স্মৃতির পাতায় একাত্তর

ধীরাজ কুমার নাথ
Published : 26 March 2015, 09:03 AM
Updated : 26 March 2015, 09:03 AM

উনিশশ' একাত্তর। বাংলার মানুষের জীবনে এক অবিস্মরণীয় বছর। একাত্তর শুধুমাত্র বাংলাদেশিদের রাজনৈতিক ও ভৌগলিক স্বাধীনতা অর্জনের প্রত্যক্ষ সংগ্রামের বছর নয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার এক মহান সন্ধিক্ষণ এবং স্বাধিকার অর্জনের বছর। আমাদের জীবনে এ সময় ঘুরে ঘুরে আসে; আর আমাদের স্মৃতিতে ভেসে থাকে ঘটনাপ্রবাহ যা ভাবলে এখনও রাতে ঘুম ভেঙে যায়, কেঁপে উঠি শঙ্কায়।

তখন ছিল যৌবন, যুদ্ধে যাবার উৎকৃষ্ট সময়। তাই বোধহয় পেরেছি সকল বিপত্তি অতিক্রম করে বিজয়ীর বেশে ফিরে আসতে, স্বাধীন মাতৃভূমিকে গৌরবের মহিমায় ভরিয়ে দিতে। সেদিনের কথা বার বার বলি, তবুও শেষ হয় না; আবারও বলতে ইচ্ছা করে।

বর্তমানে যেমন গণমাধ্যম ও যোগাযোগের ভুবনে মহাবিপ্লব ঘটেছে, তখন ছিল তখন সম্পূর্ণ বিপরীত। সড়ক, নৌপরিবহন ও রেলপথে জনগণের যাতায়াত ছিল সময়সাপেক্ষ ও সমস্যাসঙ্কুল। সত্যি বলতে কী, পঁচিশে মার্চ কালোরাতে ঢাকায় কী ভয়াবহ গণহত্যা হয়েছিল তার খবর পটুয়াখালীতে বসে তিন দিন পরেও পাইনি। বিছিন্ন কিছু জানলেও তা ছিল বিভ্রান্তিতে ভরা। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ও মহাকাব্যিক ভাষণ জনগণের মনে যেমন স্বাধীনতার বার্তা পৌঁছে দিয়েছিল, উজ্জীবিত করেছিল তাদের সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে, তেমনি এক ভয়াবহ দিনের আভাস দিয়েছিল প্রতি জনে, প্রতি ঘরে। কুকুর গভীর রাতে কেঁদে উঠত; কাক দিনরাত কা কা শব্দে অশুভ দিনের বার্তা জানাত। জনগণের মুখে হাসি নেই; রাস্তাঘাটে শুধু এক কথা– 'কী হবে এর পর!'

তবে ২৭ মার্চে মেজর জিয়ার কণ্ঠস্বর (প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি) দেশবাসীকে জানান দিয়েছিল আমরা অবতীর্ণ হয়েছি রক্তক্ষয়ী এক মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে, অজানা ভবিষ্যত বাজি রেখে।

দুর্গম ও অগম্য যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রকারান্তরে আর্শীবাদ হয়ে এসেছিল ঐ সময়ে। পাকিস্তানি জঙ্গিবাদী ও গণহত্যাকারীরা গ্রামে-গঞ্জে দ্রুতগতিতে পৌঁছুতে পারেনি, যতটা আশা করেছিল। অন্যদিকে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানকারী বাংলাদেশি মুক্তিকামী সৈনিকরা পাল্টা আক্রমণের জন্য সঠিক স্থানের অনুসন্ধান এবং সীমান্তের ওপারে নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে অভিযান চালাতে সুযোগ পেয়েছিলেন এ কারণেই।

নিরীহ জনতার উপর পাকিস্তানি গণহত্যাকারীদের আক্রমণের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেছি, তার শিকার হয়েছি। কালোরাতের প্রায় এক মাস পর, ২৬ এপ্রিল ১৯৭১, পাকসেনারা আক্রমণ করে পটুয়াখালী জেলা সদর, ডিসি অফিসসহ সকল বৃহৎ অবকাঠামো। আকাশ থেকে অবিরাম গুলিবর্ষণ করতে করতে ছ'টি হেলিকপ্টার নেমে আসে শহরে। দুটি জেট বিমান উপর থেকে নিচে নামে প্রচণ্ড শব্দে অনর্গল গুলিবর্ষণ করতে করতে; আবার উপরে উঠে। অবিরাম গোলাবর্ষণ ও বিধ্বসী মারণাস্ত্রের আক্রমণে রাস্তার দু'ধারে মৃত মানুষের কাফেলা সৃষ্টি হয় চোখের নিমিষে। মুহূর্তেই গোলপাতার শহর আগুনে জ্বলতে থাকে। তার লেলিহান শিখা দেখতে পাওয়া যায় দূরদূরান্ত থেকে। হাজারো শহরবাসী, নারী-পুরুষ-শিশু দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে, সঙ্গে যোগ দেয় জেলভাঙা অসংখ্য কয়েদি। জেট বিমান থেকে চলে নদীতে ভাসমান মানুষের উপর অবিরাম গুলিবর্ষণ। নদীর জল লাল হয়ে যায় মুহূর্তে। নিরীহ জনগণের ওপর এমন জঘন্য নির্বিচারে গুলি বিশ্বের গণহত্যার ইতিহাস বিরল।

এমনি এক সন্ধিক্ষণে জীবন বাজি রেখে বেরিয়ে পড়ি ডাকবাংলো ছেড়ে। তারপর শুরু হয় অজানা ভবিষ্যতে ভর করে নিরুদ্দেশ-যাত্রা। প্রায় ২২ দিন পর কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম জগন্নাথ দিঘীর পাশ দিয়ে ঢুকে পড়ি ত্রিপুরা রাজ্যে। লক্ষ্য করেছি, অগণিত শরণার্থীর কাফেলা– মিছিল ধরে ভারতে প্রবেশ করছে; তারা সকলে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত; চোখে-মুখে উৎকণ্ঠা। বিলোনিয়া থেকে উদয়পুর; তারপর আগরতলা; দীর্ঘ শত মাইল; তার দু'পাশে শরণার্থী শিবির আর শিবির। কয়েক দিন আগেও যাদের বাড়িতে ছিল গোলাভরা ধান, পুকুর-ভরা মাছ, সম্পদের ছড়াছড়ি– তাদের এখন আশ্রয়স্থল রাস্তার পাশের বস্তি।

এমন অনেক শরণার্থী শিবির, যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল। মুজিবনগর সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের মুচলেকা দানের পর আমার নিয়োগ হয় স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুর্নবাসন মন্ত্রীর একান্ত সচিব হিসেবে। লবণ হৃদে অবস্থিত লক্ষ মানুষের শরণার্থী শিবির (বর্তমানে সল্ট লেক, আধুনিক কলকাতা শহর) এবং উত্তরবঙ্গের অনেক ত্রাণ শিবির পরিদর্শন করেছি কয়েক বার। এমনি এক সময়ে অক্টোবর মাসে হাজির হই মেখলিগঞ্জ জেলার ডাকবাংলোতে। পরদিন মন্ত্রী মহোদয় দেখতে যাবেন দহগ্রাম, আঙ্গরপোতাসহ অনেক মুক্তাঞ্চল।

যাত্রার দিন সকালে একদল যুবক এসে হাজির হয় ডাকবাংলোতে মন্ত্রীর সাক্ষাৎপ্রার্থী হিসেবে। তারা নক্সালপন্থী। চারু মজুমদার ও কানু সান্যালের অনুসারী। তারা মন্ত্রীকে সরাসরি বলল, ''আপনারা হলেন পাতি বুর্জায়া গোষ্ঠী, নব্য পুঁজিপতি বণিক শ্রেণির প্রতিনিধি। নিরীহ জনগণের জীবন বাজি করে, তাদের চরম দুর্দশাগ্রস্ত করে ক্ষমতাগ্রহণে অভিলাষী। আপনারা কবে এ নাটকের অবসান করবেন?''

মন্ত্রী শহীদ এ এইচ এম কামারুজ্জামান একটুও বিচলিত হননি। তিনি বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭০এর নির্বাচন এবং ২৫ মার্চের কালোরাতের ভয়াবহ নিষ্ঠুরতার চিত্র তাদের কাছে অনর্গল তুলে ধরলেন। তারা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে থাকল। পরিশেষে তিনি বললেন, ''এ হচ্ছে আমাদের পুঁজিবাদী ও সামরিক জান্তার হাত থেকে অসহায় নিরন্ন মানুষের মুক্তির সংগ্রাম। এ যুদ্ধ অসাম্প্রদায়িক ও সামজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। এ সংগ্রাম থেকে গণমানুষের উদ্ধারকল্পে যুদ্ধ ছাড়া বিকল্প নেই। পাকিস্তানি সামরিক সরকার অস্ত্রের ভাষায় কথা বলছে, তাই অস্ত্রের ভাষায় আমাদের জবাব দিতে হবে।''

মনে হল তারা কিছুটা হলেও বাস্তবতা অনুধাবন করতে পেরেছিল সেদিন।

কিন্তু ওটুকুই। মেখলিগঞ্জ শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া মহানন্দা নদীর পাড়ে গিয়ে দেখতে পাই, প্রধানমন্ত্রী শহীদ তাজউদ্দিনকে 'পাতি বুর্জোয়াদের প্রতিনিধি' হিসেবে চিহ্নিত করে শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, শহীদ ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, শহীদ কামরুজ্জামানের ভারত ছাড়ার দাবিতে পোস্টারে সয়লাব রাস্তাঘাট। আঁতকে উঠি দেখে। মনে মনে ভাবলাম, এরা জানে না আমাদের বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের কথা, চৌষট্টির সাম্প্রদায়িকতার ভয়াবহতা প্রতিরোধে বাঙালির প্রতিবাদের ভাষা, ছেষট্টির ৬ দফার আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যূথান, সত্তরের নির্বাচনে জনতার রায়ের প্রতিফলন। এর ফলে আমাদের দহগ্রামে প্রবেশের পথে সময় দু'ঘণ্টা পিছিয়ে দিল।

অপর একটি ঘটনার কথা বলতেই হয়। আমরা পৌঁছুলাম আসামের গোয়ালপাড়া জেলার ধুবরিতে, অক্টোবরের এক রাতে। সভা শুরু হল ধুবরি সার্কিট হাউজে। মন্ত্রী কামারুজ্জমান, আসামের শিল্পমন্ত্রী সুলতান আহমেদ এবং ভারতের লোকসভার সদস্য কোচবিহার থেকে নির্বাচিত শ্রী সন্তোষ রায়। আলোচনায় সহায়তা করছেন গোয়ালপাড়া জেলার প্রশাসক এবং তাকে সহায়তা করছেন জেলার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত পুলিশ কর্মকর্তারা। আলোচনার বিষয় ছিল এ রকম; বেশ কিছুদিন থেকে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের চিলমারী, রহুমারীসহ রংপুর থেকে আগত শরণার্থীদের ক্যাম্পে উক্ত মুসলিমপ্রধান এলাকার জনগণ গরম পানি ঢেলে দিয়ে তাদের ভারত ছাড়ার নির্দেশ দিচ্ছে। তাদের অভিযোগ, কিছু বিভ্রান্ত বাংলাদেশি নেতা ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে অনেক কষ্টে অর্জিত পাকিস্তান ভেঙে দিতে উদ্যত হয়েছে।

বিষয়টি এমনই নাজুক যে, এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে সমগ্র ভারতবর্ষে দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হতে পারে। কারণ, পাকিস্তানি সৈন্যরা যুদ্ধে হিন্দুদের নিশ্চিহ্ন করার অভিযানে সকল আক্রমণ পরিচালনা করে এবং তারা ভারতে আশ্রয় নিয়ে ভারতীয়দের সব অবহিত করে। এমন অবস্থায় যদি জানতে পারে যে, ভারতীয় মুসলিমরাও হিন্দুদের উপর আক্রমণ করছে, তখন বিপদ হতে পারে, স্বাধীনতার পথে প্রবল বাধা সৃষ্টি হতে পারে। তাই অনেক রাত অবধি আলোচনা করে স্থির করা হয়, জনাব কামারুজ্জামান এবং সন্তোষ রায় স্পর্শকাতর এলাকায় সভা করবেন এবং বুঝাবেন স্বাধীনতা যুদ্ধ কেন করতে হচ্ছে। মন্ত্রী সুলতান আহমেদ গোয়ালপাড়া জেলা এবং পার্শ্ববতী এলাকায় গিয়ে মুসলিম লীগ নেতা এবং কংগ্রেসের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে তাদের সঠিক পথে নিয়ে আসবেন।

এ সব ঘটনার উল্লেখ করার কারণ হচ্ছে, অনেক ভারতীয়ও আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপট বুঝতে পারেনি। যেমন পারেনি বাংলাদেশে অবস্থানরত কিছু নেতা ও তাদের অনুসারীরা। তারা অনেকেই রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস হয়েছে। তাদেরকে বুঝানোর লোক ছিল না। স্বাধীনতার পর ভুল তাদের ভেঙেছে; তবে আমরা, কিছু মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সঙ্গে পুর্নমিলনের উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয়েছি। বিজয়ীরা সব উপভোগ করবে (Winner takes all) এমন মানসিকতা নিয়ে সর্বত্র বিচরণ করেছি। তাই চুয়াল্লিশ বছর পরও সেই বিদ্বেষ, হিংসা, ভুলবুঝাবুঝি আমাদের তাড়া করছে।

স্বাধীনতা সহজ ছিল না। শুধু আমেরিকা সপ্তম নৌবহর নিয়ে উপনীত হয়েছিল তাই নয়, অনেক দেশের স্বীকৃতি বাংলাদেশ পায়নি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পূর্ব পর্যন্ত। এখনও ৭ মার্চের মহাকাব্যিক ভাষণ বুঝতে পারছে না অনেকে। যে সকল নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা জীবন দিয়েছেন, যারা নির্যাতিত হয়ে নিঃস্ব হয়েছেন এবং পঙ্গুত্ব বরণ করে নিরবে অশ্রুজল বির্সজন করছে, তাদের কথা ভেবে স্বাধীনতার চেতনা সমুন্নত রেখে সামনে এগুতে হবে।

দেশ এখন নবপ্রজন্মের; তাদের সুস্থভাবে, নির্মল পরিবেশে নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ দিতে হবে।

ধীরাজ কুমার নাথ: সাবেক সচিব।