নির্বাচন বর্জন ও কিছু রাজনৈতিক হিসাবনিকাশ

বিজন সরকার
Published : 30 April 2015, 03:38 PM
Updated : 30 April 2015, 03:38 PM

ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন বহু ঘটনার মধ্য দিয়ে শেষ হল। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা থেকে শুরু করে ফলাফল ঘোষণার আগ পর্যন্ত একের পর এক চমক ছিল নির্বাচনের প্রতিটি ধাপে। শেষাবধি বিএনপির নির্বাচন বর্জনের মধ্য দিয়ে তিনটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেই আওয়ামী লীগসমর্থিত মেয়রপ্রার্থীরা জয়লাভ করেছেন। কাউন্সিলর পদেও সরকারি দলসমর্থিত প্রার্থীরা বিএনপিসমর্থিত প্রার্থীদের চেয়ে বেশি সংখ্যায় জয় পেয়েছেন।

তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পরের তিন ঘণ্টায় তেমন কোনো অনিয়মের অভিযোগ ছিল না। বিচ্ছিন্ন কিছু ছিল যেগুলি তেমন গুরুতর নয়। তবে সকাল এগারটা থেকেই বিএনপিসমর্থিত প্রার্থীদের অভিযোগ একযোগে বাড়তে থাকে। অভিযোগের ধরনও অভিন্ন। শুরু হয় চট্টগ্রাম দিয়ে এবং শেষ হয় ঢাকায়। বেলা বারটার দিকে বিএনপির তরফ থেকে জানানো হল, ভোট জালিয়াতি এবং ভোট প্রদানে বাধার অভিযোগে বিএনপিসমর্থিত প্রার্থীরা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। তবে নির্বাচনে মোট ভোটগ্রহণ এবং মেয়রপ্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোটের বিষয়টি বিবেচনায় নিলে মনে হয়, বিএনপির অভিযোগগুলি নির্বাচনকেন্দ্রিক নয়, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই বুঝি করা হয়েছে। এ কথা বলার পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে।

প্রথমত, যদি ভোট কেন্দ্রে কোনো অনিয়ম ঘটে, তাৎক্ষণিকভাবে এ বিষয়ে অভিযোগ করতে হয় নির্বাচন পরিচালনাকারী সংস্থার কাছে। বিএনপি তা না করেই চট্টগ্রামে বেলা এগারটা এবং ঢাকায় বেলা বারটার দিকে তাদের সমর্থিত মেয়রদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে। তাই কাজটি কতটুকু যৌক্তিক, সে প্রশ্ন সামনে চলে আসে।

দ্বিতীয়ত, নির্বাচন যদি বর্জন করতে হয়, তবে বিএনপিসমর্থিত মেয়রপ্রার্থীরাই কেবল কেন তা করবেন? তাদের সমর্থিত কাউন্সিলরপ্রার্থীদের কেন একই নির্দেশ দেওয়া হল না? এ ক্ষেত্রে তাদের দ্বৈত ভূমিকা তাদের নির্বাচন বর্জনের উদ্দেশ্য পরিষ্কার করে তুলে।

তৃতীয়ত, চট্টগ্রামে বিএনপিসমর্থিত মেয়রপ্রার্থী মোহাম্মদ মনজুর আলম কেবল নির্বাচন থেকে নয়, রাজনীতি থেকেও সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। যেখানে সরকারি দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে জাল ভোটের অভিযোগে মোহাম্মদ মনজুর আলমের স্থির থাকার কথা, তিনি তা না করে দলীয় নেতাকর্মীদের সামনেই দলীয় রাজনীতি থেকে ইস্তফা দিলেন? এখানে উল্লেখ্য যে, মিডিয়ার সামনে কথা বলার সময় মনজুরের মুখমণ্ডল দেখেই বুঝা যাচ্ছিল যে, উনি বেশ চাপে আছেন।

চতুর্থত, ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ছিল দুহাজার সাতশ এক। বিএনপির মতো একটি দল কেন প্রতিটি কেন্দ্রে নির্বাচনী এজেন্ট নিয়োগ দিতে পারেনি? নির্বাচন নিয়ে তাদের যে যথেষ্ট প্রস্তুতির অভাব ছিল, তা কি এতে প্রকাশ পায়নি?

পাঠক এবার দৃষ্টি দিই ভোটের ফলাফলের দিকে। ফলাফল বিশ্লেষণ করার সময় আমাদের অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে যে, বিএনপি নির্বাচনে ছিল চট্টগ্রামে তিন ঘণ্টা এবং ঢাকাতে চার ঘণ্টা। প্রথমে চট্টগ্রামে বিএনপিসমর্থিত প্রার্থী মোহাম্মদ মনজুর আলম জাল ভোট প্রদান এবং ভোটদানে বাধার অভিযোগ এনে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মোট ভোটের সংখ্যা ১৮ লাখ ১৩ হাজার। চট্টগ্রামে বেলা এগারটায় নির্বাচন বর্জন করার পরেও বিএনপিসমর্থিত প্রার্থীর প্রতীক 'কমলা লেবু' পেয়েছে ৩ লাখ ৪ হাজার ৮৩৭ ভোট। আওয়ামী লীগসমর্থিত প্রার্থীর প্রতীক 'হাতি' পেয়েছে ৪ লাখ ৭৫ হাজার ৩৬১ ভোট। দুই প্রার্থীর মধ্যে ভোটের ব্যবধান মাত্র ১ লাখ ৭০ হাজার ৫২৪।

বিএনপি যদি বেলা এগারটায় নির্বাচন বর্জন না করত, সে ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের চিত্রটি ভিন্ন হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি ছিল। তাছাড়া চট্টগ্রামের ৭১৯ কেন্দ্রের মধ্যে কটি কেন্দ্রে ভোট জালিয়াতি হয়েছে, বিএনপি তাও নির্দিষ্ট করে বলেনি। যদি কোনো নির্দিষ্ট কেন্দ্রে ভোট জালিয়াতি হয়েই থাকে সে কেন্দ্রে আবারও ভোটগ্রহণের দাবি জানাতে পারত ওরা। সবচেয়ে অবাক করার মতো বিষয় হল, বিএনপি নির্বাচন কমিশনের কাছে কোনো অভিযোগ পর্যন্ত করেনি।

তবে নির্বাচন বর্জনের পাশাপাশি মোহাম্মদ মনজুর আলমের রাজনীতি ছেড়ে দেবার ঘোষণাটি সাধারণ মানুষের মনে সন্দেহের জন্ম দেয়। চট্টগ্রামের লোকজন বলছেন যে, প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে বিএনপির প্রার্থী নিজের নির্বাচনী এজেন্টই নিয়োগ দিতে পারেনি। মাঠে থাকা জামায়াত-শিবির পরিকল্পনা করেই বিএনপির পক্ষে এজেন্ট নিয়োগ না দেওয়ার জন্য কৌশলী ভূমিকা নেয়। এতে বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা চাপে পড়েন বলে অভিযোগ রয়েছে।

এবার আসুন ঢাকা উত্তরের সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ফলাফলের দিকে। এখানে মোট কেন্দ্র ১ হাজার ৯৩। মোট ভোটার ছিলেন ২৩ লাখ ৪৫ হাজার ৩৭৪ জন। আওয়ামী লীগসমর্থিত প্রার্থী আনিসুল হকের প্রতীক 'টেবিল ঘড়ি' পেয়েছে ৪ লাখ ৬০ হাজার ১১৭ ভোট। আর বিএনপিসমর্থিত প্রার্থী তাবিথ আউয়ালের প্রতীক 'বাস' পেয়েছে ৩ লাখ ২৫ হাজার ৮০ ভোট। দুই প্রার্থীর মধ্যে ভোটের ব্যবধান ১ লাখ ৩৫ হাজার ৩৭। মনে রাখতে হবে, বিএনপিসমর্থিত প্রার্থী ভোটের মাঠে ছিল মাত্র চার ঘণ্টা। এখানেও আমরা প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধানটি চার ঘণ্টার ও আট ঘণ্টার সাপেক্ষে খুব যে বেশি, তা দেখছি না।

ঢাকা দক্ষিণের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগসমর্থিত প্রার্থী সাইদ খোকন এবং বিএনপিসমর্থিত প্রার্থী পলাতক মির্জা আব্বাসের প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধানটি ঢাকা উত্তর এবং চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসমর্থিত প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধানের তুলনায় বেশি। দক্ষিণে মোট ভোটারের সংখ্যা ১৮ লাখ ৭০ হাজার ৭৫৩ এবং মোট ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ৮৮৮। সাইদ খোকনের 'ইলিশ' প্রতীক পেয়েছে ৫ লাখ ৩৫ হাজার ২৯৬ ভোট এবং মির্জা আব্বাসের 'মগ' প্রতীক পেয়েছে ২ লাখ ৯৪ হাজার ২৯১ ভোট। দুই প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধান ২ লাখ ৪৪ হাজার ৫। এ ক্ষেত্রে সাইদ খোকনের পিতা, প্রয়াত সফল মেয়র হানিফের একটি ভূমিকা রয়েছে। তাছাড়া সাইদ খোকনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নেই। অন্যদিকে মির্জা আব্বাসের ব্যক্তি ইমেজ অনেক ক্ষেত্রেই প্রশ্নবিদ্ধ। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অনেক অভিযোগ রয়েছে; বেশ কিছু মামলা বিচারাধীন। ফলে বিএনপি যদি ঢাকা দক্ষিণে আট ঘণ্টা নির্বাচন চালিয়ে যেত, তাহলেও জয় পাওয়া তাদের জন্য সম্ভব হত না।

সামগ্রিকভাবে, তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ভোট পড়েছে ২৬ লাখ ৪৮ হাজার ২০৫, যা শতকরা হিসাবে দাঁড়ায় মোট ভোটের ৪৩ দশমিক ৯ শতাংশ। বিভিন্ন অসঙ্গতির কারণে বাতিল হয় ১ লাখ ২১ হাজার ৩ ভোট। যে কোনো নির্বাচনে ৪৩ দশমিক ৯ শতাংশ ভোট পড়লে একে অবশ্যই ভোটারবিহীন নির্বাচন বলা যাবে না। বিএনপির নেতা মওদুদ আহমদ বলেছেন, ভোট পড়েছে ৫ শতাংশ। তিনি যদি তার দাবির পক্ষে পরিসংখ্যান দিতেন, তাহলে তা গ্রহণযোগ্য হত। তাছাড়া মওদুদ অবশ্যই ভুলে যাননি যে, ২০০২ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মাত্র ১০ থেকে ১২ শতাংশ ভোট পড়েছিল।

মোট ভোটের ফলাফল এবং ভোটের মাঠে থাকার সময় বিশ্লেষণ করলে এটি স্পষ্ট যে, বিএনপি যদি ভোটের মাঠে আট ঘণ্টা থাকত, ঢাকা উত্তর এবং চট্রগ্রামে বিএনপিসমর্থিত প্রার্থীদের জয়লাভের সম্ভাবনাই বেশি ছিল। তবে ঢাকা দক্ষিণের ভোটের প্রবণতা দেখে বলা যায়, এটিতে আওয়ামী লীগসমর্থিত প্রার্থীই জয় পেতেন।

এবার আসুন, নির্বাচন নিয়ে বিএনপির রাজনৈতিক উদ্দেশ্যটি বিশ্লেষণ করি। এটি একটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন। এর মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতার পরিবর্তন হয় না। বিএনপি শুরু থেকেই এটি নিয়ে ইস্যু তৈরি করার পরিকল্পনা করে এগিয়েছে। নির্বাচনটি নিয়ে বেশ হোমওয়ার্ক করেছে তারা, এটা তাদের গৃহীত পদক্ষেপে দৃশ্যমান। তারা হিসাব-নিকাশ করে দেখেছে যে, সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে জিতলেও তাদের রাজনৈতিক মুনাফার চেয়ে ক্ষতি বেশি হবে। বিএনপিসমর্থিত প্রার্থীরা জয় পেলে সরকারি দল রাজনৈতিকভাবে সুবিধা পাবে। কারণ তাতে একটি রাজনৈতিক সরকারের অধীনেও যে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব, তা আবারও প্রমাণিত হয়ে যাবে। তখন বিএনপি কেয়ারটেকার সরকারের দাবি নিয়ে এগুতে পারবে না।

বিএনপির আরেকটি হিসাব হল, সিটি কর্পোরেশনে জয় পেলে সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাস হয়েছে দাবি করে তারা বর্তমান সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটাতে পারবে না। বর্তমান বাস্তবতায় বিএনপির সে সাংগঠনিক শক্তিও নেই। তাছাড়া দলসমর্থিত প্রার্থী মেয়র হলেও বিএনপির খুব একটা লাভ যে হবে না সেটি ওরা বুঝতে পেরেছে। বিভিন্ন অভিযোগে কয়েকটি সিটি কর্পোরেশনের বিএনপি-সমর্থিত মেয়ররা জেলে আছেন; আবার কেউ কেউ পলাতকও রয়েছেন।

বিএনপিসমর্থিত প্রার্থীর জয় অনেক ক্ষেত্রেই যে বিএনপির জন্য মঙ্গলদায়ক হয়নি, তার একটি উদাহরণ দিই। চট্টগ্রামের মনজুর আলম আওয়ামী লীগ ছেড়ে বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলেন। বিএনপির টিকেটে মেয়র হওয়ার পর তাকে বিএনপি কোনো আন্দোলন-সংগ্রামে পাশে পায়নি। বরং তাকে দ্বিতীয়বারের মতো মেয়র নির্বাচিত হতে সাহায্য করার চেয়ে নির্বাচন থেকে সরিয়ে নেওয়াই বিএনপির জন্য বেশি লাভজনক।

ঢাকা উত্তরের মেয়রপ্রার্থী হওয়ার জন্য চেষ্টা করেছিলেন আবদুল আওয়াল মিন্টু। একসময় আওয়ামী ঘরানার রাজনীতি করা এই ব্যবসায়ী নেতা ঢাকার মেয়র হওয়ার জন্যই আওয়ামী লীগ ছেড়ে বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায় বলে বিভক্ত ঢাকার মেয়র হওয়া মিন্টুর কাছে নিরাপদ বলে মনে হয়নি। তাই ইচ্ছাকৃত ভুল করে নিজের প্রার্থিতা হারালেন তিনি। বিএনপিও মিন্টুর হিসাবটি বুঝতে পেরেছে। তাই তারা মাহি বি চৌধুরীকে সমর্থন না দিয়ে মিন্টুর ছেলে অপরিচিত তাবিথ আউয়ালকে দলীয় সমর্থন দেয়। মনজুর আলমের মতো তাবিথও বিএনপির বাইরের লোক। জয় পেলে তাবিথ বিএনপি নেতাদের বাঁশির সুরে নাচবেন না, এটিও নেতারা ভালো করেই জানতেন।

বিএনপির একমাত্র দলীয় প্রার্থী ছিলেন ঢাকা দক্ষিণের মির্জা আব্বাস। কিন্তু তিনি নির্বাচিত হলেও লাভ হত না দলের। কারণ তার নামে বহু মামলা রয়েছে। যদি আব্বাস নির্বাচিত হয়েও যেতেন, সরকার পরে বিভিন্ন অভিযোগ করে তাকে সরিয়ে সেখানে প্রশাসক নিয়োগ করতে পারে, এমন আশঙ্কা রয়েই যায়। তাই এই পলাতক নেতা মেয়র নির্বাচিত হলে গাজীপুর ও রাজশাহীর মেয়রদের মতো অবস্থা হতে পারে, সেটি খালেদা জিয়াসহ বিএনপি নেতারা ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন।

সব হিসাব-নিকাশ করে দলসমর্থিত প্রার্থীদের জয়লাভের সুযোগ না দিয়ে নির্বাচন বর্জন করে রাজনৈতিক সুবিধা নিতেই বিএনপি ব্যস্ত ছিল। নির্বাচনে জয়লাভ তাদের উদ্দেশ্য ছিল না, ছিল ইস্যু তৈরি করা। এখন দেখা যাক, সামনে তারা কোন ধরনের রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেয়।


বিজন সরকার:
গবেষক।