পানি নিয়ে যুদ্ধ নয়, চাই ন্যায্য বণ্টন

এম এম খালেকুজ্জামানএম এম খালেকুজ্জামান
Published : 23 March 2015, 01:25 PM
Updated : 23 March 2015, 01:25 PM

পানি-কূটনীতিতে পেরে না ওঠা দেশগুলোর অপেক্ষা শেষ হয় ১৯৯৭ সালে। সেবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে তুলে আনা হয় জলপথ সংক্রান্ত ফ্রেমওয়ার্কটি। যেটির পুরো নাম, United Nations Convention for Non Navigational uses of Water Courses, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সংখ্যাধিক্যের ভোটে গৃহীত কনভেনশনটির বিপক্ষে ভোট পড়েছিল তিনটি– চীন, তুরস্ক ও রুয়ান্ডার। ভারতের সঙ্গে ব্রহ্মপুত্রসহ আরও কিছু আন্তঃসীমান্ত নদীর উজানের দেশ বলেই বোধহয় চীন বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিল। ভোটদানে বিরত ছিল ভারত, পাকিস্তানসহ কয়েকটি দেশ। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের রয়েছে ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদীর হিস্যা-সংক্রান্ত জটিলতা। পক্ষে ভোট দিয়ে বাংলাদেশ সঠিক ভূমিকা পালন করেছে।

কনভেনশনটি তখনই আইনে পরিণত হলে ভাটির দেশ বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পানি-কূটনীতিতে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকত। এ জন্য দরকার ছিল ৩৫ দেশের স্বাক্ষর। ২০১৪ সালের মে মাসে ভিয়েতনাম ৩৫ তম দেশ হিসেবে ১৯৯৭ সালের এ কনভেনশনে সই করেছে। রীতিমাফিক ৯০ দিন পর, মানে ২০১৪ সালের ১৭ আগস্ট থেকে এ আইন কার্যকর হয়।

অবাক বিষয়, যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় 'সাসটেইনেবল ডেভলপমেন্ট গোল' (এসডিজি) নিয়ে আলোচনা করছে, তখন অত্যাবশ্যকীয় এই আইনের খসড়া প্রস্তুতকরণ ও প্রয়োজনীয় অনুমোদন পেতেই প্রায় পঞ্চাশ বছর লেগে গেল! এতে প্রমাণ হয়, বহুপক্ষীয় সমঝোতার ক্ষেত্রে বড় ধরনের ফাঁক রয়ে গেছে এখনও।

আন্তঃসীমান্তীয় পানি-বণ্টন ও ব্যবস্থাপনায় মতানৈক্য বহুদিনের। আবার আন্তর্জাতিক আইনের বদলে সরকার ও পানিবিদেরা অববাহিকা-ভিত্তিক মতৈক্যের ওপর আস্থাশীল। এ দুটি বিষয় ছাড়াও পঞ্চাশ বছরের অপেক্ষার পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক নেতৃত্বের পরিবেশগত সদিচ্ছার অভাব।

জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত যে সব কনভেনশন ও ট্রিটি রয়েছে তার অনেকগুলোই দেশ নির্বিশেষে অনুমোদন পায়নি। তাই সময় এসেছে 'কিয়োটো প্রটোকল' বাদ দিয়ে একটি নতুন কাঠামো প্রণয়ন ও গ্রহণের। কারণ পানিচক্রের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি প্রভাব রয়েছে। উন্নত দেশগুলো গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানোয় যে পদক্ষেপ নিয়েছে, সেগুলো বৃষ্টিপাতের ধরন স্বাভাবিক করতে সহায়তা করবে। দুনিয়ার নানা স্থানে পানির যে চরম সংকট রয়েছে, তার মোকাবিলাও সম্ভব। এ জন্য উচ্চাভিলাষী কর্মসূচি গ্রহণ করা দরকার।

জাতিসংঘের জলপথ আইনটি কার্যকর হওয়ার প্রাক্কালে এমন সব প্রশ্নের উদয় হচ্ছে, যেগুলোর অস্তিত্ব এটি গ্রহণের আগেও ছিল। যেমন, এটি বাস্তবায়নের ব্যবহারিক ফল কী হবে? দেশগুলো কীভাবে নিজেদের ভেতরে বা নদীতীরের দেশের ক্ষেত্রে এ আইন ব্যবহার করবে? আমেরিকান ও এশিয়ান যে দেশগুলো আইন অনুমোদনে গড়িমসি করেছে, তারা কীভাবে সাড়া দেবে? এ আইনের সঙ্গে 'কনভেনশন অন দ্য প্রোটেকশন অ্যান্ড ইউস অব ট্রান্সবাউন্ডারি ওয়াটার কোর্সেস অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল লেকস'এরই-বা কী সম্পর্ক হবে? ইউরোপ ও কেন্দ্রীয় এশিয়ার অনেক দেশেই আইনটি ২০১৩ সাল থেকে বলবৎ আছে। এর সদস্যপ্রাপ্তির দরজাও খোলা রয়েছে। তাই আইনটি কার্যকর হলে বিদ্যমান ও আন্তঃদেশীয় মতৈক্যগুলোর ওপরই-বা কী প্রভাব পড়বে?

সোভিয়েত রাশিয়ার সাবেক প্রধান মিখাইল গর্ভাচেভের 'প্রোজেক্ট সিন্ডিকেট'এ করা এই প্রশ্নগুলোর সদুত্তর পাওয়া জরুরি।

যে দেশগুলো আইনে স্বাক্ষর করেছে, তাদের ওপর দায়িত্ব বর্তায় আন্তঃদেশীয় পানির টেকসই ব্যবহার ও রক্ষার। সে ধারা বজায় রেখে এবার বিশ্ব পানি দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল 'ওয়াটার অ্যান্ড সাসটেইনেবল ডেভলপমেন্ট'। ১৯৯২ সালের ২২ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৪৭/১৯৩১ সিদ্ধান্তে বিশ্ব পানি দিবস ঘোষণা করা হয়। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও সামাজিক কল্যাণের জন্য পানি সম্পদ উন্নয়নে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যেই পানি দিবস পালনের শুরু। ইতোমধ্যে পালিত দিবসগুলোতে গুরুত্ব দেওয়া হয় নারী ও পানি, তৃষ্ণার জন্য পানি, পানির প্রতুলতা, ভূগর্ভস্থ পানি, ভাটির অধিবাসীর জীবন, একুশ শতকের পানি, পানি ও স্বাস্থ্য, উন্নয়নের জন্য পানি, ভবিষ্যতের জন্য পানি, জীবনের জন্য পানি, পানি ও সংস্কৃতি, পানির অপ্রতুলতা, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ইত্যাদি। এর মধ্যে 'পানি ও জীবন' শিরোনামে ১৯৯৫ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত একটি পানি দশকও পালিত হয়েছে।

পৃথিবীর সকল প্রাণেরই উৎস পানি। ৭০০ কোটি মানুষ আজ খাদ্য ও জ্বালানির মতো মৌলিক বিষয়ের পাশাপাশি যে বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি তা হচ্ছে, সবার জন্য বিশুদ্ধ ও পর্যাপ্ত খাবার পানির জোগান। ওদিকে যে সব অঞ্চলে পানিস্বল্পতা রয়েছে, সেখানে বিভিন্ন নদী নিয়ে পানি-যুদ্ধের আশঙ্কা প্রবল। যেমন, লেবানন-ইসরায়েলের মধ্যে হাসবানি নদী; তুরস্ক, সিরিয়া ও ইরাকের মধ্যে ইউফ্রেটিস; সিরিয়া ও ইসরায়েলের মধ্যে গ্যালিলি সাগর; ইসরায়েল, ফিলিস্তিন ও জর্দানের মধ্যে জর্দান নদী; সুদান, মিশর, ইথিওপিয়া ও আরও কিছু দেশের মধ্যে নীলনদ; সেনেগাল ও মৌরিতানিয়ার মধ্যে সেনেগাল নদী; ইরান ও আফগানিস্তানের মধ্যে হেলম্যান্ড নদী নিয়ে বিরোধ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিবাদ তো আছেই।

পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে আমাদের নূতন করে তাই ভাবতে হবে। অবশ্যই পানির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা দরকার। উদ্ভুত সকল সমস্যার সমাধানে বাস্তবমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করা না হলে অচিরেই যুদ্ধে লিপ্ত হবে বিশ্ব এবং তা হবে পানির কারণে।

পৃথিবীতে যে ২৬৩ স্বাদু পানির হ্রদ ও নদী অববাহিকা রয়েছে, তা বিশ্বের ১৪৫ দেশের সীমানায় অবস্থিত। এ অববাহিকাগুলোতেই পৃথিবীর বড় বড় সভ্যতার বাস। টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিসে শাতিল আরব; ইউরোপের দানিয়ুব নদী অববাহিকায় সতেরটি; কঙ্গো, নাইজার, নীল, রাইন, জাম্বেজি নদী অববাহিকায় নয়টির বেশি এবং আমাজন, গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা, মেকং, ভলগা নদী অববাহিকায় কমপক্ষে পাঁচটি দেশে সভ্যতা রয়েছে। ঐতিহাসিক সত্য হচ্ছে, এসব আন্তঃসীমান্ত নদী বা হ্রদ যুগে যুগে একাধিক দেশের মধ্যে সংঘাতের সৃষ্টি করেছে। সময়-পরিক্রমায় আমাদের পরিবেশ যেমন বিপর্যস্ত হচ্ছে, সে সঙ্গে বাড়ছে পানির চাহিদা যা ভবিষ্যতে সংঘাত আরও নিশ্চিত করবে। জাতিসংঘের জন্মের পর গত ষাট বছরে পৃথিবীতে কম আন্তর্জাতিক চুক্তি হয়নি। তবু একাধিক দেশের মধ্যে ঘটছে সংঘাতের ঘটনা।

বিজ্ঞানের জয়জয়কার যখন আধুনিক বিশ্বে, তখন প্রায় ১৫০ কোটিরও বেশি মানুষের জন্য নেই নিরাপদ পানির ব্যবস্থা। প্রতি বছর শুধু পানিবাহিত রোগে ভুগে মারা যাচ্ছে প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ। আমাদের দেশে পানযোগ্য পানির প্রধান উৎস, নদী-খাল-বিল, হাওর-বাওড়, পুকুর ও জলাশয়। এক সময় এ দেশে ১৩শর বেশি নদী থাকলেও বেশিরভাগই এখন মৃত। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সর্বশেষ হিসাবে বর্তমানে দেশে নদীর সংখ্যা ৩১০।

দুঃখের বিষয়, যেগুলো আছে তাতেও পানি নেই। তিস্তার ৬৫ কিলোমিটার উজানে গজলডোবায় ভারত ব্যারাজ নির্মাণ করে ৮৫ শতাংশ পানি প্রত্যাহার করে নিয়েছে। ফলে এটি এখন জলশূন্য ধু ধু প্রান্তর। যে নদী দিয়ে শুষ্ক মৌসুমে পাঁচ থেকে আট হাজার কিউসেক পানি প্রবাহিত হত, সেখানে এখন মাত্র পাঁচশ কিউসেক মিলছে। পানি ও কৃষি বিশেষজ্ঞরা হিসাব করে দেখিয়েছেন, এর ফলে সেচ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের ৮০ হাজার হেক্টর জমি। ফলে এই জমিতে ধান চিটা হয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞদের হিসাব মতে, এতে কৃষকের ক্ষতি হয়েছে ৪২৭ কোটি টাকার মতো।

আন্তর্জাতিক নীতিমালা মানলে ভারত একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করতে পারে না। কারণ এটা আন্তর্জাতিক নদী-সংক্রান্ত ১৯৬৬ সালের হেলসিংকি নীতিমালার পরিপন্থী। উজানের দেশ ভাটির দেশের অনুমতি এবং উভয় দেশের মধ্যে চুক্তি ছাড়া ইচ্ছামতো নদীর পানি সরিয়ে নিতে পারে না। জানা যায়, পদ্মা-তিস্তা ছাড়াও আরও অনেক নদীতে বাঁধ দিচ্ছে ভারত, চুক্তি ছাড়াই।

যে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের চিরশত্রুতা তার সঙ্গে কিন্তু পানি-বণ্টন নিয়ে চুক্তি হয়েছিল ভারত-ভাগের পর পরই। সে সময় সিন্ধু ও তার শাখা নদী নিয়ে পাক-ভারতের মধ্যে চুক্তি হলেও গঙ্গা ও পদ্মার পানি নিয়ে চুক্তি হয়নি। পাক শাসকরা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থের ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন বলেই এ অঞ্চলের পানি-বণ্টন নিয়ে চুক্তি করতে আগ্রহ দেখাননি। ভারত সরকারও পূর্ববঙ্গের জনগণের চরম ক্ষতির বিষয়টি হিসাবে না এনে কলকাতা বন্দরের নাব্যতা বৃদ্ধির প্রয়োজন দেখিয়ে ফারাক্কায় বাঁধ নির্মাণ করেছিল।

নদী মানুষের সভ্যতার ইতিহাস অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করছে; এমনকি তার ক্রোধ ও প্রশান্তিও। বাস্তব জীবনে আমরা তা মানি না। আমরা যে মুহূর্ত কাটাচ্ছি, সেটির বাইরে প্রায় কিছুই দেখতে পাই না; চাইও না। যে কোনো কাজের ফলে কয়েক বছর বা দশক পরে পৃথিবীর কী ক্ষতি হবে, তা আমাদের ক্ষুদ্র বোধবৃত্তে তরঙ্গ তুলতে ব্যর্থ হয়। গোটা পৃথিবীর মানুষকে এখন বুঝতে হবে, নদী তথা জলপ্রবাহের প্রতি আমাদের যথেচ্ছাচার সভ্যতা ধংসেরই কারণ হতে পারে। তাই বিরোধ মিটিয়ে সবার ন্যায্যতা নিশ্চিত করাটা জরুরি।

এম এম খালেকুজ্জামান: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।