তিন সিটি নির্বাচন ও বিএনপির বর্জনের রাজনীতি

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 29 April 2015, 08:08 PM
Updated : 29 April 2015, 08:08 PM

তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচনেই আওয়ামী লীগসমর্থিত প্রার্থীরা জয়লাভ করেছেন। বেসরকারি ফলাফল অনুযায়ী ঢাকা উত্তরে আনিসুল হক, দক্ষিণে সাঈদ খোকন এবং চট্টগ্রামে আ জ ম নাছির উদ্দিন মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। এর আগে, ২৮ এপ্রিল তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচন দৃশ্যত শান্তিপূর্ণভাবেই অনুষ্ঠিত হয়েছে।

তবু বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটেছে। ঢাকায় গোলযোগের কারণে তিনটি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত করেছে নির্বাচন কমিশন। এছাড়া ২৫টির মতো কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ সাময়িকভাবে বন্ধ ছিল। একটি দৈনিকে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ঢাকার দুই সিটির ১৯৮২টি কেন্দ্রের মধ্যে বিচ্ছিন্ন কিছু গোলযোগ হয়েছে অর্ধশত কেন্দ্রে। দুই সিটিতে মোট ভোটার ৪২ লাখের বেশি। গোলযোগ হওয়া কেন্দ্রগুলোতে মোট ভোটার এক লাখের বেশি নয়। অন্যদিকে, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে কেন্দ্র সংখ্যা ৭১৯ এবং ভোটার সংখ্যা ১৮ লাখ ১৩ হাজার। ৫ থেকে ৭টি কেন্দ্রে কিছু গোলযোগের ঘটনা ঘটেছে। সেখানে সর্বোচ্চ ভোটার সংখ্যা ১০ থেকে ১২ হাজার। অর্থাৎ সমস্যা হয়েছে যে সব কেন্দ্রে তা পুরো নির্বাচনের ফলাফল প্রভাবিত করার মতো নয়।

তা সত্ত্বেও ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার তিন থেকে চার ঘণ্টার মধ্যেই কেন্দ্র দখল, জাল ভোট প্রদান, অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ এনে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়ে সরে দাঁড়ায় বিএনপি তথা ২০ দলীয় জোট। অনিয়মের যেসব অভিযোগ বিএনপি উত্থাপন করেছে তার সঙ্গে যারা সহমত পোষণ করেন তাদের অনেকে মনে করছেন না যে, নির্বাচনপ্রক্রিয়া থেকে বিএনপির সরে আসা ঠিক হয়েছে। বিএনপি মনোনীত প্রার্থীরা যে সংখ্যক ভোট পেয়েছেন তা কোনোভাবেই কম নয়। শেষ পর্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকলে অন্তত ঢাকার একটি আসনে তাদের প্রার্থীর জয়লাভের সম্ভাবনার কথা এখন কেউ কেউ বলছেন। কিন্তু দলটি অপেক্ষা না করে, ভোটারদের প্রকৃত মতিগতি না বুঝে নিজেদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছে।

এসব কারণেই বিএনপি আসলে জয়লাভের জন্য নির্বাচনে অংশ নেয়নি বলে অনেকে মনে করছেন। জয়েরর মনোভাব থাকলে প্রার্থী মনোনয়নে দলটি এতটা হেলাফেলা করত না। ঢাকা উত্তরের প্রার্থী হিসেবে বিএনপির পছন্দের তালিকায় ছিলেন ব্যবসায়ী নেতা আবদুল আউয়াল মিন্টু। কিন্তু তার প্রার্থিতা যিনি সমর্থন করেছিলেন তিনি ঢাকা উত্তরের ভোটার না হওয়ায় তার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যায়।

মিন্টুকে যারা চেনেন জানেন তারা মনে করেন, এই ভুল ইচ্ছাকৃত। তিনি খুবই গোছানো এবং হিসাবি মানুষ। ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি তিনি অনেক দিন ধরেই নিচ্ছেন। এমনও বলা হয়ে থাকে যে, ঢাকার মেয়র হওয়ার জন্যই তিনি বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন। তিনি ভালো করেই জানতেন কী কী কারণে একজনের মনোনয়নপত্র বাতিল হতে পারে। তারপরও তিনি কীভাবে এমন একজনকে সমর্থক হিসেবে বেছে নিলেন যিনি ঢাকা উত্তরের ভোটারই নন?

কেউ কেউ তাই এমনও বলেছেন যে, মিন্টু অর্ধেক সিটির মেয়র হতে চাননি বলেই তার মনোনয়নপত্রে ওই ভুলটি ছিল। মনোনয়নপত্র বাতিল হতে পারে জেনেই নিজের বিকল্প হিসেবে পুত্র তাবিথ আউয়ালকে দিয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। মিন্টুর মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিএনপি যদি তাবিথ আউয়ালের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করত তাহলেও নির্বাচনী প্রচারে পিছিয়ে পড়তে হত না তাবিথকে।

ঢাকা দক্ষিণে প্রার্থী বাছাইয়েও বিএনপি খুব বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন না। মির্জা আব্বাস বিএনপির বড় নেতা হতে পারেন, কিন্তু তার ভাবমূর্তি সাধারণ মানুষের কাছে খুব উজ্জ্বল নয়। এমনকি দলের মধ্যেও তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ঢাকার সাবেক নির্বাচিত মেয়র সাদেক হোসেন খোকার সঙ্গে তার বিরোধের কথা কারও অজানা নয়। মির্জা আব্বাস ঢাকার মেয়র এবং মন্ত্রী ছিলেন। তিনি কি মেয়র এবং মন্ত্রী হিসেবে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন? তখন তিনি এমন কী কাজ করেছেন যার জন্য তার প্রতি মানুষের সমর্থন থাকবে?

মির্জা আব্বাসের প্রতি বিএনপির বাধা ভোটার ছাড়া আর কারও উৎসাহ থাকার কথা নয়। সবচেয়ে বড় কথা, তার বিরুদ্ধে রয়েছে অসংখ্য মামলা। কয়েকটি মামলায় আগাম জামিন না পেয়ে তিনি 'পলাতক' রয়েছেন। এসব জেনেশুনেও তাকে ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র প্রার্থী হিসেবে সমর্থন জানিয়ে বিএনপি সম্ভবত এই বার্তাই দিয়েছে যে, তিনি জিতলে ভালো, না জিতলেও সমস্যা নেই।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে প্রার্থী মনোনয়নেও বিএনপির দায়সারা মনোভাবেই পরিচয় পাওয়া গেছে। মনজুর আলম আগের বার চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন বিএনপির সমর্থনে। তিনি ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত। আগের রাজনৈতিক পরিচয় ছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে। তিনি চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা মহিউদ্দিন চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ। বিএনপির সমর্থনে মেয়র নির্বাচিত হয়েও মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে তার খুব বেশি দূরত্ব তৈরি হয়নি বলেই শোনা যায়। তার কাছ থেকে আশানুরূপ সুযোগ-সুবিধা পায়নি বলে বিএনপির নেতা-কর্মীরা তাকে অপছন্দই করে।

এমন একজন নেতাকে সমর্থন দিলে দলের নেতা-কর্মীরা খুশিমনে তার পক্ষে নির্বাচনের মাঠে নামবে না এটা বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের অজানা থাকার কথা নয়। তারপরও তাকেই প্রার্থী হিসেবে সমর্থন করায় এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, বিএনপি নেতৃত্ব নির্বাচনে অংশ নিতে চেয়েছে, জয় চায়নি। কারণ, তারা হয়তো বুঝতে পেরেছিল যে, নির্বাচনে জয়লাভ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। সে জন্য শুরু থেকেই তারা নির্বাচনটি প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত করার জন্য সব ধরনের চেষ্টা করেছে। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় থাকবে না, সব প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ দেওয়া হবে না এবং সরকার বিজয় ছিনিয়ে নেবে, এ ধরনের প্রচারণা তাদের পক্ষ থেকে চালানো হয়েছে।

খেয়াল করার বিষয় হল, এ সব প্রচারণা চালানোর জন্য বিএনপি গণমাধ্যমের কাছ থেকে এক ধরনের সহযোগিতাও পেয়েছে। ফলে তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে যতটুকু না অনিয়ম হয়েছে, গণমাধ্যমে প্রচার হয়েছে তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। জাল ভোট, ভোট কেন্দ্র দখল এগুলো সব নির্বাচনেই আমাদের দেশে কমবেশি হয়ে থাকে। অনিয়মের মাত্রা কতটুকু, বিবেচনার বিষয় সেটাই। তিন সিটি করপোরেশনে যদি ভোট কেন্দ্র দখল করে সরকারসমর্থিত প্রার্থীদের পক্ষে ঢালাও সিল মারা হয়ে থাকে, তাহলে বিএনপিসমর্থিত প্রার্থীরা লাখ লাখ ভোট পেল কীভাবে? আওয়ামী লীগের কর্মীরা কি বিএনপিসমর্থিত প্রার্থীদেরও ভোট দিয়েছে?

নির্বাচন শতভাগ সুষ্ঠু হয়নি এটা হয়তো ঠিক। কিন্তু সে জন্য এটা বলা যাবে না যে, এই নির্বাচন একেবারেই অগ্রহণযোগ্য হয়েছে। বিএনপি ভোট গ্রহণের অর্ধেক সময়ের মধ্যেই রণে ভঙ্গ দিয়েছে। অর্থাৎ তাদের সমর্থিত ভোটাররা দুপুর ১২টার পর আর ভোট কেন্দ্রে যাননি এবং ভোটাধিকার প্রয়োগ করেননি। তারপরও বিএনপিসমর্থিত প্রার্থীরা বিপুল ভোট পেয়েছেন। শেষ পর্যন্ত তারা লড়াইয়ে থাকলে ফলাফল কী হত সে প্রশ্ন করা যায়।

আরও প্রশ্ন উঠে, তাহলে কি দলটি তিন সিটি নির্বাচন একটি 'ইস্যু' করতে চেয়েছে? সন্দেহ নেই, এতে তারা সফলও হয়েছে। কিন্তু সামগ্রিক বিবেচনায় বিএনপি রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে কিছু অর্জন করতে পেরেছে বলে মনে হয় না। নির্বাচনে অংশ না নিলে ভিন্ন কথা ছিল। অংশ নিয়ে মাঝপথে পিছু হটায় দলের মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মধ্যে যেমন প্রশ্ন ও হতাশা দেখা দেবে, তেমনি তাদের ভোটাররাও আশাহত হবেন এই ভেবে যে, তাদের ভোট কোনো কাজে এল না।

ঢাকা এবং চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে কিংবা জোর করে সরকারসমর্থিত প্রার্থীরা বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছে এটা সম্ভবত মনে করছেন না। বরং তারা এটাই মনে করছেন যে, বিএনপি সাংগঠনিকভাবে প্রস্তুত হয়ে এই নির্বাচনে অংশ নেয়নি। সে জন্যই ভোট কেন্দ্রে বিএনপির প্রার্থীদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়নি।

সরকারের পক্ষ থেকে কোথাও কোথাও বিএনপির নেতা-কর্মীদের ভয়-ভীতি দেখানো হয়নি তা বলা যাবে না। হামলা-মামলার ভয় তাদের নেতা-কর্মীদের মনে ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি কোনোভাবেই এমন ছিল না যে, তারা রাস্তায় নামতে পারবে না। সরকারের দিক থেকে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হবে সেটা বিএনপির জন্য প্রত্যাশিতই ছিল। তারপরও ভোটের দিন তারা কেন একেবারে সকালেই মাঠ ছেড়ে দিল বা আত্মসমর্পণ করল তার কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা তাদের নেতৃত্ব দিতে পারবেন বলে মনে হয় না। ভোটাররা যে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে নিরবে বিএনপিসমর্থিত প্রার্থীদের ভোট দিয়েছেন এটাও সম্ভবত নেতারা বুঝতে পারেননি।

এ প্রেক্ষিতে তিন সিটি নির্বাচনে 'ভোট ডাকাতি' হয়েছে এ কথা বলে দেশের মধ্যে নতুন করে সরকারবিরোধী বড় ধরনের আন্দোলন গড়ে তোলা বিএনপির পক্ষে সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। মানুষের কাছে যদি নির্বাচনটি গ্রহণযোগ্য না হত তাহলে কোনো না কোনোভাবে তার প্রতিক্রিয়া ভোটের পরে লক্ষ্য করা যেত। বিএনপিকে এখন নতুন করে ভাবতে হবে এবং আরও অপেক্ষা করতে হবে।

ভাবতে হবে সরকারকেও। তিন সিটিতেই সরকারসমর্থিত প্রার্থীরা মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন, কিন্তু নির্বাচনটি সবার কাছে সমানভাবে গ্রহণযোগ্য হয়নি। যারা মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন তাদের যোগ্যতা নিয়ে হয়তো সেভাবে বিতর্ক করা যাবে না। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় তারা নির্বাচিত হলেন সেটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকল।

নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা অনেকেই পছন্দ করতে পারেননি। কমিশন আরও দৃঢ় ও শক্ত অবস্থান নিলে সবার জন্যই ভালো হত। তাদের সম্পর্কে বিএনপিসহ সরকারবিরোধীদের যে ধারণা সেটাই সত্য বলে প্রমাণ করতে কমিশন সচেষ্ট ছিল বলে কেউ কেউ মনে করছেন। বিরোধীদের দুয়েকটি অভিযোগ আমলে নিলে কমিশনের প্রতি মানুষের আস্থা বরং বাড়ত। তাদের নড়বড়ে অবস্থান সরকারের জন্য কোনোভাবেই সহায়ক হয়নি।

সব মিলিয়ে মানুষের মনোভাব ও প্রতিক্রিয়া বিবেচনায় নেওয়ার সময় এসেছে। বিএনপির ভুলের জন্যই সরকার সফল হতে পারছে। কিন্তু বিএনপি বার বার একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করবে এটা মনে করে বসে থাকা ঠিক হবে না। তাই সরকার ও সরকারি দল আওয়ামী লীগকেও বদলাতে হবে। মানুষের মেজাজ না বুঝলে ভবিষ্যতে বড় ক্ষতির মুখোমুখি হবার আশঙ্কা রয়ে যাবে।

বিভুরঞ্জন সরকার: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।