আপনা মাঁসে হরিণা বৈরী আর কতকাল

Published : 28 March 2015, 11:49 AM
Updated : 28 March 2015, 11:49 AM

ঢাকার রাজপথ দিয়ে হেঁটে, রিকশায় বা বাসে চলাচল করতে গেলেই আমার নিজেকে সেলিব্রিটি বলে মনে হয়। যে নারীরা আমার মতো রাস্তায় চলাচল করেন পায়ে হেঁটে, পাবলিক বাসে বা রিকশায় চড়ে তাদেরও নিঃসন্দেহে নিজেকে সেলিব্রিটি বলে মনে হয়।কারণ আমাদের একটু ছোঁয়ার জন্য, এক নজর দেখার জন্য এবং দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য অধিকাংশ পুরুষের কী আকুল প্রচেষ্টা। একমাত্র দুগ্ধপোষ্য নাবালক ছাড়া প্রায় সকল শ্রেণির অসংখ্য পুরুষের মধ্যেই পথচলতি নারীর দিকে তাকানোর আকাঙ্ক্ষা ব্যাকটেরিয়ার মতো রয়েছে।

রিকশাযাত্রী পুরুষরা যখন দেখে তার আশপাশের রিকশায় কোনো নারী রয়েছে তখন তার চেহারা মোবারক না দেখা পর্যন্ত যেন স্বস্তি পায় না। ক্ষেত্রবিশেষে নিজের রিকশা থেকে উঁকি দিয়ে অন্য রিকশার নারীকে এক নজর দেখতেই হবে। এ জন্য চলে প্রাণান্ত চেষ্টা! আর বাসযাত্রী নারীকে একটু ছোঁয়ার জন্য সে কী আকুলতা। বাসের কন্ডাক্টর পর্যন্ত 'গুড কনডাক্টের' পরোয়া না করে এবং হেলপার নারীদের বাস থেকে নামতে 'হেলপ' করার উসিলায় একটু স্পর্শ করার জন্য রীতিমতো আকুলি-বিকুলি করতে থাকে। ভিড়ের মধ্যে নারীকে ছোঁয়ার জন্যও তৎপর থাকে অনেক পুরুষ। জানতে ইচ্ছা করে, এই সামান্য ছোঁয়ায় কতখানি আনন্দ ও শান্তিলাভ হল তাদের। সম্ভবত তারা ওই সামান্য ছোঁয়া দিয়েই মনে মনে 'ফাল্গুনী' রচনা করে!

পথচারী নারীকে দেখলে রিকশাচালকদের 'কই যাবেন' হাঁক-ডাকও বেড়ে যায়। ভাবখানা যেন রিকশা থাকতে নারীরা হেঁটে যাবে কেন? নারীর কাছে ভাড়াও হাঁকে তারা বেশি। কারণ তাদের মতে, নারীর তো রিকশা ছাড়া গত্যন্তর নেই। যে পথচারী নারীদের কোনো পান-সিগারেটের দোকান, চায়ের দোকান বা মুদি দোকানের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে হয়, তারা অবধারিতভাবে দোকানের খরিদ্দার কিংবা অলস আড্ডাবাজদের নানা রকম সৃজনশীল মন্তব্য শুনতে পাবেন। পথচারী নারীকে দেখলে অনেক পুরুষের আবার সঙ্গীতশিল্পী হওয়ার খায়েশ জাগে। তারা তাদের শিল্পচর্চার নমুনা পেশ করার জন্য অস্থির হয়ে ওঠে।

সেলিব্রিটি ছাড়া এত মনোযোগ আর কে আকর্ষণ করতে পারে? বাংলাদেশের পুরুষ কবে পথচারী নারীর দিকে হা করে তাকানো বন্ধ করবে তা সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কেউ জানেন বলে মনে হয় না।

এখন আবার গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো যুক্ত হয়েছে নতুন উপসর্গ। নারীকে দেখলে তাদের দিকে থুতু বা অন্য কোনো তরল পদার্থ ছুঁড়ে দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি এদের হামলার শিকার হয়েছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কয়েক জন সাংবাদিকসহ ঢাকার বেশ কিছু কর্মজীবী নারী।

ওদিকে ফেসবুকে আমাদের বন্ধু কবি চঞ্চল আশরাফ একটি স্ট্যাটাসের মাধ্যমে আরেক ভয়াবহ তথ্য দিলেন। বোরকা বা হিজাব না পরলেই নাকি এক শ্রেণির পুরুষ, নারীর দিকে থুতু দিচ্ছে বা তাদের হয়রানি করার চেষ্টা করছে। এদের ভাবখানা হল, নারী কেন রাস্তায় বের হবে? তাও আবার 'বস্তাবন্দি' না হয়ে চলাচল করবে, 'নারীর এত সাহস?'

নারী-পুরুষ সকলেরই যে নিজের সুবিধা, রুচি এবং ইচ্ছামাফিক পোশাক পরার ও চলাচল করার অধিকার রয়েছে তা তারা মানেন না বা জানেন না। বিশেষ করে আমার মতো যে নারীরা শার্ট-প্যান্ট পরে চলাচল করেন তারা 'অতি বেপর্দা ও বেহায়া'। এই সব 'বেপর্দা' নারীকে শায়েস্তা করার ভার যেন তাদের উপর কেউ ন্যস্ত করেছে। এই 'মহৎ' উদ্দেশ্যে তারা নারীকে হয়রানি করছে। এইসব 'মহৎ' পুরুষেরাই মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি নারীকে 'গনিমতের মাল' বলে ফতোয়া দিয়েছিল। আর এদেরই উত্তরসূরীরা নারীকে 'তেঁতুল' অভিহিত করে অপমান করতে দ্বিধা করেনি। রাস্তাঘাটে নারীকে হয়রানি করা যে একটি অপরাধ সে কথা এইসব 'মহৎ' পুরুষদের কে বোঝাবে?

আমার ভাবতে অবাক লাগে, দেশের আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির এ কী হাল! নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে উচ্চ পর্যায়ে যত কথাই বলা হোক না কেন, নারী যদি স্বাধীনভাবে পথেঘাটে চলাচল করতে না পারে তাহলে কিন্তু সবই বেফায়দা। এ জন্য রাস্তায় সাদা পোশাকে নারী পুলিশ থাকা প্রয়োজন। আর অভিযোগ পেলে বা নিজের চোখে দেখলে রাস্তাঘাটে যেসব পুলিশ সদস্য রয়েছেন তারা যেন এর প্রতিবিধানে তৎপর হন সে বিষয়েও উপর থেকে জরুরি নির্দেশ আসা প্রয়োজন।

এমনিতেই তো ঢাকা মহানগরীর রাস্তাঘাট কোনো সভ্য মানুষের চলাচলের উপযোগী নয়। রাস্তায় যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগ; সড়ককে নিজস্ব গ্যারেজ মনে করে অবৈধ গাড়ি পার্কিং; ফুটপাতজুড়ে বাজার, দোকান, হকার, নির্মাণ সামগ্রীর বৈচিত্র্যময় সমাবেশ; রাস্তার উপর মানুষের বসবাস; ফুটওভার ব্রিজের সবটুকু জায়গা দখল করে শোয়া মানুষ; রাস্তাজুড়ে খানা-খন্দ, উন্মুক্ত ম্যানহোল ঢাকার পথঘাট পথচারীর জন্য আমাজান অরণ্যের চেয়েও বিপদসংকুল করে তুলেছে। এর উপর রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক অসভ্যতা।

বিষয়টি একটু বুঝিয়ে বলি। ঢাকার রাস্তায় প্রচুর সংখ্যক মানুষ মলমূত্র ত্যাগ করছে এটা নাগরিকদের অসভ্যতা। আর সিটি কর্পারেশন রাজপথের উপর খোলা ডাস্টবিনে বিপুল পরিমাণ ময়লা জড় করছে এবং সুয়ারেজ লাইন থেকে বিপুল পরিমাণ মলের নির্যাস রাস্তার উপর উন্মুক্তভাবে জমা করে রাখছে এটা প্রাতিষ্ঠানিক অসভ্যতা। দুটোই জাতি হিসেবে আমাদের নোংরামি প্রকট করে।

এই সব অসভ্যতার সঙ্গে যখন নারীর ক্ষেত্রে আরও বাড়তি অসভ্যতা করা হয় সেটা সহ্যের সব সীমা অতিক্রম করে যায়। এখন নারীর ক্ষেত্রে যে বিশেষ হয়রানিগুলো করা হচ্ছে তা প্রতিরোধের জন্য সমষ্টিগতভাবে আমাদের সকলেরই কিছু করণীয় আছে। তা হল, নারীরা যদি দলে দলে রাস্তায় নামেন, তাদের সুবিধাজনক যে কোনো পোশাকে সাহসের সঙ্গে চলাফেরা করতে থাকেন, যেখানেই সম্ভব সেখানেই হয়রানিকারীকে ধরে পুলিশে হস্তান্তর করেন এবং পথে কোনো নারীকে হয়রানির শিকার হতে দেখলে অন্য নারী এবং পুরুষরা (যারা সচেতন এবং সত্যিকারের সভ্য মানুষ) সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করেন তাহলে 'থুতু দেনেওয়ালারা' আর হয়রানিকারী বখাটেরা ভয়ে পালাতে পথ পাবে না। হয়রানিকারীদের কবল থেকে ঢাকাসহ সারা দেশকে রক্ষার এটাই উপায়।

যেদিন নারী এবং পুরুষ নিরাপদে, স্বস্তিতে, স্বাধীনভাবে চলাচল করতে পারবে সেদিনই আমরা জাতি হিসেবে নিজেদের সভ্য বলে দাবি করতে পারব। নইলে 'ক্যানিবল'দের সঙ্গে আমাদের কোনো মৌলিক পার্থক্য আছে বলে মনে হবে না।

শান্তা মারিয়া: কবি, সাংবাদিক।