ফিরোজায় ফেরার পথটি যে খুনের রঙে লাল

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 6 April 2015, 08:24 PM
Updated : 6 April 2015, 08:24 PM

'রঙ্গভরা বঙ্গদেশ' বলে একটা কথা চালু আছে। এটি যদি বিনোদনের কারণে বলা হয়, এখন এর সবচেয়ে বড় কারিগর আমাদের রাজনীতি। কী যে সে পারে, আর কী পারে না সে হিসাব কেউ জানে না। তাই দেখা গেল, নব্বই দিনেরও বেশি 'আপিসবাসের' পর বেগম জিয়া তাঁর বাড়ি, 'ফিরোজায়' ফিরে গেছেন।

যখন কোনো কিছু মিলে যায় বা সন্দেহাতীতভাবে মনে দোলা দেয়, তখন আমরা নড়েচড়ে বসি। যেমন দেখছি, ফিরোজায় যাবার রাস্তাটি কিন্তু লালে লাল। নব্বই বা পঁচানব্বই দিন, দীর্ঘ সময় বটে। যে কোনো মানুষ বা জাতির জীবনে নব্বই দিনে অনেক কিছু ঘটে যেতে পারে। যারা 'উন্নত' নামের আধুনিক দেশে বসবাস করেন তারা জানেন, এসব দেশে একটি বাড়তি ছুটি পাওয়া কত কষ্টের, কতটা শ্রমসাধ্য। মানুষ এখানে ছুটছে। তার ব্যক্তিজীবনের আনন্দ, ভালোলাগা বা কল্যাণের প্রায় সবটাই কষ্টার্জিত। একটা দিনও কামাই বা ফাঁকি চলে না।

বাংলাদেশের শ্রমজীবী কৃষিজীবী সাধারণ মানুষ যখন সেভাবে নিজেদের শ্রমে, মেধায় দেশকে উন্নত করতে স্বপ্ন দেখছেন, নিজেরা ভালো থাকতে চাচ্ছেন, তখন এই নব্বই বা ততোধিক দিনে কী ঘটানো হল? কীভাবে আমাদের সাধারণ মানুষ পুড়ে কয়লা হল, কতগুলো যানবাহন ছাই হল আর কত মানুষ চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেল সেটা কারও অজানা নয়। এর একটা যৌক্তিক ব্যাখ্যা দেবারও কি কোনো প্রয়োজন নেই? মনে হতে পারে যে, আমি সরকারি দলের হয়ে কথা বলছি। মোটেই তা নয়। এই বাড়ি ফেরা বা খালেদা জিয়ার ফিরোজায় প্রত্যাবর্তনের পেছনে সরকারি দলের আর্শীবাদ বা সরকারের আপোষের দিকটা একেবারে প্রকাশ্য।

আমরা খুব অবাক হয়ে দেখেছি, যে দরজা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর জন্য বন্ধ থাকে, তাঁকে দেখেও যে তালা খোলে না, সে তালা ড. কামাল বা মান্নার জন্য খুলে যেতে। যে পুলিশ খোকাকে গ্রেপ্তার করতে পারে না, যে খোকা বিদেশে কেমো নিয়ে ফোনালাপে উস্কানি দেন, তার অপর প্রান্তের টার্গেট এক রাতেই ধরা পড়েন।

খুনের রঙে বাংলার আকাশ লাল করে দিয়ে খালেদা জিয়ার ফিরোজায় ফেরা আপোসের এই নাটক কাউকে ছেড়ে কথা বলবে না। নতুনভাবে আমাদের শেখানো হল, মানুষ মারার নব নব সব প্রক্রিয়া। পেট্রোল বোমা ছুঁড়ে হত্যার কথা কেউ জানত না। অবরোধের নামে শিশুদের লেখাপড়া, চাকরি, ব্যবসা, কৃষি, শিল্প ধ্বংসের এমন লীলা আগে দেখা যায়নি। খালেদা জিয়া কেন অ্যাদ্দিন এসব করালেন বা এর পেছনে উস্কানি দিলেন সে প্রশ্নও করছে না কেউ।

মিডিয়ার ভূমিকায় হতবাক হলাম। কেউ কেউ তাঁর এই প্রত্যাবর্তনের পর সহানুভূতি জাগানোর জন্যে তিনি ফিরে গিয়ে কোন গাছের দিকে চেয়েছিলেন, কোন বারান্দায় তাঁকে ভাবাবেগে আপ্লুত দেখা গেছে, এসবও লিখেছে। দেশ ও জনগণের এমন দুর্ভোগ আর এত জীবননাশের পরও যারা সরাসরি সত্য জানাতে ভয় পায়, তাদের কি আসলেই কোনো নৈতিক অধিকার আছে মিডিয়া চালানোর? তারা যদি খালেদা জিয়াকে সমর্থন করতে চায়, তবে সরকারকে কেন পাকড়াও করে না? কেন তাদের কাছে জানতে চায় না যে, প্রতিকার, প্রতিবিধান আর শাস্তির পরিবর্তে পুরানা পল্টনের বিএনপি কার্যালয় ঝাড়পোছ করার হেতু কী? কেন পুলিশ গুলশান কার্যালয় থেকে বেরুনোর সময় তাঁকে আটকাল না বা বাধা দিল না? কেন এক ঘণ্টার রাস্তায় পরোয়ানা আটকে থাকল দিনের পর দিন?

যারা আমাদের 'বোকা', 'শিশু' বা 'পাগল' মনে করেন তারাই এদেশের রাজনীতিবিদ। তারা অবশ্য এগুলো বলেনও। তারপরও আমরা নির্বোধ অথবা সুবিধাবাদের দাস বলে এদের পেছনে দৌড়াই। যে কোনো সভ্য দেশ বা সমাজে কোনো রাজনীতিবিদ ইচ্ছে হলে আপিসে বা বাসায় থাকতে পারবেন বা লুকিয়ে থাকবেন এমনটা চলে না। অং সান সুচি বা আরও অনেকেই সরকারের রোষে অনেক কিছু হারিয়েছেন, কিন্তু তাদের থাকা না থাকা নিয়ে এত নাটক বা কুয়াশা ছিল না।

সরল অংকের মতো সমীকরণ। আমি তখনই আদালতে যাব যখন জানব আমি জামিন পাচ্ছি। আমি তখনই দপ্তর ছাড়ব যখন আমি গ্রেপ্তার হব না। আমি তখন মানুষ মারার আদেশ দেব না যখন আমার হিসাব-নিকাশ মেনে নেওয়া হবে। এই হল রাজনীতি।

খালেদা জিয়া এখন নিছক একটা পার্টির কাণ্ডারি। সে রকম কাণ্ডারি আরও আছেন দেশে। কিন্তু তিনি প্রমাণ করলেন, সরকারের যত মাথাব্যথা তাঁকে নিয়ে। যে জামায়াত সরকার বা প্রগতির বড় দুশমন, তাকে নিয়েও এত কাণ্ড হয় না। টপাটপ ফাঁসি আর শাস্তির আইনে ধরা পড়া জামায়াত নেতাদের জন্য এখন আর তেমন বোমাও ফাটে না। নেই আগের মতো হুঙ্কার। বড় বড় ধর্মীয় নেতাদের কাত করে দেওয়া সরকারি দল খালেদা জিয়ার কাছে কেমন যেন মিনমিনে। এর ভিত্তি যদি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমর্থন আর বখে যাওয়া সুশীল মেধা হয়, তবু সরকার বা প্রশাসন কি সেটি ঠিকভাবে সামলাতে পেরেছে?

এ যাবত যা কিছু হয়েছে সবটাই গোলমেলে আর চোরাগোপ্তা। যারা বিষয়গুলো দুএকটা সভা সমাবেশ করা না করার কারণে ঘটেছে বলে মনে করছেন আমি তাদের সঙ্গে একমত নই। আপিসে আসার পর থেকে গত তিন মাসে বিএনপি একটা সমাবেশও করতে পারেনি ঠিকভাবে। দেশের কোথাও কোনো আন্দোলনও দানা বাঁধেনি। যা কিছু ঘটেছে সব পর্দার অন্তরালে। ফলে আসল চাল কাদের হাতে তা আমরা কেউ ঠিক জানি না। শুধু বুঝি, দূতেরা দেখা করার পর থেকে সুর পাল্টে যাওয়ার শুরু।

নানা ঝামেলা আর চক্রান্তে খালেদা জিয়া এবার যে ভুল করলেন সেটা বিএনপির কোমর ভেঙে দেবার জন্য যথেষ্ট। ভারপ্রাপ্ত সচিব ভারমুক্ত প্রবীণ মওদুদদের বাদ দিয়ে এমাজউদ্দীনীয় ঘরানায় তাঁকে আরও বড় মাশুল দিতে হবে। ঠিক এরশাদের মতো। কেউ একজন বলেছিলেন, 'বাঘে ছুঁলে বারো ঘা আর আওয়ামী লীগ ছুঁলে আঠারো ঘা'। এই মামলা আবারও প্রাণ ফিরে পাবে। আবার নির্বাচনের আগে এই মামলায় তাঁকে ঘায়েল করা সম্ভব হবে।

তবে খালেদা জিয়াও জেনে গেছেন, তাঁর ক্যারিশমা শেষ। যে কোনো মাধ্যমে ক্যারিশমা, জেল্লা বা অবস্থান হারানো মানুষ এক সময় পেছনে, অবসরে বা দূরে চলে যায়। আমাদের রাজনীতি সে কালচার শেখায়নি বলে কেউ জায়গা ছাড়তে চায় না। হয় মৃত্যু অথবা ঠেলে না নামানো পর্যন্ত তারা থাকতে হয়। অথচ আমার মতে, ক্যারিশমা হারানো বেগম জিয়ার উচিত সরে দাঁড়ানো। একটি গল্প মনে পড়ছে। এক টিভি উপস্থাপক কিছুতেই তার অনুষ্ঠানের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে পারছিলেন না। কে একজন বুদ্ধি দিল, 'এক কাজ কর, শুরুতে একটা ভূমিকম্পের সিন লাগিয়ে দাও; আর কিছু কাঁপুক বা না কাঁপুক পর্দা তো কাঁপবে'। কেঁপেছিল বটে! তবে শেষবারের মতো। বিএনপি কি এই অবরোধ আর গ্রেপ্তার নাটকে তাদের শেষ খেলাটা খেলে ফেলল?

আমাদের যৌবনে আমরা অনেক বই পড়তাম। জানবার আর কোনো মাধ্যম ছিল না তখন। সেই সময়কালে জন রিডের 'দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন' নামে একটা বই পড়ে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতাম। বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়ার উচিত 'বাংলাদেশ জ্বালোনো নব্বই দিন' নামের একটা কিছু লেখা। যা পড়ে আগামী দিনের নাগরিকরা জানবে কীভাবে নেতা বাড়ি থেকে পালিয়ে আপিসে আসেন; আপিসে এসে মানুষ জ্বালানো পোড়ানোর নিস্ফল আন্দোলনের পর আবার জামিন নাটকে মুচলেকা দিয়ে সুড়সুড় করে ফিরোজায় ফিরে যেতে পারেন!

ফিরোজার লাল রং যদি বিএনপির জন্য বিপ্লবের রংও হয় ভবিষ্যত ছেড়ে কথা বলবে না। নাট্যকার ব্রেখটের একটা অসাধারণ কবিতা আছে, যেখানে বলা হচ্ছে:

"জেনারেল, তোমার বোমারু বিমানটা জব্বর, নিমিষে সব তছনছ করে দিতে পারে; কিন্তু তার একটাই গলদ, তাকে চালাতে লাগে মানুষ। জেনারেল, তোমার সাবমেরিনটাও জব্বর, মুহূর্তে সব লণ্ডভণ্ড করে দিতে পারে। তবে তার একটাই গলদ, তাকে চালাতে লাগে মানুষ। জেনারেল, তোমার রাইফেলটাও জব্বর, সে নিমিষেই জান নিতে পারে। তবে তারও একটাই গলদ, তাকেও চালাতে লাগে মানুষ। আর মানুষের একটাই গলদ, সে ভাবতে জানে তার আছে মগজ।"

আমাদের সরকারি দল, বিএনপি সবাই এ কথা ভুলে বসে আছে। বাংলার আকাশে ফিরোজা কখন যে লাল হয়ে আসে তা কেউ জানে না।

সিডনি; ৭ এপ্রিল, ২০১৫