নায়ক, নায়কোচিত আর কাপুরুষের উন্মাদনার সমাজ

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 20 April 2015, 11:48 AM
Updated : 20 April 2015, 11:48 AM

যে সব দেশকে আমরা উদার আধুনিক খোলামেলা বলে ভাবি বা সেভাবে চিনি তাদের ভেতরটা আমরা জানি না। জানতে চাইও না। মিডিয়ায় কয়েকটা ছবি আর সিনেমা-বায়স্কোপ বা গুটিকয় ভিডিও দেখেই কিছু একটা ধারণা করে নিই। কথায় বলে, অর্ধসত্য বা অনুমাননির্ভরতা মিথ্যার চেয়েও ভয়ংকর। আমাদের তারুণ্য বা নতুন প্রজন্মের কাছে উদার দেশের ছবিটা বড় গোলমেলে। সেটা আমাদের যৌবনেও একই ধরনের ছিল। আমরা ভাবতাম, একবার বিদেশে যেতে পারলেই হল, সব 'সুন্দরী' আর 'যুবতীদের' গালে চুম্বন 'ফ্রি'! ধারণা ছিল, যাবতীয় অবদমন আর ফ্রয়েডীয় বাস্তবতার পূরণ হবে নিমিষে। আসলে কি তাই?

নিঃসন্দেহে পশ্চিমা নামে পরিচিত গণতান্ত্রিক আর খোলামেলা সমাজের দেশগুলো উদারনৈতিক। কিন্তু এই উদারতার মানে কি যৌনতা বা অবদমনের জন্য সমাজ বা রাষ্ট্রকে যা খুশি তা করতে দেওয়া? এই যে এত বছর বিদেশে আছি, বসবাস করছি, দুগালে সহস্র চুম্বনের দাগ থাকার পরও কি এর একটি কামনার চিহ্ন বহন করে? যারা সকালে আপিসে, বিকেলে হঠাৎ কোথাও দেখা হয়ে গেলে বা কারও বাড়িতে বেড়াতে গেলে গাল বাড়িয়ে চুমু দিয়ে 'হাই-হ্যালো' বলে জড়িয়ে ধরে তাদের এই আহ্বান বা সৌজন্যে কামনার লেশমাত্র থাকে না। এটা বিদেশ দিয়ে বুঝতে হবে কেন?

গত কয়েক দিনে যে ছবিটি আমার মনে রেখাপাত করে আছে সেটিও গালে চুম্বনের। মেয়র পদপ্রার্থী আনিসুল হকের গালে আদর দেওয়া মহিলাকে দেখলেই বোঝা যাচ্ছে, এটি মায়ের আদর। আমাদের দেশে এমন আদর আমরা মা-খালাদের কাছ থেকে পেয়েই বড় হয়েছি। কিন্তু তখন যে সৌজন্য আর স্বাভাবিকতা ছিল সেটি এখন প্রায় বিলুপ্ত হবার পথে। ঐ যে বলছিলাম, মানুষ যখন ভুল জানে আর সে জানা হয় অপরিমিত, তখন তার নিয়ন্ত্রণ থাকে না। আজ বলগাহীন মিডিয়া অথবা বাধাহীন দৃশ্য ও অদৃশ্যমান মিডিয়ার ভেতর তারুণ্য নিজেদের পরিচয় ও শেকড় এড়িয়ে উন্মাদ আর যৌনতানির্ভর হয়ে উঠতে চাইছে। এ জন্য তারা যতটা দায়ী, ঠিক ততটাই দায়ী আমাদের সমাজ ও জীবনব্যবস্থা।

মানুষের মতো জাতির জীবনে যদি শান্তি ও স্থিতিশীলতা না থাকে, সে জাতি কোনোদিনও মাথা উঁচু করে চলতে পারে না। বাংলাদেশে একদিকে যেমন উন্নয়ন আর প্রগতির ধাবমান রথ চলছে, আরেক দিকে রয়েছে অনুশাসনের নামে কঠিনতর জোয়াল তুলে দেওয়ার খেলা। আপনি এক হাঁড়ি মিষ্টি দেবেন অথচ তার ব্যবহারবিধি জানাবেন না এটা কি ঠিক? মোল্লারা তো এ সুযোগেই বলে, পোশাক বা আবরণের স্বল্পতাই এ জন্যে দায়ী। অথচ যে কোনো পরিসংখ্যান বলে দেবে, মোল্লার দেশে বা কঠিন ধার্মিকতার নামে আবদ্ধ দেশে বা সমাজে যৌনাচার ও নির্যাতন আধুনিক দেশের চেয়ে অনেক বেশি। মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত এক বিলেতি চিকিৎসকের একটা বই পড়ে চমকে উঠেছিলাম। বইটি ছিল বাংলায় অনুদিত। তিনি লিখেছিলেন, সেখানে প্রতি ১০ জন রোগীর ভেতর ৮ জন আসত এক সমস্যা আর এক আবদার নিয়ে– কীভাবে যৌনক্ষমতা বা আগ্রহ আরও বাড়ানো যায়। ডাক্তার তাদের কারও কারও সক্ষমতার কথা শুনে এমনও বলতে বাধ্য হয়েছিলেন যে, তারা যে কোনো সাধারণ মানুষের চাইতে বেশি সক্ষম।

অন্যদিকে দেখুন, রাশিয়া বা ইউরোপের শীতপ্রধান দেশগুলোর নানা ভিডিও বা ছবি দেখে আমরা যা ভাবি বাস্তবতা ঠিক তার উল্টৌ। সেখানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার শূণ্যের কোঠায়। সাধারণত মানুষ আবহাওয়ার কারণেও পরিমিত।

আমরা আসলে কোন জীবনবোধ ধারণ করছি? অনুসরণ করছি কেমন জীবনচর্চা? বাহ্যিকভাবে আমরা বিনোদন আর ভালোলাগার জন্য হিন্দি ও ইংরেজি সিনেমার কাছে হাত পাতলেও অন্তর্জগত মরুময়। সে মরুতে নারী দেখলেই লালা ঝরবে, এ কথা তো হুজুর নামধারী রাজনৈতিক নেতারাই বলে আসছেন। হেফাজতের হুজুর সাহেবের বয়ানে এমনও শুনেছি যে, কোনো নারীর পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে কোনো পুরুষের শরীরে প্রতিক্রিয়া না হলে তিনি নাকি 'নপুংসক'। এসব সরল বিশ্বাসে শোনা আর গিলে খাওয়া তরুণ কী জানল, কী শিখল?

আরও কিছু বিষয় দেখুন। উদার দেশগুলোয় রাত বারোটা বাজার আগেই টিভিতে ঘুম ঘুম ভাব। আপনি পে চ্যানেলে কী দেখবেন তার কথা আলাদা। মাথায় রাখা হয়েছে পরিবার ও সমাজ। তাই বারোটার পর চলবে প্রাপ্তবয়স্কদের অনুষ্ঠান বা ছবি। যে ধারণা থেকে এগুলো দেখানো হয় তা হল, মানুষ এখন ঘুমোতে যাবে বা বিশ্রামে, তাই তার প্রয়োজন নিছক বিনোদন বা হালকা কিছু। তাও ছোটদের বাদ দিয়ে। রেটিং ব্যাপারটা আমাদের দেশে থাকলেও কেউ মানে না। এখানে মানতেই হয়। আছে জরিমানা এবং কোড দিয়ে প্রোগ্রাম বন্ধ করার কৌশল।

স্লিপিং ডিসঅর্ডার নিয়ে কথা বলার সময় এরা বলে, রাতে যারা ফেসবুকিং করে, রাতজেগে টিভি দেখে বা এসএমএসে ম্যাসেজ করে তাদের আয়ু কমে যায়। বিশিষ্টজনেরা বিশেষত ডাক্তার, মনোরোগ বিশারদ আর সাইকোলজিস্টরা বলেন, এগুলো একাকীত্ব আর সর্বনাশের প্রতীক। তারা রাতদিন জাতিকে বিশেষত তরুণদের সাবধান করে যাচ্ছেন। এতে কী কী রোগ হয় তারও একটা ব্যাখ্যা চলে প্রতিদিন। আর আমাদের অবস্থাটা দেখুন।

রাত যত গভীর, টকশো নামের উন্মাদনা তত প্রকট। যারা তাতে যোগ দেন তারা সাধারণ মানুষের ঘুমিয়ে পড়ার আগের সতেজ মনটাও করে তোলেন উন্মাদ আর অস্থির । এর কারণ কী? এখন মানুষ মিডিয়াকে চায় সব সময়ই। কিন্তু তাই বলে এভাবে? রাত যত দুপুর, তত কিছু চেনামুখ টকশোর নামে ঠকবাজি করে দেশের মানুষের রক্তের স্পন্দন বাড়াবে? আর তা শুনে ঘরে ঘরে লোকের রক্তচাপ বাড়বে, ঝগড়া চলবে? এর নাম কি সুস্থতা? এই সেদিন ফাঁসি নিয়ে রাতভর কী ধুমধাম! ফাঁসি কি এমন বিষয় যে জেলখানা থেকে সরাসরি সম্প্রচার করতে হবে? যার যা প্রাপ্য, আইন বা বিচার যা করবে, তাই হবে। ফাঁসির আসামিকে নিয়ে মানুষের রক্তপ্রবাহ বাড়াতে হবে কেন?

শুধু সে রাতে নয়, ভোর না হতেই এ নিয়ে আবার উন্মাদনা! গাঁধীর মৃত্যুর পর জওহরলাল নেহেরু রেডিও এবং টেলিভিশনে মানুষকে শান্ত থাকার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কী হয়েছে আমাদের আসলে? আমরা কি সুস্থ আছি, থাকতে পারছি?

এ জন্যেই বুঝি লেনিন তাঁর আমলে মানুষকে 'ড. জিভাগো' পড়তে দেননি। ইসলামের নবী নিজে চিনি খাওয়া বন্ধ করার পর আরেক জনকে তা ত্যাগ করতে বলেছিলেন। আমাদের দেশের সবদিকে যখন এত উত্তেজনা আরা নোংরামি, বৈশাখি আয়োজনে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা যুবকদের কি বিচ্ছিন্ন কিছু বলে ভাবা সম্ভব? আপনি একদিকে উস্কানি দিবেন, আরেক দিকে বলবেন 'সব গেল সব গেল', তাহলে কী করে সম্ভব এগুলো রোধ করা? পারবেন না। যে দেশে মানুষ জানে কোটি কোটি টাকা চুরি করলে শাস্তি নেই, মানুষ মারলে মাফ পাওয়া যায়, জানে বোমা মারলে আগুন জ্বালালেও কিছু হয় না, চাপাতি দিয়ে খুন করলেও পালিয়ে থাকা যায়, সে দেশে নারীদের উত্যক্ত করা তো কোনো ঘটনাই নয়!

আর একটা বিষয় দেখুন। এই যে লিটনরা নারীদের নিপীড়নের হাত থেকে বাঁচাল, আমরা জানি এরাই হিরো। এরাই ভরসা। এখনও অন্ধকারে এরাই আলো। অথচ রাষ্ট্র কি তা জানে? নায়ক আর নায়কোচিত দুটো ভিন্ন বিষয়। চেহারা-সুরত ভালো হলে আর ক্যামেরার চোখে পড়লে অনেকেই নায়ক হতে পারেন। নায়কোচিত বা বীরোচিত হবার জন্যে চাই শুদ্ধ রক্ত আর বিশুদ্ধ আত্মা। যে দেশে শকুন আর শেয়ালের খাদ্য আজ মানুষের হৃদয়– যে সমাজে পুরুষের হাত নারীর বসনে ও শরীরে ঘৃণ্য মাছির মতো ভনভন করে, সে দেশে লিটনরাই নায়কোচিত কাজ করেছে, ওরাই বীর।

কত তুচ্ছ কারণে কত মানুষ বড় বড় ভবনে ডাক পায়। অতিথি হয়, পুরস্কারও নেয়। দেশের প্রধান নেতা নারী, বিরোধী দলীয় নেতা নারী, কোনো কিছুতে নেই অথচ দাপটের সঙ্গে একটি বড় দলের নেৃত্বত্বি দিচ্ছেন যিনি তিনিও নারী। অথচ নারীর সম্ভ্রম বাঁচানো লিটনদের প্রতি কারও চোখ পড়ল না এখনও। মানুষ যদি তাদের মাথায় তুলে না রাখে, সমাজ যদি মায়া ও ভালোবাসায় কাছে না টানে, রাষ্ট্র ও সরকার বা রাজনীতি যদি স্বীকার করে না নেয়, এ দেশে ধর্ষক আর খুনি জন্মাবে, বীর জন্মাবে না।

আমরা কি পারি না তাদের আরও বড় করে তুলতে? আমাদের মাথা ছাড়িয়ে দিগন্তে পৌঁছে যাক তারা। এ জায়গা নষ্ট হয়ে গেলে বাঁচবারও পথ থাকবে না আমাদের ।

সিডনি; ১৮ এপ্রিল, ২০১৫