ভূমিপুত্রদের মেট্রোপলিস হয়ে ওঠা: প্রসঙ্গ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন

এম এম খালেকুজ্জামানএম এম খালেকুজ্জামান
Published : 18 July 2011, 02:39 PM
Updated : 27 April 2015, 05:28 AM

মেট্রোপলিস হয়ে ওঠা আর হল না আমাদের ভূমিপুত্রদের। কারণ যেসব কারণের উপস্থিতিতে মেট্রোপলিটন গড়ে ওঠে, ঢাকা সেভাবে গড়ে উঠতে পারেনি। গত পঞ্চাশ বছরে চারশ বছরের পুরনো এই ঢাকা ঘিরে ইতিহাসের বড় ধরনের অদল-বদল ঘটেছে। শহর বিকাশের স্বাভাবিক গতি এখানে ছিল না। মোঘল নবাব, ব্রিটিশ ও পাকিস্তানিরা এখানে আধিপত্য সৃষ্টি করেছে। সুবিধাবাদে প্রাধান্য দিয়ে তারা তাদের ইচ্ছামতো শহর গড়ে নিয়েছে, শহরের ব্যবহার করেছে।

মূলত বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশের রাজধানী হওয়ার মাধ্যমে ঢাকা আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধান করে। অনুসন্ধানের খোঁড়াখুড়িতেই কেটে গেছে সাড়ে চার দশক, পুনঃর্গঠনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা যায়নি। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প, প্রশাসন ও কর্মক্ষেত্রের প্রধান কেন্দ্র হয়ে শহর বেড়েছে, রোশনাই চমকে দিয়েছে সবাইকে; কিন্তু সত্যিকার শহরের অনেক চরিত্রই অনুপস্থিত রয়ে গেছে।

ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিট একটি ব্রিটিশ থিংক ট্যাংক প্রতিষ্ঠান যারা প্রতি বছর বিশ্বে বসবাসের অনুপযোগী শহরের তালিকা প্রকাশ করে থাকে। এক দশক ধরে প্রতি বছরই বসবাসের অনুপযোগী শহরের তালিকার শেষের দিকে জায়গা হচ্ছে ঢাকার। গত বছরের জরিপেও ১৪০ শহরের মধ্যে ঢাকার স্থান ছিল ১৩৯তম। মূলত বাসযোগ্যতা, পরিবহন, রাস্তাঘাট, পানি ও বিদ্যুতের সমস্যা, পয়োনিষ্কাশন ও জ্বালানি এসব অবকাঠামোগত সুবিধার ভিত্তিতে এ তালিকা করা হয়। বরাবরই তালিকার তলানিতে থাকব এ সত্য যেন আমরা মেনে নিয়েছি। তা না হলে দুর্নীতির কারণে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের তালিকায় উপরের দিকে থাকলে যেমন প্রতিক্রিয়া হয়, বসবাসের অনুপযোগী শহরের তালিকার শেষের দিকে থাকলে তেমন সাড়াশব্দ দেখা যায় না কেন?

ঢাকার নাগরিকদের সেবা প্রদানের উদ্দেশ্যে ১৯৯০ সালে ঢাকা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনকে ঢাকা সিটি করপোরেশনে রূপান্তর করা হয়। তখন নাগরিকদের প্রদত্ত সেবার মান বাড়াতে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। ১৯৯৪ ও ২০০২ সালে সরাসরি নগরবাসীর ভোটে দুজন মেয়র নির্বাচিত হন। ২০১১ সালে সিটি করপোরেশন প্রশাসনিক ও ভৌগোলিকভাবে দুভাগে বিভক্ত হলে মেয়র ও কাউন্সিলরের পদ বিলুপ্ত হয়ে যায়। তারপর আর নির্বাচন না হওয়ায় নগরবাসী নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে সেবাগ্রহণের সুযোগ থেকে এখনও বঞ্চিত।

মেট্রোপলিটন, কসমোপলিটন, মেগাপলিটনের কালে আমাদের ঢাকা মেগা মেগা সমস্যা নিয়ে ধারণ করে আছে তার নাগরিকদের। আমরা জানি যে, বিশ্বের সব বড় শহরেই একটি কেন্দ্রীয় পরিচালনা কর্তৃপক্ষের হাতে থাকে নগর পরিচালনার সার্বিক ক্ষমতা। কিন্তু ঢাকা শহর সে অর্থে বিপরীত। এ নগর প্রায় অভিভাবকহীন, নয়তো বহু অভিভাবকের পরিচালনার চাপে পিষ্ট। ১৯ মন্ত্রণালয়ের বায়ান্নটি (কোনো কোনো হিসাব মতে ছাপ্পান্নটি) সংস্থা ঢাকা শহর পরিচালনা করছে। এগুলোর মধ্যে সমন্বয় নেই, আছে তীব্র বিভাজন। একটি সংস্থা কোনো কাজে হাত দিলে অনেক সময় অন্য সংস্থা দাঁড়িয়ে যায় বাধা দিতে। ওয়াসা, ডেসা, বিটিসিএল বিভিন্ন প্রয়োজনে তাদের লাইনের জন্য রাস্তা কাটে। কিন্তু রাস্তার দেখভাল করে ঢাকা সিটি করপোরেশন। স্বাধীনতার আগে ওয়াসা ডিসিসির অধীনে থাকলেও পরে একে আলাদা করে ফেলা হয়। অন্যদিকে রয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। এটি আমলাতান্ত্রিকতায় পুরো নিমজ্জিত। তাদের কর্মকাণ্ডে জনসম্পৃক্ততা নেই। অনেকেই মনে করেন, রাজউকের কোনো পরিকল্পনা কখনও জনগণের উপকারে আসেনি; উল্টো জনগণকে হয়রানি করেছে এসব।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো একটিমাত্র কর্তৃপক্ষের অধীনে পরিচালিত হওয়া উচিত। সে হিসেবে তিতাস, ওয়াসা, ডিপিডিসি, রাজউক, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি), সড়ক ভবন, বাংলাদেশ টেলিফোন কোম্পানি লিমিটেডসহ (বিটিসিএল) ফায়ার সার্ভিস, ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট সব সেবা প্রতিষ্ঠানের একক কর্তা প্রতিষ্ঠান বা কোঅর্ডিনেটর হতে পারত ঢাকা সিটি করপোরেশন। তাহলেই শুধুমাত্র নগরবাসী সর্বোচ্চ নাগরিক সেবা পেতে পারে।

উন্নত সেবা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে ২০০৫ সালে একটি স্টাডি করা হয়। বিভিন্ন মহলের সঙ্গে আলাপ করে কিছু সুপারিশও তৈরি হয়েছিল তখন। সুপারিশে ঢাকার সব সেবা সংস্থাকে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসার কথা বলা হয়। সেখানে এককেন্দ্রিক একটি শক্তিশালী সিটি করপোরেশনের কথাও হয়েছিল। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তা অনুমোদিত হয়।

বাস্তবে দেখা গেল, সে সব কিছু না করে উল্টো ঢাকাকে বিভক্ত করা হল। সেবা বাড়ানোর কথা বলে ডিসিসি ভাগ করা হলেও, আসলে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সংশ্লিষ্টরা জানান, শুধু সমন্বয়হীনতাই নয়, সেবাদানকারী এই বায়ান্ন সংস্থার ঢাকা শহরের অঞ্চল পরিধি নিয়েও বিভাজন রয়েছে। সংস্থাগুলো নিজেদের মতো করে তাদের পরিধি নির্ধারণ করেছে। ফলে সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে তারা বরাবরই বঞ্চিত থাকছেন। যেমন, দুই ডিসিসির প্রশাসনিক এলাকা ৩৬০ বর্গকিলোমিটার। যদিও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার আয়তন এক হাজার ৩৫৩ বর্গকিলোমিটার। অন্যদিকে রাজউকের আওতাধীন এলাকা রয়েছে এক হাজার ৫৩০ বর্গকিলোমিটার। রাজউকের এই এলাকার মধ্যে রয়েছে ডিসিসি ছাড়াও সাভার, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, টঙ্গী ও কদমরসুল পৌরসভা।

অনেকে মনে করেন, এটা আসলে এক ধরনের অভিভাবকহীনতা। আর এ কারণে ঢাকা শহর কখনও-ই পরিকল্পনামাফিক গড়ে ওঠেনি। নাগরিকরাও বঞ্চিত হচ্ছেন সেবা থেকে।

স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সব প্রয়াস ও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীভূত। অর্থাৎ একটি এককেন্দ্রিক সরকারের সব উন্নয়ন পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন, আর্থিক ব্যয় সবই কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে হয়ে আসছে। একই সঙ্গে সরকারি প্রশাসনও কেন্দ্রীভূত। ফলে দেশের উন্নয়নকাজের বিকেন্দ্রীকরণ হয়নি। এতে প্রশাসন ও উন্নয়ন সত্যিকার অর্থে ঢাকা এবং অন্য কয়েকটি বড় শহরকেন্দ্রিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ঢাকা শহরই হয়ে গেছে বাংলাদেশের সব ধরনের কাজের প্রাণকেন্দ্র।

স্থানীয় সরকারের একটি বিশেষ এবং স্বতন্ত্র সত্তা রয়েছে, যা আমাদের সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তর, সেগুলোর ক্ষমতা সংবিধানে সংযোজিত এবং সেগুলো না মেনে বা বাস্তবায়ন না করা মানেই সংবিধানের ধারাগুলোর অবমাননা। বিভিন্ন সময় কেন্দ্রীয় সরকারের অযাচিত হস্তক্ষেপের ফলে স্থানীয় সরকার সঠিকভাবে গঠন করা হয়নি;এগুলো কাজও করতে পারেনি। তাছাড়া দায়সারা গোছের যে সব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তাতে স্থানীয় সরকারের কাজে বিঘ্ন ঘটেছে।

পাকিস্তান আমলে জেনারেল আইয়ুব আর বাংলাদেশ আমলে জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদ 'বিরাজনীতিকরণ'-এর অন্যতম কৌশল হিসেবে স্থানীয় নির্বাচনের ব্যবহার করেছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা কমবেশি সফলতাও পেয়েছেন। স্থানীয় নির্বাচনের টোপ দিয়ে রাজনৈতিক উত্তাপ-উত্তেজনা প্রশমনে সাময়িক দম নেওয়ার ফুরসত সৃষ্টি করেছেন তারা। সবাই একই কৌশল আসলে ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষিত থেকে প্রয়োগ করেছেন। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলীয় সরকারগুলো কিছুটা ব্যতিক্রম। ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকার বিতর্কিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কলঙ্ক মাথায় নিয়ে জাতীয় রাজনীতির দাবার ছকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের চাল দিয়ে বাজিমাত করেছে।

বলা হয় এই নির্বাচন নির্দলীয়; তবুও দলীয় মনোনয়ন ও সমর্থন দেওয়া হচ্ছে আর নির্বাচন কমিশন নির্বাক থাকছে। সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও সংসদে দলীয়ভাবে নির্বাচন করার পরামর্শ দিয়েছেন। আমরা মনে করি, এ ব্যাপারে আরেকটু চিন্তা-ভাবনা করা দরকার। কারণ সিটি করপোরেশন একটি বাস্তবায়নকারী সংস্থা। এ নির্বাচন যদি দলভিত্তিক হয়, তাহলে দলমতনির্বিশেষে নাগরিকের স্বার্থরক্ষা হবে না। আমরা দেখছি, দলীয় বিবেচনায় মেয়র অপসারণ হচ্ছে; বরাদ্দ কমবেশি দেওয়ার সংস্কৃতিও পুরনো। তার চেয়ে বড় কথা, এখনও এ নির্বাচন আইনিভাবে নির্দলীয়। সেখানে দলীয় মনোনয়ন ও প্রচারণা আইনের লঙ্ঘন।

স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন ২০০৯ (৬০ নং আইন)-এর প্রথম অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, সিটি কর্পোরেশন একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা হইবে এবং ইহার স্থায়ী ধারাবাহিকতা ও একটি সাধারণ সিলমোহর থাকিবে এবং এই আইন ও বিধিসাপেক্ষে, ইহার স্থাবর ও অস্থাবর উভয় প্রকার সম্পত্তি অর্জন করিবার, অধিকারে রাখিবার ও হস্তান্তর করিবার ক্ষমতা থাকিবে এবং ইহার নামে মামলা দায়ের করিতে পারিবে বা ইহার বিরুদ্ধেও মামলা করা যাইবে। এর অর্থ হচ্ছে, সিটি কর্পোরেশনগুলো পৃথক সত্তা ও পরিচয় বহন করে এবং এগুলো প্রশাসনিক একাংশ বা ইউনিট হিসেবে গণ্য হবে, যা কেন্দ্রীয় রাজনীতি থেকে পৃথক।

জনগণের ক্ষমতায়ন হল আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্য। নির্বাচনের মাধ্যমে নাগরিকরা তাদের আত্মরক্ষা ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা রক্ষার তাগিদে একত্র হয়ে আইনের শাসন দ্বারা পরিচালিত হওয়ার শর্তে তাদের ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছা শাসকদের কাছে সমর্পণ করে। নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও এক ধরনের দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে তাদের দায়িত্ব পালন করেন এবং একটি নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে জনগণ তা মূল্যায়ন করে। এটাই হচ্ছে গণতন্ত্রের আচরিত রীতি। হবসের 'সামাজিক চুক্তি' ধারণাটি এখান থেকেই বাস্তব রূপ লাভ করেছে।

সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আমরা একালের 'সামাজিক চুক্তি'র বাস্তবায়ন দেখতে চাই।

এম এম খালেকুজ্জামান: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।