বিয়ের বয়স কমালে কার ষোলকলা পূর্ণ হবে

ফরহাদ আল করিম
Published : 11 April 2015, 07:13 AM
Updated : 11 April 2015, 07:13 AM

এ বছর বাংলাদেশ 'ডব্লিউআইপি' (উইমেন ইন পার্লামেন্ট) পুরস্কার জিতেছে। এ বছরের মার্চে ইথিওপিয়ার আদ্দিস আবাবায় সংগঠনটির সম্মেলনে বাংলাদেশ এ সম্মাননা পায়। মূলত দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য যে কমে এসেছে তার স্বীকৃতি হিসেবে আমাদের সরকারপ্রধান পুরস্কারটি পেয়েছেন। এ প্রাপ্তি আমাদের আনন্দিত ও গর্বিত করেছে।

ডব্লিউআইপি সারা বিশ্বের নারী সাংসদদের একটি সংগঠন যার হেডকোয়াটার জার্মানিতে। বিশ্বের নারী সাংসদদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়ন ও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষার মাধ্যমে যাতে সামাজিক অগ্রগতি সাধন করা যায় সে লক্ষ্যে এ সংগঠনের জন্ম।

চুয়াল্লিশ বছরে বাংলাদেশের অর্জনের ঝুলিতে উল্লেখ করার মতো অনেক কিছু রয়েছে; খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, নারীর ক্ষমতায়ন ত্বরান্বিতকরণ, দারিদ্র বিমোচনে অগ্রগতি, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধিসহ জেন্ডার-সমতা আনয়ন, শিশুমৃত্যুর হার কমানো এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারীর অংশগ্রহণসহ ধারাবাহিকভাবে প্রবাসী আয় অর্জন ইত্যাদি। ভবিষ্যত বাংলাদেশকে সম্মুখপানে এগিয়ে নিতে চাইলে নারী পুরুষদের হাতে হাত ধরে আরও বেশি কাজ করতে হবে যার বিকল্প নেই। তাই প্রয়োজন সকল ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।

আমাদের নারীরা এখন শিক্ষা, রাজনীতি, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, মানসম্মত চাকরি, সব জায়গায় যোগ্যতার মাপকাঠিতে নিজ আসন পোক্ত করে নিচ্ছেন। বর্তমানে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে নারী শ্রমিকরা বিদেশে গিয়েও চাকরি করছেন। নারীর এই ছুটে চলার পথ আরও মসৃণ হোক, এটি নিন্দুক আর হিংসুক ছাড়া সকলের চাওয়া।

তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিবারে নারীর অবস্থান এখনও নিম্নস্তরে ও তার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতার পরিসর অত্যন্ত সীমিত। পুরুষশাসিত সমাজে তারা বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা ও অমর্যাদার শিকার হন। বাংলাদেশি নারীরা এখনও পারিবারিক সহিংসতা, যৌতুকসংক্রান্ত সহিংসতা, বাল্যবিবাহ, ইভ টিজিং, ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ, অবৈধ ফতোয়া ও যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। সামাজিক বৈষম্যের জন্য তারা বিভিন্ন ধরনের সুবিধাপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এবং পুরুষদের থেকে পিছিয়ে পড়ছেন। তবে বর্তমানে বাংলাদেশের নারীদের সামাজিক অবস্থার কিছুটা ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।

এ পর্যন্ত অর্জন যা-ই হোক, আমাদের নারীরা যে আশানুরূপ আগ্রগতি লাভ করতে পারেনি তার প্রমাণ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদন। গত বছর জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) প্রকাশিত 'হিডেন ইন প্লেইন সাইড' নামক একটি বিশ্লেষণমূলক রিপোর্টে 'দক্ষিণ এশিয়ার কিশোরী নির্যাতনে বাংলাদেশ শীর্ষে' বলে মত প্রকাশ করা হয়। ১৯০ দেশের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের মাধ্যমে তৈরি রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীতে যে রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাল্যবিবাহ ও অপেক্ষাকৃত কম বয়সে মা হওয়ার প্রবণতা দেখা যায় বাংলাদেশ তার অন্যতম।

যদিও বিভিন্ন সামজিক সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে, তবু বাল্যবিবাহ বন্ধে এ পর্যন্ত তেমন অগ্রগতি অর্জন করতে পারেনি। আমাদের সমাজে এখনও মেয়েশিশু জন্ম নিলে তাকে বোঝা মনে করা হয়, তাকে শিক্ষার সুযোগ থেকে দূরে সরানো হয়, ভালো পাত্র পেলে তাকে দ্রুত বিয়ে দেওয়ার প্রবণতাও লক্ষণীয়। যৌতুকের বিনিময়ে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হচ্ছে তার উদাহরণ অহরহ। সরকার এ সামাজিক ব্যাধি কমাতে নানাভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। নাগরিক সমাজ ও এনজিওগুলোও বিভিন্ন মাধ্যমে নানা সময়ে বাল্যবিবাহ নিয়ে সোচ্চার। প্রকাশ্যে বা গোপনে এই অপকর্ম ঘটলেও এ কথা ঠিক, বাল্যবিবাহ যে খারাপ ও অমার্জনীয় অপরাধ এ নিয়ে সরব হচ্ছেন সবাই।

কোনো পক্ষের দাবি-দাওয়া না থাকলেও হঠাৎ আমাদের সরকার অতিউৎসাহী হয়ে মেয়েদের বিয়ের বয়স কমানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। সম্প্রতি 'বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৪'এর খসড়া মন্ত্রিসভায় উত্থাপিত হলে সেখানে মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ বছর অপরিবর্তিত রাখার পাশাপাশি একটি অপ্রয়োজনীয় ধারা সংযুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিদ্ধান্তটি হল, মা-বাবা চাইলে আদালতের অনুমতি নিয়ে ১৬ বছরেও মেয়েকে বিয়ে দিতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে সরকারের ব্যাখ্যা হল, ষোলতে মেয়েদের বিয়ে হলে সামাজিক সমস্যা কিছুটা কম হবে।

ব্যাখ্যাটি উদ্ভট মনে হচ্ছে। অনেকটা যেন ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়ে আসলে বাল্যবিবাহের স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে। নতুন আইনে বলা হয়েছে, যদি পিতামাতা চায় তবেই আদালতের অনুমতি নিয়ে ১৬ বছর বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিতে পারবেন। পাগলকে সাঁকো নাড়া দিতে নিষেধ করার মতো বিষয়! সরকারের বর্তমান এ উদ্যোগে সমাজ সচেতন মহলের মনে যেমন খটকা লাগছে, তেমনি সবাই উদগ্রীব হয়ে উঠেছেন সিদ্ধান্তটির যৌক্তিকতা জানতে।

অতীতে বাল্যবিবাহ আমাদের দেশের সাধারণ চিত্র ছিল। মূলত সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি হবার ফলে গত দুদশকে বাল্যবিবাহের হার কিছুটা কমে এসেছে। তবে এটি যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন সচেতন মহল। বাল্যবিবাহ সমূলে উৎপাটন করতে পারলে সমাজ ও সভ্যতা আরও এগিয়ে যাবে। এ জন্য চাই আরও বেশি কার্যকর আইনের প্রয়োগ ও সচেতনতা বৃদ্ধি। কিন্তু বাস্তবতা হল, সরকার যেন কার স্বার্থে উল্টো পথে হাঁটছেন যা, সর্বমহলের মতে, একপ্রকার বোকামি।

বাল্যবিবাহের কুফল সবাই কম বেশি জানি। মেডিক্যাল সায়েন্স বলছে, অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে হলে বিয়েপরবর্তী সময়ে তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি প্রকট আকার ধারণ করে। যেমন, অপরিপক্ক শরীরে গর্ভধারণ, গর্ভপাতের আশঙ্কা, মায়ের প্রসবজনিত মৃত্যু, নবজাতকের জন্মকালীন মৃত্যু, অপুষ্ট নবজাতকের জন্ম হওয়া এবং মায়ের স্বাস্থ্য ভেঙে যাওয়া ইত্যাদি।

অন্যদিকে বিয়ের পরেও মেয়েরা স্বামীর গৃহে শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হতে পারে। অপ্রাপ্তবয়ষ্ক বধূ শ্বশুরবাড়ির করণীয় বুঝতে পারে না বলে নানা ভোগান্তিতে পড়ে। বিশেষজ্ঞের মতে, পারিবারিক পর্যায়ে এসব নির্যাতন কেবল বাল্যবিবাহ বন্ধ করলে থামানো সম্ভব।

বিগত সময়ে ধারাবহিকভাবে সরকারের নানাবিধ প্রণোদনার কারণে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কন্যাশিশুদের অংশগ্রহণ বাড়ছে যা সার্বিক শিক্ষার হারের উন্নতিতে প্রভাব রেখেছে। কিন্তু বাল্যবিবাহের কারণে কোমলমতি মেধাবী কন্যাশিশুরা শিক্ষা থেকে ছিটকে পড়বে যা দেশের সার্বিক উন্নয়নে বাধাগ্রস্ত করবে, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

সরকারের বর্তমান এ সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে কেউ কেউ বলছেন, এটি রাজনৈতিক চাল বা ভোট টানার রাজনীতি। যদিও সরকার অন্যান্য দেশে মেয়েদের বিয়ের বয়স কমানোর উদাহরণ দিয়ে সুকৌশলে এ অভিযোগ পাশ কাটিয়ে আদালত ও মা-বাবার সম্মতিতে জোর দিচ্ছেন। কিন্তু আইনটি যদি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে কন্যাশিশুদের ওপর অভিভাবকদের জবরদস্তি করার সুযোগ তৈরি হবে বলে মনে করেন অধিকারসচেতন মহল। ক্ষেত্রবিশেষে অভিভাবকরা অপরিণত বয়সে মেয়েকে বিয়ে দিতে বাধ্যও হবেন। আবার সুযোগসন্ধানী, যৌতুকলোভী ও ধর্মান্ধরা এতে উৎসাহিত হবে।

জাতিসংঘ ঘোষিত শিশু অধিকার সনদ ১৯৯০ অনুযায়ী ১৮ বছরের কমবয়সী সকল মানবসন্তান 'শিশু' বলে গণ্য হবে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে শিশু অধিকার সনদে অনুসমর্থন করেছে। ১৮ বছর বয়স না হলে আমাদের কোনো নাগরিক ভোট দিতে পারবে না। কারণ তারা নাবালক। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনেও মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ বলা হয়েছে। এছাড়া ২০১৩ সালে পাশ হওয়া শিশু অধিকারসংক্রান্ত নতুন চিলড্রেন অ্যাক্টে ছেলে ও মেয়েদের সাবালকত্বের বয়স ১৮ বলে ঠিক করা হয়েছে। তাহলে বলা যেতে পারে, সরকারের গৃহীত আইনটি যদি পাশ হয়, তাহলে নির্ঘাৎ নারী ও শিশুঅধিকার লঙ্ঘন হবে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান পদক্ষেপের চেয়ে ১৯২৯ সালের সিএমআরএ বা চাইল্ড ম্যারেজ রিস্ট্রেইন্ট অ্যাক্ট অনেক ভালো। কারণ এই আইনে ১৮ বছরের কমবয়সী মেয়ে ও ২১ বছরের কমবয়সী ছেলেদের বিয়ে দেওয়া আইনত দণ্ডনীয়; যদিও সীমিত ক্ষেত্রে এটি অনুসরণ করা হচ্ছে। তবে যারা বাল্যবিবাহের শিকার হয়, তাদের সাহায্য করা ও সামাজিক সমর্থন দেওয়ার বিষয়ে কোনো বিধান সিএমআরএতে ছিলন না যা একটি সীমাবদ্ধতা।

২০১৪ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত গার্ল সামিটে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বাল্যবিবাহ কমানোর অঙ্গীকার করেন। এছাড়া আমাদের অন্যান্য অঙ্গীকারগুলো ছিল: ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের কমবয়সী মেয়েদের বিয়ে সম্পূর্ণ বন্ধ করা, ২০২১ সালের মধ্যে ১৫-১৮ বছর বয়সী মেয়েদের বিয়ের ঘটনা এক তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনা এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে বাল্যবিবাহ চিরতরে উৎখাত ইত্যাদি। এছাড়া সরকার ২০১৫ সালের মধ্যে এই কুপ্রথা বন্ধে একটি জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন করবেন বলে জানান। সচেতন মহলের প্রশ্ন, সরকার কি তাহলে লন্ডনের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করতে আইনটি সুকৌশলে পরিবর্তন করছেন?

পৃথিবীতে এমন অনেক দেশ আছে যেগুলো বাল্যবিবাহ বন্ধে সফল হয়েছে। আমরা এসব দেশের সুখকর অভিজ্ঞতা ধার করে নিজেদের উন্নতি করতে পারি। তবে যা-ই করি না কেন, যে কোনো ভাবে শিশুর স্বার্থ যাতে বিঘ্নিত না হয় তা খেয়াল রাখা দরকার। বিয়েতে জন্ম নিবন্ধন সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র বা বয়স প্রমাণ করে এমন সব ডকুমেন্ট প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করতে হবে। তাহলে জটিলতা অনেক কমে যাবে। সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিসহ স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি, যেমন, চেয়ারম্যান, মেম্বার, মেয়র ও কাউন্সিলরদের যদি আইন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেওয়া যায় তাহলে মাঠ পর্যায়ে এই অপকর্ম কমতে শুরু করবে।

শোনা যাচ্ছে, সরকার জাতিসংঘ শিশু তহবিলের সঙ্গে মিলে বাল্যবিবাহসংক্রান্ত জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে যাচ্ছেন। এ উদ্যোগ মানবাধিকারের স্বার্থে শুভ দিক অবশ্যই। তবে তার আগে প্রয়োজন বর্তমান পদক্ষেপ অর্থাৎ মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ থেকে ১৬তে নামানোর যে অভিপ্রায় তা থেকে সম্পূর্ণভাবে সরে আসা। এছাড়া বাল্যবিবাহসংক্রান্ত যে কোনো জাতীয় পরিকল্পনা যেন অধিকারসচেতন প্রতিষ্ঠান ও জেন্ডার-সাম্য নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়।

তাহলে সমাজে স্থিতিশীলতা আসবে ও সকলের অংশগ্রহণে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা যাবে।