আইনের ‘স্বাভাবিক’ প্রক্রিয়া ও খালেদা জিয়ার রাজনীতি

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 5 March 2015, 05:00 PM
Updated : 5 March 2015, 05:00 PM

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিলেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৩ এর বিচারক আবু আহমেদ জমাদার। ৪ মার্চ আদালতে মামলার পরবর্তী তারিখ ছিল। কিন্তু বেগম জিয়া সে দিনও আদালতে হাজির হননি। আদালত থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হওয়ার পর মনে করা হচ্ছিল যে, পুলিশ হয়তো বেগম জিয়াকে গ্রেপ্তার করবে। কিন্তু পরোয়ানা জারির এক সপ্তাহের বেশি সময়ের পরও আদালতের আদেশ নাকি সংশ্লিষ্ট থানায় পৌঁছেনি। বিস্ময়কর ঘটনা বটে!

আইন সবার জন্য সমান এবং তার নিজস্ব গতিতে চলবে বলে বলা হলেও বস্তুত তা যে চলছে না সেটা বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি এবং তা যথাযথভাবে তামিল না হওয়ার ঘটনা থেকে কিছুটা বোঝা যাচ্ছে। খালেদা জিয়া দেশের একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং একটি বড় রাজনৈতিক দলের প্রধান বলেই সম্ভবত আদালতের নির্দেশ কার্যকর করার ক্ষেত্রে নানা ধরনের বিবেচনা কাজ করেছে। অন্য একজন সাধারণ নাগরিকের বেলায় বিষয়টি অবশ্যই এ রকম হত না।

আদালতে হাজিরার একদিন আগে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছিলেন, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা, জামিন দেওয়া এবং তাঁর রাজনৈতিক কার্যালয়ে ফেরত পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলে খালেদা জিয়া আদালতে উপস্থিত হতে পারেন। বেগম জিয়া জামিন পাবেন কি পাবেন না সেটা সম্পূর্ণ আদালতের এখতিয়ার। এটা আদালতে উপস্থিত হওয়ার পূর্বশর্ত হতে পারে না। অথচ একজন সিনিয়র আইনজীবী হয়েও খন্দকার মাহবুব হোসেন এই শর্তই দিয়েছিলেন।

বেগম জিয়া আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাঁকে জামিন দেওয়া হত না এটা কেউ বিশ্বাস করেন না। তারপরও তিনি আদালতে উপস্থিত হননি। বলা হয়েছে, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নিরাপত্তার অভাবে তিনি তা পারেননি। আসলে কি তাই? বেগম জিয়া আদালতে গেলে তাঁর জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হত না, এটা কি কোনোভাবে বিশ্বাসযোগ্য?

আইন-আদালতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হয়ে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানে অগ্রাধিকার দিয়ে আদালতে হাজির হওয়া থেকে বিরত থেকেছেন বলে মনে করার যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে। গুলশান কার্যালয় থেকে বেগম জিয়া বের হলেই সরকার ওই কার্যালয়ে তালা লাগিয়ে দেবে বলে তিনি ও তাঁর পরামর্শদাতারা হয়তো মনে করেছেন।

৩ জানুয়ারি রাত থেকেই বেগম জিয়া গুলশান কার্যালয়ে অবস্থান করছেন এবং সেখান থেকে বিভিন্ন উপায়ে নির্দেশনা দিয়ে টানা অবরোধের কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি গুলশান কার্যালয়ে না থাকলে আন্দোলনের কী ক্ষতি হবে সেটা অবশ্য অনেকের কাছেই পরিষ্কার নয়। দেশে আন্দোলনের নামে এখন যা চলছে তার জন্য বেগম জিয়ার উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে অনেকেই মনে করেন না। তাঁকে দুর্নীতির মামলায় গ্রেপ্তার করা হলেও তাঁর সমর্থক এবং অন্যদের কাছেও এটাই মনে হবে যে, বর্তমান আন্দোলনের কারণেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ জন্য সহিংসতার মাত্রা বেড়ে যাওয়ার আশংকাও যে নেই তাও নয়।

হয়তো এসব কারণেই তাঁকে ৪ মার্চের গ্রেপ্তার করে আদালতে উপস্থিত করা হয়নি। মামলার পরবর্তী তারিখ ধার্য হয়েছে ৫ এপ্রিল। তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বহাল আছে। কাজেই ৫ এপ্রিল তাঁকে হয় আদালতে উপস্থিত হতে হবে; অন্যথায় তাঁকে গ্রেপ্তার করে আদালতে নিয়ে যাওয়া হবে। বেগম জিয়া সম্ভবত দ্বিতীয়টি চাইছেন। তিনি স্বেচ্ছায় আদালতে উপস্থিত হলে রাজনৈতিকভাবে খুব একটা সুবিধা পাবেন না। কিন্তু তাঁকে গ্রেপ্তার করা হলে এ থেকে রাজনৈতিক বেনিফিট পাবেন। আবার সরকার হয়তো তাঁকে এই বেনিফিট দিতে চাচ্ছে না।

দু'পক্ষের এই কৌশলের খেলারও একটা শেষ হতে হবে। যেমন, বিএনপি-জামায়াত জোটের চলমান হরতাল-অবরোধেরও একটি পরিসমাপ্তি ঘটতে হবে। প্রশ্ন হল, সেটা কবে এবং কীভাবে? দু'দফায় বিশ্ব ইজতেমা, আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যু, এসএসসি পরীক্ষাসহ বেশ কয়েকটি উপলক্ষ্য ছিল হরতাল-অবরোধ থেকে সরে আসার। কিন্তু সব সুযোগই হাতছাড়া করেছি বিএনপি। এখন যে কোনো উপলক্ষে চলমান 'মানুষখেকো' কর্মসূচি সাময়িক স্থগিত ঘোষণা করলে বিএনপি সব মহলেরই প্রশংসা পাবে।

বিএনপিকে নতুন করে ভাবতে হবে। রাজনীতির নামে হরতাল-অবরোধের মতো অর্থনীতিবিনাশী কর্মকাণ্ড এখন পৃথিবীর কোনো দেশেই করা হয় না। যারা দেশের এবং দেশের মানুষের অগ্রগতি ও উন্নয়ন চান, যারা সামনে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন, তারা কেউ এ ধরনের ধ্বংসাত্মক কর্মসূচির পক্ষে থাকতে পারেন না। কেউ কেউ বলছেন, বিএনপিকে গণতান্ত্রিক রাজনীতিচর্চায় 'স্পেস' না দেওয়ার জন্যই দেশে বর্তমান সহিংসতা চলছে। যারা এ রকম বলেন তারা বিএনপিকে যতটা সুবোধ-সুশীল দল মনে করেন, দলটি কার্যত সে রকম নেই। জামায়াতের সঙ্গদোষে গণতান্ত্রিক চরিত্র অনেকটাই হারাতে বসেছে।

৫ জানুয়ারি বিএনপিকে ঢাকায় সমাবেশ করতে দিলে বর্তমান পরিস্থিতির উদ্ভব হত না বলে যারা মনে করেন, তারা ৫ জানুয়ারি ঘিরে বিএনপির প্রস্তুতির খবর সম্ভবত জানেন না। দাবি মানতে সরকারকে বাধ্য করার জন্য যা যা করা দরকার তা-ই করা হবে– এমন কথা খালেদা জিয়া, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপির শীর্ষনেতারা গত কয়েক মাস ধরে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে প্রকাশ্যেই বলে আসছিলেন। আগের বছর ঢাকায় আন্দোলন দানা না বাঁধায় এবার ঢাকাকেও গরম করার কথা তারা আগে থেকেই বলেছেন।

কোনো ধরনের পূর্ব-প্রস্তুতি না থাকলে ঢাকায় সমাবেশ করতে না দেওয়ায় দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় একই কায়দায় নাশকতা শুরু হল কী করে? পেট্রোল বোমা, ককটেল নিশ্চয়ই মুড়ি-মুড়কির মতো বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না। ইচ্ছে করলেই যে কেউ এটা কিনে যখন-তখন যেখানে সেখানে ছুঁড়ে দিতে পারে না। এটা ব্যবহারের জন্য আগাম পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি থাকতে হয়।

আসল কথা এটাই যে, ৫ জানুয়ারি ঢাকায় সমাবেশ করতে দিলেও বিএনপি-জামায়াত রাজপথ দখলে নিয়ে হেফাজত স্টাইলে পরিস্থিতি 'অশান্ত' করে তুলত, না দেওয়াতে অন্যভাবে সেটাই করছে। তবে বিএনপিকে ঢাকায় সমাবেশ করতে দিলে সরকারের অবস্থান শক্ত হত। বিএনপির 'পেটে পেটে' কী আছে মানুষের কাছে তা আরও বেশি স্পষ্ট হত।

বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া তাঁর সহযোগীদের নিয়ে জবরদস্তি করে বা সন্ত্রাস-সহিংসতার মাধ্যমে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চাইবেন, আর সরকার হাত গুটিয়ে নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করবে, বলপ্রয়োগ করবে না, দমন-পীড়নের আশ্রয় নেবে না, তাই কখনও হয়? দুনিয়ার কোন গণতান্ত্রিক দেশে সরকার পতনের আন্দোলন রাষ্ট্রযন্ত্র দমন করতে তৎপর হয় না? সরকার প্রশাসনিক শক্তির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার করলে সেটা যদি গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিপন্থী হয় তাহলে বিএনপি-জামায়াত জোট রাজনীতির নামে যা করছে তাকে কোন বিবেচনায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকারসম্মত বলা হবে? নারী-শিশুসহ বাসযাত্রীদের পেট্রোল বোমা ছুঁড়ে পুড়িয়ে মারা, বাসের ঘুমন্ত হেলপারকে পুড়িয়ে মারা, কোনোভাবেই গণতন্ত্র ও মানবাধিকারসম্মত হতে পারে না।

সরকার পক্ষের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে যারা বিচলিত তারা হরতাল-অবরোধের নামে বিরোধী পক্ষ প্রতিদিন যে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন করছে, সেটা বলেন না। জাতিসংঘ ঘোষিত সর্বজনীন মানবাধিকার সনদের ১৩ নম্বর ধারায় বলা আছে:

''রাষ্ট্রীয় সীমানার ভেতর প্রত্যেক মানুষের চলাচল ও বসবাসের স্বাধীনতা রয়েছে।''

অথচ অবরোধ-হরতাল আহ্বানকারীরা দু'মাসের বেশি সময় ধরে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ভয় ছড়িয়ে মানুষের চলাচলের এই স্বাধীনতা হরণ করছেন, যা মানবাধিকারের চূড়ান্ত লঙ্ঘন।

বিএনপির সঙ্গে কোনো সমঝোতায় না এলে দেশে সহিংসতা বন্ধ না হয়ে আরও বাড়বে বলে যে আশঙ্কা করা হচ্ছে, রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ তা সঠিক বলে মনে করছেন না। বর্তমানে দেশে যা ঘটছে তার চেয়ে বেশি সন্ত্রাস-সহিংসতা করার শক্তি বা ক্ষমতা বিএনপি-জামায়াতের নেই। ইতোমধ্যে বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা যে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, তাদের দম যে ফুরিয়ে আসছে, সেটা জানা গেছে বিএনপি নেতা ও ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার সঙ্গে নাগরিক ঐক্যের নেতা মাহমুদুর রহমান মান্নার ফাঁস হওয়া টেলিফোন সংলাপ থেকেই।

লন্ডনপ্রবাসী পুত্র তারেক রহমানের পরামর্শে এবং জাতীয়-আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির ভুল বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করেই সম্ভবত খালেদা জিয়া সরকার পতনের চূড়ান্ত অবস্থান নিয়ে ফেলেছেন। আন্দোলন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের প্রকৃত মনোভাব কী সেটা বোঝার চেষ্টাও সম্ভবত করা হয়নি। দেশের মানুষ সব বিএনপির পক্ষে এই ভুল ধারণা থেকেই কর্মসূচি ঘোষণায় বেপরোয়া মনোভাবের পরিচয় দেওয়া হয়েছে। কিছুদিন সন্ত্রাস-সহিংসতা চালালেই সরকারের ক্ষমতার ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়বে, বিদেশিদের নানামুখী তৎপরতা ও চাপে সরকার নমনীয় হতে বাধ্য হবে, সম্ভবত এসব বিবেচনা থেকেই বেগম জিয়া এ আন্দোলনে নেমেছেন।

কোনো পক্ষ বা মহলবিশেষ যদি তাঁকে বিশেষ কোনো আশা দিয়েও থাকে তাহলে তার ওপর নির্ভর করা বেগম জিয়ার উচিত হয়নি। এর আগে নির্বাচনের সময়ও তাঁকে কোনো পক্ষ থেকে সম্ভবত 'ফলস্ হোপ' দেওয়া হয়েছিল। তখনও তিনি প্রতারিত হয়েছিলেন।

আন্দোলনের ঘোষণা দেওয়ার সময় বিএনপির নিজস্ব সাংগঠনিক শক্তি-সামর্থ্যের দিকটি যেমন বিবেচনায় নেওয়া দরকার ছিল, তেমনি এটাও মনে রাখা দরকার ছিল যে, আওয়ামী লীগও দেশের একটি বড় সংগঠিত রাজনৈতিক দল। বিএনপির যেমন জনসমর্থন আছে, তেমনি আওয়ামী লীগও বানের পানিতে ভেসে আসা কচুরিপানা নয়, এই দলের শিকড়ও অনেক গভীরে প্রোথিত।

রাজনীতি বিজ্ঞানের কোনো তথ্যসূত্রই এটা বলে না যে, বর্তমান আন্দোলনে বেগম জিয়া জয়লাভ করবেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারকে ফেলে দেওয়ার মতো বাস্তব অবস্থা দেশে এখনও তৈরি হয়নি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কোনো পরিস্থিতিই সেভাবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রতিকূলে নয়। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি, জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ ঢাকায় নিযুক্ত বিদেশি কূটনীতিকদের বক্তৃতা-বিবৃতি ও তৎপরতায় বিএনপি মহলে নাকি কিছুটা স্বস্তির ভাব দেখা দিয়েছে। তাদের তৎপরতায় সরকার আলোচনায় বসতে বাধ্য হবে, বিএনপি হয়তো এখনও সেটাই বিশ্বাস করছে।

বিদেশি বন্ধুরা যে রাজনীতির নামে সন্ত্রাস-সহিংসতা, মানুষ-হত্যা বন্ধের কথাও জোরালোভাবেই উচ্চারণ করছেন, সেটা বিএনপি নেতৃত্ব শুনতে বা বুঝতে পারছেন না কেন সেটা অনেকেরই বোধগম্য নয়। পেট্রোল বোমায় মানুষ পুড়িয়ে মারা বন্ধ না হলে সরকারের সঙ্গে আলোচনার কোনো সম্ভাবনাই কেউ দেখছেন না।

বিএনপি তথা বেগম জিয়াকে হরতাল-অবরোধের অবসান ঘটাতেই হবে। এটা করলে তার রাজনৈতিক পরাজয় হবে বলে মনে করার কারণ নেই। রাজনীতিতে এক পা এগিয়ে দু'পা পিছিয়ে আসা একটি পুরনো ও কার্যকর কৌশল। তাছাড়া 'সময়' রাজনীতির একটি বড় ফ্যাক্টর বা উপাদান। ঠিক সময়ে ঠিক সিদ্ধান্ত না নিলে রাজনীতিতে কামিয়াব হওয়া কঠিন। বেগম জিয়া সরকার পতনের আন্দোলনের জন্য ভুল সময় বেছে নিয়েছেন। কিলিয়ে যে কাঁঠাল পাকানো যায় না, এটা তিনি ভুলে গেছেন। পেট্রোল বোমা, ককটেল নিক্ষেপ করে শেখ হাসিনাকে যে দুর্বল করা যাবে না, এটা বুঝতে তিনি যত দেরি করবেন, তার ভুলের মাত্রা তত বাড়বে, তাকে তত বেশি খেসারত দিতে হবে।

মানুষের জন্যই রাজনীতি। তাই রাজনীতির নামে সহিংসতা চালিয়ে মানুষ হত্যা করা, দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত করা দেশে কিংবা বিদেশে কেউই সমর্থন করছে না, করতে পারে না।

আরেকটি বড় বিষয় হল, এক সময় যেমন কমিউনিজমের ভূত তাড়া করত, এখন তেমনি ইউরোপ-আমেরিকাকে সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গিবাদের ভূত তাড়া করে ফিরছে। জামায়াত-শিবিরের মতো জঙ্গিবাদী-সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে রাজনীতি করছে বিএনপি। সে জন্যই বিএনপির জামায়াতনির্ভর সন্ত্রাসী রাজনীতির সমর্থনে ইউরোপ-আমেরিকাকে পাশে পাওয়ার সম্ভবনা খুবই কম। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপসহ আরও কেউ কেউ বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগের পরামর্শ ইতোমধ্যেই দিয়েছে।

দেশের রাজনীতি বিদ্বেষপ্রবণ ও সংঘাতপূর্ণ হয়ে ওঠার জন্য আমাদের দেশে এক শ্রেণির নিরপেক্ষ ব্যক্তি শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়াকে সমানভাবে দায়ী করে থাকেন। অথচ বাস্তব এটাই যে, রাজনীতিতে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার ধারাটি বিনষ্ট করেছেন প্রধানত খালেদা জিয়া। এরশাদ পতনের পর আওয়ামী লীগ ও বিএনপি, এই দুই দলের ঐতিহাসিক সমঝোতার ভিত্তিতেই সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় ফেরা সম্ভব হয়েছে।

তারপর বেগম জিয়া যা করেছেন তা কোনোভাবেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষায় সহায়ক হয়নি। প্রধানমন্ত্রী হয়ে খালেদা জিয়া ১৫ আগস্ট নিজের জন্মদিন পালন শুরু করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর শোকাবহ দিনটি আকস্মিকভাবে নিজের জন্মদিন বানিয়ে সমঝোতার রাজনীতির বুকে প্রথম পেরেক ঠুকে দেন বেগম জিয়া। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করতে কুখ্যাত ইনডেননিটি অধ্যাদেশ বাতিলের জন্য সংসদে আওয়ামী লীগ উত্থাপিত বিল হিমঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের প্রতি সমর্থন, সহযোগিতাও অব্যাহত রাখেন বেগম জিয়া। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর খুনিচক্রের অন্যতম কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) আবদুর রশিদকে সংসদে বিরোধী দলের নেতাও বানানো হয়েছিল।

এসব ঘটনা কি আওয়ামী লীগের জন্য স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়া সহজ? বেগম জিয়া ক্রমাগত 'কলসির কণা' মারবেন, আর শেখ হাসিনা তার প্রতি 'প্রেম' বিলাবেন– রাজনীতিতে তা কি কখনও হয়? আওয়ামী লীগকে নির্মূল করার মিশন বেগম জিয়ার নেই তাই-বা কীভাবে প্রমাণ করা যায়? একুশ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মতো মর্মান্তিক ও বর্বরোচিত ঘটনা বেগম জিয়া ক্ষমতায় থাকতেই ঘটেছিল। কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল তখন সরকারের পক্ষ থেকে?

এছাড়া সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া, আহসানউল্লাহ মাস্টারসহ আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় নেতাদের হত্যার ঘটনাও ঘটেছিল বেগম জিয়ার প্রধানমন্ত্রিত্বকালেই। আওয়ামী লীগকে নির্মূল করতে চাইবে বিএনপি, আর বিএনপিকে দুর্বল কিংবা পরাস্ত করতে চাইবে না আওয়ামী লীগ, তাই কি হয়?

বেগম জিয়াকে গ্রেপ্তার করে আদালতে হাজির না করায় আইনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হয়তো ব্যাহত হয়েছে। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সরকারের সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশও ঘটেছে। এখন বিএনপিকেও হরতাল-অবরোধের সহিংস কর্মসূচি থেকে সরে আসার ইতিবাচক মনোভাব দেখাতে হবে। বিএনপিকে মনে রাখতে হবে, সরকারকে তারা আন্দোলন করে যতটা না চাপে রাখতে পারবে, সরকার প্রশাসনিক ও আইনি চাপ প্রয়োগ করে তাদের তার চেয়ে বেশি কোণঠাসা করতে পারবে।

তাই এখন বিএনপিকেই ঠিক করতে হবে, তারা কি জামায়াতকে নিয়ে কোণঠাসা অবস্থাতেই থাকতে চায়, নাকি জামায়াতকে বাদ দিয়ে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির ধারায় ফিরে স্বস্তিকর রাজনৈতিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনবে?