চিন্তার স্বাধীনতা যেভাবে রক্ষা পেতে পারে

হাসান মামুনহাসান মামুন
Published : 12 March 2015, 11:05 AM
Updated : 12 March 2015, 11:05 AM

আমাদের মূল সংবিধান এবং এখনও যেটি বহাল আছে, তাতে চিন্তার স্বাধীনতার স্বীকৃতি রয়েছে বলেই জানি। চিন্তার স্বাধীনতার মানে আসলে চিন্তা প্রকাশের স্বাধীনতা। শুধু চিন্তা করা গেল, কিন্তু প্রকাশ করা গেল না, তার তো কোনো মানে হয় না। চিন্তা কোথায় কোথায় প্রকাশ করা যাবে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। যেসব বিষয়ে চিন্তা জাগে বা একজন চিন্তা করেন, তার সব কিছুই কি তিনি প্রকাশ করতে পারবেন, সে প্রশ্নও রয়েছে।

অধুনা কেউ কেউ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের কথা তোলেন। সেটাকে ভিত্তি মেনে নিলেও বলতে হয়, ওখানে 'মানবিক মর্যাদার' কথা ছিল। চিন্তা প্রকাশের স্বাধীনতা ছাড়া এটা কল্পনা করা যায় কী? চিন্তা প্রকাশ করতে পারলাম না, কিন্তু খেয়েপরে ভালোমতোই থাকলাম– তাতে মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা যাবে কিনা? ওখানে 'ইনসাফের' কথাও ছিল। চিন্তার স্বাধীনতা খর্ব করা হলে বা সেটি খণ্ডিতভাবে থাকলে মানুষের সমাজে ওটা প্রতিষ্ঠিত হবে কি?

চিন্তার বা বাকস্বাধীনতা প্রয়োগ করতে গিয়ে লোকে যাতে আবার অরাজকতা সৃষ্টি করতে না পারে, সে জন্য আইনে কিছু নির্দেশনা রয়েছে। তা অমান্য করলে আছে শাস্তির ব্যবস্থা। বর্তমান সময়ে 'স্পর্শকাতর' বলে বিবেচিত বিষয়ে রয়েসয়ে চিন্তাভাবনা প্রকাশ করতেও বলা হয়। মানুষ মাত্রেরই অনুভূতি রয়েছে; সংখ্যালঘুর অনুভূতিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে রাষ্ট্রকে বরাবরই দেখা গেছে সংখ্যাগুরুর অনুভূতির দিকে বেশি দৃষ্টি দিতে। এর রাজনৈতিক দিক অস্বীকার করা যাবে না। তবে আইন অনুযায়ী যে কেউ তার অনুভূতি আক্রান্ত হওয়ার কথা বলে আদালতে যেতে পারেন।

ইন্টারনেটের যুগে ঢুকে পড়ার পর, ফেসবুক-ব্লগ হাতের কাছে এসে যাওয়ার পর কে, কোথায় বসে, কী লিখছেন, সেটা মনিটর করা কঠিন। তবু এর প্রশ্ন ওঠে। অনলাইন সংবাদপত্রের যুগেও তো আমরা প্রবেশ করেছি। এর জন্য নীতিমালা, আইন-কানুন কিছুটা প্রণীত হয়েছে। বাকিটা প্রক্রিয়াধীন। এর ন্যায্যতা নিয়ে বিতর্ক আছে; তবু এর মধ্যে উঠে দাঁড়িয়েছে একটি আইনি কাঠামো। সভ্য নাগরিক সেটা মেনে চলবেন, এটাই তো কাম্য। বিতর্ক থাকলেও মান্য করেই সেটা করতে হবে।

চিন্তার স্বাধীনতা চর্চায় কেউ অতিউৎসাহী হলে বা স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে বেশি সক্রিয় থাকলে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ নিজেও তাকে সংযত হতে বলতে পারে। আর একে সীমা লঙ্ঘন বা আক্রমণাত্মক মনে করলে মামলা ঠুকে দিতে পারেন ব্যক্তিবিশেষ। এরই মধ্যে আমরা দেখেছি, ফেসবুকে দেশের প্রধান নির্বাহীকে নিয়ে অশিষ্ট কাজ করায় লোকজন গ্রেপ্তার হয়েছে। তাদের কারও কারও দীর্ঘ কারাবাসের দণ্ডও হয়ে গেছে, যা কিনা সর্বোচ্চ আদালতে চূড়ান্ত হবে।

এ ধরনের সুযোগ না নিয়ে যদি কেউ গুরুতর কোনো বিষয়ে বিক্ষুব্ধ হয়ে একা কিংবা দলবদ্ধভাবে কাউকে হুমকি দেন নির্যাতন বা এমনকি হত্যার, সেটা আইনত গ্রহণযোগ্য নয়। নিজ পছন্দমতো বক্তব্য প্রকাশ করতে গিয়ে অনেকে গালাগালেরও শিকার হচ্ছেন। এর সুযোগ বেড়ে গেছে অনলাইনে। আইনে এটাও অনুমোদিত নয়। কিন্তু যেখানে নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে হত্যার হুমকি প্রদানও মনে করা হচ্ছে 'অধিকারের' বিষয়, সেখানে গালাগাল তো নস্যি।

চিন্তার স্বাধীনতা প্রয়োগ করতে গিয়ে সব দেশেই মানুষ নির্যাতিত ও নিহত হয়েছে যুগে যুগে। প্রথাগত চিন্তার বেশি বাইরে চলে যাওয়ায় অনেককে দেশত্যাগীও হতে হয়। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের অভিজ্ঞতায়ও মানুষ এসব প্রত্যক্ষ করেছে। তাই শুধু একটি বিশেষ জনগোষ্ঠী ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে দায়ী করলে চলবে না। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশে চিন্তার স্বাধীনতায় বিশ্বাসী একশ্রেণির মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন একের পর এক। আইনত আক্রান্ত হওয়ার বদলে তারা আক্রান্ত হচ্ছেন দৈহিকভাবে।

সম্প্রতি একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা পুলিশ তদন্ত করছে। এফবিআইও এতে যুক্ত হয়েছে আক্রান্তরা মার্কিন নাগরিক বলে। ঘটনাটি আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে গুরুত্বের সঙ্গে এসেছিল। তাতে দেশের ভাবমূর্তিও খারাপ হয়েছে। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক মহল থেকে নতুন করে বলা হয়েছে, সরকার যেন চিন্তা তথা বাক সবাধীনতা রক্ষায় সচেষ্ট হয়। রাজনৈতিক অঙ্গনেও এটা সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে বলে তারা মনে করেন। মিডিয়ার একটি অংশও একই অভিযোগ করছে সরকারের বিরুদ্ধে।

আমাদের অর্থনীতি বড় হয়েছে এবং সেটা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে চলেছে। তাতে জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে, সন্দেহ নেই। একই সঙ্গে সমাজে অসহিষ্ণুতা বেড়েছে বললে ভুল হবে না। রাজনীতিসহ এটা প্রায় সব ক্ষেত্রে। অসহিষ্ণু মনোভাব থেকে সমানে সমানে লড়াই চলছে একদিকে; অন্যদিকে দুর্বলের ওপর হানা হচ্ছে আঘাত। চিন্তায় যারা সবল, দৈহিক শক্তিতে তাদের দুর্বল হতে দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রেই। এরা তাই আক্রান্ত হয়ে পড়েন সহজে।

এ ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তাদের সুরক্ষা দিতে পারলে ভালো হত। সেটি বাংলাদেশে অন্তত ঘটছে না। এর প্রভাব গিয়ে পড়ছে সমগোত্রীয় অন্যদের ওপর। চিন্তার স্বাধীনতা প্রয়োগে তারা দ্বিধাগ্রস্ত বা অনেক ক্ষেত্রে শঙ্কিত হয়ে পড়ছেন। এটা গণতান্ত্রিক ভাবনাচিন্তা প্রসারে, সভ্য সমাজ গঠনে হয়ে পড়তে পারে এক বড় অন্তরায়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ হলে যে কোনো সরকারেরই এটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ার কথা।

তেমন দুশ্চিন্তা থাকলে ঘটনার পেছনে নয়, আগেই ছুটতেন তারা। যারা স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের বিপরীতে হুমকি প্রদান তথা ফৌজদারি অপরাধ করছিল, তাদের নিবৃত্ত করা জরুরি ছিল শুরুতেই। সমাজ বাস্তবতা মাথায় রেখে বা রাজনৈতিক সমীকরণ বুঝে সবাই চিন্তাভাবনা প্রকাশ করবেন, এতটা আশা করা যায় না। এদের বিষয়ে ওঠা অভিযোগের তদন্তও সরকার গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি। চিন্তার স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকেও এসব 'অ্যাড্রেস' করা যায় বৈকি।

এরই মধ্যে চিন্তার অবারিত স্বাধীনতায় বিশ্বাসী কয়েকজন হতাহত হয়েছেন বলে সরকারকে এখন প্রধানত খতিয়ে দেখতে হবে, ঠিক কাদের দ্বারা তারা আক্রান্ত হলেন। হুমকিদাতারা সরাসরি জড়িত নাও থাকতে পারেন এসবে। তবে হুমকি প্রদানের সাজাও হতে হবে। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে কোনো কারণেই কাউকে হুমকি দেওয়া যায় না। কেননা এটা ভয়ের সংস্কৃতি জোরদার করে। জীবন নিয়ে ভীতিমুক্ত থাকা হল ন্যূনতম মানবাধিকার। এটা খর্ব হতে দেওয়া যায় না।

এ ক্ষেত্রে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিচারে মোহমুক্ত হতে হবে সরকারকে। কেন তিনি আক্রান্ত হয়েছেন, সেটি প্রাসঙ্গিক হলেও প্রধান বিষয় নয়। হত্যাকাণ্ড যারা ঘটিয়েছে, তাদের বিচার হতে হবে দ্রুততার সঙ্গে। এটা প্রতিষ্ঠা করা দরকার যে, কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে হত্যাসহ কোনো ধরনের ফৌজদারি দণ্ড প্রদান এবং তা কার্যকরের অধিকার দেওয়া হয়নি। এটা বরং রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করা। কারণ রাষ্ট্রই কেবল পারে বিচারিক প্রক্রিয়ায় কারও প্রাণ সংহার করতে।

কোনো কোনো রাষ্ট্র তো প্রাণদণ্ড রদ করেও দিয়েছে। একই রাষ্ট্রের মধ্যেও রয়েছে একাধিক বিধান। আমাদের দেশে মৃত্যুদণ্ড রদের সর্বশেষ ক্ষমতা রয়েছে রাষ্ট্রপতির হাতে। সরকারের পরামর্শে ক্ষেত্রবিশেষে তিনি এর প্রয়োগ ঘটান। চিন্তার স্বাধীনতা প্রয়োগের দায়ে যাকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে বা হানা হচ্ছে আঘাত, যাকে মেরেই ফেলা হচ্ছে প্রকাশ্যে বা গোপনে– 'অপরাধ' করলেও তিনি নিশ্চয়ই মৃত্যুদণ্ডযোগ্য কাজ করেননি। চিন্তার স্বাধীনতার 'অপপ্রয়োগ' ঘটালেও এদেশে তার সাজা মৃত্যুদণ্ড নয়। কম কঠিনও নয় সেটা। আর সাজা যাই হোক, ওটা কিন্তু কার্যকর হবে আদালতের মাধ্যমে।

চিন্তার স্বাধীনতায় যারা বিশ্বাসী নন বা যারা একে সীমাবদ্ধ করে দিতে চান, তারা কিন্তু নিজেদের বাকস্বাধীনতা অবারিত ভাবেন। ভিন্নমত বা ধারার মানুষকে আক্রমণ করে বক্তব্য রাখতে তাদের অনেকেই কুণ্ঠিত নন। তারা ভেবে দেখেন না, রাষ্ট্র ও সমাজে এর প্রতিক্রিয়াও তৈরি হবে। কথায় বলে, 'শত ফুল বিকশিত হোক, শত মত পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করুক'। বাস্তবে সেটা আদর্শ রূপে ঘটে না। বিরোধী বা নতুন মতের মানুষজন চিন্তাভাবনা প্রকাশে সঙ্কটে থাকেন এবং তাদের অনেকে আক্রান্তও হন।

কথা ছিল, আধুনিক রাষ্ট্র এর মাঝখানে দাঁড়িয়ে প্রতিযোগিতার পরিবেশ রক্ষা করবে এবং কাউকে দৈহিকভাবে আক্রান্ত হতে দেবে না। চিন্তার জবাব চিন্তা দিয়েই দিতে হবে, এটা নিশ্চিত করার কথা ছিল তার। কৌশলগত রাজনৈতিক বিবেচনায়ই বোধহয় সেটি দৃঢ়তার সঙ্গে করছে না রাষ্ট্র তথা সরকার। রাজনৈতিক অবস্থান নির্বিশেষে সব সরকারের ক্ষেত্রেই এটা কমবেশি প্রযোজ্য।

আমাদের রাষ্ট্রটি কতটা আধুনিক, সে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। সংবিধান কতটা গণতান্ত্রিক রয়েছে, সে প্রশ্নও অনেকে তোলেন। এও বলা যাবে, এটা অনাধুনিক রাষ্ট্র বা অগণতান্ত্রিক সংবিধান নয়। এর আওতায় চিন্তার স্বাধীনতা নিশ্চিত করার সুযোগ রয়েছে। নইলে আপন ভাবনাচিন্তা প্রকাশের জন্য পরিচিতরা নিহত হওয়ার পর তাদের দোষটাই খোঁজা হত, ঘটনার তদন্ত হত না। উঠত না বিচারের প্রশ্ন।

বিশ্বে কিছু দেশ রয়েছে, যেখানে চিন্তার স্বাধীনতা অনুপস্থিত বা খুবই সীমাবদ্ধ। বাংলাদেশ নিশ্চিতভাবেই তেমন দেশ নয়। এ সংক্রান্ত জাতিসংঘ সনদেও আমরা সই করেছি। সে কারণে বাংলাদেশে সংঘটিত কোনো কোনো ঘটনায় সর্বোচ্চ এ বিশ্ব সংস্থাও জানিয়েছে প্রতিক্রিয়া। এ সমস্ত ঘটনায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে বলে তাদের আশ্বস্তও করতে দেখা যাচ্ছে সরকারকে।

সরকার কাজের মধ্য দিয়ে তার প্রমাণ দিক। চিন্তা চর্চা করতে গিয়ে যারা দৈহিকভাবে আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের বেলায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে সরকার পারে এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে আইন সংস্কার করতে। অনেকে কিন্তু বলেন, আমাদের আইসিটি আইন বেশি কঠোর আর এটা ঠিক প্রয়োগযোগ্য নয়। যেটুকু প্রয়োগযোগ্য, ক্ষমতাহীন জনগোষ্ঠী তার সুফল নিতে পারছে না, এমন মতও রয়েছে। এ সমস্যা অবশ্য সুশাসনের অভাবের সঙ্গে সম্পর্কিত।

সুশাসনের অভাব ঘটলে আবার চিন্তার স্বাধীনতা এমনিতেই সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। এর নামে নৈরাজ্যও কাম্য নয়। কিন্তু কোনটি নৈরাজ্যকর, তা নির্ধারণ করবেন কে? ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিশ্চয়ই নয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এটা করতে পারেন আদালত। আদালত সংবিধানেরও ব্যাখ্যাদাতা। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এর আশ্রয় না নিয়ে যারা 'মুক্তচিন্তার' মানুষদের ওপর হামলে পড়ছেন, তারা আদালতের অধিকারও লঙ্ঘন করছেন কিন্তু।

একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি চিন্তার স্বাধীনতার ওপর আক্রমণকারী অভিযুক্তদের অসতর্কভাবে জামিন দেওয়ার বিষয়ে যে কঠোর মন্তব্য করেছেন, তা যেন সবাই মনে রাখি। বিষয়টি গুরুতর হিসেবে গ্রহণের ওপর তিনি জোর দিয়েছেন আসলে। রাজনীতিতে সৃষ্ট উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সামলাতে ব্যস্ত সরকারও যেন এটা মাথায় রাখে।

হাসান মামুন: সাংবাদিক, কলামিস্ট।