মাদ্রাসা বন্ধই সমাধান নয়

অমি রহমান পিয়ালঅমি রহমান পিয়াল
Published : 5 April 2015, 05:44 AM
Updated : 5 April 2015, 05:44 AM

আমার বন্ধুতালিকার অনেককেই দেখলাম, সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ড বা ইসলামি চাপাতির প্রতিষেধক খুঁজে পেয়েছেন মাদ্রাসা বন্ধ করার মধ্যে। তাদের ধারণা, বাংলাদেশের মাদ্রাসাগুলো বন্ধ করে দিলে কিংবা কড়া নজরদারিতে নিলে এ দেশে জঙ্গি উৎপাদন এবং এ ধরনের সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ড বন্ধ হবে। এমন ধারণা জন্ম নেওয়ার যৌক্তিকতা আমি খুঁজে পেয়েছি ওয়াশিকুর বাবু হত্যাকাণ্ডে ধরা পড়া দুজন খুনির স্ট্যাটাস দেখে। দুজনই মাদ্রাসার ছাত্র। একজন আবার হাটহাজারীর ছেলে; খোদ শফি হুজুরের মাদ্রাসার ছাত্র।

আমি বলব, এটা 'সারফেস জাজমেন্ট'– বিষয়ের গভীরে না ঢুকে উপরিভাগ দেখে সিদ্ধান্তে আসা। মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থায় যা আছে তা শিক্ষার্থীদের হিংস্র করে গড়ে তোলে না, সে অবকাশ নেই। তবে একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর তাদের ভুলভাবে ব্যবহারের সুযোগ করে দেয়। ঢাকায় হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে আসা ছেলেগুলো হিংস্র ছিল না। তারা আধপেটা থেকে, দশ টাকার মুড়ি তিনজনে ভাগ করে খেয়ে অবস্থান নিয়েছে। কারণ সে নির্দেশই দিয়েছেন হুজুর।

অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, এ বছর ৫ ফেব্রুয়ারি গণজাগরণের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তিতে শাহবাগের তরুণরা যখন বহুধাখণ্ডিত অবস্থায় 'আমরাই সহি শাহবাগী' নাটকে অভিনয় করছে, সেই একই দিনে বাংলা মটর থেকে মিরপুর পর্যন্ত রাজপথের দুপাশে দাঁড়িয়ে সন্ত্রাস ও সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে মানববন্ধন করেছে মাদ্রাসাছাত্ররা।

আমি আসলে বলতে চাচ্ছি যে, এই ধর্মান্ধ উগ্র মানসিকতার খুনি গোষ্ঠীর অধিষ্ঠান মাদ্রাসায় নয়। মাদ্রাসাগুলো ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পায় না। সেখানকার ছাত্রদের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নেই। তারা ব্লগ, ব্লগিং, ব্লগার বলতে কী বোঝায় তা জানে না। তারা শুধু বোঝে, যে চর্চায় তাদের অদ্যাবধি যাপিত জীবন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে গেছে তা বিপন্ন করতে আসা যে কোনো কিছু তার অস্তিত্বের জন্যও বিপজ্জনক। তাকে যখন বলা হয় এভাবে– এই লোক, এই গোষ্ঠী আল্লাহ, তাঁর নবী, কোরআন এবং হাদিস নিয়ে গালমন্দ করছে, নোংরা আক্রমণ করছে– সে আহত হয়, ক্ষুব্ধ হয় এবং প্রতিবাদের উপায় খোঁজে।

সে মাত্রাই ঠিক করে নির্দেশনা– ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে মিছিল করা হবে, না কি তার বিচার চাওয়া হবে। তার গ্রেফতারের দাবি জানানো বা তাকে হত্যা করার ঘোষণা দেওয়াও নির্ভর করে ব্যক্তির 'অপরাধের' মাত্রার ওপর। আর এসব নির্দেশনা দেবেন বড় হুজুর। যিনি তার ছাত্রদের মতো একই শিক্ষাব্যবস্থায় বড় হয়েছেন। তার ইন্টারনেটে প্রবেশের সুযোগ নেই। তিনি ছবি তোলা গুনাহ মনে করেন। তার কাছে আঙুর ফলের চেয়ে 'তেঁতুল বেশি টক'।

এই পশ্চাদপদ অবস্থান থেকে তাকে উস্কানি দেয় কে? ছাত্রদের ইসলামরক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়তে নির্দেশ দিতে অনুরোধ করে কে? এমন কেউ যার ইন্টারনেট আছে। যে মনে করে, ইসলামনির্দেশিত যাবতীয় উপাসনার, যেমন, নামাজ রোজা হজ্ব যাকাতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও 'শর্টকাট' নেকি কামাইয়ের পথ হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা। সে ইসলামের কোনো চর্চাতে নিয়মিত না হলেও বাকিদের চেয়ে বড় মুসলমান। ইসলামের অস্তিত্ব নির্ভর করছে তার 'অ্যাড্রেনালিন' ক্ষরণের উপর!

এই বিশ্বাসে নিয়মিত ইসলামবিরোধী কাজ করে যায় সে। সে গিবত করে, মিথ্যা বলে। অবলীলায় কোরআনের বাণী এবং এডাল্ট পেইজের অ্যাডমিনশিপের দায়িত্ব পাশাপাশি পালন করে। মেয়েদের নগ্ন অর্ধনগ্ন ছবি দেখিয়ে তরুণদের গুনাহগার বানিয়ে মুনাজাতের ভঙ্গিরত কোনো শিশুর ছবি দিয়ে আহবান জানিয়ে লেখে, ''বলেন, আলহামদুলিল্লাহ''।

এই গোষ্ঠী বিপজ্জনকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে সমাজের বিভিন্ন স্তরে। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিগুলোয় এদের সংখ্যাধিক্য। তারা শিক্ষিত; স্মার্টফোন ও ল্যাপটপ ব্যবহার করে। তাদের থাকে একাধিক ফেসবুক অ্যাকাউন্ট। আইসিস, লস্কর-ই-তাইয়্যেবা, কাশ্মিরি জঙ্গি, তালিবান, বোকো হারাম, আলবদর (মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার জঙ্গি) ইত্যাদির সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। তাদের মতবাদ উগ্রতা ধারণ এবং উপস্থাপন করে। এদের ভাবনায়, ''আল্লাহতায়ালা দুর্বল একটি শক্তি, যাকে রক্ষা করতে তারা জন্ম নিয়েছে''!

এটা ইসলাম নয়। তারা যা করে তা 'ক্রিমিনাল' ইসলাম বা ইসলামকে একটি ভয়ঙ্কর অপরাধমূলক তত্ত্ব হিসেবে উপস্থাপন। তারা মানুষকে আতঙ্কিত করে, আক্রমণ করে, হত্যা করে তার মাঝে ইসলামের বিজয় খোঁজে। কোরআন ও হাদিসের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে। ভারতের (তাদের ভাষায়, 'হিন্দুস্তান') প্রতি তীব্র ঘৃণা ও বিদ্বেষ তাদের পাকিস্তানিদের আপন ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে। সেই পাকিস্তানি যারা 'বিসমিল্লাহ' বলে ধর্ষণ করে এবং ধর্ষণ শেষে বলে 'আলহামদুলিল্লাহ'। যেন আল্লাহ তাকে ধর্ষণ করার জন্য সৃষ্টি করেছেন, সে ধর্ষণ করে আল্লাহকে খুশি করল, 'সওয়াব' কামিয়ে নিল!

এই উগ্র ও নেতিবাচক মানসিকতার বিরুদ্ধে কী উপায় নেবেন? প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিগুলো বন্ধ করে দেবেন? এ জন্য কি শুধু জামায়াতে ইসলামী বা ছাত্র শিবিরকে দায়ী করবেন? নাকি বিএনপিকে? অভিজিত রায় কিংবা ওয়াশিকুর বাবু হত্যাকাণ্ডে সরাসরি উল্লাস না দেখালেও এগুলো অবশ্যম্ভাবী রায় দিয়ে মেনে নেওয়া এবং মেনে নিতে আহবান জানানো আওয়ামী লীগারদের কি দেখেননি আপনারা? মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বলে দাবি যারা করে তাদের মধ্যে কি দেখেননি ধর্মনিরপেক্ষতা বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ধর্মান্ধতা?

এই মারাত্মক ও ক্ষতিকর মোনাফেকি মনোভাবের বিরুদ্ধে ইসলাম ও ইসলামি চেতনা রক্ষার জন্য এগিয়ে আসতে হবে আলেমদেরই। সরকারের উচিত হবে তাদের এ ব্যাপারে সার্বিক সহযোগিতা করা যাতে তারা মানুষকে বিষয়গুলো সহজভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন। ন্যায়-অন্যায়ের তফাত এবং কোনটা গুনাহ হচ্ছে কোনটা নয় তা তাদের মুখ থেকে আসতে হবে। সুনির্দিষ্ট রূপরেখা দিয়ে প্রতিটি মসজিদে শুক্রবার জুম্মার নামাজের খুতবা পাঠের নির্দেশনা দিতে হবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোয় ওয়াজের মাধ্যমে বোঝাতে হবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা ইসলামের অন্যতম অঙ্গ। বোঝাতে হবে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি অত্যাচারী মনোভাব পোষণ গুনাহের কাজ।

প্রতিটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি ও কলেজে সেমিনারের আয়োজন করতে হবে। সেখানে ছাত্রছাত্রীরা সরাসরি প্রশ্ন করে জেনে নিতে পারবে তাদের ভুলগুলো, শুধরাতে পারবে নিজেদের। এতে ভয়ঙ্কর এক ভবিষ্যতের দিকে তীব্র বেগে ধেয়ে যাওয়া সমাজ ও দেশ বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাবে। পাশাপাশি নোংরা ও অভিসন্ধিমূলক উস্কানির মাধ্যমে ধর্মান্ধতা জিইয়ে রাখছে যারা তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর আইনি ব্যবস্থার ঘোষণা দিতে হবে। জেল, জরিমানাসহ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে যাতে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়ানোর ঘৃণ্য অবস্থান থেকে তারা সরে যেতে বাধ্য হয়।

এদের কেউ যদি বিদেশে অবস্থান করে তাহলে সংশ্লিষ্ট দেশের বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে তাদের ডিপোর্ট করিয়ে দেশে ফিরিয়ে এনে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।

ধর্মের ব্যবহার করে একাত্তরে তিরিশ লাখ মানুষ হত্যা করা হয়। ধর্মের নামেই ধর্ষিত হন লাখ লাখ নারী আর ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হন প্রায় এক কোটি মানুষ। সে সব ছিল মানবতাবিরোধী অপরাধ। একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি ক্ষুদ্র আঙ্গিকে নিয়মিত হচ্ছে এ দেশে। মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী সে অপরাধ ঠেকাতেই এগিয়ে এসেছিলেন, কোরআনের সহি তফসির দিয়ে মানুষকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন। তাঁকেও একইভাবে হত্যা করা হয়েছে। তার মানে, তিনি বিপন্ন করে তুলেছিলেন ধর্মান্ধ ওই গোষ্ঠীর অস্তিত্ব, যারা আসলে স্বার্থের জন্য ধর্মের ব্যবহার করছে, ধর্ম ক্বলবে ধারণ না করে।

নিজের জীবন দিয়ে ফারুকী বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন, এদের ঠেকানোর একমাত্র রাস্তা হচ্ছে তাঁর দেখানো রাস্তা। সরকারকে সে রাস্তায় নিয়ে আসতে হবে দেশের আলেমদের। মাদ্রাসায় মুনাফেকি শেখানো হয় না। রাজনৈতিক ইসলাম তাদের পাঠ্য নয়।

সহি কোরআন হাদিসের চর্চা করা মাদ্রাসাছাত্ররাই ঠেকাতে পারবে মুনাফিকদের। রক্ষা করতে পারবে ইসলামের ভাবমূর্তি।