রাজদূতদের রাজকীয় অনাচার ও ককটেল ভবিতব্য

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 12 March 2015, 02:54 AM
Updated : 12 March 2015, 02:54 AM

বাঘা বাঘা মানুষকেও দেখি কথা বলা বা লেখার সময় যে কোনো একদিকে ঝুঁকে পড়েন। এই যে যে কোনো এক দিক, তার এক প্রান্তে আওয়ামী লীগ, আরেক প্রান্তে বিএনপি। এ দু'দিকের বাইরে যে কিছু নেই তেমন কিন্তু নয়। আছে. তবে তার চেহারা আরও ভয়াবহ। একদা আমরা যাদের 'বাম' বলতাম তারা কেউ হজ করে, কেউ তওবা করে, কেউ-বা নিজের পরিচয় ধুলায় মিশিয়ে দিয়ে ওই দুই স্রোতের যে কোনো একটিতে মিশে গেছেন। আর যাদের 'ডান' বলতাম, তারা কোনো ধানাই পানাই বা মাঝামাঝিতে নেই। তারা তাদের সাধের বিএনপি বা বোমার রাজনীতিতে মজে আছেন।

ফলে এখন যে তৃতীয় বা বিকল্প কিছু, সে জায়গাটা দখলে নিয়েছে 'সুশীল' নামের কিছু মানুষ আর মিডিয়া। এদের শিরোমণি হবার চেষ্টায় যেসব বুদ্ধিজীবী বা সফল মানুষ লাইন দেন, তাদের আসন যে কত নড়বড়ে সেটা দু'একজনকে দেখলেই টের পাওয়া যায়। এরা আসলে ওই মিডিয়া বা পাওয়ার হাউসগুলোর খেলার পুতুল।

মানবাধিকার কমিশন নামের যে সংগঠন, তার কর্তা মিজানুর রহমানের কথাই ধরুন। ভদ্রলোককে আমি মানবাধিকারের চেয়ে বেশি চিনি তাঁর পাতলুনের কারণে। ওই জাতীয় বকলেস আঁটা পাতলুন আমি প্রথম দেখি চার্লি চ্যাপলিনের পরিধানে। চার্লি মানবাধিকার কর্মী ছিলেন কিনা জানি না; তবে তিনি এবং পরবর্তী আমলে থ্রি স্টুজেস খ্যাত ছবির নায়করা সবাই ওই ধরনের পাতলুন পরে আমাদের ব্যাপক বিনোদনের যোগান দিতেন।

মিজানুর রহমান বেচারি মাঝে মাঝে কোথাও কোথাও গিয়ে চোখের জল ফেলে আর প্রধানত গোলটেবিল নামের লম্বা বা চৌকোনা টেবিলের আলোচনায় বিখ্যাত হলেও, এখন আর হালে পানি পাচ্ছেন না। যতদিন তিনি ওই দু'দলের বড়টির বিরোধিতা করেছেন আর খালেদা জিয়ার ব্যাপারে 'ধরি মাছ না ছুঁই পানি' জাতীয় কথা বলেছেন, ততদিন তিনি ছিলেন 'পাদপ্রদীপের প্রথম আলোয় উদ্ভাসিত'। যখন থেকে জঙ্গিবাদ আর রক্তপাতের কারণ বলতে শুরু করলেন, হয়ে গেলেন 'পরিত্যাজ্য'। 'বদলে যাও বদলে দাও' নামের আড়ালে বদলে যাওয়া বাংলাদেশের বাস্তবতা ধরতে পারা সুশীলদের কি আমরা আসলেই তৃতীয় শক্তি বলব? তবে এটা মানি এরা যে কারও চেয়ে শক্তিশালী।

শেখ হাসিনাকে যারা জানেন তারা একবাক্যে স্বীকার করবেন, তিনি আর যাই করুন বৈরিকে একহাত নিতে ছাড়েন না। এর একটা সুফলও আছে। আমাদের দেশের মতো গোলমেলে রাজনীতির সমাজে মাঝামাঝি মানেই আত্মসমর্পণ। বঙ্গবন্ধুকন্যা এ কাজ করেন না বলেই তাঁর বিরুদ্ধে সমালোচনার শেষ নেই। সে তিনিও কিন্তু এদের ব্যাপারে কোনো ধরনের কঠোর অ্যাকশনে যেতে পারেননি। পারবেন কীভাবে? যেদিন তিনি সংসদে এদের কাউকে আইএসআই-এর এজেন্ট সন্দেহে মত দিলেন, তার দু'একদিন পর সন্দেহভাজনকে দেখি ভারতের খাস ঘরে, মনমোহন সিংএর সঙ্গে বসে। ব্যস, কেল্লা ফতে! আমি যখন দু'ধারী তলোয়ার, তখন আমার যে দিকে ধর, হাত কাটবেই।

এসব কারণে বড় দু'দিকের বাইরে এখন আর কিছু নেই। যে কোনো সমাজে এমন অবস্থা হলে মানুষের নাভিশ্বাস উঠবে এটাই স্বাভাবিক। যতদিন ভারতে বিজেপি ছিল না, মানুষ কংগ্রেস আর বামদের ভেতর ভাগ হয়ে লড়াই করত। যখন বিজেপি এল, একটা পথ খুলল; সঙ্গে দেখা গেল সাহসে ভর করে আম জনতার দল নামেও মানুষ পাওয়ারে আসার রাস্তা তৈরি করল। যেটা আমাদের দেশে এখনও অলীক। এই অলীক অলৌকিকত্বের হাত ধরে এখন সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন লর্ড ক্লাইভের দল।

এ দেশের দু'একজন চাঁই মানুষের সঙ্গে আলাপ ও খাতিরের সুযোগ ঘটে যায় মাঝে মাঝে। তেমনি এক লেবার দলের এমপিকে একবার এখানকার একটি বিষয়ে খোলামেলা আলোচনার আহ্বান জানালে তিনি পরে জবাব দেবেন বলে এড়িয়ে গিয়েছিলেন। অনেক দিন পর লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন যে, এ দেশের রাজনীতি ও সামাজিক যে কোনো ব্যাপারে আমাদের একশবার বলার অধিকার থাকলেও বাংলাদেশের কারও কিছু করা বা বলার এখতিয়ার নেই। অর্থাৎ যা বলতে হবে বা করতে হবে তা অষ্ট্রেলিয়ান হয়েই করতে হবে। খুব খাঁটি কথা।

আমার সে অধিকার আছে। আমি এদেশের সুবোধ নাগরিক। তাছাড়া এদেশের যে মূল চেতনা, গণতন্ত্র ও উদার জীবন, আমি তার একশ ভাগ সমর্থক। জঙ্গিবাদ, জামাত আর ধর্মান্ধতার কারণে আমরা দেশত্যাগী। এমন নয় যে, কেবল নিরাপদ জীবন আর টাকার লোভে কেউ সারাজীবন বিদেশে থেকে যায়। আমাদের বেলায় সাম্প্রদায়িকতা, সামাজিক অনাচার, রাজনীতির একচোখা ব্যবহার ও মূল কারণের কয়েকটি। একজন অজি নাগরিক হিসেবে আমার বলা বা লেখার অধিকার এদেশ হাজারবার সমর্থন করে। কিন্তু অন্য কারও নাক গলানো পছন্দ করে না। আমেরিকার কথা তো না বলাই ভালো।

ফের এদের রাজদূতরা আমাদের দেশে কী করছেন? যে কোনো বৈরি সময়ে বা সুযোগমতো আমাদের ব্যাপারে এদের অতিআগ্রহ বা নাকগলানো কি আসলে কূটনৈতিক শিষ্টাচারের পর্যায়ে পড়ে? আমাদের তো এমনিতেই মেরুদণ্ড নেই। বিলেতি নামে বহুল প্রচলিত সাদা মানুষদের দেখলেই আমাদের পেছনে একটি লেজ গজিয়ে যায়। তাদের অপিসে বা বাসায় একগ্লাস সস্তা লাল ওয়াইন খেতে দিলে আমরা ধন্য হয়ে যাই। এই যে কিছুদিন আগেও বাংলাদেশে লুঙ্গি পরে রিকশা চালিয়া মাঠে-হাটে, শৌচাগার থেকে শুরু করে পানির কল অব্দি উদ্বোধন করে মিডিয়া কভারেজে থাকা মজিনা সাহেব এখন কোথায়? আমেরিকার জাতীয় মিডিয়া দূরের কথা, সাপ্তাহিক, লোক্যাল, বিনি পয়সার ট্যাবলয়েডও তাকে এক কলাম জায়গা দেবে না। অথচ কী মাতামাতি আর জয়জয়কার তার এ দেশে!

আমাদের রাজনীতিতে এখন যারা নেতা, এরা ভালো করে কথা বলতে জানেন না। ভালো করে যুক্তি-তর্ক দিয়ে কথা খণ্ডন করতে পারেন না। লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়েছেন অনেক আগে। মাথার ভেতর মানুষ ঠকানোর কুচিন্তা ছাড়া কিছু নেই। যে কারণে এরা এখন পরনির্ভর।

আমাদের সাংবাদিকতার মুখোশ খুলে সম্প্রতি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সম্পাদক মহোদয় চমৎকার একটি লেখা লিখেছেন। আমি তাঁকে বিনয়ের সঙ্গে জানাই, বাংলা কাগজের বহুত নামজাদা সাংবাদিক আর সম্পাদকেরা দু' লাইন ইংরেজি বা অন্য ভাষা পড়তে বা লিখতে জানলেও এমন সব পরিস্থিতির উদ্ভব হত না। ফলে ষড়যন্ত্র আর হিসাব-নিকাশের বাইরে এখন আর কিছু নেই।

তাতে যোগ হয়েছে জামাতিদের অর্থ, বিদেশি লবিং। খালেদা জিয়া আমাদের দেশের একজন সম্মানিত রাজনীতিবিদ। তাঁর কোনো অপমান বা ইচ্ছে করে তাঁকে কষ্ট দেওয়া আমাদের কাম্য হতে পারে না। কিন্তু যে ভদ্রমহিলা দেশের প্রধানমন্ত্রীকে ফটক থেকে বিদায় দেন, সে ফটক বিদেশি দূত আর মুখচেনা কিছু নেতার জন্য কি আপনা থেকেই খুলে যায়? কেন মিডিয়া ও দূতরা একবারও জানতে চান না যে, দিনের পর দিন অবরোধ আর হরতালের মূল রহস্য কোথায়? কেন সাধারণ গরিব মানুষের জানমাল নিয়ে এমন মশকরা?

শুনি দেশের বিপদ দেখেই নাকি তাঁরা এমন সব উদ্যেগ বা কাজকর্মে আগ্রহী হন। তাই যদি হবে সেটা গুলশানের অন্দর মহলে কেন? তাদের হাতেই যদি তুরুপের তাস, তবে কেন তারা বলেন না, দুজনেই বাইরে আসুন, আমাদের সঙ্গে বসে কথা বলুন? কেন তারা তাদের পপভাব খাটিয়ে উভয়কে একটা সমাধানে আসার পথে আনতে পারেন না? জানি বলা হবে, এটাই সে চেষ্টা। না এটা তা নয়। এটা এক ধরনের সন্দেহ আর আমাদের স্বাধীনতার প্রতি অবমাননা। আওয়ামী লীগ যেমন ভেতরের শক্তি হারিয়েছে, তেমনি বাংলাদেশও হারিয়েছে আত্মমর্যাদা। ফলে এটা এক ধরনের হুমকি আর তোয়াজ।

বিএনপি এটা জানে, একদিন তাদের ঘাড় ধরে বা ধরার কারণেই তারা আজ এ জায়গায় এবং তা আবারও হবে। তারপরও দূতদের দেখলেই আমাদের হাতজোড় হয়ে যায়। মাথা নুইয়ে আসে। এই ভয়াবহ বাস্তবতা উপমহাদেশের আর কোথাও নেই। নেই মর্যাদা হারিয়ে এমন আত্মসমর্পণ। এটা আমাদের জাতীয় জীবনের কলঙ্ক আর আমাদের সার্বভৌমত্বের জন্য চ্যালেঞ্জও বটে। সরকারের দুর্বলতা তারা জেনেও এটা নিয়ন্ত্রণ করছে না বা করতে পারছে না। সেটা তাদের ব্যর্থতার পরিচয়। আর বিএনপি ও জামাত শেষ ভরসা হিসেবে এদের পায়ে ধরে উদ্ধার চাইছে। ডুবছে আশা, ডুবছে মর্যাদা। মনে হচ্ছে আমরা আসলেই আমাদের শাসন করার অধিকার রাখি না। এই অপমানের পরও মুক্তিযুদ্ধ বা চেতনা নিয়ে গর্বকারীদের কী নামে ডাকব?

মানুষের জীবনে শান্তি ও ভালো থাকার অধিকার না থাকলে সে এদের চেয়ে খারাপ কিছুও মেনে নেবে। তাদের দোষ না দিয়ে নিজেদের বদলাতে হবে। না বদলালে একদিন সুশীল ও আলোর নামে অন্ধকারের কবলে পড়ে 'হাফ পাকি হাফ বাঙালি আর হিন্দির ককটেলে' পরিণত হব আমরা।

সে কাজ দ্রুতই এগিয়ে চলেছে দেখতে পাচ্ছি।

সিডনি; ৯ মার্চ ২০১৫