গণতন্ত্রের বিজয়ই সকলের বিজয়

আমানুল্লাহ কবীর
Published : 16 April 2015, 04:26 PM
Updated : 16 April 2015, 04:26 PM

উত্তপ্ত আবহাওয়ায় কাঙ্ক্ষিত স্বস্তিদায়ক এক পশলা বৃষ্টি যেন আমাদের গা ছুঁয়ে গেল ৫ এপ্রিল। বেগম খালেদা জিয়া আদালতে হাজিরা দিলেন এবং জামিন পেলেন; তারপর নির্বিঘ্নে ফিরে গেলেন বাসায়। গত তিন মাস উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় থাকার পর স্বস্তির নিশ্বাস দেখল সকল স্তরের মানুষ। ওই দিন দলমতনির্বিশেষে সকলের চোখ ছিল বকশি বাজারের বিশেষ জজ আদালতের দিকে। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে খালেদা জিয়া গিয়েছেন আদালতে আত্মসমর্পণ করতে। এরপর জামিন পেয়ে কি ফিরে যেতে পারবেন বাসায়, না তাঁর স্থান হবে জেলে, এতদিন যে হুমকি দিয়ে আসছেন সরকারি দলের মন্ত্রীএমপিরা?

না, তা হয়নি। আপাতত শুভ লক্ষণ দাঙ্গা-হাঙ্গামাবিক্ষুদ্ধ রাজনীতিতে। অনেকটা আকস্মিকভাবেই যেন রণক্ষেত্রে অস্ত্র-সংবরণ। গুজবের হাত-পা আছে, আদালত থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর সারা দেশে ছড়িয়ে গিয়েছিল, খালেদা জিয়ার গ্রেপ্তার এখন কেবল সময়ের ব্যাপার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও জাতীয় সংসদে বলেছিলেন গ্রেপ্তারি পরোয়ানা সংশ্লিষ্ট থানায় পৌঁছলেই তাঁকে গ্রেপ্তার। কিন্তু বকশি বাজার থেকে ৩৮ দিনেও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পৌঁছেনি গুলশান থানায়। তখন অবশ্য শুরু হয় নানা গুঞ্জন। এ বিলম্ব কি খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তারের সরকারি প্রস্তুতি, না সরকার শেষ সুযোগ দিচ্ছে তাঁকে?

এরই মধ্যে সরকার রব তুলল সিটি করপোরেশন নির্বাচনের– ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণে এবং চট্টগ্রামে। নির্বাচন কমিশন ডান-বাম চিন্তা না করে বলল, তারা প্রস্তুত। পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি বলল, তারাও প্রস্তুত। ভোট গ্রহণের দিনক্ষণ ঠিক করে গত মাসের শেষের দিকে ঘোষণা করা হল নির্বাচনের তফশিল। অনেক সংশয়বাদী রাজনৈতিক পণ্ডিত বললেন, বিএনপির জন্য সরকারের এটা আরেক ফাঁদ। বিএনপিসহ সরকারবিরোধী মহলের অনেকরই আশঙ্কা একই। কেউ কেউ বললেন, সরকার ঘরপোড়ার আগুনে আলু পুড়ে খাওয়ার ব্যবস্থা করছে।

এমনকি, আওয়ামী লীগের কোনো কোনো সিনিয়র নেতা-মন্ত্রীও এমন রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠানে আপত্তি তুলেছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ছিলেন অনড়, আর বিএনপি ছিল অপ্রস্তুত। অপ্রস্তুত বিএনপির সামনে ভোটের বাক্স হাজির করে কি তিনি তাদের ফাঁদে ফেলতে চেয়েছিলেন? নাকি, তাঁর কাছে গত বছরের ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের মতো নিশ্চিত তথ্য ছিল যে আন্দোলনরত বিএনপি সিটি নির্বাচনে অংশ নেবে না?

সরকারবিরোধীরা বলছেন, আওয়ামী লীগ বিএনপিকে ফাঁদে ফেলতে গিয়ে নিজেই ফাঁদে পড়েছে, নির্বাচন ঘোষণার আকস্মিকতায় দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে অংশগ্রহণে সায় দিয়ে বিএনপি পাল্টা বেকায়দায় ফেলেছে সরকারকে। তাদের বক্তব্য অবশ্য ফাঁপা বুলি নয়। বস্তুত তিন সিটি নির্বাচন এখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সরকারবিরোধী দল বিএনপির জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসেবে হাজির হয়েছে নানা কারণেই।

তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচন ঘোষণা, সশরীরে খালেদা জিয়ার আদালতে হাজিরা ও জামিন, তিন মাস পর গুলশান অফিস ছেড়ে বাসায় ফিরে যাওয়া এবং বিএনপির নয়া পল্টনে কেন্দ্রীয় অফিসের সামনে থেকে পুলিশ প্রত্যাহার ও তা খোলার সুযোগ প্রদান– এসব ঘটনার মধ্যে একটা যোগসূত্র রয়েছে মনে করেছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। সময়ের সুযোগ গ্রহণ করে সরকার কৌশল হিসেবে সিটি নির্বাচন ঘোষণা করলেও বাস্তবতা হচ্ছে, চলমান সংহিস রাজনৈতিক পরিস্থিতি সরকার ও বিএনপি কারও জন্যই স্বাভাবিক ছিল না, একটা অস্বাভাবিক পরিবেশেই চলছিল তাদের কর্মতৎপরতা। দেশ ও জনগণের জন্য তো বটেই।

এক পর্যায়ে সরকার ও বিএনপি উভয়ের জন্যই এ পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসা জরুরি হয়ে পড়ে। সরকার যেমন বলপ্রয়োগে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার নীতি গ্রহণ করেছিল, বিএনপি ও তার মিত্র জামায়াতে ইসলামীও তেমনি সহিংস পথে অচল করে দিতে চেয়েছিল সরকারকে। উভয়ের বলপ্রয়োগের নীতির ফলে যে অস্থির ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তাতে কেবল অপমৃত্যু আর অর্থনীতির ক্ষতিই হয়নি, জঙ্গিবাদ উত্থানের পথও সুগম করে দিয়েছে। একই সঙ্গে দেশে-বিদেশে সমালোচনার মুখে পড়েছে বিএনপি-জামায়াতের সহিংস রাজনীতি ও সরকারের দমননীতি। এমনকি জামায়াতের সঙ্গ পরিহারের জন্য পাশ্চাত্য দেশগুলোর চাপ সৃষ্টি হয় বিএনপির উপর।

৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে বিএনপির পক্ষে পাল্লা ভারি হলেও লাগাতার সহিংস হরতাল-অপরোধের কারণে তা দিনে দিনে হালকা হয়ে থাকে। গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও দমননীতির জন্য সমালোচিত হলেও জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযানের জন্য সরকার প্রশংসিত হয় ইউরোপ-আমেরিকা ছাড়াও জাতিসংঘের কাছে।

দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ই নির্বাচনীমুখী দল। নির্বাচনে অংশগ্রহণ ছাড়া তাদের পক্ষে রাজনীতিতে টিকে থাকার দ্বিতীয় উপায় নেই। নির্বাচন তাদের কাছে কেবল গণতন্ত্রের স্বার্থে নীতিগত ব্যাপার নয়, অর্থসহ নানা সামাজিক প্রাপ্তিযোগও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত– তা সরকারি দলে থেকেই হোক, আর বিরোধী দলে থেকেই হোক। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে বিএনপি তার পরিণতিটা নিশ্চয় এখন উপলদ্ধি করছে। বলা যায়, অদূর ভবিষ্যতের জন্য এটা নির্ধারিত হয়ে গেছে যে, গণতন্ত্র থাকলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির স্থান ঘুরে-ফিরে সরকারে বা বিরোধী দলেই হবে এবং রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে তারাই। সুতরাং সিটি নির্বাচন বর্জন করে পূর্বের ভুলের পুনরাবৃত্তি করে বিএনপি তার বঞ্চিত নেতা-কর্মীদের দলে ধরে রাখবে কতদিন, কীভাবে?

তৃতীয়ত, তিন মাসের শক্তিপরীক্ষায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি অবশ্যই উপলদ্ধি করতে পেরেছে যে, এ কৌশলের কার্যকারিতা দীর্ঘদিন বা অনির্দিষ্টকালের জন্য বজায় রাখা সম্ভব নয়, যেহেতু জনগণের সমর্থন যখন চূড়ান্তভাবেই দ্বিধাবিভক্ত। শত প্রচারণার পরেও সরকারের উন্নয়ন তৎপরতা ও জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযান জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারেনি। আবার বিএনপির আন্দোলনেও সরকারবিরোধী গণঅভ্যুত্থান হয়নি। আজ আমরা উভয় পক্ষের মধ্যে যে নমনীয়তা দেখছি, এই পরিস্থিতি তার অন্যতম কারণ। সরকার নমনীয়তা প্রদর্শন করায় খালেদা জিয়া জামিন পেয়েছেন, তাঁর গুলশান অফিসে পুলিশ তালা ঝুলায়নি এবং বিএনপির কেন্দ্রীয় অফিসের তালা খুলে গেছে। নির্বাচনের কারণে বিএনপি তিন সিটিতে হরতাল-অবরোধ স্থগিত করায় তার প্রভাবে দেশের অন্যত্রও এই কর্মসূচীর তীব্রতা স্তিমিত হয়ে এসেছে, যা সরকারের জন্য স্বস্তির কারণ।

মোট কথা, সিটি নির্বাচনের ঘোষণা সরকার ও বিএনপি উভয়ের জন্য রণাঙ্গনে থেকে নিষ্ক্রমণের পথ তৈরি করে দিয়েছে। কারা এই নিষ্ক্রমণপথ তৈরির অন্তরালে কুশীলবের কাজ করেছেন, তা এখনও দৃশ্যমান না হলেও কৌতূহল আছে সবারই। সরকারের নীতি নির্ধারণ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিএনপির নীতি নির্ধারণ করেন চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। কাজেই সিটি করপোরেশনের নির্বাচন ঘোষণা করে নিষ্ক্রমণের পথ নির্মাণ করা হবে কিনা, এ নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীই আর তা গ্রহণ করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা হবে কিনা, এ নীতিগত সিদ্ধান্ত অবশ্যই খালেদা জিয়ার। এদিক থেকে বলা যায়, নিষ্ক্রমনে পথের নির্দেশনা দিয়েছেন শেখ হাসিনাই। আর তা গ্রহণ করে নিষ্কৃতি পেয়েছেন খালেদা জিয়াও।

সিটি নির্বাচনকেন্দ্রিক উপাখ্যানের এটি প্রথম পর্ব। আশাবাদীরা বলছেন, পালে সুবাতাস লেগেছে। তবে সব কিছুই নির্ভর করছে উপাখ্যানের চূড়ান্ত পর্ব কীভাবে শেষ হবে। তার বড় দায় নির্বাচন কমিশনের। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। সুতরাং গতানুগতিক কর্মকাণ্ড দিয়ে কমিশন নির্বাচনোপযোগী পরিবেশ সৃষ্টির শর্তাবলীও পুরণ করতে পারবে না। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সকলের জন্য সমান সুবিধা নিশ্চিত করার মতো দুরূহ দায়িত্ব পালন করতে হবে কমিশনকে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এ দায়িত্ব পালনের সার্বিক ক্ষমতাই রয়েছে তাদের। কিন্তু তারা যে সে ক্ষমতা প্রয়োগের যোগ্যতা ধারণ করেন না, অতীতে তারা নিজেরাই তা প্রমাণ করেছেন। সংবিধান তাদের যে দন্ত-নখর দিয়েছে, তা দিয়ে তারা ভোজন আর গা-চুলকানি ছাড়া কিছুই করতে পারেন না। তাদের দৃশ্যমান অতীত রেকর্ড তা-ই বলে। নজির ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন এবং পরবর্তীতে উপজেলা ও পৌরসভা নির্বাচনের শেষ ধাপ।

এবার যদি তারা তাদের সুঠাম দন্ত ও নখর ব্যবহারে ব্যর্থ হন, তা কেবল তিন সিটিতে সীমাবদ্ধ থাকবে না, তার নেতিবাচক তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়বে জাতীয় রাজনীতিতে। আমরা আজ যাকে সুবাতাস বলে স্বস্তি বোধ করছি, তা পরিণত হবে ঘূর্ণিঝড়ে। সিটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের পেছনে যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা রয়েছে বলে শুনছি, তাও ভণ্ডুল হয়ে যাবে।

খাতা-কলমে নির্দলীয় নির্বাচনের কথা বলা হলেও বাস্তবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন কখনও নির্দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত হয়নি। সিটি নির্বাচনে এবারের চ্যালেঞ্জ রাজনৈতিক ও দলীয় কারণেই ভিন্ন মাত্রার। নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় সমান সুযোগ-সুবিধার কথা উঠলেই বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীদের ঝুঁকির বিষয়টি গুরত্বপূর্ণভাবে আসে। বিশেষত ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণে যারা বিএনপিসমর্থিত প্রার্থী, সরকারবিরোধী আন্দোলনের কারণে তাদের অধিকাংশের মাথার উপর ঝুলে আছে ফৌজিদারি মামলা। অনেকেই ফেরারি আসামী। পুলিশের কর্তাব্যক্তিরা ইতোমধ্যেই হুমকি দিয়েছে, যারা এখনও জামিন নেয়নি বা পায়নি, তাদের দেখামাত্রই গ্রেপ্তার করা হবে।

কেবল প্রার্থীরাই নয়, যেসব বিএনপি নেতাকর্মী তাদের পক্ষে নির্বাচনী তৎপরতা চালাবে, তাদের বিরুদ্ধেও রয়েছে এ ধরনের মামলা-মোকদ্দমা। এসব মামলার আসামিদের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হলে নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যে রাজনৈতিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে সিটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তার আলোকেই কমিশনও সিদ্ধান্ত নিতে পারে। অর্থাৎ আরেকটা বোঝাপড়ার মধ্য দিয়েই পুলিশ এসব অভিযুক্তের বিরুদ্ধে সাময়িকভাবে তাদের অভিযান স্থগিত করতে পারে। অথবা নির্বাচন কমিশন উদ্যোগী হয়ে 'নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বপালনে সহায়তা করা সকল নিবাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হইবে'– এই ক্ষমতাবলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা চাইতে পারে।

ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে, Chair makes a man, তবে এটাও সত্য যে, ওই চেয়ারে কে বসেছে, তার ব্যক্তিত্বের উপরই নির্ভর করে চেয়ারের মূল্যায়ন। নির্বাচন কমিশন তাকে প্রদত্ত অবাধ ক্ষমতা কতটুকু প্রয়োগ করতে পারবে, তা সম্পূর্ণভাবেই নির্ভর করে তার ব্যক্তিত্ব, সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার উপর। ইতোমধ্যেই অভিযোগ উঠেছে, ক্ষমতাসীন জোটের মন্ত্রী-এমপিরা চট্টগ্রামে নির্বাচন বিধি লঙ্ঘন করার পরেও কমিশন জেনেশুনে নিরবতা অবলম্বন করছে। সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয়েছে, কমিশনের অভ্যন্তরেই গণতান্ত্রিক চর্চা নেই। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দিন অন্য কমিশনারদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা না করেই সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছেন। কমিশনের কোনো কোনো সদস্য ভোটারের নয়, সরকারের আস্থাভাজন হওয়ার জন্যই তাদের ভূমিকা পালনে বেশি আগ্রহী। আওয়ামী লীগসমর্থিত ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণের দুই মেয়রপ্রার্থী দলবল নিয়ে প্রচার অভিযান শুরু করলেও বিএনপিসমর্থিত প্রার্থীসহ স্থানীয় নেতাকর্মীরা পুলিশের ভয়ে বের হতে পারছে না। বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের মাথাব্যথার কারণ কিনা, এর জবাব আইনের কাছে থাকলেও তাদের কাছে নেই।

ভোটারদের অতীত আস্থাহীনতার চিহ্ন কপালে ধারণ করেই কমিশন সিটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সে চিহ্ন মুছে যাবে কিনা, তা নির্ভর করছে ভোট কতটা অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে। তবে তার চেয়েও বড় কথা, জাতীয় রাজনীতিতে প্রবাহিত ক্ষণিকের সুবাতাস আবার উত্তপ্ত মরু হাওয়ায় রূপান্তরিত হবে কিনা।

যা হোক, যে কারণে তিন সিটির নির্বাচন হতে যাচ্ছে তা রাজনৈতিক। ইস্যু রাজনৈতিক হলে তার সমাধানও রাজনৈতিকভাবে হতে হবে। ৫ জানুয়ারি 'কালো দিবস' না 'বিজয় দিবস,' তা নিয়ে সরকার ও বিএনপির মধ্যে যে মারদাঙ্গা বিরোধ শুরু হয়েছিল, তা ছিল রাজনৈতিক। তা রাজনৈতিকভাবে সুরাহা করার সুযোগ একাধিকার বিএনপির সামনে এসেছেও। কিন্তু প্রজ্ঞার অভাবে বা অবিমৃষ্যকারিতার কারণে বিএনপি নেতৃত্ব সে সুযোগ কাজে লাগায়নি অথবা লাগাতে পারেনি। বিএনপি হয়তো ভেবেছিল আন্দোলনের তোড়েই সরকারের তখতে-তাউস উড়ে যাবে অথবা ভেঙে খান খান হবে। এটা ছিল বিএনপির নিজের উপর অতিআস্থা।

৫ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচনের পর রণে ভঙ্গ দিয়ে বিএনপি রাস্তায় পড়েছে, আর আওয়ামী লীগ কালবিলম্ব না করে মসনদে বসে নতুন করে আস্থা ও শক্তি সঞ্চয় করেছে। এক বৎসর সময়ে সরকারের সে আস্থা আরও বেড়েছে এবং শক্তি আরও সংহত হয়েছে। কিন্তু বিএনপির সমর্থন হ্রাস না পেলেও তা সংগঠিত করতে পারেনি সরকারবিরোধী আন্দোলনের পক্ষে। তার চাক্ষুষ প্রমাণ বিএনপি (চলতি বছরের) ৫ জানুয়ারি রাজপথে নামতে পারেনি এবং খালেদা জিয়ার গুলশান অফিসের সামনে বালির ট্রাক রেখে যখন রাস্তা আটকে রাখা হল, তখন আন্দোলন করে অবরোধ ভাঙার জোয়ার সৃষ্টি করতে পারেনি। অনুরূপ ঘটনা শেখ হাসিনার বেলায় ঘটলে কী কাণ্ড ঘটত, আওয়ামী লীগের আন্দোলনের শক্তি সম্পর্কে যারা অবগত তাদের কাছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ফলে খালেদা জিয়া নিজ অফিসেই অবরুদ্ধ রয়ে গেলেন।

অবরুদ্ধ অবস্থায় থেকেই তিনি ডাক দিলেন সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরোধের। এর পর অবরোধের সঙ্গে হরতাল। সে হরতাল-অবরোধ থেকে গণআন্দোলন বা গণঅভ্যুত্থানের জন্ম হয়নি, জন্ম হয়েছে সহিংস রাজনীতির, যা এদেশে নজিরবিহীন। সহিংস কর্মকাণ্ড দমনের জন্য সরকারও বেছে নিল সহিংস পথ। প্রধানমন্ত্রী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দিলেন, আপনারা যেভাবেই হোক সন্ত্রাসী তৎপরতা নিয়ন্ত্রণ করুন, দায়িত্ব আমার। একদিকে বিএনপি-জামায়াতের রাজনৈতিক সন্ত্রাস, আরেকদিকে সরকারের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস– এ পরিস্থিতির যারা শিকার তাদের দায়-দায়িত্ব নেবে কারা? অপরাধী-নিরাপরাধী বিচারের মানদণ্ড নির্মিত হবে কীভাবে, কাদের দ্বারা? জাতীয়-আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিন্দা করেছে সবাই, কিন্তু বিচারের বাণী কাঁদছে নিভৃতেই। আহাজারি যেমন শুনেছি বার্ন ইউনিটে, তেমনি পঙ্গু হাসপাতালেও। লাশের মিছিল হয়তো একদিন শেষ হবে, কিন্তু স্বজনহারাদের আহাজারি?

গণতন্ত্রচর্চার অভাব বা অনুপস্থিতি সমাজকে জঙ্গিয়ায়ন করে। এ জঙ্গিপনা রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দুই-ই হতে পারে। এ দুধরনের জঙ্গিপনার উপস্থিতিই দেখছি এখন আমাদের সমাজে, যা গণতন্ত্রচর্চার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা যে গণতন্ত্রের চর্চা করছি তা অনেকটা মেয়াদোত্তীর্ণ বটিকার মতো, যা আমাদের রাজনীতিকরা ক্যানভাসারের কায়দায় ফেরি করছে। আমাদের এ গণতন্ত্রের প্রধান– একমাত্রও বলা যেতে পারে– নিয়ামক শক্তি নির্বাচন যার মানদণ্ড নির্ধারিত হয় কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠতা দ্বারা। Participatory democracy বা অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র কিংবা গণতন্ত্রে proportional representation বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণা আমাদের নেতানেত্রীদের হয়তো সামান্যই রয়েছে। আমরা যে গণতন্ত্রের চর্চা করছি তার বড় দোষ হল majoritarianism বা সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ, যা যুগে যুগে স্বৈরতন্ত্রের জন্ম দিয়েছে এবং গণতন্ত্রকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যাও করেছে।

আমাদের চল্লিশোর্ধ্ব দেশেও একাধিকবার তার নজির স্থাপিত হয়েছে, গণতন্ত্র ভারসাম্যহীন সমাজে বারংবার হোঁচট খেয়েছে। না ভেবে না বুঝে good governance বা সুশাসনের প্রশংসায় আমাদের মুখে খৈ ফুটে। Good বা 'সু' (ভাল) কথাটা যে relative বা আপেক্ষিক, তা আমরা কখনও ভেবে দেখি না। কথার মারপ্যাঁচে আমাদের চিন্তাশক্তিকে গণ্ডির মধ্যে আটকে দিয়েছে পাশ্চাত্যের ধুন্ধর পণ্ডিতরা। তাদের দেশে participatory governance থাকলেও আমাদের মুখে তুলে দিয়েছে good governance, যার প্রকৃত কোনো মাপকাঠি নেই। মাপকাঠি তাদের হাতে, যাকে যখন ইচ্ছা সার্টিফিকেট দেয়। ফলে আমাদের দেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রায়শই জটিল আকার ধারণ করে।

মূল আলোচনায় ফিরে আসা যাক। সংঘাত-সহিংসতা দ্বারা গণতন্ত্রচর্চা হয় না, গত তিন মাসের পরিস্থিতি আবার তা প্রমাণ করেছে। গণতন্ত্রে আন্দোলনের অধিকার থাকলেও তা আপস-সমঝোতার পথ রুদ্ধ করে নয়। কিন্তু সে পথই রুদ্ধ দেখেছি, কখনও সরকারের পক্ষ থেকে, কখনও বিএনপির পক্ষ থেকে। সর্বশেষ, আরাফাত রহমান কোকোর অকালমৃত্যুর পর যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গিয়েছিলেন সন্তানহারা মাতাকে সমবেদনা জানাতে তখন তাঁর মুখের উপর বন্ধ করে দেওয়া হয় খালেদা জিয়ার গুলশান অফিসের দরজা। এটা ছিল হটকারিতার চরম নিদর্শন।

শেখ হাসিনা খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন– এ ঘটনাই যথেষ্ট ছিল সংকটের অর্ধেক সমাধানে। সমাধানের সূত্রপাত নিঃসন্দেহে সেখানেই রচিত হত; কেননা প্রধানমন্ত্রী হয়ে শেখ হাসিনা খালি হাতে শোকার্ত খালেদা জিয়ার কাছে গিয়েছিলেন, কোনো রাজনীতিসচেতন ব্যক্তির পক্ষে তা বিশ্বাস করা কঠিন। পরিণামে, সাধা ভাত ফেরত দিয়ে তারা উপোস করেছেন অফিসে।

আজ বিএনপি যখন সিটি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে, তখন অনেকেরই প্রশ্ন: খালেদা জিয়া কী পেলেন? বিএনপি কি হেরে গেল? প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, (পরাজয়ের) গ্লানি নিয়ে বাসায় ফিরে গেছেন খালেদা। তার এক মন্ত্রী ব্যাঙ্গ করে বলেছেন, 'সেই নথ খসালি, তবে কেন লোক হাসালি?' কথাটা একটু ঘুরিয়ে 'তবে কেন লোক কাঁদালি' বললে সময়োপযোগী হত। লোক কাঁদিয়েছেন দু'পক্ষই– এক পক্ষ অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করে; আরেক পক্ষ বৈধ অস্ত্র ব্যবহার করে। অবৈধ অস্ত্রের প্রতাপ থামাতে প্রয়োগ করা হয়েছে বৈধ অস্ত্র। সমাধানটা উভয় পক্ষই করতে চেয়েছে রণাঙ্গনে। বিপর্যয়টা ঘটেছে এ কারণেই। শেষ পর্যন্ত যে রাজনৈতিক সমঝোতা হয়েছে, তা হয়েছে আলোচনার টেবিলেই।

সমঝোতা সাধারণত হয় win-win dealএ। প্রধানমন্ত্রী ঠিকই বলেছেন, তিন মাসের সহিংস ঘটনাবলীর জন্য খালেদা জিয়াকে জবাবদিহি করতে হবে জনগণের কাছে। সিটি নির্বাচন সে জবাবদিহি করার উপযুক্ত জায়গা। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডে অবাধ ভোটের মাধ্যমে যদি তিন সিটির জনগণ বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীদের প্রত্যাখ্যান করে, তবে যে গ্লানির কথা প্রধানমন্ত্রী বলেছেন তা খালেদা জিয়ার সারা মুখে লেপটে যাবে, তিনি জনসমক্ষে বের হতে পারবেন না। মোট কথা, কে কী পেল, তার চূড়ান্ত রায় হবে সিটি নির্বাচনে।

তিন সিটির নির্বাচনে লড়াই হবে বাঘে-মহিষে, অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে। 'তিন' শব্দটা বেজোড়। এক পক্ষ দু'টিতে জিতলে অপর পক্ষ জিতবে একটিতে। অর্থাৎ পাল্লা একদিকে ভারি হবেই। ফলে এক পক্ষ খুশি হলে অপর পক্ষ বেজার হবে। তবে রাজনৈতিক প্রাপ্তিযোগ বেশি বলে ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগের হারানোর কিছু নেই। স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলেও তিন সিটি নির্বাচনের ফলাফলের প্রভাব পড়বে জাতীয় রাজনীতিতে, যা গড়াবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে।

বর্তমান সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন সম্ভব কিনা, সেই বিরোধ সিটি নির্বাচনের ফলাফল নতুন করে উত্তপ্ত করতে পারে, আবার আংশিক প্রশমিতও করতে পারে। আংশিক প্রশমিত হলে বলা যায়, দীর্ঘদিনের বিরোধের মীমাংসার জন্য টানেলের অপর প্রান্তে আলোর আভাস পরিলক্ষিত হতে পারে।

নজিরবিহীন সহিংস তিন মাস ও সিটি নির্বাচন আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জন্য নতুন উপলব্ধির অবকাশ সৃষ্টি করেছে। প্রথমত, এটা যুক্তিসঙ্গতভাবেই প্রমাণিত হয়েছে যে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরের পরিপূরক শক্তি, যদিও রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে তারা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনমুখী দলগুলোর পক্ষে নির্বাচন বর্জন করে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন। এ ক্ষেত্রে বিএনপি তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। তৃতীয়ত, দীর্ঘস্থায়ী ও সহিংস আন্দোলনের জন্য উন্নয়নকামী জনসাধারণ মানসিকভাবে প্রস্তুত নয়, সুতরাং আন্দোলনের প্রচলিত কৌশল অচল। চতুর্থত, দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির যে কোনো একটি ব্যতীত একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সমাজের সকল স্তরে ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং অস্থিরতা বিরাজ করে, ফলে অগ্রগতির স্বাভাবিক গতি বিঘ্নিত হয়। পঞ্চমত, সহিংস রাজনীতি ও ধর্মীয় উগ্রবাদের জন্ম হয়। ষষ্ঠত, রাজনৈতিক ইস্যুর সমাধান রাজনৈতিকভাবেই করতে হবে, সশস্ত্র বলপ্রয়োগে নয়।

সিটি নির্বাচনের ফলাফল যাই হোক, এ নির্বাচনের জন্য মাথাব্যথার বড় কারণ তার গ্রহণযোগ্যতা। কেননা, এর গ্রহণযোগ্যতাই নির্ধারণ করবে আগামীতে জাতীয় রাজনীতির হাল কী হবে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির হার-জিত বড় কথা নয়, বড় কথা গণতন্ত্রের বিজয়। গণতন্ত্রের বিজয়ই হবে জনগণের বিজয়।

আমানুল্লাহ কবীর: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সিনিয়র এডিটর।