কামারুজ্জামানের ফাঁসি: কে কার কাছে ক্ষমা চাইবে

আকতার হোসেন
Published : 13 April 2015, 01:11 PM
Updated : 13 April 2015, 01:11 PM

যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকরের পর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর একটি মন্তব্যে চোখ আটকে গেল। তিনি জানিয়েছেন যে, তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের বিরোধিতা করেন না। কিন্তু কামারুজ্জামানকে ফাঁসির দড়িতে ২০ মিনিট ধরে ঝুলিয়ে রেখে যে মানবতাবিরোধী অপরাধ এই সরকার করেছে তার জন্য তাদের উচিত অপরাধীর পরিবারের কাছে ক্ষমা চাওয়া।

জনাব চৌধুরী গত রবিবার প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত এক সভায় এ কথা বলেছেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন মিডিয়া যতটা লেখালেখি কিংবা আলোচনা করেছে, মানবতাবিরোধী অপরাধীদের হাতে যারা নিহত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের পরিবারের কাউকে নিয়ে এতটা সরব হতে দেখা যায় না। অন্যায় করে ব্যক্তি বা দল যে হিরো হয়ে যেতে পারে সেটাই বারবার প্রমাণিত হচ্ছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, সব দেশেই এখন অপরাধীদের জন্য শিরোনাম বরাদ্দ থাকে। হয়তো প্রচার ব্যবস্থার কোড অব কন্ডাক্ট এমনটাই বলে!

যাহোক, সম্প্রতি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত যে ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হল সে ব্যক্তিকে এখন নির্দ্বিধায় অপরাধী বলা যায়; অথচ মিডিয়া তাকে নিয়ে নানাবিধ কভারেজ দিতে ব্যস্ত। সে তুলনায় ভুক্তভোগীদের কথা তেমন প্রচার করছে না বলে এক প্রকার প্রচারবৈষম্য দেখা দিয়েছে।

এ প্রেক্ষিতে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মতো ব্যক্তি যদি অপরাধীর পরিবারের কাছে সরকারের ক্ষমা চাওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন– বিশেষ করে জনগণ যখন ভাবতে শুরু করেছেন এই রায় কার্যকরের মধ্য দিয়ে তাদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে– তখন মনে করতে হবে যে, আজকাল বিবেকবান লোকেরাই অনৈক্য সৃষ্টিতে বেশি ইন্ধন যোগাচ্ছেন।

ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর পিতা মতিলাল নেহেরু 'ইংরেজ খেদাও' আন্দোলনে অংশ নেওয়ায় বিচারের মুখোমুখি একটি ছেলেকে ব্রিটিশ বিচারকের হাত থেকে বাঁচাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। বিচারক রায় দেন, Hang him in public, মতিলাল নেহেরু সে রায় মেনে নিতে বাধ্য হন। কিন্তু ছেলেটিকে যখন ফাঁসিতে ঝুলানো হল, তিনি তখন তাকে উঁচু করে ধরে বললেন, ''রায় কার্যকর হয়ে গেছে। কাজেই এখন তার ফাঁসির দড়ি কেটে দেওয়া হোক।''

এ ঘটনার পর থেকেই ভারতে ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ড প্রদানের আইন পরিবর্তন করে লেখা হয়, Hang until Death– সে আইনের ধারাবাহিকতা বাংলাদেশেও চলছে।

মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত কেন ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে রাখা হয় এমন প্রশ্নের সম্ভাব্য কারণ হতে পরে নানা রকম। একেক মানুষ মৃত্যুকালে একেকভাবে প্রতিক্রিয়া করে। পশু কোরবানির ক্ষেত্রেও এমনটি দেখা যায়। গলাকাটা অবস্থায় কোরবানির গরুকে দৌড়াতে দেখেছেন অনেকেই। ফাঁসির সময়ও দেখা গেছে, দড়ি ছিঁড়ে অনেকে পড়ে যায়। কারও কারও ঘাড়ের হাড় ভেঙে যায় অথচ সহসা মৃত্যু হয় না। কাজেই ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির শরীর একটি নিদিষ্ট সময় পর্যন্ত ঝুলিয়ে রাখার প্রচলন চালু হয় কিছুটা যৌক্তিক কারণে। শুধু তাই নয়, ফাঁসির দড়ি থেকে নামানোর পর হাত-পায়ের রগ কেটে মৃত্যু নিশ্চিতও করা হয়।

ডা. চৌধুরীর কাছে প্রত্যাশা ছিল, তিনি সরকারের সমালোচনা না করে পদ্ধতির সমালোচনা করবেন। কিন্তু তেমন প্রস্তাব তিনি রাখেননি।

একাধিক অপরাধে যে ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত হলেন এবং যিনি বর্বরতার সঙ্গে মানুষ-হত্যাসহ আরও ভয়াবহ সব অপরাধ করেছেন, তার জন্য জনাব চৌধুরীর এমন মানবিক আহ্বান সন্দেহ তৈরি করতেই পারে। এ কথা সত্য যে, একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত ব্যক্তিরা মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে পড়লে তাদের গুলি করে হত্যা করা হত। কিন্তু দেশ স্বাধীন হবার পর সেই অপরাধীদের অনেকে বেশ ভালোভাবে জীবন কাটিয়েছে। তাদের রেখে যাওয়া সম্পত্তির উত্তরাধিকারীরাও ভালোভাবে জীবন কাটাবে বলে আশা করা যায়। ভালো নেই, ভালো থাকবেন না এসব মানবতাবিরোধী অপরাধীদের হাতে নিহতদের পরিবার আর প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ। ডা. চৌধুরী অপরাধীর পরিবারের প্রতি যতটুকু সহানুভূতিশীল, একই সঙ্গে যদি একাত্তরের ভুক্তভোগীদের জন্য কিছু বলতেন তাহলে তার দৃষ্টিভঙ্গি স্বচ্ছ মনে হত।

যেহেতু সরকারকে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিটির পরিবারের কাছে ক্ষমা চাইবার কথাই শুধু বলেছেন তিনি– বলেননি সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিটির হাতে যারা নির্যাতিত হয়েছে তাদের কাছে ওই ব্যক্তির পরিবারেরও (মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির উত্তরাধিকারীদের) ক্ষমা চাওয়া উচিত– তাই বলা যায়, তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের বিরোধিতা করেন না, বিচারে প্রদত্ত শাস্তির বিরোধিতা করেন। যার মানে দাঁড়ায়, সরকার সময় ও অর্থ ব্যয় করে বিচার করছেন ভালো কথা, কিন্তু অপরাধীদের অপরাধ প্রমাণ হবার পর, এমনকি সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রমাণিত হবার পরও তাদের ছেড়ে দিতে হবে।

কল্পনা করে বলা যায় যে, ডা. চৌধুরী সরকারকে দুষতে গিয়ে যে যুক্তি দেখিয়েছেন প্রয়োজনে সেটার পরিবর্তে তিনি হয়তো এমনও বলতে পারতেন যে, ফাঁসিতে ঝুলানোর পর মৃতদেহ নামিয়ে নিয়ে সরকারের কোনো অফিসার মৃত ব্যক্তির উদ্দেশে 'ইন্নালিল্লাহ হি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন' পড়েননি। অথবা সরকারের অন্য একটি দোষ হতে পারত, ফাঁসির দড়িটা অনেক ধার ছিল, সরকারের উচিত ছিল অমুক দেশ থেকে উন্নতমানের দড়ি আনা। অথবা ইচ্ছে করেই অমুসলিম প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে যাতে তাঁর হাতে ইসলামি একটি রাজনৈতিক দলের নেতার ফাঁসি দেওয়া যায় ইত্যাদি।

আসলে বিরোধিতা মানেই বিরোধিতা করা এখন শিক্ষিত অশিক্ষিত সব মহলেই সমান মাত্রা পেয়েছে। কাজেই সেই কথাই সত্য, 'যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা'।