নারীর ক্ষমতায়নেই মানবতার অগ্রগতি

ধীরাজ কুমার নাথ
Published : 8 March 2015, 07:17 AM
Updated : 8 March 2015, 07:17 AM

বিশ্ব নারী দিবস, ২০১৫ উৎযাপিত হচ্ছে বিশ্বব্যাপী অনেক প্রতিশ্রুতি ও প্রত্যয় নিয়ে। সর্বত্র একই কথা উচ্চারিত হচ্ছে, একই কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হচ্ছে, যার মূল বার্তা, নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে মানবতার উন্নয়ন এবং সভ্যতার সার্বিক অগ্রগতির ধারক ও বাহক। এখনই আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে নারীর ক্ষমতায়ন দরকার, মানবতা সুপ্রতিষ্ঠিত করার বৃহত্তর স্বার্থে।

নারীর ক্ষমতায়নের দাবি উচ্চারিত হয়ে আসছে ১৯১১ সাল থেকে। এটি প্রতিষ্ঠার বার্তা নিয়ে বিশ্বব্যাপী আন্দোলনের ১০৪ বছর অতিক্রান্ত হল। ১৯৯৪ সালে কায়রোতে অনুষ্ঠিত জনসংখ্যা ও উন্নয়ন শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলন এবং ১৯৯৫ সালের বেইজিং সম্মেলন হচ্ছে এ লক্ষ্যে অন্যতম মাইল ফলক। এসব সম্মেলনের মাধ্যমে ঘোষিত হয়েছে সকল কাজে নারীদের সম্পৃক্ত করার কথা, প্রজনন স্বাস্থ্যসেবায় প্রাধিকারের প্রশ্ন। কারণ, এ সব হচ্ছে নারীর অধিকার। নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য, নিপীড়ন ও নির্যাতন বিলোপ করতে হবে, এ হচ্ছে প্রতিজ্ঞা, যার প্রতিপালন করবে বিশ্বের প্রতিটি দেশ।

বাংলাদেশের সংবিধান নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নে শুরু থেকেই সোচ্চার। সংবিধানের ২৮(২) অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে: "রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন।"

একই সঙ্গে ২৮(৪) অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে: "নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যে কোনো অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।"

সংবিধানে এমন একটি অনুচ্ছেদের সংযোজন নারীদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাবোধ এবং জীবনের সকল স্তরে তাদের অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করার প্রতি গভীর প্রত্যয়ের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। লক্ষ্যণীয় যে, বাংলাদেশে এখন রাষ্ট্রপরিচালনার নানা ক্ষেত্রে– যেমন, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেতা, জাতীয় সংসদের স্পিকার– সবাই নারী। এছাড়া শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাণিজ্যিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের নারীদের অবস্থান বিশ্ববাপী অভিনন্দিত হয়েছে। ফলশ্রুতিতে, গ্লোবাল জেন্ডার ইনডেক্স, ২০১৪ অনুসারে ১৪২ দেশের মধ্যে লিঙ্গ বৈষম্য নিবারণে বাংলাদেশের অবস্থান ৬৮, যা ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও নেপালের অনেক উর্ধ্বে।

বাংলাদেশের সংবিধানে নারীর ক্ষমতায়নের অনুচ্ছেদ সংযোজন ছাড়াও বাংলাদেশ সরকার অনেক আইন বা বিধিমালা প্রণয়ন করেছে যা নারীর ক্ষমতায়ন সুনিশ্চিত করতে পারে। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, মহিলা ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ আইন ২০০০, জাতীয় শিশুনীতি ২০১১, মাতৃস্বাস্থ্য কৌশলপত্র ২০০১, পারিবারিক নির্যাতন (প্রতিরোধ ও সংরক্ষণ) আইন ২০১০, জাতীয় এসিডজনিত অপরাধ প্রতিরোধ আইন (সংশোধন) ২০১০, মহিলা ও শিশু নির্যাতন নিবারণে জাতীয় কর্মসূচি পরিকল্পনা (২০১৩-২০২৫), জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি ২০১১, জাতীয় পরিবার পরিকল্পনা নীতি ২০১০ ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

এ সব আইন ও বিধিমালা ছাড়াও সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রবল জনমত এবং প্রতিরোধ সৃষ্টিতে বাংলাদেশে প্রচুর কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়েছে এবং নিত্যনতুন কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে। বর্তমানে প্রায় সর্বত্র একটি আন্দোলন হিসেবে নারীর ক্ষমতায়নের সপক্ষে জনমত সৃষ্টি হয়েছে। ফলে বাংলাদেশে বর্তমানে নারীর গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ৭১.৮ বছরে উপনীত হয়েছে।

এছাড়া কন্যাশিশুদের শিক্ষাঙ্গনে ভর্তির হার ৭৪ শতাংশ, মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লাখে ১৯৪ হ্রাস পেয়েছে (বিডিএসএইচ ২০১১)। পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির গ্রহীতার হার ৬১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় হচ্ছে, মাতৃদুগ্ধ খাওয়ানোর প্রবণতা ৬৪ শতাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং পুষ্টিজ্ঞান ও খাদ্য সচেতনতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সকল হচ্ছে বাংলাদেশের অর্জন যা আমাদের অহংকার।

নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নে অনেক সাফল্যের পরিসংখ্যান থাকলেও ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা জাতীয় বিবেক প্রায়ই উদ্বিগ্ন ও হতাশ করে তুলছে। এতে সুশীল সমাজ যেমন উৎকণ্ঠিত, তেমনিভাবে সরকারের প্রশাসনযন্ত্র নিত্যনতুন পরিকল্পনা গ্রহণে নিবেদিত। লক্ষ্যণীয় যে, যথেষ্ট আইনকানুন থাকা সত্ত্বেও সঠিক প্রয়োগের অভাবে নারীদের প্রতি প্রচুর সহিংসতার ঘটনা ঘটছে।

'নারীপক্ষ' নামক মহিলাদের একটি সংগঠন তাদের ২৫ অক্টোবর, ২০১৪এর এক ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করেছে যে, পুলিশ হেড কোয়ার্টার থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে দেখা যায়, ২০১৩ সালে ধর্ষণ, হত্যা, যৌন হয়রানিসহ ২ লাখ ২ হাজার ৫৬৭টি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে যার মধ্যে শুধু ধর্ষণের সংখ্যা হচ্ছে ৪৪ হাজার ১৯২ এবং ৩৫৬ নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া., ৬০ হাজার ৯২৯ নারী নির্যাতনের মামলা হয়েছে, যার অন্যতম কারণ যৌতুক ও অপহরণ। অনেকে মনে করেন, পুলিশের কাছে যেসব মামলা হয় এছাড়াও প্রচুর ঘটনা ঘটছে যার হিসাব-নিকাশ নেই; ভুক্তভোগীরা লোকলজ্জার ভয়ে এসব ঘটনা প্রকাশ করেনি।

'অ্যাকশন এইড' নামক একটি সংগঠন গত বছর নারীর প্রতি সহিংসতা এবং তার ব্যাপ্তি ও পরিধি যাচাইয়ের লক্ষ্যে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করে। তাদের প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে দেখা যায় যে, ৮১ শতাংশ নারী নির্যাতনের অভিযোগ নিয়ে পুলিশের কাছে যেতে অনীহা প্রকাশে করেছে, ৪৭.৫ শতাংশ মহিলা গণপরিবহনে যাতায়াত করতে ভীত ও সন্ত্রস্ত। এছাড়া ৬৫ শতাংশ নারী বলেছে, তারা রাতে ঘর থেকে বাইরে যেতে চায় না; কারণ তাদের শালীনতাহানির আশঙ্কা আছে বলে তারা মনে করে।

এমন সব পরিসংখ্যান অনুসারে প্রতীয়মান হয়ে যে, বাংলাদেশে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ এবং নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নে অনেক কাজ করতে হবে। এটি সুনিশ্চিত করতে হলে সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ আসবে যার মোকাবিলা করা অত্যন্ত জরুরি। এ ক্ষণে কয়েকটি কার্যক্রম গ্রহণ অত্যাবশ্যকীয় বলে ধারণা করা হচ্ছে:

প্রথমত, উত্তরাধিকার আইনের পরিবর্তন আনতে হবে যাতে নারীদের সম্পত্তির উপর অধিকার বর্তাবে এবং যা পক্ষান্তরে যৌতুকের দাবি প্রশমিত করবে।

দ্বিতীয়ত, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ সৃষ্টি করতে হবে। লক্ষ্যণীয় যে, গৃহস্থালি বা পারিবারিক পর্যায়ে নির্যাতনের ঘটনা শহরের বসবাসকারী বিশেষ করে বস্তিবাসীদের মধ্যে প্রতিনিয়ত ঘটছে, যার প্রধান কারণ হল, এখানে কমিউনিটিভিত্তিক প্রতিরোধের সুযোগ নেই। গ্রামে সামাজিক প্রতিরোধ বিরাজমান যা শহরে বিবিধ অঞ্চলের বিভিন্ন শ্রেণির বসবাসকারীদের মধ্যে দৃশ্যমান নয়, অনেক ক্ষেত্রে সম্ভবও নয়। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা গ্রামে যতটা সামাজিক কর্মকাণ্ডে সরব, শহরে ততটা নয়।

তৃতীয়ত, মেয়েদের প্রজননস্বাস্থ্যের অধিকার এবং সেবাপ্রাপ্তির সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে এবং নারীবান্ধব হাসপাতাল ক্লিনিকের সম্প্রসারণ করতে হবে। এ সব ক্ষেত্রে নারী উদ্যোক্তাদের সুযোগ দিতে হবে অধিক।

চতুর্থত, সরকারি বেসরকারি অংশীদারিত্বের মাধ্যমে এইচআইভি/এইড, আরটিআই, এসটিআই, তথ্য প্রচার গণসংযোগ কর্মসূচি প্রচার করে একটি লিঙ্গ সমতাভিত্তিক আন্দোলন সমগ্র দেশে পরিচালনা করতে হবে।

সর্বোপরি, খেয়াল রাখতে হবে, নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে বহুমাত্রিক এবং বহুবিভাগভিত্তিক একটি বিষয় যার বাস্তবায়ন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের সমন্বয়ে মিলিতভাবে গ্রহণ করে লক্ষ্য অর্জনে কাজ করতে হবে। সরকারকেই এখানে সমন্বয় করার দায়িত্ব পালন করতে হবে। দেশবাসীর প্রত্যাশা, এ ব্যাপারে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করবে। খেয়াল রাখতে হবে, কিছু লোক নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বাস করে না; তাদের প্রতিরোধ করতে হবে এবং এর সুফল সম্পর্কে বুঝাতে হবে, তাদের ভুল ভাঙাতে হবে।

বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশা, 'নিরাপদ নগরী, নির্ভয় নারী' এমন একটি শ্লোগান বাস্তবায়নে দেশের সকল স্তরের জনগণ ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা গ্রহণ করবে এবং জাতীয় সমৃদ্ধি লাভে নিরলস উদ্যোগ অব্যাহত রাখবে।

পরিশেষে বলতে হয়, এ কাজ করতে হবে দ্রুত এবং এখনই। কিছুদিন আগে বাংলাদেশে বসবাসরত জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের দেশীয় প্রতিনিধি বলেছেন– If you like to change the future, now is the time– তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলতে চাই, কিছু বদলাতে হলে সময় এখনই।

ধীরাজ কুমার নাথ: সাবেক সচিব।