শিক্ষিত নাগরিক মধ্যবিত্ত মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশের রিচ্যুয়াল পালন করি। প্রেস ক্লাব, শাহবাগ কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গন যুৎসই নিউজ-আইটেম হয়ে উঠে।

রাষ্ট্র বরাবরই চামড়া-বাঁচানোর পাঁয়তারার ফন্দি এঁটে ঘটনার ভয়াবহতা পাতলা করবার কৌশল গ্রহণ করে। আর দায়িত্বশীলরা নিয়মিতভাবে অস্বীকৃতির সংস্কৃতির চর্চায় ব্যস্ত হয়ে উঠেন। এদিকে দলকানা বুদ্ধিজীবীরা ঘটনা বিশ্লেষণের নামে চিবিয়ে চিবিয়ে পাণ্ডিত্য জাহির করে সরকারের তাঁবেদারি শুরু করেন। সব সময় একটি 'তদন্ত কমিটি' গঠন করা হয়, যার প্রধান কাজ হচ্ছে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত না-করা। তারপর সকল উত্তেজনা আর উত্তাপ আস্তে আস্তে ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে। আর আমরা, নাগরিক মধ্যবিত্তরা প্রাত্যহিক জীবনে ফিয়ে গিয়ে রুটি-রোজগারে ব্যস্ত হয়ে উঠি। তারপর ঝিমিয়ে পড়ে সবকিছু।

বৈশাখের ঘটনায়ও আমি সত্যিকার অর্থে সেই লক্ষণই দেখছি। কেননা, রিচ্যুয়ালের এন্তার আলামত সেই বার্তাই দিচ্ছে এবং এ কারণেই বাংলাদেশে নারীনির্যাতনের ঘটনা বেড়েই চলছে। সংবাদপত্রের হিসাব অনুযায়ী গত পাঁচ বছরে দেশে ৯৩ হাজার ৬৮৬টি নারীনির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। কেবল ২০১৩ সালেই সংঘটিত হয়েছে ৪৭৭৭টি ঘটনা (দেখুন, দৈনিক ইত্তেফাক ০২/০১/২০১৪)। ২০১৪ সালে সংঘটিত হয়েছে ৪৬৬৫টি, যার মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ৯৩৯; আর ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৯৯ জনকে (দেখুন দৈনিক সমকাল ০১/০১/২০১৫)।

তাই, নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে রাজধানীর কোনো শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে মিনারেল-ওয়াটারে গলা ভিজিয়ে আমরা যতই সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলি না কেন, বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় নারীর অবস্থানের এখনও পর্যন্ত তেমন একটা ইতিবাচক-গুণগত পরিবর্তন হয়নি। পহেলা বৈশাখের ঘটনার বিশ্লেষণের মাধ্যমে মূলত সে বয়ানই আমি এখানে পেশ করার করার চেষ্টা করেছি।

বাংলাদেশের সমাজ-ব্যবস্থা প্রধানত পেট্রিয়ার্কাল বা পুরুষবাদী এবং সে-কারণেই এর চরিত্র পুরুষাধিপত্যবাদী। আর এ কাঠামোতে নারীর অবস্থান গবেষণা করে নৃবিজ্ঞানী সারা সি হোয়াইট রাজশাহীর কুমিরপুর (লেখিকার দেওয়া ছদ্মনাম) গ্রামের উপর লিখিত তার বিখ্যাত 'এথনোগ্রাফি আর্গুইং উইদ দ্য ক্রোকোডাইলস: জেন্ডার আ-ক্লাস ইন বাংলাদেশ' (১৯৯২) গ্রন্থে প্রতীকী উপস্থাপনায় দেখিয়েছেন যে, এ-সমাজ হচ্ছে আসলে একটা পুকুরের মতো আর এ-সমাজে বসবাস করা পুরুষ হচ্ছে 'কুমির'। সমাজের নারীরা এসব কুমিরদের সঙ্গে যুদ্ধ করে পুকুরে বাস করে। যাকে প্রবাদবাক্যে বলা হয়, 'জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে যুদ্ধ'। এটা রূপাকার্থে সমাজে বসবাসরত নারী-পুরুষের এক ধরনের অসম-ক্ষমতা এবং নারীর উপর পুরুষের একচ্ছত্র আধিপত্যবাদ বা আধিপত্যবাদী সম্পর্কই নির্দেশ করে। অতএব, সমাজের কুমিরেরা নিজের নিজের মতো করে নারীর ইচ্ছা নিয়ন্ত্রণ করবে; তাকে ইচ্ছেমতো নির্মাণ করবে; তাকে তার স্বাধীন ইচ্ছার বিরুদ্ধে পরিচালিত করবে; ভোগ করবে; কাপড় পরাবে, আবার প্রয়োজনমতো কাপড় খুলবে। এটাই কুমিরের সঙ্গে পুকুরের জলে বাস করার নিয়তি। পহেলা বৈশাখের নারীনির্যাতনের ঘটনা আমাকে সারা হোয়াইটের কুমিরপুকুরের কথাকেই বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছে।

সত্যিকার অর্থেই কিছু কিছু ঘটনা আছে যা আমাদের বিবেক, আবেগ, মনুষ্যত্ব এবং সুষ্ঠু সমাজ-ভাবনার চেতনায় তুমুলভাবে নাড়া দেয়। বাংলা নববর্ষের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে নারীনির্যাতনের যে ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে, তা গোটা সমাজকে একেবারে ভেতর থেকে ঝাঁকি দিয়েছে। প্রশাসন ও রাষ্ট্রযন্ত্র ততটা বিচলিত না-হলেও সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ রীতিমতো নড়েচড়ে উঠেছে যাকে আমি বলি 'মৌসুমী উত্তেজনা'। তবে আমার কাছে মনে হয়েছে, সমাজের এবং সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের এই যে তাৎক্ষণিক নড়াচড়া এবং নির্যাতিত নারীর জন্য বেসুমার ব্যাকুলতা, এটা যতটা না পহেলা বৈশাখের স্বাভাবিক উদ্যাপনের ফাঁকে নারী নির্যাতনের ঘটনার বেদনাবোধ থেকে, ততোধিক খুবই সুকৌশলে ঢেকে রাখা সমাজের কুৎসিত চেহারা উন্মোচিত হওয়ার কারণে। কেননা সমাজের এ চেহারা উন্মোচিত হওয়ার ভেতর দিয়ে শহুরে নাগরিক মধ্যবিত্তের মধ্যে নিজেদেরকে সভ্য সভ্য ভাববার যে গোপন সুখ আছে, সেটা বেশ সংকটের মধ্যে পড়ে যায়।

নারীর স্বাধীনতা, ক্ষমতায়ন, অধিকার প্রতিষ্ঠার অগ্রগতি নিয়ে বগলবাজানো বুদ্ধিজীবীদের বাকোয়াজ, এনজিও ব্যবসায়ীদের দেখানেপনার ঢেঁকুর এবং মিডিয়ার মিথ্যে বাহাদুরি পহেলা বৈশাখের ঘটনার ভেতর দিয়ে অবগুণ্ঠন খুলে প্রকাশ্য হয়েছে। আমরা যতই নারীস্বাধীনতার কথা বলি-না-কেন, এ-সমাজে এখনও নারীদেরকে পুরুষের উদ্দাম-উদ্যাপনের অবজেক্ট হিসেবেই গণ্য করা হয়। পুরুষদের বড় অংশ নারীকে যৌন-লালসা মেটানোর যন্ত্র হিসেবে বিবেচনা করে। তাই, আমরা যতই আধুনিকতা, শিক্ষা এবং সভ্যতার মেকি চাদরে সব ঢেকে রাখার চেষ্টা করি না কেন, সমাজের আসল চেহারা বিরতি দিয়ে এভাবেই আমাদের সামনে হাজির হয়।

আজ থেকে প্রায় দেড় দশক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরেই প্রায় একই কায়দায় বাঁধনের বস্ত্রহরণ করা হয়েছিল। তার বিচার আমরা দেখিনি। বরঞ্চ বাঁধনের অর্ধনগ্ন ছবি দেখে আমরা অনেকেই ভেতরে ভেতরে গোপনে গোপনে ইরোটিক-সুখ অনুভব করেছি! তাই, পহেলা বৈশাখের মতো একটি সর্বজনীন অনুষ্ঠানে, বাঙালির প্রাণের অনুষ্ঠানে নারী নির্যাতনে মতো ভয়াবহ ও কুৎসিত ঘটনা ঘটে।

এ-ঘটনাই প্রমাণ করে আমরা এখনও মানুষ হয়ে উঠতে পারিনি। এখনও এতটুকু উপলব্ধি করতে শিখিনি যে, যে নারী লাঞ্ছিত হয়েছে, সে আমাদেরই কারও বোন, কারও মেয়ে কিংবা কারও বন্ধু। যে সমাজের মানুষ মা, বোন, মেয়ে কিংবা বন্ধুর সম্ভ্রম রক্ষা করতে জানে না, রাস্তায় নির্যাতন করে বুনো উৎসব করে, সে সমাজ কোনোভাবেই সভ্য হতে পারে না। এ ঘটনাই প্রমাণ করে যে, আমাদের সভ্যতা-শিক্ষাদীক্ষা-সুশীল আস্তিনের তলে আসলে বাস করে এক অসভ্য-কুৎসিত সমাজের অস্তিত্ব। এ সমাজ এখনও সত্যিকার অর্থেই একটি পুকুর যেখানে একটা উল্লেখযোগ্য-সংখ্যক পুরুষ হচ্ছে কুমির। আর নারীরা কুমিরের (পুরুষদের) সঙ্গে পুকুরে (সমাজে) বাস করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ঘটনা ঘটেছে, তার বিবরণ দিয়ে আমি সেই বীভৎস ঘটনার পুনরোৎপাদন করতে চাইনা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেন বারবার আমাদের সামনের সমাজের এ-কুৎসিত চেহারা উন্মোচিত হয়? কেন বারবার প্রকাশ্যে নারীনির্যাতনের ঘটনা ঘটে?

অনেকেই বলার চেষ্টা করছেন, পর্যাপ্ত নিরাপত্তার অভাব কিংবা প্রশাসনের নির্লিপ্ততার কারণে এ-ধরনের ঘটনা ঘটে। কিন্তু আমি মনে করি, নিরাপত্তার অভাব কিংবা প্রশাসনের নির্লিপ্ততাই মূল কারণ নয়। তার অর্থ এই নয় যে, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা এবং প্রশাসনের নির্লিপ্ততা কোনোভাবেই ক্ষমাযোগ্য। কিন্তু আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে আমাদের সামাজিক নিরাপত্তার ধারণা, নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি এবং আমাদের স্কুলিং প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকার দিকে যা মানুষকে প্রাণিত্বের উর্ধ্বে উঠে সত্যিকার সামাজিক ও মানবিক মানুষে রূপান্তরিত করতে পারে।

এখানে মনে রাখা জরুরি যে, সামাজিক নিরাপত্তা কেবল পুলিশি নিরাপত্তা নিয়ে তৈরি করা যায় না। সমাজের মানুষ এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোই মানুষের নিরাপত্তা বিশেষ করে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। আজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে এ ঘটনা ঘটেছে বলেই সমাজে এর ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এ রকম অসংখ্য নারীনির্যাতনের ঘটনা, অসংখ্য ধর্ষণ প্রতিনিয়ত দেশের প্রত্যন্ত প্রান্তরে ঘটছে, মিডিয়া এবং মেট্রোপলিটন ফোকাসের বাইরে থাকার কারণে যার খবর আমাদের গোচরে আসে না। ফলে, এ রকম কিংবা এর চেয়ে ভয়াবহ ঘটনাও আমাদের মধ্যে কিঞ্চিত হা-হুতাশ পর্যন্ত উৎপাদন করে না। তাই, কেন্দ্র-কেন্দ্রিক দৃষ্টিদারি এবং নজরদারির পাশাপাশি প্রত্যন্ত অঞ্চলেও সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া জরুরি।

তাছাড়া, সনাতনভাবেই বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় বিদ্যমান পুরুষাধিপত্যের যে প্রবল প্রভাব সেখানে নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে এখনও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে এ কথা বলা যাবে না। নারীরা সমাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে এ রকম গবেষণা-তথ্য নেই। কেবল ঢাকার চিত্র এবং চরিত্র দিয়ে বাংলাদেশকে বিচার করা যাবে না। নারীশিক্ষার হার বেড়েছে; জিপিএ-৫ এর ভাগাভাগিতে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরা সমানতালে ভাগ বসাচ্ছে; চাকুরীজীবী হিসেবে নারীর সংখ্যা বেড়েছে; পেশাজীবী হিসেবে নারী এগিয়ে আসছে; এভারেস্ট জয় করেছে; এতে রাজধানিকেন্দ্রিক নারীর দৃশ্যমানতা বেড়েছে। মিডিয়ার কল্যাণে (কিংবা অকল্যাণে!) নারীর ব্যবহার বেড়েছে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে। কিন্তু নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টেছে এ-কথা জোর দিয়ে বলা যাবে না।

তাই, পহেলা বৈশাখের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক পরিসরে নারীনির্যাতনের ঘটনা ঘটে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে একই দিনে এক আদিবাসী ছাত্রীর শাড়ি টেনে খুলে ফেলা হয়। একই রকম ঘটনা ঘটেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের আরও কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ যদি এ রকম হয়, তাহলে সমাজের অন্যান্য পাবলিক পরিসর কতটা নিরাপদ সেটা সহজেই অনুমেয়। অসংখ্য সিসিটিভি ক্যামেরা বা ব্ল্যাক-কমান্ডো কিংবা সোয়াত ব্যাটালিয়ন দিয়ে নিরাপত্তা-বলয় তৈরি করলেই সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় না। প্রয়োজন নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন।

সর্বশেষ যেটি অনেক বেশি প্রয়োজন সেটা হচ্ছে, সমাজের বিদ্যমান স্কুলিং প্রতিষ্ঠানগুলির চরিত্র, ভূমিকা এবং কার্যকারিতা সত্যিকার সামাজিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ তৈরি করবার ক্ষেত্রে কতটা কীভাবে কাজ করছে, সেটা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করা। যেমন পরিবার যদি হয় সমাজের একটি মৌলিক স্কুলিং প্রতিষ্ঠান, তবে পারিবারিক শিক্ষাই পারে নতুন প্রজন্মের ভেতর একটি সংবেদনশীল, নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মনন তৈরি করতে।

আমাদের প্রাথমিক বিদ্যাপীঠগুলোও সামাজিক স্কুলিং প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করার জন্য যথাযথভাবে তৈরি করতে হবে। বিশেষ করে, পাঠ্যক্রমে সমাজের বিদ্যমান গলদগুলো উপলব্ধির পাশাপাশি সামাজিক মূল্যবোধ শিক্ষার অংশ হিসেবে মজ্জাগত করবার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। মানুষের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, সমাজের নির্যাতিত-নিপীড়িত-বঞ্চিতদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রভৃতি শিক্ষাকার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করে আজকের প্রজন্মকে মননশীল, সংবেদনশীল ও মানুষের প্রতি মর্যাদাশীল প্রজন্ম হিসেবে তৈরি করবার মধ্যেই সমাজের দেহ থেকে এ রকম বর্বর এবং বীভৎস ঘটনা দূর করা সম্ভব।

পরিশেষে, এবং শেষ বিচারে, রাষ্ট্রকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। কেননা, রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে মানুষের জান-মাল-ইজ্জতের হেফাজত ও যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব মূলত রাষ্ট্রের। এটা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব। পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে একজন বা কয়েকজন নারীকে নির্যাতনের মধ্য দিয়ে মূলত কোনো ব্যক্তিমানুষের ইজ্জত বিবস্ত্র হয় না বরঞ্চ গোটা রাষ্ট্রের অক্ষমতা বিবস্ত্র হয়; সমাজের আসল চেহারা উন্মোচিত করে।

এখন যত দ্রুত সম্ভব সমাজকে কাপড় পরানো প্রয়োজন। নারীনির্যাতনের ঘটনার প্রতিবাদ কেবল মৌসুমী উত্তেজনায় সীমাবদ্ধ না রেখে, একে একটি নিয়মিত সামাজিক আন্দোলন হিসেবে গড়ে তুলবার মধ্য দিয়েই নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন সম্ভব।