জীবনে ন্যূনতম মজুরির মরণে ক্ষতিপূরণের লড়াই

এম এম খালেকুজ্জামানএম এম খালেকুজ্জামান
Published : 20 May 2015, 05:03 AM
Updated : 20 May 2015, 05:03 AM

জীবনযাপনের জন্য কী অমানুষিক লড়াই না করতে হয় আমাদের পোশাক শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের। জীবিত অবস্থায় চলে বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম মজুরির লড়াই। শ্রম–ঘাম ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। কর্মপরিবেশ পাবার জন্য প্রাণপাত। আর সে লড়াই তাদের লড়তে হয় প্রবল সব প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে; কখনও মালিক, কখনও প্রশাসন, কখনও-বা খোদ রাষ্ট্র অবস্থান নেয় সেখানে। উল্লিখিত প্রতিটি লড়াইয়ের নিদর্শন বাংলাদেশের পোশাক কারখানার ইতিহাসের প্রতিটি স্তরে জড়িয়ে রয়েছে অবিচ্ছেদ্য অংশের মতো।

রাষ্ট্র যেখানে শ্রমজীবীদের দেখভালের মালিক হওয়ার কথা সেখানে সেটি যখন মালিকদের হয়ে লাশ গুমের রাজনীতি করে, তখন শ্রমজীবীদের নিরাশ্রয় হওয়া ছাড়া গতি থাকে না। ২০০৫ সালে স্পেকট্রাম গার্মেন্টসের ভবনধস, ২০১২ সালে আগুনে পোড়া তাজরিন আর ২০১৩ সালে বধ্যভূমিতে পরিণত হওয়া রানা প্লাজা যেন নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের শ্রমিকদের জন্য।

কেবল পোশাক শিল্পই নয়– যে কোনো শিল্পের বিবেচনায়– শিল্পের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাণঘাতী ও মানবসভ্যতার ইতিহাসের বৃহত্তম অবকাঠামোগত দুর্ঘটনা হিসেবে রেফারেন্স দেওয়া যায় রানা প্লাজা ধসের ঘটনার। এটা বলা বাড়াবাড়ি হবে না যে, রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির দুবছর পূর্তিতে দেশবাসীর মনে সে দিনের বেদনা, অসহায়ত্ব ও ক্ষোভ নতুন করে সঞ্চারিত হয়েছিল। বিশেষ এই দিন মনে রেখে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দুর্ঘটনায় হতাহতদের ক্ষতিপূরণ, পুনর্বাসন নিয়ে একাধিক সমীক্ষা প্রকাশ করেছে। সংবাদমাধ্যমও নতুন করে আলোকপাত করছে এ বিষয়ে। এ সবই স্বাভাবিক ছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, রানা প্লাজায় হতাহতদের স্মরণ, সমবেদনা ও তাদের পুনর্বাসন প্রসঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই কি আমরা বরাবর আয়োজন শেষ করব?

রানা প্লাজা ধসের পর তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমমান উন্নয়নে নানা পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি শ্রম আইনের সংশোধন করা হয়েছে। কিন্তু একাধিকবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও সরকার শ্রম আইন বাস্তবায়নের বিধিমালা জারি করেনি। তাতে সমস্যা যেটি হয়েছে তা হল, ইউরোপীয় ইউনিয়নের অবাধ বাজার সুবিধার বিষয়ে চাপে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ। একই বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রও নানাভাবে বাংলাদেশকে চাপ দিতে চাচ্ছে।

এক সময় বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ভবিষ্যত শুধু সস্তা শ্রমের কারণে, পণ্যের সস্তা মূল্যের ওপর নির্ভর করত। এখন পণ্যের ব্যাপারে ভোক্তাদের মনোভাবে উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত শ্রমিকের শ্রমমান, পারিপার্শ্বিকতাও বিবেচনায় থাকে। রানা প্লাজা ধরনের আরেকটি বিপর্যয় হলে আমাদের শিল্পের ভাবমূর্তি ধরে রাখা যাবে না। এখানে শ্রমিকদের যে পরিবেশে কাজ করতে হয় তা অব্যাহত থাকলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের জন্য দেওয়া অবাধ বাজারসুবিধা পর্যালোচনা করতে বাধ্য হবে। মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে এটি শর্ত হিসেবে বিবেচিত হবে তখন।

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ভবনধসের পর দুবছরেও ঘটনার জন্য দায়ের করা দুই মামলার চার্জশিট দিতে পারেনি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। অবহেলাজনিত কারণে মৃত্যু ও ইমারত নির্মাণ আইনে দায়ের করা দুটি মামলার চার্জশিট দাখিল করার নির্ধারিত সময় ছিল ১৫ এপ্রিল । কিন্তু সিআইডি চার্জশিট দাখিল করতে ব্যর্থ হওয়ায় আদালত ২১ মে পরবর্তী দিন ধার্য করেছে। এই দুই মামলায় প্রধান আসামী সোহেল রানাসহ ১২ জন কারাগারে আর পৌর মেয়র রেফায়েত উল্লাহসহ ১১ জন জামিনে আছেন। এদিকে হাইকোর্ট এক আদেশে এই দুই মামলার সর্বশেষ অবস্থা প্রতিবেদন আকারে আদালতে দাখিল করতে বলেছে। এই প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তা ও সাভার থানার ওসিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

মামলা দুটির তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয় কৃষ্ণ কর জানিয়েছেন, পুলিশের দায়ের করা ফৌজদারি মামলায় ৪২ জনকে ও রাজউকের ইমারত আইনের মামলায় ১৭ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট তৈরির প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে। আদালতের নিদের্শ অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে চার্জশিট প্রদান করা হবে। সিআইডির মামলা তদন্তকারী একজন কর্মকর্তা জানান, দুই মামলায় ৫৯ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট চূড়ান্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে রাজউকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হেলাল আহম্মেদ বাদী হয়ে ইমারত আইনে দায়ের করা মামলায় ১৭ জনকে আসামি করা হচ্ছে।

১৭ জনের মধ্যে সরকারের চারটি প্রতিষ্ঠানের ১৩ জন কর্মকর্তা রয়েছেন। এই ১৩ জন কর্মকর্তাকে অভিযুক্ত করার অনুমতি চেয়ে সংশ্লিষ্ট দফতর প্রধানদের কাছে চিঠি পাঠায় সিআইডি। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে, শ্রম মন্ত্রণালয়, রাজউক এবং স্থানীয় সরকার ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। দুঃখজনক বিষয় হল, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ছাড়া অন্য তিনটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে চিঠির জবাব পাওয়া যায়নি। তাই তদন্তের কাজ শেষ হলেও ঐ চিঠির জবাব না পাওয়ায় চার্জশিট দিতে পারছে না সিআইডি।

রানা প্লাজার ভয়ংকর জীবননাশের পর দেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে বহু সভা-সম্মেলন হচ্ছে, অনেক রকম প্রতিশ্রুতি শোনা গেছে। প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি পর্যায়ে টাকা সংগৃহীত হয়েছে। কিন্তু শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ নিয়ে এখনও সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা ঘোষণা করেনি বিজিএমইএ বা সরকার। রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় পুরো ক্ষতিপূরণ বুঝে পাননি আহত শ্রমিক ও নিহত শ্রমিক পরিবারের সদস্যরা। আবার ক্ষতিপূরণ নির্ধারণে বৈষম্য হয়েছে বলেও কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন।

এদিকে ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণের মাত্র ৭০ শতাংশ দিতে পেরেছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) নেতৃত্বাধীন রানা প্লাজা সমন্বয় কমিটি। তারা বলছে, পর্যাপ্ত অর্থ পেলেই ক্ষতিপূরণের বাকি ৩০ শতাংশের অর্থ দেওয়া হবে। বস্তুত ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়ে আইনি বাধ্যবাধকতাও তৈরি করা যায়নি। গত বছর হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটি উদ্যোগ নিয়ে গঠন করেন উচ্চপর্যায়ের কমিটি। সে কমিটি ঐ বছরই হাইকোর্টে প্রতিবেদন জমা দিলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসেনি। তাই ক্ষতিপূরণের মানদণ্ড ঠিক হয়নি।

এসব কারণে ভবিষ্যতে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের বেলায় কেবল শ্রম আইনই কার্যকর হবে। অর্থাৎ দুর্ঘটনায় নিহত শ্রমিকের পরিবার সর্বোচ্চ দুই লাখ ও আহত শ্রমিক সর্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকা পেতে পারে। ঘটনার ব্যাপকতা ও বিদেশি চাপ থাকায় রানা প্লাজার ক্ষেত্রে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে মালিকপক্ষ কখনও চায় না ক্ষতিপূরণের যৌক্তিক মানদণ্ড হোক।

ক্ষতিপূরণের অর্থ নিয়েও আছে বৈষম্য। ফ্যান্টম অ্যাপারেলসের সুইং আয়রনম্যান বাবু মিয়ার লাশ ও কবর কোনোটাই খুঁজে পাননি তাঁর স্বজনেরা। তাঁর মা মেহেরা ডিএনএ পরীক্ষার পরও ছেলের কবরের সন্ধান পাননি। ক্ষতিপূরণ হিসেবে সব মিলিয়ে পেয়েছেন ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য ক্ষতিপূরণ বিষয়ে রয়েছে ব্যাপক সমন্বয়হীনতা। শ্রম আইন অনুযায়ী মালিকপক্ষের এক লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা। যদিও হাইকোর্টের বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকারের বেঞ্চের স্বতঃপ্রণোদিত রুলের প্রেক্ষিতে গঠিত কমিটির সুপারিশ ছিল, প্রত্যেক নিহত ও নিখোঁজ শ্রমিকের পরিবার এবং স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে যাওয়া শ্রমিক ১৪ লাখ ৫১ হাজার ৩০০ টাকা ক্ষতিপূরণ পাবেন। আর আহত হওয়ার ধরন অনুযায়ী শ্রমিকেরা পাবেন দেড় লাখ থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে সাত লাখ টাকা। কোর্ট নীতিমালা তৈরির আদেশ দিয়ে সিদ্ধান্ত দিলে সেটি আইন হত।

একটি শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা ও নিরাপদ অবকাঠামো হচ্ছে রক্ষাকবচ। শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম শ্রমিকের জীবন ও নিরাপত্তা ছাড়া কিছু লোক কিছুদিন মুনাফার ভিত্তি গড়তে পারে, কিন্তু তাতে শিল্পের ভিত্তি ও বিকাশ নিশ্চিত হয় না। আশা করি, বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সব পক্ষই মনে রাখবেন।

এম এম খালেকুজ্জামান: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।