জামায়াত যার বন্ধু তার শত্রুর দরকার নেই

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 16 March 2015, 06:20 AM
Updated : 16 March 2015, 06:20 AM

টানা অবরোধের ৬৬ তম দিনে এই লেখা লিখছি। পরিচিত কারও সঙ্গে দেখা হলে প্রথমেই জানতে চান, দেশে যা বলছে তার শেষ কোথায়, কীভাবে? কিন্তু এ জিজ্ঞাসার জবাব কে দেবেন বা দিতে পারবেন, আমার জানা নেই। ৬ জানুয়ারি থেকে দেশব্যাপী ২০ দলীয় জোটের অবরোধ চলছে। এর সঙ্গে সপ্তাহে 'তিন যোগ দুই' দিন থাকছে হরতাল। পাঁচ দিনের হরতাল একবারে না ডেকে প্রথমে রবিবার ভোর ছয়টা থেকে বুধবার ভোর ছয়টা পর্যন্ত; পরে আবার বুধবার ভোর ছয়টা থেকে শুক্রবার ভোর ছয়টা পর্যন্ত– এ রকম ভেঙে ভেঙে ডাকা হচ্ছে।

এভাবে হরতাল ডেকে কী রাজনৈতিক ফায়দা হচ্ছে সেটা কেউ বুঝতে পারছে না। এর তাৎপর্য কেবল খালেদা জিয়াই হয়তো জানেন। দেশের মানুষ কি বিএনপি-জামায়াত জোটের ডাকা অবরোধ-হরতাল মেনে নিচ্ছে? রাস্তায় বের হলে অবরোধ-হরতালের ছাপ কতটুকু দেখা যায়? নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী এসএসসি পরীক্ষা না-হওয়া ছাড়া হরতাল-অবরোধের কারণে আর কিছু বন্ধ থাকছে কি? এমন ফ্লপ রাজনৈতিক কর্মসূচি দেশের একটি বড় রাজনৈতিক দল অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। এর চেয়ে বড় বিস্ময়কর ঘটনা আর কী হতে পারে!

দেশে প্রধান সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হোক– এই দাবির প্রতি যত মানুষের সমর্থন আছে, এই দাবি আদায়ের জন্য অবরোধ-হরতালের মতো কর্মসূচির প্রতি সমর্থন তার খুব কম অংশেরই আছে। কারণ এসব কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে হচ্ছে না। রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের রাস্তায় দেখা যায় না। রাতের অন্ধকারে চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে যানবাহনে পেট্রোল বোমা ছুঁড়ে দেওয়া হচ্ছে। রেল লাইন তুলে ফেলা হচ্ছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, 'গণতন্ত্র উদ্ধারের চলমান' আন্দোলনে ১২১ জন নিরীহ-নিরপরাধ মানুষ চিরদিনের মতো না-ফেরার দেশে চলে গেছেন। এখনই এই সহিংস অবরোধ-হরতাল বন্ধ না হলে মৃত্যুর মিছিলে হয়তো আরও অনেককেই শামিল হতে হবে।

কারণ অবরোধ-হরতাল কর্মসূচি চললেও ঝুঁকি নিয়ে মানুষ রাস্তায় বের হচ্ছে। প্রথমদিকে রাজধানী ঢাকার বাইরে এসবের কিছু প্রভাব লক্ষ্য করা গেলেও, দিন যত যাচ্ছে ততই দেশের প্রায় সর্বত্র হরতাল-অবরোধ শিথিল হয়ে পড়ছে। জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়ার ভয় উপেক্ষা করে যানবাহন চলাচলের সংখ্যা ঢাকার বাইরেও প্রতিদিনই বাড়ছে। ঢাকায় তো রীতিমতো যানজট দেখা যাচ্ছে।

শুধু কি সাধারণ মানুষই এসব উপেক্ষা করছে? বিএনপি নেতারাও নিজেদের ডাকা অবরোধ-হরতাল মানছেন না। 'হরতালে সব চালু বিএনপি নেতাদের' শিরোনামে দৈনিক 'কালের কণ্ঠ' ১২ মার্চ প্রধান প্রতিবেদন করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে:

"সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট দীর্ঘ দুই মাসেরও বেশি সময় টানা অবরোধ ও ঘন ঘন হরতাল ডাকলেও জোটের প্রধান শরিক বিএনপি নেতাদের হরতাল-অবরোধ পালনের কোনো বালাই নেই। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, কল-কারখানা, পরিবহন, দোকানপাট, অফিস-প্রতিষ্ঠান– সবই চালু রয়েছে। অথচ অবরোধ-হরতালের নামে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে পেটের দায়ে, জীবিকার তাগিদে রাস্তায় নামা নিরীহ মানুষকে। পঙ্গু করে ফেলা হচ্ছে দেশের অর্থনীতি।"

প্রতিবেদনে বিএনপি নেতাদের কোন কোন শিল্পকারখানা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কিংবা পরিবহন স্বাভাবিকভাবে চলছে তা বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বিএনপির জেলা পর্যায়ের একজন নেতা 'যেসব বিএনপি নেতার ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান খোলা রয়েছে তাদের সশরীরে রাজপথে নেমে আসার আহ্বান জানিয়ে বলেন, প্রকৃত নেতাকর্মীরা আজ জেল-জুলুম ও হুলিয়ার শিকার। অথচ যারা নমিনেশন আনার জন্য টাকা-পয়সা খরচ করে দৌড়ঝাঁপ করেন, তারা আন্দোলন-সংগ্রামে তো থাকেনই না, বরং তাদের মিল-কারখানা খোলা রয়েছে। এটা তাদের স্ববিরোধী কর্মকাণ্ড।'

বেগম জিয়া এবং তাঁর উপদেষ্টারা কেন এটা বুঝতে পারছেন না যে, পেট্রোল বোমা, ককটেল ফাটিয়ে, সন্ত্রাস করে দাবি আদায় করা যাবে না। শুধু বাংলাদেশ কেন, পৃথিবীর কোনো দেশেই কোনো সরকার সন্ত্রাসের কাছে মাথা নত করে না, করতে পারে না। বিএনপির আহ্বানে যদি হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসত, তাহলে সরকারের পক্ষে অনঢ় অবস্থানে থাকা সহজ হত না। প্রকৃত গণতান্ত্রিক আন্দোলন যেখানে হয় সেখানে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ কিংবা সরকারের পেটোয়া বাহিনী হামলা চালায়, অত্যাচার-নির্যাতন করে। আর এবার আমাদের এখানে 'আন্দোলনকারীরা' সাধারণ মানুষের ওপর হামলা করছে, তাদের পেট্রোল বোমায় পুড়িয়ে মারছে। সরকারের জন্য এটা আবার বাড়তি সুবিধা এনে দিয়েছে। তারা সহজেই একে 'জঙ্গিবাদী কার্যক্রম' বলে প্রচার করতে পারছে।

নিরীহ মানুষদের নির্বিচারে হত্যা করায় দেশে-বিদেশে কোনো মহল থেকেই বিএনপির পক্ষে সহানুভূতি পাওয়া সহজ হচ্ছে না। এই অবস্থায় কিছু না পেয়ে খালি হাতে বিএনপি কীভাবে সরে আসবে, এ প্রশ্ন বিএনপি-দরদিরা তুললেও সরকার তাতে কান দিচ্ছে না। তারা যদি এখন বিএনপি-জামায়াতের কাছে নতি স্বীকার করে তাহলে সেটা ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য একটি 'অত্যন্ত বাজে' দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। বলা হচ্ছে, মানুষের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা বিধান সরকারের প্রধান দায়িত্ব। এই অবস্থায় কেউ কেউ আলোচনার মাধ্যমে সংকট নিরসনের কথা বললেও সরকার আলোচনায় বসতে চাইছে না। পেট্রোল বোমা হাতে নিয়ে সাধারণ মানুষের জীবন ও সম্পদ জিম্মি করে সরকারকে আলোচনায় বসতে বাধ্য করা যায় না। এটা সঠিক রাজনৈতিক কৌশলও হতে পারে না।

প্রশ্ন আসে, সরকার যদি নমনীয়তা না দেখায় তাহলে বর্তমান অবস্থা কি চলতেই থাকবে? এই প্রশ্নের জবাবে এক কথায় 'হ্যাঁ' বা 'না' বলার সুযোগ নেই। বর্তমান এই অবস্থা দীর্ঘদিন চলবে না, আবার রাতারাতি এর পরিসমাপ্তিও ঘটবে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আরও বেশি কঠোরতা এবং সক্রিয়তায় বোমাবাজরা ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে। মাঝেমধ্যে বোমাবাজি চললেও তা এক সময় মানুষের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হবে। ১৬ কোটি মানুষের দেশে কত রকম দুর্ঘটনাই তো ঘটতে পারে! মানুষ মারার রাজনীতিকেও একসময় 'দুর্ঘটনা' হিসেবেই হয়তো দেখা হবে। তবে এ মুহূর্তে সরকারকে আরও ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিচয় দিতে হবে। আন্দোলনে বিএনপির সক্ষমতা নিয়ে প্রকাশ্যে কটাক্ষ বন্ধ করে ওদের পিছিয়ে আসার স্পেস তৈরি করে দিতে হবে।

বিএনপি নেতৃত্ব স্বীকার না করলেও এটা অনেকের কাছে স্পষ্ট যে, তাদের রাজনীতি এখন পরিচালিত হচ্ছে জামায়াতের প্রভাবে। তাদের মতো একটি বড় দল, যারা নিজেদের 'গণতান্ত্রিক' বলে দাবি করে, তাদের জামায়াতনির্ভর হয়ে পড়াটা দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি ও গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর হয়েছে। দেশে যেসব উগ্রবাদী ধর্মভিত্তিক সংগঠন সক্রিয় রয়েছে, তাদের সঙ্গে কোনো-না-কোনোভাবে জামায়াতের সংশ্লিষ্টতা আছে। এটা নিয়ে কেউ ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন, বিতর্ক করতে পারেন, কিন্তু তাতে পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে না। বিষয়টি যারা এখনও অস্বীকার করেন, তারা জেনে বা না জেনে দেশটাকে ভয়াবহ বিপদের দিকেই ঠেলে দিচ্ছেন। ধর্মের নামে উগ্রবাদীরা বিভিন্ন দেশে কী বীভৎস হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে, তা কি আমরা দেখতে পাচ্ছি না?

২০-দলীয় জোটের আন্দোলনে সাধারণ মানুষ সম্পৃক্ত হচ্ছে না। কেন এই দূরত্ব, বিচ্ছিন্নতা? রাজনীতি-সচেতন সবারই এ প্রশ্নের জবাব খোঁজা উচিত। রাজনীতির নামে প্রতিহিংসাপরায়ণতা, আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস-সহিংসতা চালানোর কারণে মানুষের মনে বিএনপি সম্পর্কে এক ধরনের বিরূপতা তৈরি হয়েছে এবং হচ্ছে। এমনকি যারা বিএনপিকে ভোট দেন, তারাও দলটির বর্তমান রাজনৈতিক কৌশলের সঙ্গে একাত্ম হতে পারছেন না। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক দল জামায়াতের ওপর বিএনপির অতিমাত্রায় নির্ভরতার বিষয়টি মানুষ ভালোভাবে গ্রহণ করেনি।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারের অগণতান্ত্রিক আচরণ, স্বেচ্ছাচারী মনোভাব, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ইত্যাদি কারণে মানুষের সমর্থন যখন স্বাভাবিক নিয়মে বিএনপির দিকেই যাওয়ার কথা, তারা তখন সাধারণ মানুষের ওপর আস্থা রেখে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচির কথা না ভেবে জামায়াত ও বিদেশনির্ভর হয়ে দ্রুত ফললাভের আশায় সন্ত্রাস-নাশকতার হঠকারিতার পথ গ্রহণ করেছে।

৫ জানুয়ারির নির্বাচন সুশীল সমাজে এবং আওয়ামী বিরোধী মহলে যতটা অগ্রহণযোগ্য হয়েছে সাধারণ মানুষের কাছে ততটা নয়। ওই নির্বাচন নিয়ে মানুষ মারাত্মক ক্ষুব্ধ হলে নির্বাচনের পর রাজনৈতিক পরিস্থিতি অশান্ত ও উত্তপ্ত হয়ে উঠত, যেমনটা হয়েছিল ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে। কিন্তু শেখ হাসিনা নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এসেছিল। নির্বাচন হওয়া না-হওয়া নিয়ে বিএনপি-জামায়াত দেশে যে অরাজক অবস্থা তৈরি করেছিল, সাধারণ মানুষ তা পছন্দ করেনি। নির্বাচন ভালো হয়েছে কী মন্দ হয়েছে, তার চেয়ে মানুষের কাছে বিবেচনার বিষয় ছিল জীবনের নিরাপত্তা, শান্তি, স্বস্তি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কিছু ইতিবাচক উদ্যোগের কারণে দেশের বাইরে সরকারের গ্রহণযোগ্যতার সংকটও অনেকটাই কেটে গেছে। দেশ যখন স্থিতিশীলতার দিকে যাচ্ছিল, তখন অবরোধ-হরতালের মতো সহিংস কর্মসূচি কারও প্রত্যাশিত ছিল না।

জামায়াতের সমর্থন ও সহযোগিতায় সন্ত্রাস-নাশকতার পথে গিয়ে বিএনপি নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মেরে যে ক্ষত তৈরি করেছে, তা নিরাময়ের উপায় তাদেরই খুঁজে বের করতে হবে। আমেরিকা যার বন্ধু তার যেমন শত্রুর প্রয়োজন হয় না, তেমনি জামায়াত যে দলের মিত্র তার সর্বনাশের জন্য অন্য কারও শত্রুতার প্রয়োজন নেই।

বিএনপি নেতৃত্ব যত তাড়াতাড়ি এটা বুঝতে পারবে, দল ও দেশের ততই মঙ্গল।