শেষ হোক বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও সোহাগপুরের প্রতীক্ষা

মো. আনোয়ার হোসেনমো. আনোয়ার হোসেন
Published : 7 April 2015, 05:36 PM
Updated : 7 April 2015, 05:36 PM

৬ এপ্রিল, ২০১৫। সোমবার। ঘড়ির কাঁটা ৯টা অতিক্রম করেছে। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মোট চার সম্মানিত বিচারক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে আসন গ্রহণ করেছেন। ফাঁসির রায়ের বিরুদ্ধে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের রিভিউ আবেদনের উপর চূড়ান্ত মতামত দেবেন তাঁরা। কিছু বুঝে উঠবার আগেই বিচারকরা উঠে আদালতকক্ষ ত্যাগ করলেন। কয়েক সেকেন্ডে প্রধান বিচারপতি কী উচ্চারণ করলেন, তাও ঠিক শোনা গেল না। তারপর খানিক স্তব্ধতা। এর মধ্যে কেউ একজন বলে উঠলেন, 'রিভিউ পিটিশন ডিসমিসড'। অপেক্ষার পালা শেষ হয়েছে। রিভিউর রায়ে কামারুজ্জামানের ফাঁসির আদেশ বহাল।

১০ সেকেন্ডের কম সময়ে উচ্চারিত এই কটি কথা শোনার জন্য সোহাগপুরের বিধবা পল্লীর এখনও বেঁচে থাকা বিধবাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে ২৫ জুলাই, ১৯৭১ থেকে শুরু করে দীর্ঘ, অতিদীর্ঘ তেতাল্লিশ বছর নয় মাস দশ দিন অথবা ১৩৮ কোটি ৬৭ লাখ সেকেন্ড।

একাত্তরের ঘাতক, তৎকালীন ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতা ও বৃহত্তর ময়মনসিংহের আলবদর বাহিনীর কমান্ডার কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে মোট ৭টি অভিযোগের মধ্যে তৃতীয় অভিযোগ শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ি থানার সোহাগপুর গ্রামে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীকে নিয়ে গিয়ে গণহত্যা চালানো। যার ফলে সোহাগপুর গ্রামের একটি পল্লী পুরুষশূন্য হয়ে পড়ে, যা পরে 'বিধবা পল্লী' নামে পরিচিতি পায়।

এ হত্যাকাণ্ডের উপর আপিলে বিচারপতি এস কে সিনহার লেখা রায়ে বলা হয়:

"হত্যা ও ধর্ষণের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তিনি (কামারুজ্জামান) সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। ওই ঘটনা ছিল অত্যন্ত নিষ্ঠুর, অমানবিক ও বর্বর। অপরাধ সংগঠনকারীরা কেবল পুরুষদের হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, তাদের হাত থেকে বিধবারাও নিস্তার পাননি। […] এমনকি যে নারীরা অপরাধের ভয়াবহতা বুঝতে পেরে পালিয়ে গিয়ে দুতিন দিন পর ফিরে এসেছিলেন, তারাও রেহাই পাননি।"

কামারুজ্জামানের অপরাধের ভয়াবহতা ও ক্ষতিগ্রস্তদের মানসিক পীড়ন তুলে ধরতে গিয়ে আপিল বিভাগের রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, রাষ্ট্রপক্ষের ১২ নম্বর সাক্ষী যখন শুনানিতে তার স্বামীকে হত্যা ও তার প্রতি নির্যাতনের বর্ণনা দিচ্ছিলেন, তখন তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় তিনি বারবার নিঃশ্বাস নিচ্ছিলেন:

"চল্লিশ বছর পরও তিনি আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলেন না। কী বিভীষিকাময় একটা ঘটনা ছিল! একই ধরনের অভিজ্ঞতা ছাড়া অন্য কেউ এটা কল্পনাও করতে পারে না। এ সব বর্বর ঘটনায় কামারুজ্জমান সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। কিছুর সঙ্গে এর তুলনা করা যায় না। এমনকি নাৎসিরাও এ ধরনের নিষ্ঠুর কাজ করেনি।"

পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়:

"বিচারের কোনো পর্যায়ে কামারুজ্জামান তার এ ধরনের কাজের জন্য অনুশোচনা প্রকাশ করেননি, বরং আস্ফালন দেখিয়েছেন। নির্বিচারে হত্যা ও ধর্ষণে তিনি সশস্ত্র গ্রুপের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।"

রায়ে বলা হয়, আলবদর বাহিনী গঠন এবং পরে সোহাগপুর গ্রামে গণহত্যা ও বিধবাদের ধর্ষণে কামারুজ্জামানের কার্যক্রম ছিল অমানবিক ও বিভীষিকাময়।

"এই অপরাধ সংগঠনে আমরা একজন মানুষ ও একটি জানোয়ারের মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পাই না।"

আদালত আরও বলেছেন:

'''ঠাণ্ডা মাথায় হিসাব কষে' কোনো হত্যাকাণ্ড ঘটানো হলে সাধারণ আইনেও আদালত মৃত্যুদণ্ড দিয়ে থাকে; কারণ এ ধরনের ঘটনা সমাজের বিবেকে নাড়া দেয়। […] এমনভাবে তারা খুনের উৎসব চালাচ্ছিল, যেন তারা পাখি বা প্রাণি শিকার করছে।"

পূর্ণাঙ্গ রায়ে সর্বোচ্চ আদালত বলেন:

"আমরা এটা ভাবতেও পারি না যে, একজন বাঙালি হয়ে তিনি কীভাবে এ ধরনের ভয়াবহ অমানবিক কাজে যুক্ত হলেন। দণ্ডের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের কৃপা তিনি পেতে পারেন না।"

২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর, ২০১১ সালের ২১ জুলাই কামারুজ্জামানের যুদ্ধাপরাধের তদন্ত শুরু করে প্রসিকিউশনের তদন্ত দল। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে একটি মামলায় একই বছর ২৯ জুলাই তাকে গ্রেপ্তারের পর, ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন ২০১২ সালের ১৫ জানুয়ারি কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে। ৩১ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনাল তা আমলে নেয়। পরে মামলাটি ট্রাইব্যুনাল-২ এ স্থানান্তর করা হয়।

২০১২ সালের ৪ জুন ট্রাইব্যুনাল-২ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মোট ৭টি অভিযোগের উপর চার্জ ফ্রেমিং অর্ডারের আদেশ প্রদান করে। ৭ জুলাই, ২০১২ শুনানি শুরু হয় এবং ১৫ জুলাই, ২০১২ পর্যন্ত প্রসিকিউশনের পক্ষে তদন্ত কর্মকর্তাসহ মোট ১৮ জন এ মামলায় সাক্ষ্য দেন। আসামিপক্ষে সাক্ষ্য দেন পাঁচজন। ২৪ মার্চ, ২০১৩ তাদের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। ১৬ এপ্রিল, ২০১৩ শেষ হয় সমাপনী বক্তব্য।

এরপর ২০১৩ সালের ৯ মে ট্রাইব্যুনাল-২ কর্তৃক দেওয়া রায়ে ৭টির মধ্যে ৫টি অভিযোগ প্রমাণিত বলে জানানো হয়। ৩ ও ৪ নম্বর অভিযোগে কামারুজ্জামানকে ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। ৩ নম্বর অভিযোগটি ছিল সোহাগপুর হত্যাকাণ্ড। আসামিপক্ষ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি (বর্তমানে প্রধান বিচারপতি) এস কে সিনহার নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের বেঞ্চ ৩ নভেম্বর, ২০১৪ ফাঁসির আদেশ বহাল রেখে রায় ঘোষণা করেন।

১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫ বিচারকদের স্বাক্ষরের পর সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখা পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করে। আসামিপক্ষ আপিল রায়ের রিভিউ চেয়ে আবেদন করলে দুদফা শুনানি পেছানোর পর ৫ এপ্রিল, ২০১৫ প্রায় দুঘণ্টার রিভিউ শুনানি শেষে পরদিন ৬ জুলাই, ২০১৫ ফাঁসির আদেশ বহাল রেখে চূড়ান্ত আদেশ প্রদান করেন মহামান্য প্রধান বিচারপতি।

তাই একদিকে সোহাগপুরের জীবন্মৃত বিধবাদের বিচার পাওয়ার অপেক্ষার পালা যেমন ছিল দীর্ঘ, তেমনি কয়েক সেকেন্ডের চূড়ান্ত আদেশ প্রদান করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগকে বিভিন্ন আইনি ধাপ অতিক্রম করতে হয়েছে সেই ২০১১ সালের ২১ জুলাই থেকে সাড়ে তিন বছরেরও বেশি সময়।

নানা কথা মনে পড়ে। একাত্তরে, মুক্তিযুদ্ধকালে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা এবং রংপুরের একাংশ নিয়ে ছিল সর্ববৃহৎ সেক্টর, ১১ নম্বর সেক্টর। সে বছরের জুলাই মাসে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া কমান্ডো অফিসার মেজর আবু তাহের এ সেক্টরের অধিনায়কত্ব গ্রহণ করেন। আমাকে তিনি নিয়োগ দেন সেক্টর হেডকোয়ার্টারের স্টাফ অফিসার হিসেবে। অপারেশন কক্ষে ম্যাপ সাজিয়ে রাখা, 'যুদ্ধ সংবাদ', যুদ্ধের পরিভাষায় যাকে Situation Report বলা হয়, তা তৈরি করে ওয়্যারলেস অপারেটরের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রেরণ এবং অধিনায়কের সঙ্গে সব সময় থাকার দায়িত্ব দেওয়া হয় আমাকে। সে সূত্রেই যুদ্ধের নানা গোপন সংবাদ আমার জানা হয়ে যেত।

আগস্ট মাসে খবর এল হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগিতায় বদর বাহিনী গঠন করেছে কামারুজ্জামান নামের এক যুবক, যার বাড়ি শেরপুরে। তার দুই সহযোগী, জামালপুর শহরের আশরাফ ও মান্নান। এরা তিনজনই জামালপুর শহরে আশেক মাহমুদ কলেজে পড়ত এবং ইসলামী ছাত্র সংঘের সক্রিয় সদস্য ছিল। ইতোমধ্যেই হানাদার বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে বহু হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে এ তিনজন। নালিতাবাড়ির সোহাগপুর গ্রামে গণহত্যা ও বিধবা নারীদের গণধর্ষণের খবরও এল। মেজর তাহের কয়েকবার মুক্তিযোদ্ধা দলকে পাঠিয়েছিলেন এদের ধরে নিয়ে আসতে অথবা হত্যা করতে। তা সফল হয়নি।

১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ফাঁসির মঞ্চে ১১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক কামালপুরের সম্মুখযুদ্ধে এক পা-হারানো কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তমকে হত্যা করলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। দেশদ্রোহিতার দায়ে কারাভ্যন্তরে এক মাসের গোপন বিচার। ফাঁসির রায় ঘোষণার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে তা কার্যকর করা হল। অন্যদিকে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালীন ১১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক তাহেরের আওতাধীন এলাকায় গণহত্যায় লিপ্ত যুদ্ধাপরাধী সেই কামারুজ্জামান কর্নেল তাহেরের হত্যাকারী জিয়াউর রহমানের আমল থেকে শুরু করে ২০১১ সালের ২৯ জুলাই গ্রেপ্তারের পূর্ব পর্যন্ত কী দোর্দণ্ড প্রতাপে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কার্যকলাপ চালিয়ে গেল!

তারপর সাড়ে তিন বছরেরও বেশি সময় এই ঘাতকের বিরুদ্ধে বিচারকাজ চলেছে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে এবং পরে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টে। তার প্রতি সর্বোচ্চ মানবাধিকার প্রদর্শন করা হয়েছে এসব উন্মুক্ত আদালতে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত তার আপিল গ্রহণ করেছে; দীর্ঘ সময় নিয়ে ৫৭৭ পৃষ্ঠার আপিল রায় দিয়েছে। তার বিরুদ্ধে আসামির পক্ষ থেকে রিভিউ গ্রহণ করেছেন দেশের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগের চারজন বিচারপতি। কোনো তাড়াহুড়া কেউ করেননি। রিভিউ আবেদনের শুনানিঅন্তে শেষ পর্যন্ত সেই কাঙ্ক্ষিত রায় ফাঁসির আদেশ বহাল রইল।

ডেভিড বার্গম্যান ও তাঁর সঙ্গী মানবতাবাদী (!) সুশীলরা আশা করি বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে সামনের দিনগুলোতে সুপরামর্শ দেবেন।

বাংলাদেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার দুরুহ সংগ্রামে যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় ও তা কার্যকর হওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ জন্য আমাদের ধন্যবাদ পাবেন। ধন্যবাদ বাংলাদেশের সাধারণ জনগণও পাবেন; কারণ তারা শেখ হাসিনাকে এই কঠিন কাজ সম্পাদনের জন্য নৈতিক সমর্থন প্রতিদিন দিয়ে যাচ্ছেন। সপরিবারে জাতির জনক, চার জাতীয় নেতা ও কর্নেল তাহেরের হত্যার বিরুদ্ধে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়; কাদের মোল্লার ফাঁসি এবং কামারুজ্জামানের ফাঁসির হাত ধরে বাংলাদেশ বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসবে।

তবু বহু পথ এখনও বাকি। মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী কাজী আরেফ আহমেদ, খালেদ মোশাররফ, নাজমুল হুদা, এটিএম হায়দার, এম এ মঞ্জুর হত্যার বিচার আজও হয়নি– যেমন হয়নি জেনারেল জিয়ার হাতে হাজারো সিপাহী হত্যার বিচার। আরও কত হত্যাকাণ্ড! এই দীর্ঘ পথ পার হলেই এর মধ্য দিয়ে বহু যুগের বিশেষ করে গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধে বহু আত্মদানে অর্জিত আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিতে একটি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল, সহনশীল, মানবিক সমাজ যা জনগণের কাছে সতত দায়বদ্ধ থাকবে, তা অর্জনে আমরা সুনিশ্চিত পদক্ষেপ ফেলতে পারব।

শিরোনামে সোহাগপুরের বিধবা পল্লীর এখনও বেঁচে থাকা বিধবাদের দীর্ঘ অপেক্ষার পালা শেষ হওয়ার কথা বলেছি। বাস্তবে তা শেষ হবে যখন তাঁরা দেখবেন ঘাতক কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে।

ড. মো. আনোয়ার হোসেন: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।