নিঃশব্দতার চাপাতি ও জীবন বাঁচাতে জীবন

মো. আনোয়ার হোসেনমো. আনোয়ার হোসেন
Published : 10 March 2015, 04:19 PM
Updated : 10 March 2015, 04:19 PM

দিনে-দুপুরে কাশিমপুর কারাগার থেকে নেওয়ার পথে ভ্যানের পুলিশ গার্ডকে খুন করে ফাঁসি ও যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত তিন দুর্ধর্ষ জঙ্গির পলায়ন; ব্লগার রাজীব হত্যায় উস্কানিদাতা হিসেবে গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গি ফারাবি শফিউর রহমানের হাইকোর্ট থেকে জামিন লাভ; পরে শিবির ক্যাডারদের নেতা এই ফারাবীরই অভিযোগে চট্টগ্রাম শহরে দুই কিশোর ব্লগার রায়হান রাহী ও উল্লাস দত্তের গ্রেপ্তার; 'লাখো কণ্ঠে সোনার বাংলা' অনুষ্ঠানে ইসলামী ব্যাংকের ভিক্ষামুষ্টি ও প্যারেড গ্রাউন্ডের সেই অনুষ্ঠানে জামায়াতি মালিকানার 'ইবনে সিনার' পক্ষ থেকে স্যালাইন প্রদান; পাবনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নির্বাচিত সভাপতি ড. মুশফিকের জঙ্গি শিবির ক্যাডারদের আক্রমণে মারাত্মক আহত হওয়ার পরও আঞ্চলিকতার ধোঁয়া তুলে মূল পরিকল্পনাকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের জামায়াতি শিক্ষকদের বাদ দিয়ে পুলিশের দুর্বল চার্জশিট প্রদান– এসব গুরুতর ঘটনার তড়িৎ প্রতিবিধান করে 'শিষ্টের পালন ও দুষ্টের দমনে' রাষ্ট্রকে খড়গহস্ত করবার জন্য স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছিলাম।

অভিজিৎ হত্যার পর ফারাবীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু ২০১৪ সালের ৩ এপ্রিলে আমার প্রকাশিত আবেদন ছাড়াও তার আগে পরে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম (আইসিএসএফ), ব্লগারস কমিউনিটি অ্যালায়েন্স, গণজাগরণ মঞ্চ, ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি এবং বিশিষ্টজনেরা কত আবেদন করেছেন সরকারের কাছে। তাতে সাড়া দিলে হয়তো বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একজন ড. অভিজিতকে জামায়াতি জঙ্গিদের চাপাতির আঘাতে জীবন দিতে হত না।

এসব ভেবে মন বড় বিষণ্ণ হল। একটু রাত হয়েছে, তারপরও স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে রিকশায় অজয় স্যারের সঙ্গে দেখা করতে রওনা হই। ১৯৬৭-৬৮, এই দু'বছর ফিজিক্স সাবসিডিয়ারিতে স্যার সরাসরি আমার শিক্ষক ছিলেন। ১৯৭০-৭১এ অজয় স্যার ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক। চলতে চলতে মন চলে যায় গত কয়েক দিনে দ্রুতলয়ে ঘটে যাওয়া নির্মম দৃশ্যাবলীতে। স্কাইপে ছেলের কাছ থেকে সংবাদটি শুনে ফুলার রোড থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে হাজির হলাম। গভীর বিষাদ, শঙ্কা ও ক্ষুব্ধতা মেশানো চেহারার মানুষজনদের দেখি ইমারজেন্সির বাইরে, ভেতরে।

ইমারজেন্সি অপারেশন কক্ষে ট্রলির উপর চিত হয়ে শুয়ে আছেন অভিজিৎ। মাথায় ব্যান্ডেজ। চাদর সরিয়ে মুখটি দেখান তরুণ ডাক্তার। ছোট্ট ঘরটির মেঝেতে শুধু রক্ত। ডাক্তার জানালেন যে, অল্প আগেই তিনি মারা গেছেন। ধারালো চাপাতির কোপে মাথার একপাশের খুলি হাড়সহ আলাদা হয়ে গিয়েছিল। মগজও বেরিয়ে এসেছিল তা দিয়ে। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হওয়ার কথা। শুধুমাত্র খুব ভালো স্বাস্থ্য বলে এখানে পৌঁছা অবধি জীবন ছিল। তাঁর স্ত্রীর মাথায়ও চাপাতির গুরুতর আঘাত ছিল। হাতের একটি আঙুল ছিল না। মাথা ও হাত থেকে রক্তে পোশাক ভিজে যাচ্ছিল। কিন্তু নিজে চিকিৎসা না নিয়ে পুরো সময় ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলেন স্বামীর পাশে। আশঙ্কা নিয়ে ডাক্তার বললেন, ''জানি না তিনি বেঁচে থাকবেন কিনা। নিউরোলজি ওয়ার্ডে নিয়ে গেছে সিটিস্ক্যান করতে।"

নিউরোলজি ওয়ার্ডটি দূরে নয়। করিডোরে অনেকের ভিড়ে অজয় স্যারকে দেখি। অভিজিতের মতো সন্তান হারিয়েছেন এই পিতা। ড. আবুল বারাকাত পাশে আছেন। স্যার ফোন করছেন নানা জায়গায়। তাঁকে জড়িয়ে ধরি। বললেন, "আনোয়ার, তুমি তো ভিসি ছিলে, প্রধানমন্ত্রীর পিএসকে ফোন কর। ওকে বাঁচাতে হলে ভালো হাসপাতালে পাঠাতে হবে।"

হায় রে, পুত্রের মৃত্যুসংবাদ তখনও তিনি জানেন না। চুপ করে থাকি। মিথ্যা আশ্বাস দিতে ইচ্ছা হয় না। ভেতর থেকে একজন একটি টুল বের করে দেয়। স্যার যেন একটু বসতে পারেন।

"ওখানে অপারেশন শেষ হয়নি? বন্যার সিটি স্ক্যান তো এখনও হল না।"

স্যারের এসব আর্ত জিজ্ঞাসায় তেমন উত্তর কেউ দেয় না। এর মধ্যে নিউরোলজির ইমারজেন্সি থেকে ট্রলি বেরিয়ে আসে। কাত হয়ে বন্যা শুয়ে আছেন। মাথায় ব্যান্ডেজ। লাল কামিজ আরও লাল হয়েছে রক্তে। নিজের ও অভিজিতের রক্ত। কেমন কুণ্ডলি পাকিয়ে শান্ত মেয়েটির মতো যেন ঘুমিয়ে পড়েছেন।

আরও মানুষজন আসছেন। অভিজিৎ আর নেই, টিভি স্ক্রলে তা দেখেই ছুটে আসছেন। মধ্যবয়সী টকটকে ফর্সা মানুষটি বারবার তাকাচ্ছিলেন আমার দিকে। বিষাদের প্রতিমূর্তি। অজয় স্যারের মতোই চেহারা।

"আপনি কি স্যারের কেউ হন?"

আমার এ জিজ্ঞাসায় ভদ্রলোক বলেন: "না না আমি আশরাফ। সেনাবাহিনীর রিটায়ার্ড ব্রিগেডিয়ার।"

তারপর চিৎকার করে বলেন: "ওই পশুরা কি জানে কাকে তারা মেরে ফেলেছে? তাঁর নখের সমান কি হতে পারবে তারা? এমন একজন মানুষ কি আর পাওয়া যাবে?"

করিডোর-ভর্তি মানুষ নির্বাক হয় সেই আহাজারি শুনে।

যখন অজয় স্যারের ফ্ল্যাটে পৌঁছেছি, তখন রাত ৯টা বেজে গেছে। শুনলাম, স্যার ঘুমিয়ে পড়েছেন। চারদিন আগে প্রায় এ সময় অভিজিৎ ও তাঁর স্ত্রী বন্যা বই মেলা থেকে বের হয়েছেন। মনে বড় একটি প্রশ্ন ছিল। খোলাখুলি ব্লগে জানান দিয়ে ফারাবীর মতো জঙ্গিরা তাঁর মৃত্যু পরোয়ানা ঘোষণা করেছে। মায়ের সঙ্গে দেখা করবেন এবং বই মেলা ঘুরে যাবেন, তার জন্য পুত্র ও পুত্রবধূর দেশে আসবার পরিকল্পনা শুনে পিতা অজয় রায় বলেছেন দেশে অবরোধ-হরতালে মানুষের করুণ মৃত্যুর কথা, দুঃসময়ের কথা এবং তাই সম্ভব হলে যাত্রা স্থগিত করার কথা। তাহলে কোন বিবেচনায় অভিজিৎ ও বন্যা এত রাত করে হেঁটে বই মেলা থেকে ফিরছিলেন? আমার এমন কথায় অভিজিতের ছোট ভাই ও তার স্ত্রী জানালেন ভিন্ন কথা।

"ওরা সাবধানেই চলাফেরা করত। গাড়ি করে মেলায় যেত। সেদিনও অল্প দূরেই তাদের গাড়ি পার্ক করা ছিল।"

রাজু ভাস্কর্যের উত্তর কোনায় যেখানে ডা. মিলনের স্মৃতি ভাস্কর্যটি আছে, তার উল্টোদিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘেঁষে ফুটপাতটি ঘাতকরা বেছে নিয়েছিল। এখানে ফুটপাত একটু বাঁকা হয়ে একটা ব্লাইন্ড স্পট তৈরি করেছে। একদম কাছে উদ্যানের প্রবেশপথের বাম পাশের বটগাছটির নিচে অপেক্ষমান পুলিশের দৃষ্টির আড়ালে পড়ে গেছে ঘাতকদের বেছে নেওয়া ব্লাইন্ড স্পট। ঘাতকরা নিশ্চয়ই অভিজিতকে অনুসরণ করেছে। দেখেছে কোথায় তার গাড়িটি পার্ক করা ছিল। তার অদূরেই ব্লাইন্ড স্পটে তারা অপেক্ষা করেছে।

ওরা কি শুধু দু'জন ছিল, যারা চাপাতির কোপে অভিজিতের মাথার খুলির কিছু অংশ কেটে ফেলেছিল? তা নিশ্চয়ই নয়। মোবাইলে অপেক্ষমান ঘাতকেরা বার্তা পেয়েছে, টার্গেট এগিয়ে আসছে। শব্দ-সৃষ্টিকারী আগ্নেয়াস্ত্র তারা ব্যবহার করেনি। প্রশিক্ষিত পাকা হাতে মাথায় চাপাতির নিঃশব্দ আঘাতে মৃত্যু নিশ্চিত করে সরে পড়েছে দ্রুত। যতদূর জানা গেছে, একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। অন্যজন একই ফুটপাত ধরে মানুষের ভিড়ে। আর অল্প কিছুদূর। তারপরই অভিজিৎ ও বন্যা হয়তো পার্ক করা গাড়িতে উঠে বসতে পারতেন। সে সুযোগ দেয়নি ঘাতকেরা।

'বাংলার চোখ' ফটো এজেন্সির তরুণ ফটো সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম জীবন। মাত্র ছ'মাস হল সে এ পেশায় ঢুকেছে। তার তোলা ছবিটি নিয়ে কথা হল। রক্তে ভেজা বন্যা দাঁড়িয়ে আছেন। তার সামনে উপুড় হয়ে পড়ে আছেন স্বামী ও সাথী অভিজিৎ। খুলির একটি অংশ নেই। কিছু মানুষ হাঁটাচলা করছে। যেন কিছুই হয়নি। ডয়েশ ভ্যালে টিভি চ্যানেলে প্রচারিত ফুটেজে দেখলাম মধ্যবয়সী বাঙালি মহিলা দারুণ ক্ষোভে বলছিলেন: ''চিৎকার করে বলেছি, ওদের ধরেন। কেউ আগায় আসে নাই।"

ওই ঘাতক দু'জনের চারপাশে যারা ছিল, তারা হয়তো ওদের দলেরই। এও শোনা গেছে, স্পটের কাছাকাছি অস্থায়ী ক'টি দোকানও জঙ্গি জামায়াতি সংগঠনের।

কথা হয়েছিল জীবনের সঙ্গে। সে ও তার বন্ধু, 'ফোকাস বাংলা'র ফটো সাংবাদিক রহমান সেদিনের কাজ শেষে স্পটের কাছেই উদ্যানের বেষ্টনির ওপাশে চা খাচ্ছিল। এক নারীর আর্তচিৎকার শোনে তারা। বেষ্টনির গ্রিলের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে ফুটপাতের পাশে রাখা একটি মটর সাইকেলের উপর এক নারীকে তারা পড়ে থাকতে দেখে। ফুটপাতেও একজন পুরুষ উপুড় হয়ে পড়ে আছে। রক্তে ভেজা ফুটপাত। উদ্যানের গেট দিয়ে বেরিয়ে স্পটের কাছে আসে তারা। রহমানের অভিজ্ঞতা মাত্র তিন মাসের। ফটো সাংবাদিকতার প্রশিক্ষণে শেখানো হয়েছে, তাদের কাজ হল ঘটনার ছবি তোলা, তাতে জড়িয়ে পড়া নয়, বিপন্নজনকে বাঁচানোও নয়। রহমান তাই করেছিল। দুটো ছবি তুলে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেছিল দ্রুত।

জীবন তা করতে পারেনি। সে দেখেছে একেবারে কাছে দাঁড়ানো পুলিশ বা পথচারী কেউ সাহায্যে এগিয়ে আসছে না। এর মধ্যে পড়ে থাকা নারী উঠে বসেছেন।

"আমি তার হাত ধরে বলি, চলেন। তিনি আমার দিকে তাকান। এমন ভয়ংকর দৃষ্টি আমি কখনও দেখিনি। তার মাথা থেকে রক্ত পড়ছিল।''

'কড়ির মতন সাদা মুখ তার, দুইখানি হাত তার হিম;

চোখে তার হিজল কাঠের রক্তিম চিতা জ্বলে।'

জীবনের কথা শুনে জীবনানন্দ দাশের কবিতার চরণ মনে পড়ল। জীবন জানায়, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সে নারী উঠে দাঁড়ালেন। যেন এক ঘোরের মধ্যে আছেন তিনি।

"কী হয়েছে, কে পড়ে আছে"– সম্মোহিতের মতো কথা বলছিলেন রক্তে ভেজা সেই নারী।

"কোপাইছে"– কেউ একজন বলে।

"অভিজিৎ, ওঠো।"

উপুড় হয়ে পড়ে থাকা মানুষটির শরীর একটু কেঁপে ওঠে। বেঁচে আছেন অভিজিৎ। তাকে ওঠাতে চেষ্টা করেন নারী।

"আপনারা একটু আসেন, ধরেন।"

নারীর এই আর্ত আবেদনে কেউ সাড়া দেয় না। কাছে দাঁড়ানো পুলিশও এগিয়ে আসে না। জীবন তার প্রশিক্ষণের কঠোর অনুশাসন বিস্মৃত হয়। সিদ্ধান্ত নেয় সে। দ্রুত ছবি তোলা দরকার। পড়ে থাকা মানুষটিকে হাসপাতালে নেওয়া দরকার।

"স্যার, মুহূর্তে তিনটা ক্লিক করি। তার দুটোতে ছবি ওঠে। একটি আউট অব ফোকাস হয়ে যায়।"

জীবন কাজে নেমে পড়ে। পুলিশ বা অন্য কেউ এগিয়ে আসে না।

"আপু, একটা হাত ধরেন।"

আরেক হাত ধরে জীবন তাকে ওঠাতে চেষ্টা করে। এবার কয়েকজন পথচারী এগিয়ে আসেন। একটা সিএনজি বড় দরকার। বহু মানুষ জড়ো হয়েছে। কেউ সিএনজি ডাকে না। অভিজিতকে ছেড়ে জীবন ছুটে যায় রাস্তায়। প্রচণ্ড গতিতে ছুটে আসা সিএনজির সামনে দাঁড়ায় দু'হাত প্রসারিত করে। এক অনুরোধেই দুজন আরোহী নেমে যান। এবার নানা মতামত আসতে থাকে। সিএনজিতে এমন দীর্ঘদেহী মানুষকে ওঠানো যাবে না। এসব গবেষণায় মূল্যবান কিছু সময় নষ্ট হয়। জীবন ভাবে, রাস্তা থেকে সিএনজিতে করেই তো আহতদের হাসপাতালে নেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত তাই হয়। অভিজিতের পা দুটো অবশ্য বাইরেই থাকে।

"মাঝখানে বসা আপু তাকে দু'হাতে ধরে রাখেন। কিন্তু তার মাথা আমার কাঁধে এসে পড়ে। কাটা খুলির ধারালো প্রান্ত আমার কাঁধে খোঁচা দিচ্ছিল। রক্ত ও মগজে আমার টি শার্ট মাখামাখি। এক হাতের তালু দিয়ে আমি খুলির খোলা জায়গাটা চাপ দিয়ে রাখছিলাম যাতে ঘিলু আর না বেরোয়।"

এরপর এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা বলে জীবন।

"সিএনজি ভুল কইরা বাংলা একাডেমীর রাস্তায় ঢুইকা পড়ে। 'কে আপনি, আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?' আপু চিৎকার কইরা বলেন। যতই বলি ঢাকা মেডিকেলে, আমার কোনো কথা বিশ্বাস করেন না। ড্রাইভারকে বলেন থামাতে। সিএনজির বন্ধ গ্রিলে হাত দিয়া বাড়ি দিতে থাকেন আপু। পাগলের মতো আমাকে বলতে থাকেন, 'প্লিজ আমাকে মারবেন না। ছেড়ে দেন।' রাস্তায় তখন অনেক মানুষ। আপুর চিৎকার শুনে পাবলিক সিএনজি থামাইতে পারত। আমি কিডন্যাপ কইরা নিয়া যাইতেছি, এইটা মনে করতে পারত। গণপিটুনির কবলে পড়তে পারতাম আমি। ভাগ্য ভালো, মোটর বাইকে পিছনে আসছিল পুলিশ। দোয়েল চত্বরের আগের গেইটে দাঁড়ানো পুলিশ আমাদের থামায়। সব শুনে আমাদের যাইতে দেয়। স্যার, মেডিকেলের ইমারজেন্সিতে কম ঝামেলা হয় নাই। আমারেই সন্দেহ করে অনেকে। এইসব কারণেই হয়তো অফিস আমাদের ঝক্কি-ঝামেলায় জড়াইতে না করে।"

তারপরও ঝক্কি-ঝামেলায় জীবন জড়িয়ে ছিলেন। তার কথা এ লেখার শেষে আবার একটু বলব।

বসার ঘরে স্যারের অপেক্ষায় বসে থাকার সময় জীবনের কথাগুলো মনে পড়ে গিয়েছিল। পাশের ঘর থেকে স্যার এলেন। বললেন: "একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।"

তাঁর চেহারা শান্ত, সমাহিত। যেমনটা সব সময় দেখে এসেছি। উজ্জ্বল ফর্সা মায়াময় মুখে মৃদু হাসিটি এখনও আছে। ভাবলাম, কেমন করে তা সম্ভব!

"প্রধানমন্ত্রী পরদিন ফোন করেছিলেন বাবাকে। অনেকক্ষণ কথা বলেছেন।"

অভিজিতের ছোট ভাইয়ের স্ত্রীর মুখে এ কথা শুনে ভালো লাগে। মনে প্রশ্ন ছিল, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা নিহত ব্লগার রাজীবের বাড়িতে গিয়ে পিতামাতাকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, রাজীব দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ। কিন্তু অভিজিতের মৃত্যুর পর তেমন কোনে সংবাদ দেখিনি। প্রধানমন্ত্রীর ফোনের কথা শুনে বলি: "কই, গণমাধ্যমে তো এ খবর আসেনি।"

আমার এ কথা শুনে একটু ক্ষুব্ধ হন তারা, "সে জানাবার দায়িত্ব তো আমাদের নয়।"

সত্যিই তো, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর আছে, প্রেস সচিব ও উপদেষ্টারা আছেন। তাদেরই তো জানাবার কথা। আরও অবাক হই এ কথা শুনে যে, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এবং বিমান ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বাসায় এসে সমবেদনা জানিয়ে গেছেন। গণমাধ্যমে তা প্রচারিত হয়নি।

"প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমার ছাত্রীসম। তাঁর কাছে আকুল আবেদন, লক্ষ শহীদের রক্তে অর্জিত বাংলাদেশে ঘাতক জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিন, এদের হাত থেকে আমাদের বাঁচান।"

ঘাতক জঙ্গিদের প্রচারণা এবং শেষ পর্যন্ত তাদের হাতে অভিজিতের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর শিক্ষকসম অধ্যাপক অজয় রায়কে প্রধানমন্ত্রী সমবেদনা জানাবেন, এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু বিস্ময়ের এবং আতঙ্কের কথা, সে সংবাদ পর্যন্ত জনগণকে জানানো হল না! চারজন আলোকিত মন্ত্রী তাঁর বাসায় এলেন, কিন্তু সে সংবাদ গোপন রাখা হল। কী ভেবেছেন তাঁরা? এতে তারা বেঁচে যাবেন ওই জামায়াতি ঘাতকদের হাত থেকে? নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বা ১৪ দলের ভোট কমে যাবে?

'নিঃশব্দতার চাপাতি'– হিমশীতল এই কথা কেন মনে এল? কী বার্তা দিতে চান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বা তাঁর আলোকিত মন্ত্রীগণ? তাঁরা কি বিস্মৃত হয়েছেন দূর এবং নিকট অতীতের কথা? বঙ্গবন্ধুর 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'র কথা?

'৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের কথা বলছেন বঙ্গবন্ধু। গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে মুসলিম লীগের প্রার্থী ওয়াহিদুজ্জামান। বহু অর্থের মালিক তিনি। বঙ্গবন্ধু বলছেন, "বেশি টাকা খরচ করার সামর্থ্য আমার ছিল না।"

নিতান্ত গরিব জনসাধারণ ও ছাত্র ও যুবক কর্মীরা নিজেদের টাকা খরচ করে বঙ্গবন্ধুর জন্য কাজ শুরু করে।

"কয়েকটি সভায় বক্তৃতা করে বুঝতে পারলাম, ওয়াহিদুজ্জামান সাহেব শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করবেন। … জামান সাহেব ও মুসলিম লীগ যখন দেখতে পারলেন তাদের অবস্থা ভালো নয়, তখন এক দাবার ঘুঁটি চাললেন। অনেক বড় বড় আলেম, পীর ও মওলানা সাহেবদের হাজির করলেন। … 'আমাকে ভোট দিলে ইসলাম থাকবে না, ধর্ম শেষ হয়ে যাবে।' শর্ষীনার পীর সাহেব, বরগুনার পীর সাহেব, শিবপুরের পীর সাহেব, রহমতপুরের শাহ সাহেব সকলেই আমার বিরুদ্ধে যত রকম ফতোয়া দেওয়া যায় তা দিতে কৃপণতা করলেন না।"

বঙ্গবন্ধু আরও জানান কীভাবে সরকারি প্রশাসন ও পুলিশ খোলাখুলি মুসলিম লীগ প্রার্থীর জন্য কাজ করেছিল। তারপরও ওয়াহিদুজ্জামানের বিরুদ্ধে ১০ হাজার ভোটের ব্যবধানে বঙ্গবন্ধু জয়ী হয়েছিলেন। নির্বাচনে পুরো পূর্ব পাকিস্তানের চিত্র ছিল একই। এ থেকে বঙ্গবন্ধু যে গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক শিক্ষাটি পেয়েছিলেন তা তিনি বিবৃত করেছেন এভাবে:

"এই নির্বাচনে একটা জিনিস লক্ষ্য করা গেছে যে, জনগণকে 'ইসলাম ও মুসলমানের নামে' স্লোগান দিয়ে ধোঁকা দেওয়া যায় না। ধর্মপ্রাণ বাঙালি মুসলমানরা তাদের ধর্মকে ভালবাসে; কিন্তু ধর্মের নামে ধোঁকা দিয়ে রাজনৈতিক কার্যসিদ্ধি করতে তারা দিবে না, এ ধারণা অনেকের হয়েছিল। জনসাধারণ চায় শোষণহীন সমাজ এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি।"

(অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ২৫৫-২৫৮)

'৫৪ সালের এই অভিজ্ঞতার আরও উজ্জ্বল নিদর্শন '৭০এর নির্বাচন ও '৭১এর মুক্তিযুদ্ধ। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমানের ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থানের সেই সব গৌরবময় অতীত কী নির্দ্বিধায় আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক নেতারা ভুলে বসেছেন! বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা কি ভুলে গেছেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ইসলামের নামে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দালালদের গণহত্যার বিরুদ্ধে জাতির পিতার আহ্বানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ মুক্তিযুদ্ধে সামিল হয়েছিল; বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতে তাঁর নামটি জপ করেই জীবন দিয়েছিল অকাতরে এবং স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল? 'আমরা সবাই এদেশের সন্তান', এই বিশ্বাসে একত্র হয়েছিল হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-আদিবাসীরা। তারই ফসল আমাদের সংবিধান যাতে চার মৌলনীতির একটি ধর্মনিরপেক্ষতা।

উইকিলিকসএ প্রকাশিত ফেব্রুয়ারি ২০০৮ সালের এক তারবার্তায় মার্কিন দূতাবাসের তৎকালীন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স গীতা পাসি জানাচ্ছেন:

At the meeting, Acting Awami League Secretary General Syed Ashraful Islam reiterated his party's position that Jamaat should be banned because it is a party of "war criminals.

এই বক্তব্য যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে দেখা যাচ্ছে সরকার গঠনের আগে আওয়ামী লীগের পরিষ্কার অবস্থান ছিল জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা। ২০১৫ সালে দাঁড়িয়ে কি সেই বাস্তবতা বদলে গেছে? জামায়াত শুধু যুদ্ধাপরাধী সংগঠন নয়, সন্ত্রাসী সংগঠনও বটে। এই দলের সরাসরি যোগাযোগ জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), হরকাতুল জিহাদ আল ইসলাম (হুজি), হিজবুত তাহরীর, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সঙ্গে। অথচ জামায়াতকে আজও নিষিদ্ধ করা সম্ভব হয়নি।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যে হারিয়ে যায়নি, তা তো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল শাহবাগে জাতীয় পুনর্জাগরণে জেগে ওঠা নতুন প্রজন্ম। তারা সরাসরি দাবি জানিয়েছে যে, জামায়াত-ই-ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা হোক। তাহলে কেন এই দ্বিধা, এই ভয়?

নিঃশব্দের চাপাতি কি শুধু রাজনৈতিক নেতারা প্রদর্শন করছেন। না, তা নয় অবশ্যই। অভিজিতের মৃত্যুর পর কী করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়? যে শিক্ষক সমিতির গোটা কার্যকর পরিষদে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শিক্ষকরা রয়েছেন, অভিজিতের নির্মম মৃত্যুতে তারা কোনো কর্মসূচি নেওয়া তো দূরের কথা, একটি বিবৃতি পর্যন্ত দিতে পারেননি! যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অতীতে জাতিকে, রাজনীতিবিদদের দিকনির্দেশনা দিত, আজ তাদের এই পরিণতি? নিঃশব্দতার চাপাতি তাদেরও হাতে। মাছের পচন শুরু হয় মাথা থেকে। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের দারিদ্র্য, সেখানে তা যে পরিব্যাপ্ত হবে সর্বত্র, তাতে সন্দেহ কী?

তাই আমরা দেখি জঙ্গিদের চাপাতির আঘাতে অভিজিতের মৃত্যুর পর ছাত্রলীগ দায়সারা গোছের কর্মসূচি পালন করে দায়িত্ব শেষ করে। অতীতে যেখানে ছাত্র সংগঠন রাজনৈতিক দল ও তাঁর নেতাদের সামনে হাজির করতে পারত উচ্চতর কর্মসূচি, বাধ্যও করত তা বাস্তবায়নে, সেখানে আজ ছাত্রনেতারা তাকিয়ে থাকে রাজনৈতিক নেতাদের ভাবনার দিকে। বিশ্বস্ত লেজুড়ের মতো তাদের নির্দেশ তালিম করে যায় তারা।

অন্যদিকে, অভিজিৎ হত্যার প্রতিবাদে প্রগতিশীল ছাত্র জোটের ডাকা ধর্মঘট কতটুকু প্রগতিশীল? বাস্তবে এ ধরনের লোকদেখানো কর্মসূচির জামায়াত-শিবির-হিজবুত তাহরীর-আনসারুল্রাহ বাংলা টিমকে ফুলের টোকা দেওয়ারও ক্ষমতাও নেই। সময় নষ্ট না করে জঙ্গিদের তালিকা তৈরি করে তা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দাও। সময়ের সদ্ব্যবহার হবে। সংগঠিত হয়ে হাজির হও শিবিরের আস্তানায়। তাদের তুলে দাও পুলিশের হাতে।

বাংলাদেশের বাম সংগঠনগুলোর গৌরবময় সংগ্রামের ইতিহাস আছে। তাদের বর্তমান অবস্থাটি কী? ওয়ার্কার্স পার্টি এবং জাসদ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকারের অংশ। তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু তাদের দলের উচ্চতর কর্মসূচি কোথায় যা দিয়ে তারা আওয়ামী লীগ ও সরকারকে আলোকিত করতে পারেন, যা তাঁরা পারতেন এরশাদবিরোধী মোর্চাবদ্ধ আন্দোলনের সময়? এখন আওয়ামী লীগের মন্ত্রীদের মতো তাঁরাও অভিজিতের পিতাকে সমবেদনা জানাতে তাঁর বাসায় যান, কিন্তু তা প্রকাশে দ্বিধাগ্রস্ত থাকেন!

সিপিবি ও বাসদের অবস্থা আরও করুণ। এ দুটো দলের মেধাবী সভাপতিগণ টিভি চ্যানেলের টকশোতে অধিক ব্যস্ত আছেন। দেশের এই দুঃসময়ে তাঁরা বহু সময় ব্যয় করেন এই তত্ত্বকথা বোঝাতে যে, বিএনপি ও জামায়াত এক নয়। বেগম খালেদা জিয়া ঘোষিত অবরোধ-হরতালের মধ্যে গণতান্ত্রিক লক্ষ্য তাঁরা খোঁজেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে শুধু ১৯/২০ পার্থক্য দেখেন। বেগম খালেদা জিয়াকে স্পষ্ট বলতে পারেন না যে, প্রথমে অবরোধ-হরতাল প্রত্যাহার করুন। সংলাপের কথা হবে পরে।

অবাক বিস্ময়ের কথা, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এই তত্ত্ব দেন যে, অবরোধ-হরতালের সঙ্গে অভিজিতের হত্যা এক করা যাবে না। এর মধ্য দিয়ে তিনি হয়তো বোঝাতে চান যে, বেগম খালেদা জিয়া-তারেক জিয়া-জামায়াতের লক্ষ্য ইসলামি জঙ্গিদের থেকে আলাদা।

শিক্ষক ও সুশীলদেরও একই অবস্থা। সামান্য প্রাপ্তির জন্য তারা কোথায় নামতে পারেন মান্না ও খোকার ফাঁস ফোনালাপ থেকে তা একেবারে খোলা হয়ে যায়। তাই দেখি নাগরিক উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত সুশীলরা ধর্মীয় জঙ্গিদের হাতে অভিজিতের হত্যার বিষয়ে রাজনীতিবিদের মতোই নিঃশব্দ থাকেন। আরও গুরুতর কথা, জামায়াত-বিএনপির কাতারে নেমে গিয়ে ক্ষমতার জন্য মানুষ পুড়িয়ে মারার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন সুশীলদের মুখপাত্র মাহমুদুর রহমান মান্না। নিঃশব্দতার চাপাতি তাই আজ সর্বব্যাপী।

আজ দেশ ও জনগণের মূল শত্রু ধর্মীয় মৌলবাদ ও তাদের জঙ্গি সহিংসতা। জামায়াতে ইসলামী তার পরিকল্পনাকারী। বিএনপির সভাপতি বেগম খালেদা জিয়া এবং তার পুত্র তারেক জিয়া সে ষড়যন্ত্রে সামিল আছেন। নানা জঙ্গি সংগঠনের নামে এরা একের পর এক আঘাত করে চলেছে মানবতার উপর। তাদের চাপাতির আঘাতে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ, অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনুস, অধ্যাপক এম তাহের, অধ্যাপক একেএম শফিউল ইসলাম লিলন, প্রভাষক জিয়াউদ্দিন জাকারিয়া, আহমেদ রাজীব হায়দার, আশরাফুল আলম, আরিফ রায়হান দ্বীপ, মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী, জগত জ্যোতি তালুকদার, জাফর মুন্সী, ড অভিজিতরা জীবন দিচ্ছেন।

আমাদের চোখের সামনে একের পর এক ঘটে যাওয়া এসব মৃত্যু আমরা অবলীলায় ঘটতে দিচ্ছি আমরা। ঘুমিয়ে আছি এই জন্য যে, 'ঘুম ভাঙলেই পাবে ভূতের ভয়।' কিন্তু চোখ বন্ধ করে রাখলেই প্রলয় বন্ধ হবে না। ফুলের মালা দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা যতই জামায়াত নেতাদের নিজ দলভুক্ত করুন না কেন, তাদের চাপাতি ও পেট্রোল বোমার হাত থেকে তারা রক্ষা পাবেন না। খবর নিয়ে দেখুন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত কত অসংখ্য নেতা-কর্মী ও শুভানুধ্যায়ী জামায়াত-শিবির ও তাদের নানা ঘাতক সংগঠনের হাতে জীবন দিয়েছেন। এও খবর নিন, এদের মূল টার্গেট বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। অতীতেও ছিলেন, এখনও আছেন। অভিজিতের পিতাকে জানানো সমবেদনা গোপন রাখলেও তার হেরফের হবে না। সে কারণেই নিঃশব্দতার চাপাতি হিমশীতল, ভয়াবহ।

কে মৌলবাদী ধর্মীয় জঙ্গি গোষ্ঠীর হাত থেকে দেশবাসীকে বাঁচাতে পারে? বাস্তব নিখাদ সত্য হল, একমাত্র বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাই তা পারেন। যিনি আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি, জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরোয়া না করে কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করতে পারেন, তিনিই তো যথার্থ অর্থে সেই রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়ক যিনি সংকটে সেই রাজনৈতিক দৃঢ়তা দেখাতে পারবেন। একবার, দু'বার নয়, গত পঁয়ত্রিশ বছর ধরে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে, সংসদে বিরোধী দলের নেত্রী বা সরকার প্রধান হিসেবে, কারাগারের ভেতরে কিংবা বাইরে শেখ হাসিনা সঙ্কট মোকাবেলায় রাজনৈতিক দৃঢ়তা ও দূরদৃষ্টি দেখিয়েছেন। ১৯৭০ সালের পর ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে আরও এক নির্ধারক নির্বাচনী বিজয়ের মধ্য দিয়ে ক্ষত-বিক্ষত সংবিধানটি কিছু সীমাবদ্ধতাসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ফসলে ফিরিয়ে এনেছেন। সরকার গঠনের মাত্র এক মাসের মাথায় বিডিআর হত্যাকাণ্ড দুর্দমনীয় সাহসের সঙ্গে মোকাবেলা করে জামায়াত-বিএনপির ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়েছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অনুষ্ঠান ও রায় কার্যকর করার দৃঢ়তা দেখিয়েছেন। ২০১৩ সালের ৫-৬ মে শাপলা চত্বরে সমবেত হেফাজত-জামায়াত-বিএনপির জঙ্গি আক্রমণে ক্ষমতা দখলের নীলনকশা অকার্যকর করেছেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির আগে ও পরে বিএনপি-জামায়াত-হেফাজতসৃষ্ট ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের হাত থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করে তাকে এক অপার সম্ভাবনার দেশে পরিণত করতে চলেছেন। সর্বশেষ, সরকার পতনের লক্ষ্যে বেগম খালেদা জিয়া ঘোষিত দীর্ঘ-প্রলম্বিত অবরোধ-হরতাল অন্তঃসারশূন্য ও অকার্যকর করে দিয়েছেন।

সেই শেখ হাসিনাই পারবেন ওই রাজনৈতিক দৃঢ়তা, সাহস ও দূরদৃষ্টি প্রদর্শন করতে যা দিয়ে বাংলাদেশে ধর্মীয় জঙ্গি মৌলবাদ কার্যকরভাবে নির্মূল করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের উপলব্ধি, বিশ্বাস ও দৃঢ়তা তাঁকে প্রতিনিয়ত সাহস ও অনুপ্রেরণা জোগাবে। আজ পৃথিবীজুড়ে ধর্মীয় জঙ্গিবাদের আঘাতে ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে পড়া মানবতা, আইএস জঙ্গিদের হাতুড়ির আঘাতে গুড়িয়ে যাওয়া সমৃদ্ধ অতীতের ইতিহাস-ঐতিহ্যের করুণ পরিণতির এই দুঃসময়ে বাংলাদেশকে খালেদা জিয়া-তারেক জিয়া-জামায়াতের একই জঙ্গি ষড়যন্ত্রের হাত থেকে রক্ষা করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় চালিত করতে পারেন একমাত্র শেখ হাসিনা।

দেশের সত্যিকার সুশীল সমাজের কর্তব্য হচ্ছে এই বাস্তবতা স্বীকার করে শেখ হাসিনার পেছনে কাতারবন্দি হওয়া। তা হতে পারলেই দেশের আলোকিত অংশ সেই নৈতিক বিবেকের জায়গাটি ফিরে পাবেন যার উপর দাঁড়িয়ে নিঃশব্দতার চাপাতির ভার থেকে শেখ হাসিনা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক রাজনৈতিক শক্তিকে মুক্ত করতে নিঃশঙ্ক সমালোচনায় তাঁরা ব্রতী হতে পারবেন। আমরা সবাই যে অতল গিরিখাদের একেবারে কিনারায় দাঁড়িয়ে আছি, তা থেকে উদ্ধার পেতে আর কোনো বিকল্প আমাদের সামনে নেই।

'অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ,

যারা অন্ধ, সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা;

যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই-প্রীতি নেই-করুণার আলোড়ন নেই

পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।

যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি,

এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়

মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা

শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।'

জীবনানন্দ দাশের এই কবিতার প্রতিটি কথা আজকের বাংলাদেশের এই সময়, তার সুশীল সমাজ এবং শকুন ও শেয়ালের হাতে অভিজিতের মতো মানুষদের মৃত্যুর সঙ্গে কতই না সায়ুজ্যপূর্ণ। কিন্তু জীবনেরা আছে। তার কথা দিয়ে শেষ করি। 'অদ্ভুত আঁধারে' পথ দেখিয়েছে জীবন। জীবন বাঁচাতে সে এগিয়ে এসেছে। আমাদের ভয় কী?


ড. মো. আনোয়ার হোসেন:
অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।