আমার তাহের

এম সানজীব হোসেন
Published : 22 April 2011, 03:47 PM
Updated : 22 April 2011, 03:47 PM

আমি তখন অনেক ছোট। সম্ভবত ক্লাস ওয়ান বা টুতে পড়ি। আমি তখন আমার বাবা মা'র সাথে থাকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানকার পারডু বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বাবা সেই সময় বন্যা-সহনশীল ধান নিয়ে গবেষণা করছিলেন। একদিন একটি দাওয়াত থেকে বের হতে হতে দাওয়াতে উপস্থিত একজন ভারতীয় ভদ্রলোক আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, 'তুমি তোমার তাহের চাচার কথা জানো? জানো তিনি কত বড় মাপের মানুষ ছিলেন?' আমার বয়শ তখন পাঁচ কি ছয় বছর। তাহের চাচার কথা বাসায় শুনেছিলাম। কিন্তু ছাব্বিশ বছর বয়সে এসে যা জানতে পেরেছি তা তো তখন জানার প্রশ্নই আসে না। আমি তাকে হা-না কিছুই বলতে পারি নি। তবে মূলত সেই দিন থেকেই কর্নেল আবু তাহের (বীর উত্তম)-এর প্রতি আমার আগ্রহ জন্মাতে শুরু করে। আমি আমার বাবাকে মুক্তিযুদ্ধ এবং তাহের নিয়ে শত ধরণের প্রশ্ন করতে থাকি। আমার মনে আছে বাবাকে করা অনেক প্রশ্নই ছিল বেশ অদ্ভুত ধরণের। বিদেশী স্কুলে তখন আমি 'রেড ইন্ডিয়ান'দের গল্প নতুন নতুন শিখছি। তাই স্বাভাবিকভাবেই বাবাকে প্রশ্ন করি, 'আচ্ছা, তোমরা কি মুক্তিযুদ্ধের সময় তীর ধনুক ব্যবহার করতে?' আরও কত কী জিজ্ঞেস করতাম। মনে পড়ে আরেকবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'তোমরা কি যুদ্ধের সময় স্পীড-বোট ব্যবহার করতে?'। চলতে থাকে আমার এবং আমার বাবার মুক্তিযুদ্ধ ও একই সাথে তাহেরকে চেনার গল্প। ১৯৭১ সালের ১৪ই নভেম্বরে পাকিস্তানিদের শেলের আঘাতে পা হারানোর কিছুক্ষণ পরেই যখন আমার বাবা তাহেরের মুখে ফ্লাস্কে রাখা চা ঢেলে দিতে যাচ্ছিলেন, তাহের তখন কাপটি নিজ হাতে তুলে নেন এবং বাবাকে বলেন, 'আমার হাত তো ঠিক আছে'। বলার অপেক্ষা রাখে না, এমন গল্প শুনলে যে কারোরই আগ্রহ প্রবলভাবে বাড়ারই কথা। আমিও এর ব্যতিক্রম ছিলাম না। ঠিক এভাবেই একদিন আমি জানতে পারি ১৯৭৬ সালে কীভাবে নির্দোষ কর্নেল তাহেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। একজন 'অপূর্ব' মানুষকে নিজ চোখে দেখার সুযোগ থেকে আমি বঞ্চিত হই এবং '৭৬ পরবর্তী বাংলাদেশ বঞ্চিত হয় একজন প্রতিভাবান দেশপ্রেমিক-রাজনীতিবিদ থেকে।

১৯৯৪ সালে আমরা বাংলাদেশে ফিরে আসি। আমার মনে আছে প্রতি বছর ২১শে জুলাই ও ৭ই নভেম্বর আমরা পুরো তাহের পরিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি'র অডিটোরিয়ামে যেতাম কর্নেল তাহের সংসদের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার জন্য। প্রায় প্রতি বছর এই দুটি দিনে আমি তাহেরের উপর আমার বাবা, প্রয়াত মেঝ চাঁচা আবু ইউসুফ খান (বীর বিক্রম)সহ বিভিন্ন মানুষের লেখা পত্রিকায় পড়তাম। আর সেই সুযোগে আমার জানা হয়ে যেত মুক্তিযুদ্ধে তাহেরের অবিস্মরণীয় অবদান, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তাঁর মৌলিক এবং সাধারণ সেনা অফিসার থেকে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি, স্বাধীনতা পরবর্তী নতুন বাংলাদেশে অর্থনীতির উপর বোঝা নয় এমন এক সেনাবাহিনী বাস্তবায়নের প্রস্তাবনা, ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষার মরিয়া চেষ্টা এবং ঠিক তার পরের বছর ১৯৭৬ সালের জুলাই মাসের ২১ তারিখে তাহেরের বীরোচিত ফাঁসির কথা। ফাঁসির ঠিক আগ মুহূর্তে কেউই যখন তা কার্যকর করতে এগিয়ে আসছিল না, তাহের বিদ্রূপ করে বলেছিলেন, 'তোমাদের এই সাহসটুকুও নেই?'। আমার পড়া হয়ে যায় মেজর আনোয়ার হোসেনের লেখা 'হেল কমান্ডো'। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অভিজাত প্যারা-কমান্ডো গ্রুপ 'স্পেশাল সার্ভিসেস গ্রুপ (এস.এস. জি.)' এর সিনিয়র অফিসার তাহের নতুন আগত মেজর আনোয়ারকে বলেন, বাংলাদেশকে স্বাধীন করার কথা। তাহের এই কথাটি উচ্চারণ করেছিলেন সেই ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় যখন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরাও স্বাধীনতার কথা মুখে আনতেন না। আমি যখন আরেকটু বড় হই তখন নতুন করে লরেন্স লিফশুলজের 'বাংলাদেশঃ দি আনফিনিশড রেভোলিউশান' বইটি পড়ি। এই বইটির ইংরেজি কপি তখন বাংলাদেশে খুবই অল্প সংখ্যক লোকের কাছেই ছিল। তাহেরের কথা যাতে বাংলাদেশের মানুষ না জানতে পারে সেই লক্ষে জেনারেল জিয়া বইটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। লিফশুলজের বইয়ে তাহেরের ঐতিহাসিক জবানবন্দী আমি একদিন পড়ে ফেলি। আমি জানতে পারি পরবর্তীতে এই এস.এস.জি.'ই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে গ্রেফতার করে। তাহের তখন সেই সুদূর পাকিস্তানে কোয়েটার স্কুল অফ ইনফ্যান্ট্রি অ্যান্ড ট্যাকটিক্সের প্রশিক্ষণে অংশ নিচ্ছিলেন। পরে বাবার কাছে শুনেছি তার কিছুদিন আগেই এক পাকিস্তানি সেনা অফিসার বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করলে তাহের তার কলার চেপে ধরে হত্যা করার হুমকি দেন এবং বক্তব্য প্রত্যাহার করতে বাধ্য করেন। তাই তাহেরের উপর তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃপক্ষের চরম নজরদারি নেমে আসে। তাহেরের জবানবন্দী থেকেই আমি পরিষ্কার ধারণা পাই পাকিস্তানিরা বাঙালিদের কি চোখে দেখত। সেখান থেকেই উদ্ধৃতি দিচ্ছি। তাহের বলেন, 'আমার এখনও মনে পড়ে পাকিস্তানিরা আমাদের কী পরিমাণ ঘৃণা করতো। তাদের অবজ্ঞা ও উপহাস ছিল অসহ্য। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে আমাদের শেখানো হতো বাঙালিরা হচ্ছে বিশ্বাসঘাতকের জাতি। তাদের জন্ম হয়েছে গোলামী করার জন্য। বাঙালিদের পাক্কা মুসলমান ও দেশপ্রেমিক বানানো পাকিস্তানিদের পবিত্র দায়িত্ব'।

আমার মনে আছে, প্রতি বছর ২১শে জুলাই তাহের হত্যার বিচার চেয়ে হাইকোর্টের সামনে আমরা হাতে হাত ধরে দাঁড়াতাম মানববন্ধনে। সেখানে উপস্থিত মিডিয়া কর্মীরা সবসময় আমার ছোট বোন দামিনী, বিনীতা ও দীপান্বিতার প্ল্যাকার্ড হাতে ছবি পত্রিকায় ছাপাত, এই আশায় যে ছোট শিশুর আকুতিতে যদি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বোধোদয় হয় যে ১৯৭৬ সালের এই দিনে তাহেরের প্রতি চরম অবিচার করা হয়েছিল। আমরা যখন ফজলুল হক হলের টিচার্স কোয়ার্টারে থাকি, জাসদ-ছাত্রলীগের মিছিল প্রায়ই আমাদের বাসার সামনে দিয়েই যেত। তাদের প্রধান দুটি স্লোগান ছিল, 'ছিয়াত্তরের ক্ষুদিরাম, তাহের তোমায় লাল সালাম', ও 'যে তাহের জনতার সে তাহের মরে নাই'। ফজলুল হক হলের ছোট ছোট চুপচাপ ওলিগলি দিয়ে বয়ে যাওয়া মিছিল আমাকে দারুনভাবে নাড়া দিত। বেশ মজাও লাগত যখন ছাত্ররা আমাদের বাসার ঠিক সামনে আসতেই স্লোগানের তীব্রতা বাড়িয়ে দিত। তাহেরের ভাই যে এই কোয়ার্টারে থাকেন এটি তাদের অজানা ছিল না। ঠিক যেন তারা আমাদের জানান দিচ্ছিল, 'তাহেরের অনুসারীরা এখনো মরে যাইনি, তাহের হত্যার বিচার একদিন হবেই, তাহেরের স্বপ্ন একদিন বাস্তবায়িত হবেই'। আমার নিজেকে তখন শক্তিশালী মনে হতো, মনের ভেতর সঞ্চারিত হতো তখন অনেক সাহস। নিজেকে বলতাম সত্যের জয়কে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। জিয়া যে তাহেরকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করেছিলেন সেই সত্য বাংলাদেশের মানুষের কাছে একদিন প্রকাশিত হবেই। পরবর্তীতে তাহেরের জবানবন্দী আমি অসংখ্যবার পড়েছি। জবানবন্দী প্রদানের শেষ প্রান্তে এসে তাহের বলেন, 'আমি একজন অনুগত নাগরিক নই বলে অভিযোগ করা হয়েছে। একজন মানুষ যে তার রক্ত ঝরিয়েছে, নিজের দেহের একটা অঙ্গ পর্যন্ত হারিয়েছে মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য তার কাছ থেকে আর কী আনুগত্য তোমরা চাও? আর কোনভাবে এদেশের প্রতি আমার আনুগত্য প্রকাশ করবো? আমাদের সীমান্তকে মুক্ত রাখতে, সশস্ত্র বাহিনীর স্থান আর জাতীয় মর্যাদা সমুন্নত রাখবার ইচ্ছায় ঐতিহাসিক সিপাহি অভ্যুত্থান পরিচালনা করতে যে পঙ্গু লোকটি নিজের জীবনকে বিপন্ন করেছিল তার কাছ থেকে আর কী বিশেষ আনুগত্য তোমাদের পাওনা?'। এই কথাগুলো পড়লে প্রতিবারই আমার চোখে পানি চলে আসত।

শুধুমাত্র তাহের পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে নয়, একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবেও আমি অনুভব করতে থাকি তাহের হত্যার বিচারের প্রয়োজনীয়তার কথা। আমার মাথায় বুদ্ধি আসে যে নিজে আইন পড়ে তাহের হত্যার বিচার করবো। একদিন আমাদের বাসায় বেড়াতে আসেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ পাবলিক হেলথ-এর শিক্ষক এবং পরবর্তীতে 'ক্র্যাচের কর্নেল' উপন্যাসটির লেখক ড. শাহাদুজ্জামান। বাসায় তাহের চাচার ছেলে মিশুও উপস্থিত ছিল। আমার 'ল পড়বার ইচ্ছার কথা শুনে তারা আমাকে ড.শাহদীন মালিকের কথা বলেন। সেভাবেই আমি এবং আমার বাবা ২০০৫ সালের একটি দিনে উপস্থিত হই ড.শাহদীন মালিকের সেগুনবাগিচার চেম্বারে। আমার স্পষ্ট মনে পড়ে বাবা ড.মালিককে সেদিন বলেছিলেন, 'আমার ছেলের কিছু লফটি আইডিয়াস আছে। ও 'ল পড়তে চায় ওর চাচার হত্যার বিচার করার জন্য'। শুধুমাত্র শাহদীন স্যারের কারনেই ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ 'ল তে আমি ভর্তি হই। 'ল স্কুলে স্যার আমাদের প্রথম প্রবন্ধের বিষয় দিয়েছিলেন, 'হোয়েয়ার আই ওয়ান্ট টু বি ইন দি নেক্সট ফিফটিন ইয়ারস'। সেখানেও আমি উল্লেখ করি তাহের হত্যার বিচার প্রক্রিয়ায় আমার অবদান রাখার ইচ্ছার কথা। বেশ কিছু বই পড়ে আমি তাহেরের পক্ষে আইনি যুক্তিও সেই প্রবন্ধে উপস্থাপন করি। প্রবন্ধে শাহদীন স্যার আমাকে 'এ' গ্রেড দিয়েছিলেন। এতে আমার অনুপ্রেরণা আরও বহুগুণ বেড়ে যায়। আজকে যখন ২০০৫ সালের ঐসব দিনের কথা মনে করি আমার মনে একফোঁটাও দ্বিধা হয় না এই ভেবে যে কেন সরাসরি ব্র্যাকে এসেছিলাম 'ল পড়তে। ব্র্যাকে না এলে শাহদীন স্যারসহ আরও বহু গুণীজন ও বন্ধুর সংস্পর্শে আমার আসা হতো না। হয়তো ২০১০ সালে এসে স্যারের সাথে '৭৬ সালে তাহেরের বিচার প্রক্রিয়া চ্যালেঞ্জ করা রিট লেখার সুবর্ণ সুযোগও পেতাম না।

'ল পড়ার সময়েই আমি 'অধিকার' এবং 'হিউম্যান রাইটস ওয়াচ'-এ কাজ করার সুযোগ পাই। সেখানে কাজ করতে গিয়েই আমার সামনে উন্মোচিত হয় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের এক অতি ভয়ানক রূপ। প্রধানত র‍্যাবের মাধ্যমে রাষ্ট্র কী করে একের পর এক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে যাচ্ছিল– তা এই দুটি সংস্থায় কাজ করার সময় আমার জানা হয়ে যায়। ক্রসফায়ারের একেকটি অনুসন্ধানী রিপোর্ট পড়ে আমার শুধু একটি কথাই মনে হতো: তাহেরও তো এমনই বিচারবহির্ভূত ঘটনার শিকার হয়েছিলেন। তাঁকে হয়ত গুলি করে মেরে ফেলা হয়নি, তবে যেই বিচার ১৯৭৬ সালে করা হয়েছিল তা কি প্রকৃত বিচার ছিল? মোটেই তা ছিল না। ১৯৭৬ সালের জুন-জুলাই মাসে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে স্পেশাল মার্শাল 'ল ট্রাইব্যুনালের প্রক্রিয়া ছিল সম্পূর্ণভাবে সাজানো একটি নাটক, যাকে আমরা বলি বিচারের নামে প্রহসন।

২০১০ সালে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট বাংলাদেশের অন্যতম কালো আইন বলে পরিচিত পঞ্চম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে। তখন অনেকটা হঠাৎ করেই আমাদের সামনে হাই কোর্টের দুয়ার খুলে যায় তাহের হত্যার বিচার চাওয়ার জন্য। গত ৩৪ বছর ধরে এই পঞ্চম সংশোধনীই ছিল আমাদের আদালতের কাছে বিচার চাওয়ার ক্ষেত্রে একমাত্র বাঁধা। অনেকেই হয়তো এই বিষয়ে অবগত নন যে জেনারেল জিয়াউর রহমান পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমেই ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ই এপ্রিল পর্যন্ত তখনকার মার্শাল 'ল অথরিটি দ্বারা জারিকৃত সকল ফরমান, আদেশ, নির্দেশ, বিধি ইত্যাদিকে বৈধতা প্রদান করেন। একই সাথে সেই সংশোধনীতে এও বলা হয় যে কোন কোর্ট, ট্রাইব্যুনাল বা অথরিটির কাছে ওগুলোর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। এখানে উল্লেখ্য, কর্নেল তাহেরকে বিচার করার জন্য ১৯৭৬ সালের ১৪ই জুন একটি মার্শাল 'ল রেগুলেশান, যার নাম ছিল মার্শাল 'ল রেগুলেশান নং ১৬, জারি করা হয়। এই রেগুলেশানটির মাধ্যমেই সেই কুখ্যাত স্পেশাল মার্শাল 'ল ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয় যেটি তাহেরকে ১৯৭৬ সালের ১৭ই জুলাই ফাঁসির রায় দেয়। ফলে গত ৩৪ বছর ধরে তাহেরের পরিবার এবং অনুসারীগণ পঞ্চম সংশোধনীর কারনে মার্শাল 'ল রেগুলেশান নং ১৬'র এবং সেই রেগুলেশানের অধীনে তাহেরের বিচার প্রক্রিয়ার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করতে পারেনি। তাই গত বছর পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হয়ে গেলে আমাদের বহু বছরের প্রতীক্ষার সমাপ্তি ঘটে। প্রথমেই এগিয়ে আসেন আমার বাবা। মহামান্য হাই কোর্টের কাছে কর্নেল তাহেরের বিচার প্রক্রিয়ার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একটি রিট পিটিশান পেশ করার ভাবনা তিনি আমার সাথে আলোচনা করেন। আমরা বুঝতে পারছিলাম যে এমন একটি ব্যবস্থা গ্রহণের উপযুক্ত সময় এখনই। ঠিক সেই ২০০৫ সালের মত আবারো আমি এবং বাবা রওনা দিলাম শাহদীন স্যারের চেম্বারে। এবার তাঁর কাছে তুলে ধরলাম আমাদের এই চিন্তার কথাটি। ঠিক হল রিট পিটিশানে বাদী আমার বাবা, তাহের চাচার স্ত্রী লুৎফা তাহের এবং আমার প্রয়াত মেঝো চাচার স্ত্রী ফাতেমা ইউসুফ হবেন। বাবা শাহদীন স্যারকে বাদীপক্ষের আইনজীবী হওয়ার অনুরোধ করলে স্যারও সানন্দে রাজি হয়ে যান। আরও সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে মামলার জন্য যাবতীয় আইনি গবেষণার কাজের বেলায় আমি স্যারকে সাহায্য করব। সেদিন আমরা খুবি স্ট্র্যাটেজিক একটি সিদ্ধান্ত গ্রহন করি। ঠিক হয় যে মামলায় আমরা কোন প্রকার রাজনৈতিক তথ্য উপস্থাপন করব না। এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাবার পেছনে একটি বিশ্বাস আমাদের মনের মধ্যে কাজ করছিলো। বিশ্বাসটি ছিল এই যে আদালত হচ্ছে আইনি বিরোধ নিষ্পত্তির জায়গা। এটি রাজনৈতিক বিরোধ নিষ্পত্তির জায়গা নয়। রাজনৈতিক বিতর্কের অবসান হওয়া উচিত রাজনৈতিক যুক্তিতর্ক ও আলোচনার মাধ্যমে যা প্রতিদিনই ঘটছে পত্রিকার কলামে, রাস্তার মিছিলে বা জনসভায়। কোর্টের কাছে আমরা তাহেরের রাজনীতি ও তা নিয়ে দৈনন্দিন বিতর্কের অবসান চাচ্ছিলাম না, বরং আমরা চাচ্ছিলাম তার বিচারের বৈধতা নিয়ে বিতর্কের অবসান।

বলতে গেলে তখন থেকেই শুরু হয় স্যারের সাথে আমার রিট পিটিশান তৈরির দিন রাত প্রচেষ্টা। স্যারের সাথে এই রিট পিটিশান লেখার সুবাদে দুই মাস আমি তাঁর একদম কাছ থেকে কাজ করার সুযোগ পাই। প্রায় প্রতিদিন গবেষণা শেষে স্যার আমাকে বসতে দিতেন তাঁর ঐতিহাসিক রিভলভিং চেয়ারে। আমাদের গবেষণা থেকে প্রাপ্ত নতুন নতুন তথ্য স্যার ডিক্টেশান আকারে বলে যেতেন এবং আমি তাঁর রিভলভিং চেয়ারে বসে কম্পিউটারে তা টাইপ করতাম। এ ছিল এক অন্যরকম অনুভূতি! তবে আমার এই অনুভূতি খুব অল্পসংখ্যক মানুষের সাথে শেয়ার করতে পেরেছিলাম কারণ রিটের প্রস্তুতির কথা আমরা কাউকেই জানাই নি। এমনকি আমাদের পরিবারের অধিকাংশ সদস্যরাও এই বিষয়ে কিছুই জানতেন না। ইচ্ছা করেই আমরা জানাই নি। আমাদের কোন ধারণা ছিলো না এই রিট পিটিশান দায়ের করলে কী হবে বা কত দিন পর আমরা রায় পাব। তাই ৩৪ বছর ধরে অপেক্ষা করা একটি পরিবারের মনে আমরা এমন কোন আশা জাগাতে চাচ্ছিলাম না যেই গল্পের শেষ আমাদের সেই মুহূর্তে অজানা ছিল। গোপনীয়তা রক্ষার আরেকটি বড় কারণ ছিল যে এই মামলার প্রস্তুতি সম্পর্কে স্বাধীনতাবিরোধী যেকোনো পক্ষ আগাম আভাস পেলে আমাদের প্রচেষ্টা ভেস্তে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল।

বাকি ইতিহাসটা তো মোটামুটি আপনাদের জানাই আছে। গত বছর আগস্ট মাসের ২৩ তারিখে আমরা মহামান্য বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও বিচারপতি মো. জাকির হোসেনের বেঞ্চে আমাদের দুই মাসের চেষ্টার ফল, সেই রিট পিটিশানটি দায়ের করি। সেদিনই রুল ইস্যু হয় এই মর্মে যে কেন মার্শাল 'ল রেগুলেশান নং ১৬ ও একই সাথে সেই রেগুলেশানের অধীনে তাহেরের বিচারকে অবৈধ এবং অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না। এটি ছিল আমাদের জন্য একটি বিরাট সাফল্য কারন আদৌ রুল ইস্যু হবে কিনা তা নিয়েই আমরা পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলাম না। আমাদের শুধুমাত্র একটিই ভয় ছিল যে না জানি কখন কোথা থেকে কোন হস্তক্ষেপ এসে পরে। রুল ইস্যু হওয়ার পর স্যার আমাকে মজা করে বলেন, 'সানজীব, আপনি যেই কারণে 'ল পড়তে এসেছিলেন তা তো আজকে মোটামুটি সার্থক হয়ে গেল। আপনি বরং তাহলে এখন অন্য কোন বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন'। এখানে বলে রাখা দরকার শাহদীন স্যার তাঁর ছাত্রছাত্রীদেরকে 'আপনি' বলে সম্বোধন করেন। এরপর চলতে থাকে আমাদের মামলার শুনানি। গত মার্চ মাসের ২২ তারিখে তাহের পরিবার এবং স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশের সকল মানুষ তাদের বহুল প্রতীক্ষিত রায় পান। মহামান্য বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী কর্নেল তাহেরের বিচারকে অবৈধ ঘোষণা করেন। তিনি বলেন যে ১৯৭৬ সালের স্পেশাল মার্শাল 'ল ট্রাইব্যুনাল বা বিশেষ সামরিক আদালতের বিচার ছিল লোক দেখানো প্রহসন এবং কর্নেল তাহেরের ফাঁসি ছিল ঠাণ্ডা মাথায় একটি পরিকল্পিত হত্যা। রায়ে এও বলা হয় যে কর্নেল তাহেরের হত্যাকাণ্ডের প্রধান পরিকল্পনাকারী ছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান।

কেন তাহেরের বিচারটি অবৈধ ঘোষণা করা হল? এটিকে বিচারের নামে প্রহসন আখ্যায়িত করা হল কেন? কী ছিল আইনি যুক্তিগুলো? সেগুলোই এখন সহজ ভাষায় তুলে ধরার চেষ্টা করব।

১) প্রথমেই বলি তাহেরের বিরুদ্ধে কী অভিযোগ আনা হয়েছিল। ১৯৭৬ সালের জুন মাসের ৪ তারিখে ঢাকার মোহাম্মদপুর থানার এফআইআর নং ৮-এ কর্নেল তাহেরের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ১২১-এ'র অধীনে অপরাধ করার অভিযোগ আনা হয়, যার মানে এই দাড়ায় যে রাষ্ট্রপক্ষের চেষ্টা ছিল প্রমাণ করা যে তাহের তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-প্রচেষ্টার ষড়যন্ত্র করেছিলেন। দণ্ডবিধির ১২১-এ ধারার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে যে এর সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, মৃত্যুদণ্ড নয়। অনেকেই বলেন যে যেহেতু তাহের সেনা কর্মকর্তা তাঁকে আর্মি এ্যাক্ট ১৯৫২'র অধীনে বিচার করে ফাঁসিও দেয়া যেত। এই ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। কর্নেল তাহের ১৯৭২ সালের ২২শে সেপ্টেম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে এক ঐতিহাসিক পদত্যাগপত্র পেশ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহন করেন। ফলে তাহেরের বিরুদ্ধে ১৯৭৬ সালে আর্মি এ্যাক্ট ১৯৫২ অথবা অন্য কোন সেনা আইনের অধীনে বিচার করা সম্ভব ছিল না কারণ তার প্রায় ৪ বছর আগেই তাহের সেনাবাহিনী ত্যাগ করেছিলেন। সেনা আইন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণে তাহেরের মামলায় প্রযোজ্য ছিল না। তাহেরকে বিচার করার জন্য গঠিত স্পেশাল মার্শাল 'ল ট্রাইব্যুনালের দুইজন সদস্য ছিলেন সিভিলিয়ান ম্যাজিস্ট্রেট। তারা সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন না এবং তাই তাদের পক্ষে কোন সেনা 'প্রসিডিং'-এ অংশগ্রহণ করার যোগ্যতা বা ক্ষমতা ছিল না। ফলে যারা ভেবেছিলেন যে তাহেরের মামলা সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৫ দ্বারা প্রটেক্টেড এবং এটি একটি 'মিলিটারি প্রসিডিং' তারা ভুল ভেবেছিলেন। আজকে যারা তাহেরের বিরুদ্ধে সেনা অফিসার হত্যার অভিযোগ আনেন তারা ভুলে যান যে সেনা অফিসার হত্যার অভিযোগ সেই ১৯৭৬ সালেও তাহেরের বিরুদ্ধে আনা হয়নি। অথচ তখনকার সরকার ছিল অনেক বেশি আগ্রাসী ও হিংস্র। যত রকমের অভিযোগ আনা সম্ভব তাই তাহেরের বিরুদ্ধে দাড় করানোর চেষ্টা নেয়া হয়েছিল। ফলে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ও তার পরে যেই অল্পসংখ্যক সেনা অফিসার মারা গিয়েছিলেন তাদের কাউকেই যে তাহেরের নির্দেশে হত্যা করা হয়নি– এটা তখনকার ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা খুব ভালো করেই জানতেন। তাহের তার অনুগত সিপাহিদের প্রতি স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছিলেন যে কাউকে হত্যা করা যাবে না। সিপাহিরা সেই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিল। এমনকি খালেদ মোশাররফকেও কিন্তু তাহেরের সিপাহিরা হত্যা করেনি। খালেদ, হুদা এবং হায়দারকে হত্যা করে তাদেরই মত সেনা অফিসার যারা তাহেরের অধীনে ছিলেন না। হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পরপরই সেই সব অফিসার খালেদের লাশ জিয়াউর রহমানের কাছে নিয়ে আসেন, তাহেরের কাছে নয়। এই বিষয়ে প্রয়াত কর্নেল হামিদ তার বই 'তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা' তে বর্ণনা দিয়েছেন। ফলে বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ১২১এ'ই ছিল তাহেরের বিরুদ্ধে আনীত একমাত্র অভিযোগ।

২) মার্শাল 'ল রেগুলেশান নং ১৬ নানা কারণেই অসাংবিধানিক ও অবৈধ। প্রথমত আমরা যদি আমাদের সংবিধানের দিকে তাকাই তাহলেই দেখতে পাই যে সেখানে কোন ধরণের মার্শাল 'ল রেগুলেশান জারি করার বিধান নেই। ফলে সহজ ভাষায় বলতে গেলে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্জন আমাদের সংবিধানের অধীনে কোন প্রকার মার্শাল 'ল রেগুলেশান জারি করা যায় না। তাই ১৯৭৬ সালে জারি করা মার্শাল 'ল রেগুলেশান নং ১৬ ছিল সম্পূর্ণভাবে সংবিধানবহির্ভূত এবং অবৈধ এবং সেই রেগুলেশানের অধীনে তাহেরকে বিচার করার জন্য গঠিত স্পেশাল মার্শাল 'ল ট্রাইব্যুনালও ছিল সংবিধানবহির্ভূত এবং অবৈধ কারণ এমন কোন ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা আমাদের সংবিধানে নেই।

৩) ১ নম্বর পয়েন্টে উল্লেখিত এফআইআরের উপর ভিত্তি করেই পরবর্তীতে জুন মাসের ১৪ তারিখে অসাংবিধানিকভাবে জারি হয় মার্শাল 'ল রেগুলেশান নং ১৬ যার ৩(১) ধারার উপর নির্ভর করে একটি অবৈধ স্পেশাল মার্শাল 'ল ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। কর্নেল তাহেরের মামলাটি ছিল ১৯৭৬ সালের স্পেশাল মার্শাল 'ল ট্রাইব্যুনাল কেস নং ১। বলে রাখা প্রয়োজন এই মার্শাল 'ল রেগুলেশান নং ১৬ স্পেশাল মার্শাল 'ল ট্রাইব্যুনালকে বিশেষ কিছু ক্ষমতা প্রদান করে। সেগুলো ছিলঃ
– ধারা ৩(৪)'র অধীনে ট্রাইব্যুনালকে তার গঠিত হওয়ার আগে ঘটে যাওয়া অপরাধ বিচার করার ক্ষমতা দেয়া হয়।
– ধারা ৩(৪)(ক)'র অধীনে ট্রাইব্যুনালকে দণ্ডবিধির চ্যাপ্টার ৬ ও ৭-এর অধীনে সকল অপরাধ বিচার করার ক্ষমতা দেয়া হয়।
– ধারা ৪(২)'র অধীনে ট্রাইব্যুনালকে 'ইন ক্যামেরা' অর্থাৎ গোপনে বসার ক্ষমতা দেয়। ঢাকা সেনট্রাল জেলের ভেতরে একটি 'ইন ক্যামেরা' গোপন বিচার পরিচালনা করা (যেমনটি তাহেরের বেলায় হয়েছিল) পুরোপুরিভাবে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৫(৩)'র সাথে সাংঘর্ষিক।

– ধারা ৪(৮)-এ বলা হয় যে ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্ত বা রায়ের বিরুদ্ধে আপীলের কোন সুযোগ থাকবে না। এই ধারাটি সুস্পষ্টভাবে তাহেরকে ট্রাইব্যুনালের দেয়া রায়ের বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের কাছে আপীল করতে বাঁধা দেয় যা আমাদের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। আমরা সকলেই জানি যেকোনো সভ্য দেশে রায়ের বিরুদ্ধে আপীলের বিধান থাকে। আমাদের দেশেও সকল অভিযুক্ত ব্যক্তি আপীলের সুযোগ পান, যেটি তাহের পান নি।

– ধারা ৪(১০)'র অধীনে বলা হয় যে মামলায় অংশগ্রহণকারী যেকোনো ব্যক্তিকে মামলার বিষয়বস্তুর ব্যাপারে একটি 'ওথ অফ সিক্রেসি' অর্থাৎ 'গোপনীয়তা রক্ষার শপথ' নিতে হবে। কেউ এই শপথ ভঙ্গ করলে তাঁকে শাস্তিস্বরূপ তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড প্রদানের ক্ষমতা ট্রাইব্যুনালকে দেয়া হয়। এমন বিধান দেখলে মনে প্রশ্ন জাগে তাহের এমন কী বলেছিলেন বা ঐ মামলায় এমন কী ঘটেছিল যে মামলার সাথে জড়িত সকলকে গোপনীয়তা রক্ষার শপথ নিতে হয়েছিল? তাহেরের জবানবন্দীতে একটু চোখ বুলালেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। তাহের বলেন, '… আমি ট্রাইব্যুনালকে অনুরোধ করেছিলাম মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, রিয়ার. অ্যাডমিরাল এম.এইচ. খান, এয়ার ভাইস. মার্শাল এম. জি. তাওয়াব, জেনারেল এম.এ.জি. ওসমানী ও বিচারপতি এ.এস.এম. সায়েমকে সাক্ষী হিসেবে হাজির করার জন্য। তারা যদি এখানে আসতেন, ট্রাইব্যুনালের যদি ক্ষমতা থাকতো এখানে আনার তাহলে আমি নিশ্চিন্ত যে তারা এমন মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগের সামনে দাঁড়াতে সাহস পেত না। কিন্তু এই ট্রাইব্যুনাল তার দায়িত্ব পালন করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে'। সত্যিকার অর্থেই ট্রাইব্যুনাল তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছিল। জিয়া থেকে শুরু করে সায়েম পর্যন্ত কেউই ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত হয়ে তাহেরের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে সাহস পান নি।

এইসব বিধান দেখে পরিষ্কারভাবেই বোঝা যায় যে, সেই সময়কার ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা তাহেরের বিরুদ্ধে মামলাটির ব্যাপারে দেশবাসীকে কিছু না জানিয়ে, গোপনে, আপীলের কোন সুযোগ না দিয়ে তড়িঘড়ি করে সমাপ্ত করার ব্যবস্থা মার্শাল 'ল রেগুলেশান নং ১৬ জারি করার মাধ্যমে পাকাপোক্ত করেছিলেন। লিফশুলজের বইতে পড়েছি কীভাবে ইত্তেফাকের সম্পাদককে সেনা কর্তৃপক্ষ ডেকে হুমকি দিয়েছিল যখন তাহেরের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার খবরটি তার পত্রিকায় ছোট্ট করে ছাপানো হয়েছিল। স্বামীর ফাঁসি ঠেকাতে আমার চাচী লুৎফা তাহের যখন সরকারের প্রতি 'স্টে অফ একজিকিউশান'-এর আবেদন জানান, অত্যন্ত অস্বাভাবিক দ্রুত গতিতে মাত্র দুইদিনের মাথায় আবেদনকে প্রত্যাখ্যান করা হয়। রায় ঘোষণার ৭২ ঘন্টার মাথায় অবিশ্বাস্য দ্রুততার সাথে তাহেরের ফাঁসি কার্যকর করা ছিল সুস্পষ্টভাবে সংবিধানের ৩১, ৩২ ও ৩৫ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন।

৪) আগেই বলেছি দণ্ডবিধির ১২১এ ধারার অধীনে সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। তাই কার্যত ১৯৭৬ সালের ২১শে জুলাই তাহেরকে এমন একটি আইনের অধীনে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল যেখানে শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেয়াটাই অসম্ভব ছিল। কোন আইনের তোয়াক্কা না করে ১২১এ'র অধীনে ফাঁসি দেয়া ছিল আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৫(১) এর জঘন্য লঙ্ঘন।
১৯৭৬ সালের ১৭ই জুলাই যখন তাহেরের ফাঁসির রায় ঘোষণা করা হয়, সবচেয়ে অবাক হন রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুলি এ.টি.এম আফজাল (পরবর্তীতে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি)। তাঁর মতে এমন শাস্তি দেয়া ছিল অসম্ভব। মামলার রায়ের ব্যাপারে যখন তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল প্রয়াত ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমেদের মন্তব্য চাওয়া হয়, তিনি কোন প্রকার মন্তব্য করা থেকে নিজেকে বিরত রাখেন এবং অ্যাটর্নি জেনারেল পদ থেকে পদত্যাগ করেন। বাংলাদেশের কোন মানুষ এই মামলার রায় মেনে নেয় নি। এই মামলায় বহু দুঃখজনক ঘটনাগুলোর মধ্যে আরেকটি ছিল এই যে স্পেশাল মার্শাল 'ল ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ছিলেন কর্নেল ইউসুফ হায়দার (পরবর্তীতে তাহের হত্যার পেছনে অবদান রাখার জন্য জিয়াউর রহমান তাকে ব্রিগেডিয়ার পদে পদোন্নতি দেন) যিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় সক্রিয়ভাবে পাকিস্তানিদের সহযোগিতা করেছিলেন।

আশা করি কিছুটা হলেও কর্নেল (অব:) আবু তাহের (বীর উত্তম) এর বিচার প্রক্রিয়ার চরম আইনি অসঙ্গতিগুলো আপনাদের সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছি এবং মহামান্য হাইকোর্ট কেন সেই বিচারকে অবৈধ ঘোষণা করলো তা বোঝাতে পেরেছি। ১৯৭৬ সালের ঘটনাবলির দিকে ফিরে তাকালে আমার মনে হয় কী রকম অন্ধকারে ঢাকা ক্রান্তিকালের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশ পার হয়েছে। তাহেরের হত্যাকাণ্ড দিয়ে জেনারেল জিয়াউর রহমান শুরু করেছিলেন। এরপর তো ঘটে গেছে জিয়া কর্তৃক আরও শত শত সিপাহি হত্যা, যাদের অধিকাংশই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা।

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত উজ্জ্বল। আমাদের লেখা রিট পিটিশানটিতে যদিও কোন রাজনৈতিক আলোচনা ছিল না, তবুও ২০১১ সালের ২২ শে মার্চের ঐতিহাসিক রায়ের মধ্যেই কিন্তু লুকায়িত আছে রাজনৈতিক তত্ত্বের দিক থেকে একটি দারুন তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার। সেটি বলেই আজকে লেখাটি শেষ করি। তাহের ছিলেন একজন 'বিপ্লবী'। তিনি স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন একটি বিপ্লবী রাষ্ট্রের। বাংলাদেশ অবশ্য এখনো সেই শোষণহীন বিপ্লবী রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে নি। কিন্তু অবিপ্লবী হয়েও আমাদের অবিপ্লবী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অন্যতম অবিপ্লবী স্তম্ভ 'হাইকোর্ট' ৩৪ বছর পরে হলেও একজন খাঁটি বিপ্লবীর প্রতি করা চরম অবিচারের কথা স্বীকার করেছে। এখানেই প্রকাশ পায় বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের 'মহানুভবতা'। যেই দেশ এমন মহানুভবতা দেখাতে কার্পণ্য করে না, সেই দেশের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হওয়া ছাড়া আর কিই বা হতে পারে? আজ হোক কাল হোক তাহেরের চেতনার বাস্তবায়ন বাংলার বুকে হবেই। যেই দেশের জন্য তাহের নিজের জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে নেমেছিলেন সেই দেশ এতদিন তাহেরকে বলে এসেছিলো বেইমান। এমন একটি ব্যাপার কারোরই ভালো লাগার কথা নয়। তাই এই রায়ের মধ্য দিয়ে আমরা তাহেরের পরিবার অবশ্যই এক ধরণের শান্তনা খুঁজে পেয়েছি, যদিও আমাদের মনে এবং হৃদয়ে তাহের চিরকালই একজন বীর ছিলেন। আমার মতে এই আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তাহেরের পরিবার যত না পেল, তার থেকে অনেক বেশি পেয়েছে অবিপ্লবী বাংলাদেশ রাষ্ট্র। কথাটি অদ্ভুত শোনালেও ২০১১ সালের ২২শে মার্চ এমন একটি দিন যেদিন বাংলাদেশ রাষ্ট্র তার চরম মহানুভবতা প্রকাশের মাধ্যমে নিজের গায়ে লেপটে থাকা বহু বছরের পুরনো একটি কালো দাগ মুছে ফেলে। শেক্সপিয়ার হয়তো এমন ব্যাপারগুলোকেই 'আইরনি' বলতেন। আর এভাবেই শেষ হল আমাদের আইনি লড়াই।