রাজনীতিতে গুম রাজধানীতে ঝড় : নতুন সিডি

শফিক রেহমান
Published : 24 April 2011, 04:49 PM
Updated : 24 April 2011, 04:49 PM

ট্র্যাক টু
টাইটেল : সারা দেশে হরতালের ডাক

রোববার ৩ এপ্রিল ২০১১তে অনেকের মধ্যে ছিল হালকা টেনশন। কারণ পরদিন সোমবার ৪ এপ্রিলে সারা দেশে হরতাল পালনের ডাক দিয়েছিল ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটি। এই কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, বর্তমান সরকারের কোরানবিরোধী নারীনীতি, ফতোয়াবিরোধী হাই কোর্টের রায় বাতিল। ইনডিয়াকে ফ্রি ট্রানজিট সুবিধা দেয়াসহ সরকারের ইসলাম ও দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে এই হরতাল ডাকা হয়েছে।
৬ জানুয়ারি ২০০৯-এ আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন হবার পরে গত সোয়া দুই বছরে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ডাকে সারা দেশে চার দিন হরতাল আহূত ও সফলভাবে পালিত হয়েছে। কিন্তু ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির ডাকে সারা দেশে হরতাল সফলভাবে পালিত হবে কি না সে বিষয়ে টেনশন ছিল।

কমিটির পক্ষ থেকে হরতাল সফলের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল। হরতাল সফল করতে রোববারে ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। রাজধানীর একটি সমাবেশে কমিটির আমির মুফতি ফজলুল হক আমিনী বলেন, 'এই হরতাল হচ্ছে কোরান রক্ষার জন্য। এই হরতাল না হলে এ দেশও রক্ষা হবে না। তাই কোরান ও দেশ রক্ষার জন্য ৪ এপ্রিলের হরতাল সফল করতে হবে।'
তিনি পুলিশবাহিনীর প্রতি অনুরোধ করেন, 'আমাদের কর্মীদের গায়ে হাত দেবেন না। যশোরে হুসাইন আহমদকে শহীদ করেছেন। আরো লাখো হুসাইন কোরানের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত আছে। যে এই গুলি করেছে তাকে ফাঁসি দিতে হবে। …আল্লাহর কসম আমাদের অধীনেও একদিন এই পুলিশ বাহিনীকে চাকরি করতে হবে। আওয়ামী সরকারের পতন হবে। কোরানবিরোধী কোনো আদেশ সরকার দিলে পুলিশের চাকরি ছেড়ে দিন।'

'শেখ হাসিনা যদি মনে করেন ইনডিয়া ও নাস্তিকদের সহযোগিতায় উলামাদের শেষ করে দেবেন, তাহলে তিনি ভুল করবেন। দেশ হাসিনা শূন্য হবে। আমি শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দেইনি। হুমকি দিয়ে লাভও নেই। কোরানের বিরুদ্ধে যে-ই হোক, তার বিরুদ্ধে এ হরতাল।'

'আমরা শেখ হাসিনা বিরোধী নই। কোরানের বিরুদ্ধে যারা কথা বলে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াবো। এবার শুধু ইসলামী মূল্যবোধ রক্ষা নয়, কোরানের আইন বাস্তবায়ন করবো। দলের কর্মীদের বলছি, হরতালে পুলিশ আক্রমণ, লাঠি চার্জ ও গুলি করলে আপনারা তাদের ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানাবেন। হরতাল পালনে সারা দিন সবাই কাফনের কাপড় পরে ও কোরান হাতে নিয়ে রাস্তায় থাকবেন। শান্তিপূর্ণ হরতহাল হবে। হরতালে বাধা দিলে লাগাতার হরতালের কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে। কোরানের ওপর আক্রমণ হলে সব অচল করে দেব। কোরান অচল করা যাবে না।'

ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির ডাকে এই হরতালের প্রতি সমর্থন জানায় সম্মিলিত উলামা মাশায়েখ পরিষদ, খেলাফত মজলিস, ইসলামী ছাত্রসমাজ, বাংলাদেশ লেবার পার্টি ও নেজামে ইসলামে পার্টি।

অন্য দিকে কক্সবাজার শহরের পুরনো সি-বিচ রেস্টহাউজ মাঠে (জেলে পার্ক) আওয়ামী লীগের একটি জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, 'মিথ্যা ও অপপ্রচার চালিয়ে যারা ধর্মের নামে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে সজাগ ও সচেতন থাকতে হবে। … ফজলুল হক আমিনী পবিত্র কোরান শরিফের অপব্যাখ্যা দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা করছেন।'

বিকেলে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সম্মিলিত নারী নেত্রীদের ব্যানারে একটি মানব বন্ধন কর্মসূচিতে একাত্মতা প্রকাশ করে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সংসদ ডেপুটি লিডার সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী বলেন, 'মুফতি আমিনী ইসলামকে নিজের সম্পত্তি মনে করে নারীনীতি বাস্তবায়নকে বাধাগ্রস্ত করছে। তবে হরতাল কিভাবে হয় তা আমরা দেখে নেব।'

আওয়ামী সরকার বনাম ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির এই সাংঘর্ষিক অবস্থানের কিছুকাল আগে থেকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ছিলেন সৌদি আরবে। সেখানে ১৪ দিন থেকে চিকিৎসা ও ওমরাহ পালন শেষে ৩ এপ্রিল বেলা ৩টায় খালেদা জিয়া ঢাকায় ফিরে আসেন। এয়ারপোর্টে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপের সময়ে তিনি চট্টগ্রামে আলেমদের মিছিলে হামলা এবং যশোরে পুলিশের গুলিতে একজন হাফেজ হুসাইন আহমদ নিহত হওয়ার ঘটনায় ক্ষোভ ও নিন্দা প্রকাশ করেন। ৪ এপ্রিলের হরতালে বিএনপির সমর্থন রয়েছে কি না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, 'আমরা এই সরকারের বিরুদ্ধে সব আন্দোলন-সংগ্রামে আমাদের শরিকদের সাথে আছি ও থাকবো।'

এভাবে পরদিন সোমবার ৪ এপ্রিল হরতালের প্রস্তুতি পর্ব শেষ হয়। প্রশ্ন থেকে যায় আলেম সমাজদের ডাকে পরদিন হরতাল পালিত হবে কি না এবং হলেও কতোটা সফল হবে? কতোটা সহিংস হবে? কতোটা রক্তাক্ত হবে?

বিশেষত আওয়ামী নেত্রী সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর উক্তি, 'হরতাল কীভাবে হয় তা আমরা দেখে নেব' টেনশন বাড়িয়ে দেয়।
শুরু হয় আমিনী-হাসিনা ড্রামা।

এই সময়ে কারোরই ধারণা ছিল না হরতালের পরেও এই ড্রামা চলতে থাকবে, অনেক টুইস্ট অ্যান্ড টার্ণ বা নাটকীয় মোড় থাকবে, গভীর সাসপেন্স থাকবে এবং এটি হবে হাই ড্রামা যেখানে অংশ নেবেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সর্বোচ্চ অথরিটি স্বয়ং আল্লাহ, আমিনী পুত্র আবুল হাসনাত এবং 'হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা' বা সংক্ষেপে 'হাবশ্রেবাজাজবশেমুরকশেহা'র একমাত্র পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়।

ট্র্যাক থ্রি
টাইটেল : দেশব্যাপী হরতাল পালিত

সোমবার ৪ এপ্রিল ২০১১-তে দেশব্যাপী পালিত হলো। দফায় দফায় সংঘর্ষ, পুলিশের লাঠি চার্জ, টিয়ার গ্যাস শেল, গুলি ও ইটপাটকেল ছোড়া এবং ব্যাপক ধরপাকড়ের মধ্য দিয়ে দেশ জুড়ে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালিত হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে আটক হয় পাচশ'র বেশি হরতাল সমর্থক। পুলিশসহ আহত হয় তিনশ'র বেশি। ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির কেন্দ্রীয় নেতা মুফতি তৈয়ব ও মুফতি আমিনীর জামাইসহ হরতালে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে দুইশ'র বেশি মানুষকে আটক করা হয়। কমিটির মহাসচিব আবদুল লতিফ নেজামীকে আটক করে তিন ঘণ্টা পর ছেড়ে দেয়া হয়। পুলিশের সাথে সংঘর্ষে রাজধানীতে আহত হয় একশ'র বেশি মানুষ। রাজধানীর বিভিন্ন মাদরাসা ও মসজিদ ভোর থেকে অবরুদ্ধ থাকে। বায়তুল মোকাররম মসজিদের গেইটে ফজরের পরই তালা লাগিয়ে দেয় পুলিশ। দাড়ি টুপিওয়ালা নিরীহ পথচারীরাও বিপদে পড়েন। হরতাল সমর্থনকারীদের সঙ্গে তাদেরও পুলিশ আটক করে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। হরতালের সময়ে রাজধানীতে যন্ত্রচালিত বাহনের সংখ্যা ছিল কম। রাজধানীর টার্মিনালগুলো থেকে দূরপাল্লার কোনো বাস ছাড়েনি। দোকানপাট, শপিং মল এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ ছিল। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো খোলা ছিল। কিন্তু সেখানে উপস্থিতি ছিল কম।

বলা যায় কিছুটা অপ্রত্যাশিত হলেও এই হরতাল হয়েছিল সফল এবং সেটা দেখেছিলেন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। তাই তিনি আর মুখ খোলেননি। তবে মুখ খোলেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু। তিনি বলেন, 'হরতাল চলাকালে রাজধানীতে যান চলাচল স্বাভাবিক ছিল। … এ দেশের মানুষ হরতাল প্রত্যাখ্যান করেছে।'

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেন, 'এটি আমিনীর ডাকা হরতাল ছিল না। এটি ছিল খালেদা-নিজামীর হরতাল, বিএনপি-জামায়াতের হরতাল। এটি ছিল রাজনৈতিক হরতাল। আমিনীকে 'টুলস' হিসেবে ব্যবহার করে এ হরতাল ডাকিয়েছিল। শুধু কৌশলগত কারণে আমিনীকে ব্যবহার করা হয়েছে। এ হরতালে অস্ত্র ও অর্থ যোগান দিয়েছে বিএনপি-জামায়াত।'

যখন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে এই অভিযোগ তোলেন তখন সৌদি আরব থেকে সদ্য প্রত্যাগত বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ব্যস্ত ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান নিয়ার ইস্ট অ্যান্ড সাউথ এশিয়ান (সংক্ষেপে এনইএসএ বা নেসা)-এর একটি প্রতিনিধিদলকে সাক্ষাৎ দানে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন আমেরিকান অ্যামবাসাডর জেমস এফ মরিয়ার্টি। খালেদা জিয়া তাদের বলেন, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে এমন কৌশল নেয়া হলে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে।
আওয়ামী নেতৃবৃন্দ ও বিএনপি নেত্রী যা-ই বলুন না কেন, আমিনী দাবি করেন, আওয়ামী লীগ আমলে এটিই ছিল সবচেয়ে বেশি সফল হরতাল। তিনি ঘোষণা দেন, ৮ এপ্রিলে দেশব্যাপী দোয়া দিবস পালিত হবে। একই দিনে যশোরে মহাসমাবেশ হবে। ২০ এপ্রিল ঢাকায় উলামা মাশায়েখ সম্মেলন হবে। ১০ মে থেকে ২৫ মে পর্যন্ত দেশের সাতটি বিভাগে বিভাগীয় সমাবেশ হবে। একই সময়ে দেশের গুরুত্বপূর্ণ জেলা শহরগুলোতে সমাবেশ এবং ২৭ মে ঢাকায় মহাসমাবেশ হবে।
আমিনী আরো বলেন, 'দেশের প্রধানমন্ত্রী কোরান বোঝেন-ই না। তাই নারী উন্নয়ন নীতিমালাটি যে কোরান বিরোধী সেটা তিনি বুঝতে পারেন না।'

এই দিন মন্ত্রিসভা বৈঠকে হরতাল প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি সম্পর্কে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে ইতিবাচক জনমত সৃষ্টি করতে তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন।

এই ক্যাবিনেট মিটিংয়ে হরতাল কেন সফল হলো অথবা হরতাল কেন সফল হতে দেয়া হলো সে বিষয়ে কি আলোচনা হয়েছে সেটা জানা যায় নি। তবে অভিজ্ঞ পলিটিশিয়ানরা মনে করতে পারেন, এই হরতাল বিষয়ে পরস্পর বিরোধী চিন্তাধারা আওয়ামী লীগের মধ্যে কাজ করেছে। একদিকে আওয়ামী লীগ চায়নি হরতালের সাফল্য। কারণ এতে তাদের সরকারের দৌর্বল্য প্রকাশিত হবে এবং দলের প্রতি জনসমর্থনের ক্ষয় জানা হবে। অন্য দিকে আওয়ামী লীগ চেয়েছে হরতালের সাফল্য। কারণ এতে তাদের মিত্রদেশ হিন্দু প্রধান ইনডিয়াকে বোঝানো সম্ভব হবে যে উগ্র ইসলামিরা বাংলাদেশে সক্রিয় আছে এবং ইসলামফোবিয়া বা ইসলামভীতিতে আক্রান্ত আমেরিকা ও ইউরোপিয়ান ইওনিয়নকে আবারও ভয় দেখানো সম্ভব হবে যে বাংলাদেশে ইসলামী জঙ্গীরা বিচরণ করছে। সুতরাং ইনডিয়া, আমেরিকা ও ইওরোপিয়ান ইউনিয়নের উচিত হবে সেকুলার পন্থী রূপে দাবিদার আওয়ামী লীগকেই সমর্থন দেয়া অব্যাহত রাখা। বিশেষত গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ড. ইউনূসকে বহিষ্কার প্রক্রিয়া সূচনার পর আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে পশ্চিমি দেশগুলোর যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ তাদের সেকুলারিজম পুজির ওপর আবারও নির্ভর করার পথটি বেছে নিয়েছে।

এই দিন সকালে আওয়ামী সমর্থক কিছু পত্রিকার শিরোনাম ছিল, 'হরতালের জঙ্গীমূর্তি'।
এই দিন সন্ধ্যা ও রাতে আওয়ামী সমর্থক টিভি স্টেশনগুলো ব্যাপকভাবে সহিংসতার দৃশ্য প্রচার করেছে।
রাজনীতির কি অদ্ভুত পরিহাস! স্বার্থ সিদ্ধির লক্ষ্যে উগ্রপন্থী ইসলামিদের মতোই তথাকথিত সেকুলারিস্ট আওয়ামী লীগও ধর্মকেই ব্যবহার করছে।

কিন্তু এই প্লাস মাইনাসের হিসাবে নেট রেজাল্ট কী হলো?
নেট রেজাল্ট হলো ১. একটি সফল ধর্মীয়-রাজনৈতিক হরতাল, ২. রাজনীতিকে ধর্মের আরো কাছে ঠেলে দেয়া এবং ৩. একজন আলেম, মুফতি আমিনীর রাজনৈতিক উত্থান।
সম্ভবত এই শেষের ফ্যাক্টরটি মুফতি আমিনী বিরোধীদের খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে। মুফতি আমিনীকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় শুরু হয় সেই প্ল্যান ও তার বাস্তবায়ন।

ট্র্যাক ফোর
টাইটেল : আমিনী পুত্র অপহরণ ও গুম

১০ এপ্রিল ২০১১। বেলা এগারোটা। মুফতি আমিনীর ছেলে মাওলানা আবুল হাসনাত তার দুই সহকর্মী আবু রায়হান ও হুমায়ুন কবিরকে সঙ্গে নিয়ে ধোলাইখালের একটি গারাজে যান। সেখানে তার গাড়িটি মেরামতের জন্য দিয়ে পাশে দিল্লি সুইটমিটে তারা আইসক্রিম খাচ্ছিলেন। এই সময়ে ছাই রংয়ের মাইক্রোবাসে শাদা পোশাকধারী কয়েক ব্যক্তি সেখানে আসে। এদের মধ্যে একজন জিজ্ঞাসা করে, 'আপনি কি আবুল হাসনাত?'

আবুল হাসনাত 'হ্যা' উত্তর দেয়ামাত্রই তারা নিজেদের পুলিশের লোক পরিচয় দিয়ে বলে, 'আপনাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে।' এরপরই তারা আবুল হাসনাতকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। যাবার সময়ে তারা হাসনাতের দুই সহকর্মীর মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে যায়।
পৈতৃক সুবাদে প্রধানমন্ত্রী হবার দেশে, পৈতৃক সুবাদে অপহৃত হবার সম্ভবত প্রথম ঘটনাটি ঘটলো।
কিন্তু তারপর?
মুফতি আমিনী সারা দিন ঠাহর করতে পারলেন না তার ছেলের কী পরিণতি হবে? অপহৃত হয়ে যাবার পর গুম হয়ে যাবে? বিএনপি ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলমের মতো নিঁখোজ হয়ে যাবে?

উদ্বিগ্ন পিতা পরদিন ১১ এপ্রিল বিকেলে দলীয় কার্যালয়ে এক জরুরি প্রেস কনফারেন্সে দাবি করেন, সরকার তার ছেলেকে অপহরণ করেছে। তিনি বলেন, 'আমার একটি ছেলেকে কেনো, পুরো পরিবারকে ধ্বংস করেও ইসলামের জন্য আন্দোলন থেকে কেউ আমাকে পিছপা করতে পারবে না।'

এই প্রেস কনফারেন্সের পর, র‌্যাবের মহাপরিচালক মোখলেসুর রহমান, গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার মনিরুল ইসলাম, ঢাকা মহানগর পুলিশের এডিসি মাসুদুর রহমান ও সূত্রাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম প্রমুখ, সাংবাদিকদের কাছে আমিনীর ছেলেকে গ্রেফতারের কথা অস্বীকার করেন।

১২ এপ্রিলে আরেকটি জরুরি প্রেস কনফারেন্সে মুফতি আমিনী জানান, 'গতকাল বেলা দেড়টায় আবুল হাসনাতের মোবাইল ফোন নাম্বার থেকে আমাকে ফোন করা হয়। আমি তখন নফল নামাজ পড়ছিলাম। এ কারণে ফোন ধরতে পারিনি। এরপর আমার স্ত্রীর নাম্বারে ফোন করলে আমার ছোট মেয়ে ফোন ধরে। 'ভাইয়া কোথায় আছেন?' জানতে চাইলে অপর প্রান্ত থেকে একটি পুরুষ কণ্ঠ বলে, 'চক্করে আছি।' অপরিচিত একজন পুরুষের কণ্ঠ শুনে বিব্রত হয়ে মেয়ে আমাকে ফোন দিলে অপরিচিত পুরুষটি প্রথমে আমাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। পরে বলে, 'বেশি বাড়াবাড়ি করছেন। আপনাকে এবং আপনার ছেলেকে আমরা হত্যা করবো।' তাদের কথায় ভীত না হয়ে জিজ্ঞাসা করি, 'আপনারা কারা যে এভাবে কথা বলছেন?' জবাবে বলে, 'আমরা মানুষ হত্যা করি।'

চারদিন অপেক্ষার পরেও যখন হাসনাত ঘরে ফেরেন না তখন ১৫ এপ্রিলে মুফতি আমিনী আবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে বলেন, গত ৪ এপ্রিলের হরতাল ছিল আমাদের শক্তি পরীক্ষার প্রাথমিক মহড়া। ভবিষ্যতে আমরা এক ঘণ্টা আগে নোটিশ দিয়ে দশ মিনিটে সারা দেশ অচল করে দিতে পারি। আর চূড়ান্ত মহড়া শুরু করলে সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকা তো দুরের কথা, পালাবারও পথ পাবে না।…

ঘোষিত নারীনীতি যদি বাস্তবায়িত হয় তাহলে নারীদের মর্যাদা তো থাকবেই না বরং পুরো দেশ জারজ সন্তানে ভরে যাবে।'
এই প্রেস কনফারেন্সেই মুফতি আমিনী সরাসরি অভিযুক্ত করেন শেখ হাসিনাকে। তিনি বলেন, 'আমার ছেলে মাওলানা আবুল হাসনাতকে শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশেই গুম করা হয়েছে। এখন আমাকে গ্রেফতারের ভয় দেখানো হচ্ছে। এতে আমি ভীত নই। গ্রেফতার হবার প্রস্তুতি নিয়েই আামি প্রতিদিন ঘর হতে বের হই।'
তিনি প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেন, 'আপনি বলেছেন আমি নাকি নারীনীতি পড়িনি। আমি নারীনীতি পঞ্চাশবার পড়েছি। আমি পঞ্চাশ বছর যাবৎ মাদ্রাসায় কোরান পড়াই। আমার সন্দেহ হয় আপনি কোরান পড়েন কিনা।'
আমিনীর এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় পরদিন গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মান্নান খান বলেন, 'আমিনীর নিজেরই পিতৃ পরিচয় থাকলে নারীনীতির সমর্থনকারী বাঙালি জাতি সম্পর্কে এ কথা বলতে পারতেন না।'
একই দিনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক প্রেস কনফারেন্সে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করেন, হাসনাতকে সরকারি নির্দেশে অপহরণ করা হয়েছে। অবিলম্বে তাকে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানিয়ে মহাসচিব বলেন, অন্যথায় পরিণতি শুভ হবে না।

এর পরদিন আরো এক ধাপ এগিয়ে যান আরেক প্রতিমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যিনি বিদেশে সেকুলার ইমেজ প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী এবং যিনি স্বদেশে ধার্মিক ইমেজ প্রতিষ্ঠায় সদা তৎপর, তার ডিফেন্সে বন ও পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, 'মুফতি আমিনী বাংলাদেশে ইবলিশের দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলাদেশে ইবলিশের কাজ কমে গেছে। ইবলিশ এখন বিশ্রামে আছেন। সেই সুযোগে মুফতি আমিনী এ দায়িত্ব পালন করছেন।'

১৭ এপ্রিলে সচিবালয়ে একটি প্রেস কনফারেন্সে ড. হাছান মাহমুদ বলেন, 'আমিনী যে ধরনের চরিত্রের অধিকারী, তাতে মনে হয় তিনি নিজেই ছেলেকে লুকিয়ে রেখে নাটক সাজিয়েছেন। … জমি মাদরাসা দখল, চাদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে শত্রুতাবশত আমিনীর ছেলে অপহৃত হয়েছেন কি না, তা পুলিশ খতিয়ে দেখছে। … শেখ হাসিনা একজন প্রকৃত মুসলমান। তিনি প্রতিদিন সকালে কোরান তেলাওয়াত করেন। নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন।'
এখানেই সবচেয়ে বড় ভুলটি করে ফেলেন প্রতিমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।
বাংলাদেশের একটি অতি জনপ্রিয় গান, 'কে প্রথম কাছে এসেছিল?'
প্রশ্নটি অতীত সম্পর্কিত। প্রতিমন্ত্রী তার প্রধানমন্ত্রীর ইসলামি আদব কায়দা চর্চার তথ্য দিয়ে প্রমাণ করতে চাইলেন তিনি (শেখ হাসিনা) একজন প্রকৃত মুসলমান। অর্থাৎ, প্রধানমন্ত্রী আল্লাহর পেয়ারের বান্দা! প্রতিমন্ত্রীর এই প্রচেষ্টার ফলে একটি চ্যালেঞ্জমুখী ভবিষ্যৎ পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো।
তবে কি মুফতি আমিনী যিনি তার প্রায় পুরো জীবনটাই কাটিয়েছেন ইসলামি আদব কায়দা চর্চা করে, তিনি প্রকৃত মুসলমান নন? তিনি কি আল্লাহর পেয়ারের বান্দা নন?
একটি দৌড় প্রতিযোগিতার হুইসল বাজালেন প্রতিমন্ত্রী। 'কে প্রথম আল্লাহর কাছে যেতে পারবে?'
অসতর্কতা অথবা অদূরদর্শিতার ফলে ড. হাছান মাহমুদ তার সরকারের মুশকিল আহসানের বদলে আরো সংকটের সৃষ্টি করলেন। কে প্রথম কাছে যেতে পারবে? যার জীবনে রাজনৈতিক চর্চা মুখ্য বা প্রাইমারি এবং ধর্মচর্চা গৌণ বা সেকেন্ডারি, তিনি? নাকি, যার জীবনে ধর্মচর্চা মুখ্য এবং রাজনৈতিক চর্চা গৌণ, তিনি?

ট্র্যাক ফাইভ
টাইটেল : আল্লাহ ও দুই পুত্র

ড. হাছান মাহমুদের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন মুফতি আমিনী।
এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ না করেও তার উপায় ছিল না।
১০ এপ্রিলে তার পুত্র হাসনাত অপহৃত হয়েছিল। তারপর আরো দশটি দিন কেটে গেলেও হাসনাতের কোনো খবর তিনি পাচ্ছিলেন না। এর মধ্যে শুধু একদিন হাসনাতের মোবাইল ফোন থেকে এক অজ্ঞাত পুরুষের হুমকি পেয়েছিলেন। একজন উদ্বিগ্ন পিতা তখন যা করতে পারেন, মুফতি আমিনীও তাই করলেন। সর্বশক্তিমানের কাছে ফরিয়াদ করলেন।
২০ এপ্রিলে বিকেলে জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির জেলা প্রতিনিধিদের নিয়ে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই বড় সম্মেলনে দেশের সব জেলা থেকে প্রতিনিধিরা অংশ নেন।

এই সমাবেশে আবেগী স্বরে মুফতি আমিনী প্রার্থনা করেন, ''হে আল্লাহ, শেখ হাসিনা যেভাবে আমার ছেলেকে গুম করেছেন, তুমিও শেখ হাসিনার ছেলেকে সেইভাবে গুম করো।… আমার ছেলেকে গুম করে শেখ হাসিনা যে অপরাধ করেছেন তার শাস্তি তিনি দুনিয়া ও আখেরাতেও পাবেন।'
এই হৃদয় বিদারক প্রার্থনার পরে মুফতি আমিনী একটি আলটিমেটাম সরকারকে দিয়ে বলেন, 'আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আমার ছেলেকে ছেড়ে দিতে হবে… শেখ হাসিনা এবং তার সরকার ইসলামের শত্রু। আমাদের টাকা নেই। গুন্ডা নেই। কিন্তু আমাদের সাথে আল্লাহ আছেন। … এই সরকার আলেমদের বিভক্ত করার চেষ্টা করছে।'
আমিনী-হাসিনার হাই ড্রামার এই পর্যায়ে কারো পক্ষে বলা সম্ভব ছিল না নাটকটি ট্র্যাজেডি হবে? নাকি কমেডি? নাটকের শেষে বিয়োগান্তক দৃশ্য? নাকি মিলনান্তক?
কে প্রথম আল্লাহর কাছে যাবে। তিনি কার কথা শুনবেন?
তবে সবকিছুর উপরে একটি গভীর দুশ্চিন্তা রাজনৈতিক মহলকে গ্রাস করেছিল। অপহরণ, গুম, আমিনীর প্রেস কনফারেন্সসমূহ, আওয়ামী মন্ত্রী-নেতাদের পাল্টা বক্তব্য এবং শেষ পর্যায়ে আমিনীর ফরিয়াদের পর নির্ভর করছিল আবুল হাসনাতের ভাগ্য যিনি শুধু একজনের পুত্রই ননÑ তিনি একজনের স্বামী এবং একটি অনাগত শিশুর পিতাও বটে। রাজনৈতিক মহল ভাবছিল, আবুল হাসনাত চিরতরে নিখোঁজ হয়ে গেলে, সভ্য ও অহিংস রাজনীতিও কি এই দেশ থেকে চিরতরে নিখোঁজ হয়ে যাবে?

ট্র্যাক সিক্স
টাইটেল : হাসনাত মুক্ত

২৪ ঘণ্টা নয়, আলটিমেটাম দেয়ার প্রায় ৩৪ ঘণ্টা পরে অপহরণকারীরা ২২ এপ্রিল শুক্রবারে ভোর সাড়ে চারটার দিকে রাজধানীর নবকুমার স্কুল ও ঢাকা আলীয়া মাদরাসা সংলগ্ন মাঠের গেইটে তাকে ফেরত দিয়ে যায়। চোখ বাধা অবস্থায় তাকে সেখানে রেখে যাওয়ার সময়ে, পিতার বাড়িতে না গিয়ে শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে মোবাইল ফোনটিও ফেরত দেয়। ১২ দিনের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে হাসনাত বন্ধ মোবাইলটি অন করে শ্বশুরকে ফোন দেন। ইতিমধ্যে অপহরণকারীরা হাসনাতের স্ত্রীকেও ফোন করেছিল। এরপর মাদরাসার মাঠ থেকে তাকে উদ্ধার করে শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়।
মুক্তি পাওয়ার ঘণ্টা সাতেক পরে শুক্রবার বেলা এগারোটায় ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির উদ্যোগে লালবাগের দলীয় অফিসে এ বিষয়ে একটি প্রেস কনফারেন্স হয়। সেই সম্মেলনে দলীয় নেতাদের সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত ছিলেন মুফতি আমিনী এবং সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত হাসনাত।

সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে হাসনাত জানান, 'আটকের পর আমাকে বারবার বলা হতো তোকে ছেড়ে দিতে পারি এক শর্তে, তোর বাবাকে দুই মাস ঘরে বসিয়ে রাখবি। তোর বাবা বড় বেশি বেড়ে গেছে।… শুক্রবার ভোর সাড়ে চারটার দিকে রেখে যাওয়ার সময়ে আমাকে বারবার বলা হয়, চারদিন শ্বশুরবাড়িতে থাকবি। ঘর থেকে বের হবি না। ছেড়ে দেয়ার কথা যেন কাকপক্ষীও টের না পায়। কথা না শুনলে গুলি করে মেরে ফেলব।'

কান্নাজড়িত কণ্ঠে হাসনাত বলেন, '১০ এপ্রিল আমাকে জোর করে গাড়িতে তোলার পরপরই চোখ বেধে ফেলায় আমি কাউকে চিনতে পারিনি। … আটকের সময়ে প্রতিটি মুহূর্ত আমার কাছে শেষ মুহূর্ত মনে হতো। কারণ, কিছুক্ষণ পর পর তারা এসে বলতো, 'তোর শেষ ইচ্ছা কি বল।'

তার মুক্তি বিষয়ে হাসনাত জানান, 'শুক্রবার ভোরে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলা হয়। এরপর আমাকে চোখ বাধা অবস্থায় সিড়ি দিয়ে নামিয়ে একটি গাড়িতে তোলা হয়। গাড়ি করে ওই স্থান থেকে লালবাগ আসতে মাত্র মিনিট দশেক সময় লেগেছে। তার মানে, আমাকে রাজধানীরই কোনো এক স্থানে রাখা হয়েছিল।' হাসনাত তার বন্দি দশা সম্পর্কে জানান, 'আটক অবস্থায় আমাকে বারবার বলা হয়, আমার বাবা যাতে আন্দোলন না করেন, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। বাবাকে আন্দোলন থেকে দূরে রাখার শর্ত মেনে নিলেই আমাকে ছেড়ে দেয়া হতে পারে। এ কথা না শুনলে আমাকে গুলি করে মেরে ফেলা হবে। তারা বলে, চৌধুরী আলমের মতো তোর লাশও খুজে পাওয়া যাবে না।'

হাসনাত আরো জানান, 'আমাকে একটি বহুতল ভবনে রাখা হয়। সেখানে যেতে সিড়ির চারটি ধাপ পেরোতে হয়। আমাকে প্রায়ই অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করা হতো। বলা হতো, 'তোর বাবা চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেছে। তোর বাবাকে বল, যেন রাজনীতি না করে।' উত্তরে আমি বলতাম, আমি আব্বাকে বলবো। কিন্তু আব্বা আমার কথা শুনবেন না।'
বন্দি দশায় খাওয়া দাওয়া সম্পর্কে হাসনাত বলেন, 'আমাকে দুই বেলা খাবার দেয়া হতো। প্রথম দিনই আমাকে খাসির বিরিয়ানি দেয়া হয়। এরপর টানা এগারো দিন আমি রোজা ছিলাম। সেহরি ও ইফতারের সময়ে খাবার দেয়া হতো।… খাওয়া ও টয়লেটে যাওয়ার সময় বাদে সার্বক্ষণিক হাতে হ্যান্ডকাফ ও চোখে একটা লালসবুজ গামছা বাধা থাকতো। বারো দিনের মধ্যে মাত্র একবার গোসলের সুযোগ দেয়া হয়। আমার পরনের কাপড় সেই ১০ এপ্রিলের পাঞ্জাবি ও সালোয়ার।'
প্রেস কনফারেন্সের পর হাসনাত ফিরে যান তার শ্বশুরবাড়িতে।
হাপ ছেড়ে বাচেন পর্যবেক্ষক মহল। নাটকের পরিণতি হয়েছে মিলনান্তক।
সাধারণত এই সময়টায় কালবৈশাখির ঝড় হয়।
সেই ঝড়ে রাজধানীর কিছু গাছ ক্যাজুয়ালটি হয়। শিকড় উপড়ে পথে পড়ে যায়।
এ বছর রাজধানীতে এখন পর্যন্ত সেই রকম কোনো ঝড় হয়নি।
কিন্তু বৈশাখে এই রাজনৈতিক ঝড়ে প্রথম ক্যাজুয়ালটি হয়তো হয়েছে সরকারের নারী নীতি।
প্রস্তাবিত নারী নীতির গুণাগুণ বিবেচনা এবং এর বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আলোচনা-সমালোচনার বদলে মানুষের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছিল অপহরণ ও গুমের ঘটনাটির প্রতি।

দ্বিতীয় ক্যাজুয়ালটি হয়েছে আওয়ামী লীগ তথা সরকারের ইমেজ। এই ঘটনার ফলে আবারও স্পষ্ট হয়েছে আওয়ামী লীগ ও এই সরকারের সহিংস চরিত্র। কারণ, হুমকি ধামকি, গ্রেফতার, রিমান্ড, মামলা, সাজানো বিচার ব্যবস্থায় দণ্ডাদেশ, জেল জুলুম, হাজার হাজার মানুষের বিরুদ্ধে গণহুলিয়া জারি, অপ্রয়োজনীয় এয়ারপোর্টের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ প্রচেষ্টা, বিরোধী নেত্রীকে তার চল্লিশ বছরের বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ এবং গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতাকে তার প্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কারের চলমান প্রচেষ্টা, প্রভৃতির ফলে গত সোয়া দুই বছরে আওয়ামী সরকারের যে সহিংস চরিত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাকেই আরো জোরালো করেছে হাসনাত গুম প্রচেষ্টা।

ট্র্যাক ওয়ান
টাইটেল : লন্ডন-নিউ ইয়র্কে গুম

চরম বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার লক্ষ্যে সর্বশক্তিমানের কাছে মুফতি আমিনীর আকুল আবেদনের ঘটনায় মনে পড়ে গেল আগস্ট ১৯৮৭-তে আমার একটি বিপদের ঘটনা। তখন উদ্ধার পাওয়ার জন্য আমি আবেদন করেছিলাম অবসরপ্রাপ্ত (বা শক্তিহীন) মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহর কাছে। বাংলাদেশে প্রেসিডেন্ট জেনারেল এরশাদের শাসনের সময়ে সাপ্তাহিক যায়যায়দিন পত্রিকাটি দ্বিতীয়বার নিষিদ্ধ হবার পরে আগস্ট ১৯৮৬-তে আমাকে লন্ডনে নির্বাসিত জীবনে যেতে বাধ্য করা হয়।
আগস্ট ১৯৮৭-র মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা থেকে আমাকে জানানো হয় আমার পিতা সাইদুর রহমান হলি ফ্যামিলি হসপিটালে মৃত্যু শয্যায় আছেন। তার বয়স তখন ৭৮। ডাক্তার এবং আত্মীয়স্বজনরা আমাকে দ্রুত ঢাকায় আসতে বললেন।
কিন্তু আমি ঢাকা এয়ারপোর্ট পেরিয়ে হসপিটালে যাবো কী করে?

ঢাকা এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশন পুলিশ যেন আমাকে না আটকায় সেই আবেদন করতে আমি সরাসরি চলে গেলাম প্রেসিডেন্ট এরশাদ নিযুক্ত বৃটেনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত বা হাই কমিশনার জেনারেল শফিউল্লাহর অফিসে।
বিনা নোটিশে হাজির হওয়া সত্ত্বেও ভদ্রতা দেখিয়ে মি. শফিউল্লাহ আমাকে দেখা করার সুযোগ দিলেন।
আগস্ট মাসের মিষ্টি রোদ পর্দা পেরিয়ে হাই কমিশনারের হাই সিলিংওয়ালা রুমে এসে পড়ছিল।
গভীর মনোযোগের সাথে মি. শফিউল্লাহ আমার কথা শুনতে থাকলেন।

সংক্ষেপে তাকে বললাম, আমি পিতার বড় ছেলে এবং তার মৃত্যুর আগে আমাকে ঢাকায় ফিরতেই হবে। আমার নির্বাসনের ছয় মাস পেরুনোর পরে ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৭-তে আমি ঢাকায় ফেরার চেষ্টা করেছিলাম। তখন আমাকে দুই দিন এয়ারপোর্টে আটক রেখে লন্ডনে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিল ইমিগ্রেশন পুলিশ। এবার যেন সেটা না হয়।

আমি যদি আমার পিতাকে মৃত্যু শয্যায় না দেখতে পাই তাহলে কী হবে? সেটাও তাকে বললাম। আমি জানালাম, বৃটিশ সরকারের দুটি সামরিক গোয়েন্দা দফতর, এমআই ফাইভ ও এমআই সিক্স (গও ৫ ও গও ৬) থেকে অফিসাররা রিটায়ার করার পর লন্ডন থেকে কিছু দূরে চেমসফোর্ডে বেসরকারিভাবে তারা বিভিন্ন সংস্থায় বিভিন্ন কাজ করেন। এসব কাজের মধ্যে রয়েছে, কনসালটেন্সি, কনট্রাক্ট কিলিং বা চুক্তি মোতাবেক হত্যা, ইভস ড্রপিং বা টেলিফোন ও অন্যান্য স্থানে আড়ি পেতে শোনা, ব্ল্যাকমেইলিং, ভয়ভীতি প্রদর্শন এমনকি ভাড়াটে সেনাবাহিনী বা মার্সেনারি ফোর্স গঠন। উপযুক্ত টাকার বিনিময়ে রিটায়ার্ড অফিসাররা এসব করেন।

সেই সময়ে প্রেসিডেন্ট এরশাদের এক শ্যালক থাকতেন লন্ডনে এবং আরেক শ্যালক থাকতেন নিউ ইয়র্কে। দুজনাই ছিলেন অধুনালুপ্ত ব্যাংক বিসিসিআইয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।

মি. শফিউল্লাহকে বললাম, যে পাউন্ড অথবা ডলারের বিনিময়ে ভাড়াটে বৃটিশ সামরিক অফিসারের মাধ্যমে এদের মধ্যে একজনকে গুম করা সম্ভব সেই সঙ্গতি আমার আছে। বিষয়টা প্রেসিডেন্ট সাহেবকে জানিয়ে দিন।
আমি সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম বৃটেনের বহুল প্রচারিত পাক্ষিক ম্যাগাজিন প্রাইভেট আই (চৎরাধঃব ঊুব যার মানে বেসরকারি গোয়েন্দা)। মি. শফিউল্লাহর সামনে ওই ম্যাগাজিনের একটি পৃষ্ঠায় একটি বিজ্ঞাপনে কয়েকটি ফোন নাম্বার দেখিয়ে বললাম, আমি যা বলছি এটা যে করা সম্ভব সেটা এসব নাম্বারে ফোন করলেই জানতে পারবেন। সুতরাং আমি আপনার কাছে আবেদন করছি আমার ঢাকায় যাবার ব্যবস্থা করুন।

আমার এই আবেদন শোনার পর গৌরকান্তি মি. শফিউল্লাহর মুখে দুশ্চিন্তার আভাস দেখা গেল। তিনি সশব্যস্ত স্বরে বললেন, আপনি একটু অপেক্ষা করুন। চা খান। আমি আসছি।
এই বলে তিনি পাশের ঘরে চলে গেলেন।
মিনিট পনেরো পরে স্মিত মুখে ফিরে এসে বললেন, হ্যা। আপনি ঢাকায় যেতে পারবেন। আপনার পিতাকে দেখতে পারবেন। তবে শর্ত হচ্ছে এই যে, আপনি আপনার বাসস্থান ইস্কাটন গার্ডেনস থেকে শুধু ওই একই রাস্তায় অবস্থিত হলি ফ্যামিলি হসপিটালে যেতে পারবেন। আর কোথাও নয়। প্রেস ক্লাবে নয়, ঢাকা ক্লাবে নয়, কোনো পাবলিক প্লেসে নয়। অর্থাৎ ঢাকায় যে আপনি আছেন, সে কথাটি যতোটা সম্ভব গোপন রাখতে হবে।

তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বললাম, আমি ঢাকায় যাবো মৃত্যুপথযাত্রী পিতাকে দেখতেÑ পত্রিকা পুনঃপ্রকাশের চেষ্টা করতে নয়। আমাকে হয়তো সারাক্ষণ হসপিটালেই থাকতে হবে। আর কোথাও যাবার প্রবৃত্তি বা সময় হবে না।
মি. শফিউল্লার কাছ থেকে গৃন সিগনাল পাওয়ার পরপরই আমি ঢাকায় যাই।
হলি ফ্যামিলি হসপিটালে পৌছে পিতাকে দেখতে পেয়েছিলাম। তবে ততক্ষণে তার বাকশক্তি প্রায় লুপ্ত হয়েছিল। তিনি হয়তো আমাকে চিনেছিলেন। হয়তো চেনেননি।

তবু সান্ত্বনা এই যে তাকে জীবিত দেখা সম্ভব হয়েছিল। দুঃখ এই যে স্বৈরাচারী শাসকের কারণে পিতার শেষ বছরগুলোতে তার পাশে আমার থাকা সম্ভব হয়নি।

পরে শুনেছিলাম সেদিন লন্ডনে হাইকমিশনে আমাকে বসিয়ে রেখে মি. শফিউল্লাহ টেলিফোনে আলোচনা করেছিলেন প্রেসিডেন্ট এরশাদ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ড. মতিনের সঙ্গে। ড. মতিন ফোন করেছিলেন হলি ফ্যামিলি হসপিটাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এবং জানতে চেয়েছিলেন (তার ভাষায়) পেশেন্ট টিকবে নাকি? উত্তর যখন নেগেটিভ হয়, অর্থাৎ পেশেন্ট টিকবে না, তাতে আশ্বস্ত হয়ে ড. মতিন প্রেসিডেন্টকে বলেছিলেন, আমাকে দেশে সীমিত সময়ের জন্য ফেরার অনুমতি দেয়া যেতে পারে।
পিতার মৃত্যু হয় ২৮ আগস্ট ১৯৮৭-তে।

গ্রামে কুলখানিতে যাবার অনুমতি আমি পেয়েছিলাম। কিন্তু তার পরপরই আমাকে লন্ডনে ফিরে যেতে বাধ্য করা হয়। চল্লিশা পালনের সুযোগ দেননি তদানীন্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মতিন এবং তদানীন্তন ডিজি, ডিএফআই মেজর জেনারেল লতিফ।

ট্র্যাক সেভেন
টাইটেল : গুমের রাজনীতি ও হুমকি

আজ প্রায় ২৪ বছর পরেও দেখা যাচ্ছে গুমের রাজনীতি কুফলদায়ক হলেও গুমের হুমকি ফলপ্রসূ হতে পারে।
গুমের রাজনীতি আওয়ামী লীগ বা আওয়ামী সরকারের জন্য সুফল আনেনি। কিন্তু গুমের হুমকি সুফল দিয়েছে মুফতি আমিনীকে। পিতা তার পুত্রকে দেখতে পেয়েছেন। গুমের হুমকি সুফল দিয়েছিল আমাকে। পুত্র তার পিতাকে দেখতে পেয়েছিল।

তাহলে ব্যাপারটা কী দাড়ালো?
সরকারের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের দুর্বলতা বা ভালনারেবিলিটি কোথায়, সেটা তারা নিজেরাই ফাস করে দিয়েছেন।
স্বৈরশাসক অথবা গণতন্ত্রের আবরণে স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে গুমের পন্থা বেছে নিতে পারে নির্যাতিত ও অসহায় মানুষ।
আর সেটাই গণতন্ত্রের জন্য একটা দুঃসংবাদ।

ট্র্যাক এইট
টাইটেল : কে পুণ্যবান?

প্রশ্ন উঠতে পারে শেখ হাসিনা একজন "প্রকৃত মুসলমান" এবং মুফতি আমিনী একজন সাচ্চা মুসলমান হলেও শুধু শেষোক্ত জনেরই আবেদন কেন আল্লাহ মঞ্জুর করলেন? প্রশ্ন উঠতে পারে এরশাদ নিয়মিত মসজিদে গেলেও (কখনও বা স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে!) এবং আমি জানাজার সময় বাদে মসজিদে না গেলেও, আমার আবেদন কেন মঞ্জুর হলো?
এর উত্তর হলো একমাত্র সর্বদ্রষ্টাই জানেন, কে প্রকৃতই পুণ্যবান।
আমিন।

২৪ এপ্রিল ২০১১