মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি আকর্ষণ করে নিবেদন

মো. আনোয়ার হোসেনমো. আনোয়ার হোসেন
Published : 2 April 2015, 08:08 PM
Updated : 2 April 2015, 08:08 PM

এবারে চাপাতিসহ হত্যাকারীরা ধরা পড়েছে। না, পুলিশ বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী কোনো বাহিনী নয়, নিতান্ত সাধারণ দুজন মানুষ, হিজড়া নাম দিয়ে সমাজ যাদের অপাংক্তেয় করে রেখেছে, তারা এগিয়ে এসেছে বিপন্নকে বাঁচাতে, দুষ্টের দমনে। নিজেদের হাতে আইন তুলে নেয়নি, পুলিশের হাতেই হত্যাকারীদের তুলে দিয়েছে।

একটি জাতীয় দৈনিকের প্রথম পাতায় ওয়াশিকুর রহমান বাবুর লাশের ছবিটি আছে। ধারালো চাপাতির কোপে থুতনির নিচে বড় ফাঁক হয়ে আছে। প্রথম দৃষ্টিতে তা একটি খোলা মুখ বলে ভ্রম হয়। পরক্ষণেই বোঝা যায় দাঁতের পাটিসহ খোলা মুখ তো উপরে। ছবিতে কপালের নিচে এবং বাম গালে কাল কালির পোঁচ দেওয়া হয়েছে। এ দুটো স্থানে কোপের চিহ্ন হয়তো আরও বীভৎস। তা আড়াল করতেই কালির পোঁচ। সে চেষ্টা ক্যামেরাম্যান, রিপোর্টার বা পত্রিকার সম্পাদক যতই করুন, এই হত্যাকাণ্ডের হিমশীতল ভয়াবহতা তাতে কোনোভাবেই আড়াল হয় না। চাপাতির এবড়োখেবড়ো কোপে রক্তাক্ত সেই মুখ, মাথা পত্রিকার ছবি না হলেও তাতে হেরফের হয় না। কেন?

তা বোঝা যাবে নিহত বাবুর ছবিটির নিচে আর একটি ছবির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে। দুজন হত্যাকারীর ছবি। হেফাজতের আমীর শফির পরিচালনাধীন চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার ছাত্র জিকরুল্লাহ এবং খোদ ঢাকা শহরের মিরপুরের দারুল উলুম মাদ্রাসার ছাত্র আরিফুল ইসলাম। নরসিংদীর রায়পুরা থানার গজারিয়াকান্দা গ্রামের মইনউদ্দিন সাহেবের পুত্র জিকরুল্লাহ নিষিদ্ধ ঘোষিত জেএমবির জঙ্গি সদস্য হিসেবে ইতোপূর্বে ধরা পড়লেও দ্রুতই ছাড়া পায় জামিনে। আমীর শফির মাদ্রাসায় সে তালিম নিয়েছে ইমানি দায়িত্ব পালনের। ঠাণ্ডা মাথায় বাবুকে হত্যা করতে চাপাতি চালিয়েছে। আরেক খুনি আরিফুল ইসলামের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার তিতাস থানার বারোকাউনিয়া গ্রামে। পিতার নাম তাজুল ইসলাম। ছবিতে এই দুই হত্যাকারীর চেহারা ভাবলেশহীন। অনুশোচনার ছাপ নেই। মাদ্রাসার পোশাক তারা পরেনি, মাথায় টুপি নেই। হাফ হাতা বাহারি টি সার্ট তাদের গায়ে। দলনেতা মাসুম তাদের চাপাতি দিয়েছে, বাবুর ছবি দিয়েছে, তেজগাঁয়ের বেগুনবাড়ির বিসমিল্লা ভবন, তাতে যাবার সরু গলিপথ চিনিয়েছে।

কী বলেছে ঘাতক দুজন?

"ব্লগ কী বুঝি না। আর তার লেখাও আমরা দেখিনি। হুজুরেরা বলেছেন, সে (বাবু) ইসলামবিরোধী। তাকে হত্যা করা ইমানি দায়িত্ব। ইমানি দায়িত্ব পালন করলে বেহেশতে যাওয়া যাবে। সেই ইমানি দায়িত্ব পালন করতেই ওয়াশিকুরকে হত্যা করেছি।"

আমাদের এই বাংলাদেশে পুরো নামের সঙ্গে ছোট্ট ডাকনাম থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মায়েরাই সে নামটি রাখেন। ওয়াশিকুর রহমানের সঙ্গে বাবু নামটি হয়তো তার মা রেখেছিলেন। কিন্তু সেই মা বেশিদিন বাঁচেননি। বাবুর ছোট বোন আশরাফি সুলতানা শিমু। বিশ বছর আগে বাবু ও শিমুকে ছেড়ে মা চলে গেছেন পরপারে। বাবুর বয়স তখন ছয় কি সাত। শিমু তো আরও ছোট। শিমু বলেছেন,

"বাবা আমাদের ভাইবোন দুজনকে কোলেপিঠে অনেক কষ্টে মানুষ করেছেন। ছোটবেলা থেকে ভাইয়া খুব মেধাবী ও শান্ত স্বভাবের ছিল। সে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত ছিল না। শুনেছি ব্লগে একটু লেখালেখি করত। এ জন্য জামায়াত-শিবির ও জঙ্গি সংগঠনের কেউ এ হত্যা করতে পারে। এ ছাড়া আমার ভায়ের কোনো শত্রু ছিল না।"

পিতা টিপু সুলতান ছেলে বাবুকে নিয়ে মাসিক ছয় হাজার টাকায় সাবলেট নেওয়া একটি কক্ষে থাকতেন। ঘটনার দিন তিনি ছিলেন গ্রামের বাড়িতে। পুত্রের এমন মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তিনি। এই পিতা, এই বোন– এদের কী জবাব দেবে রাষ্ট্র? কী জবাব আছে সরকারের, সমাজের? ড. অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ডের পর এক মাসের উপর সময় চলে গেছে। ফারাবি এবং বাঁশের কেল্লার কথিত মডারেটরকে গ্রেপ্তার করা ছাড়া সে হত্যাকাণ্ডের কোনো সুরাহা রাষ্ট্র বা সরকার করেনি। টেলিভিশনে ওই দুই সন্ত্রাসীর মুখে যে বিদ্রুপমেশানো কৌতুকের হাসির আভা দেখেছি, তাতেই বুঝেছি রিমান্ডে বেশ কয়েকদিন রাখলেও তাদের উপর ফুলের টোকাটিও পড়েনি। এই সম্মানিত মেহমানদের উপর রাষ্ট্র ছিল বড়ই সদয়।

চকিতে মনে পড়ল বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা কেমন আচরণ করেছিল ভিত্তিহীন অভিযোগে গ্রেপ্তার করা শাহরিয়ার কবির ও ড. মুনতাসির মামুনের উপর। এক এগারোর পর আমাকে ও ড. হারুন-অর-রশিদকে চোখ বেঁধে রিমান্ডে নেওয়ার কথা মনে পড়ল। রিমান্ড বাড়াতে যখন আমাদের কোর্টে আনা হত, তখন আমাদের চেহারার সঙ্গে– প্রিয় পাঠক, আপনারা একটু মিলিয়ে দেখুন– হত্যার উস্কানিদাতা ফারাবি ও বাঁশের কেল্লার মডারেটরের মুখের চেহারা। বন্দি এবং রিমান্ডে নেওয়া আওয়ামী লীগের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল এবং অপর নেতা ওবায়দুল কাদেরের বিধ্বস্ত চেহারার কথাও একবার স্মরণ করুন। তাতেই স্পষ্ট হয়ে যাবে, একদিকে ধর্মান্ধ জঙ্গি গোষ্ঠী এবং অন্যদিকে রাজনীতিবিদ বা বিপন্ন মানবতার পক্ষে দাঁড়ানো আমাদের বিষয়ে রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গিটি কী।

কিন্তু তা তো হবার কথা ছিল না। লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করা হয়েছিল, ফারাবি, জিকরুল্লাহ, আরিফুল এবং এদের মাথায় যারা বিষাক্ত প্রাণঘাতী ভাইরাস ঢুকিয়েছে, সেই জামায়াত-হেফাজত-জঙ্গিদের নির্মুল করে প্রিয় মাতৃভূমির, মানবতার এবং শুভবুদ্ধির উপর আস্থা যাঁদের আছে, তাঁদের সুরক্ষা দেওয়া। সে সব কাজের জন্যই রাষ্ট্র, তার সেনাবাহিনী, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, কারাগার এবং সর্বোপরি সরকার।

কিন্তু বাস্তবে কী হচ্ছে? জামায়াত-হেফাজত-জঙ্গি ঘাতকদের হাতে জীবন দেওয়া আলোকিত মানুষের তালিকা শুধু দীর্ঘই হচ্ছে। এমন কোনো খবর এখনও আমরা দেখিনি, যেখানে ওইসব ঘাতকদের কেউ অপঘাতে নিহত হয়েছে।

বাবুকে হত্যা করে এক ঘাতক পালিয়ে গেলেও বাকি দুজন ধরা পড়েছে রক্তমাখা চাপাতিসহ। হিজড়া নামে পরিচিত দুজন মহান মানুষ মৃত্যুভয় না করে, কোনো দোদুল্যমানতা না দেখিয়ে ঘাতকদের ধরেছেন। 'অদ্ভুত আঁধারের' এই বিপন্ন সময়ে সত্যিকারের চক্ষুষ্মান আপনারা দুজন। আপনাদের সালাম জানাই, অভিনন্দন জানাই।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার কাছে নিতান্ত সাধারণ কয়েকটি নিবেদন আছে।

১. খুনি ঘাতকদের ধরে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন যে দুজন শিখণ্ডী তাঁদের সম্মানিত করুন, পুরস্কৃত করুন। আমরা ভুলে যাইনি যে জাতীয় সংসদে শিখণ্ডীদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করে তাঁদের আইনি সুরক্ষা আপনিই দিয়েছেন।

২. যে দুটি মাদ্রাসায় ঘাতকরা তালিম পেয়েছে, সেগুলো বন্ধ করে দিন। এই দুই মাদ্রাসা পরিচালনায় যারা যুক্ত আছে, তাদের উস্কানিদাতা হিসেবে হত্যা মামলায় আসামি করতে নির্দেশ প্রদান করুন।

৩. হাতেনাতে ধৃত দুই ঘাতকসহ যে চারজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে, তাদের দ্রুত বিচার আইনে বিচারের ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিন।

৪. ইসলামি জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় আমাদের করণীয় সম্পর্কে জাতীয় আলোচনার ব্যবস্থা অবিলম্বে করুন। শাহবাগের গণজাগরণে অংশ নেওয়া তরুণ প্রজন্মকে ডাকুন। তারা আমাদের পথ বাতলে দেবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, অন্ধকারের অপশক্তির হাতে মানবতা এমনভাবে বিপন্ন হতে থাকলে, আলোকিত মানুষদের জীবন এমন নির্বিচারে সংহার হতে থাকলে, তাতে রাষ্ট্র ও সরকার এমন নিশ্চেষ্ট থাকলে, তাদের মধ্যে 'করুণার আলোড়ন' অনুপস্থিত থাকলে এবং তার ফলে শুভবুদ্ধির পরাজয় ঘটতে থাকলে, তার পরিণাম হবে ভয়াবহ। নিশ্চিত থাকুন, আমরা কেউই সেই পরিণাম থেকে রেহাই পাব না।

আপনি কেন তা হতে দেবেন?

ড. মো. আনোয়ার হোসেন: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।