সুশীলদের ‘ট্রিপল সি’

বিজন সরকার
Published : 3 March 2015, 05:16 AM
Updated : 3 March 2015, 05:16 AM

উনিশশ' একানব্বই সালে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের যাত্রার পর থেকেই আমাদের সমাজের ভিতরকার বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষুদ্র সম্প্রদায়টি ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রের সকল বিষয়ে এই সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণমূলক সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রতিনিধিদের সংখ্যাও সময়ের হাত ধরে বেড়ে যায়। এই সম্প্রদায়টি আমাদের মনোজগতে সুশীল সমাজ কিংবা নাগরিক সমাজ নামে পরিচিত।

যখনই 'সুশীল সমাজ' কিংবা 'নাগরিক সমাজ' শব্দগুচ্ছগুলো শুনতে পাই, আমাদের ভিতরে এক ধরনের বিশ্বাস জন্ম নেয়। বহু প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক সমাজের প্রতি আমরা আস্থা হারালেও নাগরিক সমাজের উপর আমরা আস্থা রাখি। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, শিল্প প্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতিক সংগঠন, শ্রমিক সংগঠনসহ বহু উন্নয়নমুখী সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণয়নে আমাদের নাগরিক সমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। যেমন, দেশের শিক্ষা নীতি, নারী নীতি, কয়লা নীতিসহ অনেক ক্ষেত্রেই। তাছাড়া রাষ্ট্রের প্রয়োজনে ছোট বড় বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিয়েও নাগরিক সমাজ গুরুদায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। এক কথায় বলা যায়, দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং সমাজে নাগরিক সমাজের ভূমিকা সমান্তরাল। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা দেশের রাজনৈতিক দলগুলির সহায়ক এবং পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেও দেশের গণতন্ত্র আরও পরিশীলিত, আরও উন্নত করছেন।

তবে দুর্ভাগ্যজনক হল, এই ক্ষুদ্র নাগরিক সমাজের মধ্যে অতি ক্ষুদ্রাকার একটি অংশ আবার গণতান্ত্রিক চর্চায় তেমন আগ্রহী নয়। লেখার শিরোনামে 'সুশীল' শব্দটি দ্বারা এই অতি ক্ষুদ্রাকার নাগরিক সমাজকেই বুঝানো হয়েছে। এই নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা আবার অনেকটাই, 'স্বঘোষিত' সুশীল। সংখ্যায় নগণ্য হলেও এই অতি ক্ষুদ্রাকার নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা অনেক বেশি প্রভাবশালী। উনারা সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। সমাজের বিভিন্ন জনপ্রিয় ইস্যু পুঁজি করে যুতসই প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক মাঠ গরম করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করাই এই অতি ক্ষুদ্রাকার নাগরিক সমাজের মূল্য উদ্দেশ্য।

এই অতি ক্ষুদ্রাকার নাগরিক সমাজের মধ্যে ব্যর্থ রাজনীতিবিদ ও সুশীল, দ্বৈত পরিচয় দানকারী ব্যক্তিরা যেমন রয়েছেন, তেমনি রয়েছেন গণতান্ত্রিক সরকারগুলি থেকে বিভিন্ন সময়ে নানাবিধ সুবিধাগ্রহীতারাও। যেমন রয়েছেন পশ্চিমা গোষ্ঠীর বহুমুখী ভু-রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষাকারীরা, তেমনি রয়েছেন পাকিস্তানের আইএসআইয়ের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সহযোগীরাও। উল্লেখ্য, দেশের একটি পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের বিরুদ্ধে (বর্তমানে জেলে রয়েছেন) পাকিস্তানের সেনা গোয়েন্দা আইএসআইয়ের কাছ থেকে চল্লিশ হাজার ডলার নেওয়ার অভিযোগ ছিল।

এই অতি ক্ষুদ্রাকার নাগরিক গোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের সম্প্রতি বিভিন্ন ফোরামে দেওয়া বক্তব্য, মন্তব্য এবং লেখালেখি বিশ্লেষণ করলে একটি সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। এরা সবাই চলমান রাজনৈতিক সহিংসতা ও পেট্রোল বোমা দিয়ে সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে মারার মতো জঙ্গিবাদী কর্মসূচিও বিভিন্ন প্রেক্ষাপটের আলোকে ইনিয়ে বিনিয়ে জাস্টিফাই করে যাচ্ছেন। গত দু'মাসে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে এই অতি ক্ষুদ্রাকার নাগরিক গ্রুপটির প্রতিনিধিরা যে সব বক্তব্য দিয়েছেন, সে সব ডিসকোর্স বিশ্লেষণ করলে তাদের একটি সমন্বিত হোমওয়ার্কের স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। প্রত্যেকের বক্তব্যে, মন্তব্যে কিংবা লেখায় একটি চমৎকার উপসংহার থাকে।

উপসংহারের বিষয়বস্তু হল, "অবশ্যই দেশে চলমান রাজনৈতিক সহিংসতা বন্ধ হতে হবে। তবে এই সব সহিংসতার জন্য কে দায়ী, তা প্রমাণ ছাড়া বলাটা যৌক্তিক হবে না। কিন্তু রাজনৈতিক সহিংসতা বন্ধ করতে হলে আমাদেরকে এই সহিংসতার উৎস মুলে যেতে হবে। আর এই উৎস মূল হল ৫ জানুয়ারির নির্বাচন। যদি মূল নিয়ে আলোচনা না হয় তাহলে তৃতীয় শক্তি ক্ষমতায় আসতে পারে। একই সঙ্গে দেশের ভিতর জঙ্গি কর্মকাণ্ড বেড়ে যাবে।"

সবচেয়ে লজ্জার এবং ভয়ঙ্কর বিষয়টি হল, এই ক্ষুদ্র সুশীল গোষ্ঠী পাকিস্তান কিংবা আইএসের মতো বোমা মেরে সাধারণ জনগণ হত্যার বিষয়টি রাজনৈতিক সহিংসতা বলে মনে করেন, জঙ্গিবাদ নয়। আপনি যদি এই সুশীল সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের কথাবার্তা পর্যালোচনা করেন, কোথাও দেখবেন না যে, আগুনে মানুষ পুড়িয়ে মারার বিষয়টির উনারা স্পষ্ট প্রতিবাদ জানিয়েছেন। অনেকটা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে বিএনপির কৌশলী অবস্থানের মতোই: "আমরাও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই, তবে/কিন্তু…, ব্লা ব্লা ব্লা।''

১. প্রেক্ষাপট (contexts)

কথিত এই অতি ক্ষুদ্রাকার নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা নির্দিষ্ট কিছু প্রেক্ষাপটে (contexts) খুব বেশি সোচ্চার হয়ে উঠেন। সমাজের বহু বিষয়ে উনাদের বক্তব্য থাকলেও দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা উনাদের কাছে আশীর্বাদ হয়ে উঠে। সেটি উনাদের ক্যারিয়ারের ভালো সময়। বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে যখন দেশের রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে বিবাদ তুঙ্গে থাকে, তখন তারা নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে রাজনৈতিক আগুনে কৌশলে ঘি ঢালেন। নিরাপদ দূরত্বে থেকে জাতির ক্রান্তিকালে সাদাকে কালো আর কালোকে সাদা বলে একটি জটিলতর প্রেক্ষাপট নির্মাণ করেন। এতে সাধারণ জনগণ সাদা-কালোর ভিতর ঘুরপাক খেতে থাকে। ফলে সাধারণের মধ্যেকার বিচার-বিশ্লেষণ করার স্বাভাবিক চেতনাও লোপ পায়।

উনিশশ' একানব্বইয়ের পর থেকেই বেশ কিছু হাই-প্রোফাইল রাজনীতিবিদ গণতান্ত্রিক চর্চার কাঠামোর ভিতর থেকে নিজের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়ে রাজনৈতিকভাবে পতিত হয়ে পড়েন। সর্বশেষ এক এগারোর পর পতিত রাজনীতিবিদের তালিকটি দীর্ঘ হয়। দেশের বড় দুটি দল থেকে অনেক বড় বড় রুই কাতলা ছিটকে পড়েন। হতাশাগ্রস্ত সেই সব রাজনীতিবিদেরা বিভিন্ন সুবিধাবাদী পকেটে রাজনীতিবিদ ও সুশীলদের ক্লোনিং হয়ে ওঠেন। প্রেক্ষাপট অনুয়ায়ী কখনও রাজনীতিবিদ, কখনও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি। এরা কোন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিত্ব করছেন, তা সাদেক হোসেন খোকার সঙ্গে মাহমুদুর রহমান মান্নার প্রকাশিত অডিও সংলাপে বেশ স্পষ্টভাবেই প্রতিফলিত হয়েছে। কেবল মান্নার রাজনৈতিক চরিত্রটি এখানে প্রকাশ পেলেও মান্নার চেয়ে আরও বড় সুশীলরা 'মান্না-মুখোশ' পরে সমাজ পরিবর্তনের জন্য দামি দামি বাণি দিয়ে বেড়াচ্ছেন।

আবার জাতীয় নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে এই সুশীল সমাজের কাছে দুটি স্বতন্ত্র প্রেক্ষাপট রয়েছে। একটি হল, বিএনপি যখন ক্ষমতায়; আরেকটি হল, আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায়। কোন দল ক্ষমতায় আর কোন দল বিরোধী দলে তা সাপেক্ষে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে এই অতি ক্ষুদ্রাকার নাগরিক সমাজের দ্বৈত নীতি অবলম্বন করতে হয়। দেশের বড় দুটি দলের সাংগঠনিক সক্ষমতা ও বৈশ্বিক ভু-রাজনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে তারা নিজেদের অবস্থান নির্ধারণ করেন।

সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগের তুলনায় বিএনপির অবস্থান অনেকটা পিছিয়ে। ফলে দল দুটিকে রাজনৈতিকভাবে ভারসাম্যপূর্ণ সংঘাতমুখী করতে সুশীলদের দুটি কাজ করতে হয়। বিএনপি যখন ক্ষমতায় থাকে তখন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বিএনপিকে পরোক্ষভাবে সমর্থন দিয়ে আরও কঠোর হওয়ার জন্য উজ্জীবিত করেন। আবার বিএনপি যখন ক্ষমতার বাইরে থাকে এবং সরকারবিরোধী আন্দোলন করে, তখন দলটির সঙ্গে সুর মিলিয়ে বিএনপির মেধাবৃত্তিক অপুষ্টির ঘাটতি দূর করে। এই সুশীলদের উদ্দেশ্য বিএনপিকে ক্ষমতায় আনা কিংবা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় থেকে নামানো নয়। মূল উদ্দেশ্য, দল দুটির মধ্যেকার দূরত্বকে আরও বাড়িয়ে রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি করে নিজেদের সুপ্ত বাসনা বাস্তবায়ন।

প্রসঙ্গত, ২০০১-২০০৬ সালে জামায়াত-বিএনপি (জামায়াত শব্দটি বিএনপি শব্দটির আগে সচেতনভাবেই ব্যবহার করা হয়েছে) জোট যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন সুশীলদের একটি বড় অংশ বিএনপির বিতর্কিত নির্বাচনমুখী পদক্ষেপে বিভিন্নভাবে সমর্থন দিয়ে গেছেন। নির্বাচন কমিশনের ভোটার তালিকায় এক কোটি বত্রিশ লাখ ভুয়া ভোটার থাকার পরেও নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস তৎকালীন মেয়র সাদেক হোসেন খোকার দেওয়া সংসদ ভবনের সামনে নাগরিক সংবর্ধনায় আওয়ামী লীগকে বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় তাগিদ দিয়েছিলেন। আন্দোলনের নামে যে দেশের অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে, তাও স্মরণ করিয়ে দিয়ে নির্বাচনে যাওয়ার জন্য পরোক্ষভাবে আওয়ামী লীগকে আহ্বান জানালেন। অথচ জামায়াত-বিএনপির বিতর্কিত প্রধান উপদেষ্টা, বিতর্কিত নির্বাচন কমিশন, বিতর্কিত ভোটার তালিকা এবং বিতর্কিত সম্ভাব্য ২২ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে টু-শব্দটি করেননি। একই ব্যক্তি ২০১৩ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন নিয়ে বিএনপির সমান্তরাল অবস্থান নিয়েছেন– 'সকল জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া একটি অর্থবহ নির্বাচন সম্ভব নয়' বলে স্পষ্ট মতামত দিয়ে।

২. বিষয়বস্তু (contents)

নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা যখন দেশের রাজনৈতিক বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করেন, তখন একটি উচ্চমাত্রার (!!) সরলীকরণ প্যারামিটার সচেতনভাবেই ব্যবহার করেন। উনাদের ব্যবহৃত প্যারামিটারে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি একই, মুদ্রার এ পিঠ ও পিঠ। প্রায়ই তীর্যক ভাষায় তারা বলেন, 'যেই লাউ সেই কদু'। তাদের দৃষ্টিতে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যকার মৌলিক পার্থক্যের রেখাপাতটি অস্পষ্ট।

দল দুটি পালাক্রমে বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতায় ছিল। প্রশ্ন জাগে, দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অনুষঙ্গে উন্নয়নের ক্ষেত্রে দল দুটির সফলতা ও ব্যর্থতার মধ্যে কি কোনো পার্থক্য নেই? একাত্তরের চেতনা অনুসরণ, বাস্তবায়ন ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে দল দুটির অবস্থানগত স্পষ্ট পার্থক্যটি নাগরিক সমাজের চোখে পড়ে না? ধর্ম, বর্ণ ও বিশ্বাস নির্বিশেষে সহাবস্থানের সহায়ক ভূমিকার ক্ষেত্রেও আওয়ামী লীগ আর বিএনপির মধ্যে কি ফারাক নেই?

আজ যারা নাগরিক সমাজের স্বঘোষিত প্রতিনিধি, তারা আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির ব্যর্থতাকে একই প্যারামিটারে মূল্যায়ন করেন। কিন্তু কোনোভাবেই বলা যাবে না যে, আওয়ামী লীগের কোনো ব্যর্থতা নেই এবং দলটি একেবারেই ধোয়া তুলশী পাতা। অপরদিকে, এটি একেবারেই ঠিক নয় যে, দেশের উন্নয়নে বিএনপির কোনো অবদান নেই। দেশ গঠনে বিএনপির বহু সফলতা রয়েছে। তার মানে এই নয় যে, রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের তুলনামূলক বিচারের প্যারামিটারে দল দুটির সক্ষমতা অভিন্ন। নাগরিক সমাজের আলোচনার বিষয়বস্তুতে এই তুলনামূলক চিত্রটি কখনও আসে না।

তাই দ্ব্যর্থহীনভাবেই বলা যায়, নাগরিক সমাজের সোজা-সাপটা সরলীকরণের মধ্যে সততা নেই। নেই যৌক্তিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। অথচ বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের একটি বিশাল অংশের মধ্যে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা একটি ধারণা প্রতিনিয়ত নির্মাণ করে যাচ্ছেন যে, বড় দুটি দলের মধ্যে পার্থক্য নেই। ফলে দল দুটি দ্বারা দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই দেশের উন্নয়নের জন্য দরকার নাগরিক সমাজের মতাদর্শের একটি রাজনৈতিক শক্তি। সে লক্ষ্যে উনারা কাজও করে যাচ্ছেন। এতেও তারা সন্তুষ্ট নন। কারণ, দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজেদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে বিশ্বাসী নন, 'সংক্ষিপ্ত' পথই তাদের কাম্য।

এক-এগারোর আগে দেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস বিএনপি প্রতি পরোক্ষভাবে সমর্থন জ্ঞাপন করলেও এক-এগারোর জরুরি অবস্থার সময় সেনাসমর্থিত সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় 'নাগরিক শক্তি' নামের একটি দল গঠন করেন। দেশের একটি ইংরেজি দৈনিকের সম্পাদকের নাগরিক শক্তির সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের কথা ছিল। তখন সকল ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকলেও তারা সেনা-সমর্থিত সরকার থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা পেয়ে মহাআনন্দে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছিলেন। অনেকেই সরকারি বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়ে যান। দেশের একটি স্বনামধন্য বাংলা পত্রিকা প্রকাশ্যে 'মাইনাস টু থিওরি' বাস্তবায়নের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। দল দুটির প্রধানকে সরাতে ব্যর্থ হয়েও পত্রিকাটি থামেনি। পরবর্তীতে পত্রিকাটি জাতীয় নির্বাচনে যোগ্য প্রার্থীর জন্য 'হান্টিং' প্রোগ্রামও পরিচালনা করেছিল।

নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা দেশে আইনের শাসনের ঘাটতি নিয়েও সোচ্চার। রাজনৈতিক দলগুলির বিরুদ্ধে সমালোচনার বিষয়বস্তুর মধ্যে সুশাসনের অভাবটিও অন্যতম। বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতায় যে দলই ছিল, প্রত্যেক দলের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, সুশাসনের অভাবের অভিযোগ ছিল। এখনও আছে। এসব আমাদের সামাজিক সমস্যা। বিশ্বের বহু দেশেই এ ধরনের সমস্যা রয়েছে। ভারতের কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বড় ধরনের দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠেছিল। অনেক মন্ত্রী জেলেও গিয়েছে। এটি চরম সত্য যে, আমাদের দেশে আইনের শাসন প্রত্যাশিত পর্যায়ে নেই। তাই বলে কি 'সেনাপ্রিয়' দেবপ্রিয়রা অগণতান্ত্রিক শক্তিকে দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় বসানোর প্রেক্ষাপট নির্মাণের জন্য কাজ করে যাবেন? উনারা ভালো করেই জানেন যে, যে কোনো সামরিক শাসনের চেয়ে সামান্যতম গণতন্ত্র সকল বিচারেই ভালো। কারণ গণতন্ত্রের বিকল্প গণতন্ত্রই হয়।

তবে লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, জাতীয় অনেক বিষয়ে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সংবেদনশীলতা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শূন্যের কোটায়; মাঝে মাঝে ঋণাত্মকও। উনাদের সুশীল ডিসকোর্সে ১৫ আগস্ট নিয়ে আলোচনা নেই; জেলহত্যা নিয়ে ক্ষোভ নেই; ২১ আগস্ট নিয়ে আগ্রহ নেই। যদি কোনো প্রেক্ষাপটে এসব নিয়ে আলোচনা করতেই হয়, তখন দেশের বিদ্যমান রাজনীতির দোষ দিয়ে নিজেদের সুশীল 'ক্যাশ'এ সস্তা জনপ্রিয়তা জমা করেন। দেশের চলমান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে তাদের অনাগ্রহই বরং বিভিন্ন পর্যায়ে প্রকাশ পেয়েছে। ড. কামাল হোসেনের মতো রাজনৈতিক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধির মেয়ের জামাই মি. ডেভিড বার্গম্যান যুদ্ধাপরাধী রক্ষা প্রকল্পে অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন। ট্রাইব্যুনাল নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করায় আদালত কর্তৃক বার্গম্যান সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার ফলে নাগরিক সমাজের উনপঞ্চাশ জন সদস্য বার্গম্যানের পক্ষে আদালতের রায়ের উপর বিবৃতি দেন। আদালতের তলবের ফলে এদের মধ্যে অনেকেই এ বিবৃতি দেওয়ার জন্য আদালতের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছেন। প্রসঙ্গত, ড. ইউনূসের পক্ষেও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে লবিস্ট হিসেবে বার্গম্যানের 'সুখ্যাতি' রয়েছে।

৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে এই সুশীল শ্রেণির আলোচনায় দেশের বড় দুটি দলের সমালোচনায় অনেকটা ভারসাম্য লক্ষ্য করা যায়। কেবল ড. ইউনূস নয়, সুশীলদের মধ্যে বহু নেগেটিভ প্রিন্স এক-এগারোর মদো আরেকটি রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টির অপচেষ্টায় লিপ্ত ছিল। পর্যবেক্ষণ করলে একটি বিষয় প্রতীয়মান হয়, নাগরিক সমাজের কাউকে কোথাও জাতীয় নির্বাচন পরিচালনার জন্য কেয়ারটেকার সরকারের যৌক্তিকতা নিয়ে কথা বলতে দেখা যায়নি। কেউ বলেনি যে, আমাদের একটি স্বচ্ছ ভোটার তালিকা রয়েছে এবং চারদলীয় জোট সরকারের তুলনায় মহাজোট সরকারের নির্বাচন ব্যবস্থা ও পরিচালনার সক্ষমতা বেড়েছে। কাউকে বলতে শুনিনি যে, নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার মধ্য দিয়ে স্থায়ী সমাধানের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। বর্তমান বাস্তবতায় বিএনপির কেয়ারটেকার ব্যবস্থার দাবিটি যে ১৯৯৬ সালের মতো গ্রহণযোগ্য নয়, সেটি বিএনপিকে বলার মতো সাহস আমাদের সুশীল সমাজ দেখায়নি। নাগরিক সমাজ থেকে বিএনপিকে যদি কেয়ারটেকার সরকারের দাবির যৌক্তিকতার বিষয়ে সৎ ও বাস্তবতার নিরিখে পরামর্শ দেওয়া হত, তাহলে দেশে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হত না।

দেশের ভিতরে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর সিস্টেমেটিক নির্যাতন হওয়ার বিষয়টিও আমাদের নাগরিক সমাজের আলোচনায় বিষয়বস্তু নয়। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় মদদে যেভাবে সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার নির্যাতন হয়েছে, সে বিষয়ে কি প্রতিবাদ করেছিল এই নাগরিক সমাজ? দেশব্যাপী জঙ্গিদের অভয়ারণ্য হলেও নাগরিক সমাজকে বক্তব্য-বিবৃতি দিতে দেখা যায়নি। কারণ এ সব ইস্যু বিভিন্নভাবে নাগরিক সমাজের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সমান্তরাল।

৩. ফলাফল (consequences)

নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা প্রেক্ষাপট এবং বিষয়বস্তুগুলি 'চুজ অ্যান্ড পিক' পদ্ধতির মাধ্যমে গ্রহণ করেন। এতে বিভিন্ন ধরনের ফলাফল প্রকাশ পায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ পদ্ধতির ফলাফল ক্ষমতালীপ্সু সুশীলদের পক্ষে যায় না। বরং নিজেদের দীর্ঘদিনের সঞ্চিত সামাজিক সম্মান ও গ্রহণযোগ্যতায় কালো দাগ পড়ে যায়। তবে ফলাফল নিজেদের পক্ষেই যাক আর বিপক্ষেই, মাঝখানে দেশের বিশাল ক্ষতি হয়ে যায়। যদি বিপরীতমুখী সমান্তরাল রেখার সঙ্গে সুশীলদের স্বপ্নভঙ্গ ও স্বপ্নপূরণের তুলনা করি, তবে দেশের সম্ভাব্য ক্ষতিটি এই সমান্তরাল রেখার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকে।

নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা যখন ব্যর্থ হন, তখন উনাদের ব্যক্তিগত ইমেজ হঠাৎ করেই তলানিতে গিয়ে ঠেকে। তবে উনারা যতক্ষণ রেইসে থাকেন, অফ স্ক্রিনে যে কোনো ধরনের অনৈতিক পদক্ষেপ নিতেও দ্বিধাগ্রস্ত হন না। উদ্দেশ্য একটাই, যেভাবেই হোক অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছুতে হবে।

ড. কামাল হোসেনের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের দিকে তাকালে পাহাড়সম ব্যর্থতার চিত্রটি সামনে আসে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ার আগে ড. কামালের প্রতি আওয়ামী লীগের অবস্থান নিছক ব্যক্তিগত রেষারেষি বলেই মনে হয়েছিল। ২০১০ সালের পর থেকে তাঁর অবস্থান দ্রুত প্রকাশ হয়ে যায়। যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত অবস্থান অস্পষ্ট। তবে তাঁর মেয়ের জামাই, ডেভিড বার্গম্যানের লম্ফঝম্প লক্ষ্যণীয়।

রাজনৈতিক জীবনেও ড. কামালের স্বার্থপরতা ও সুবিধাবাদিতার চিত্রটি উজ্জ্বল। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তাঁর জীবিত দুই তনয়া একটি বিবৃতি দিতে বিদেশ সফররত কামালকে অনুরোধ করেছিলেন। উনি তা না করে কূটনৈতিক পাসপোর্টটি লন্ডনের বাংলাদেশের হাই কমিশনে জমা দিয়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে রিসার্চ ফেলো হিসাবে থেকে যান। অতিসম্প্রতি মান্না-খোকার ভাইবার সংলাপেও জাতিসংঘ থেকে চিঠি ইস্যুর বিষয়টি ড. কামাল জানতেন এমন একটি ধারণা পাওয়া যায়। আজকের বাস্তবতায় তাঁকে রাজনৈতিকভাবে বিশ্বাস করে তেমন মানুষ খুব বেশি পাওয়া যাবে না।

২০০৬ সালে নোবেল পাওয়ার পর থেকেই ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ক্ষমতার লীপ্সাটি গোপন থাকেনি। এক-এগারোর সময় সেনা-সমর্থিত সরকারের বিভিন্ন অনৈতিক সমর্থন নিয়েও তিনি দল গঠন করতে ব্যর্থ হন। পরে অন্যায়ভাবে ব্যক্তিগত স্বার্থে বিদেশি ফান্ড তছরুপ করা ও ট্যাক্স ফাঁকির বিষয়টি জনগণের সামনে চলে আসে। ফলে ইউনূসের ব্যক্তিগত ইমেজ কালিমালিপ্ত হয়। দেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী হলেও রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার কারণে জনগণের বিশাল একটি অংশের শ্রদ্ধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তিনি।

মাহমুদুর রহমান মান্না রাজনৈতিক জীবনে জাসদ, বাসদ, জনতা মুক্তি পার্টি, তারপর আওয়ামী লীগ ঘুরে সেনা-সমর্থিত সরকারের সময় সংস্কারপন্থী বনে গেলেন। তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের শুরুর দিক নিয়ে একটি বিতর্কও রয়েছে। স্বাধীনতার আগে ছাত্র সংঘের (বর্তমান ইসলামিক ছাত্র শিবির) রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে কথিত আছে। যাহোক, গণতান্ত্রিক কাঠামোতে ইচ্ছানুযায়ী রাজনৈতিক ক্যারিয়ার না পাওয়ার ফলে 'নাগরিক ঐক্য' নামে সুশীলদের নিয়ে তিনি একটি প্ল্যাটফর্ম বানালেন। ভাইবার কেলেঙ্কারির মধ্য দিয়ে এই সুশীল ছদ্মবেশী মান্নার মুখোশ উন্মোচনের ফলে রাজনীতিবিদ হিসেবে জনগণের সামনে তিনি আর আসতে পারবেন বলে মনে হয় না।

নাগরিক সমাজের ষড়যন্ত্রের কারণে আমাদের দেশের সরকারগুলিকে মাঝে মাঝে বিপদে পড়তে হয়। যেমন ধরুন, গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিগত মহাজোট সরকারের বিবাদ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। উচ্চ আদালতে ইউনূস হেরে গেলেও বাংলাদেশকে এর খেসারত দিতে হয়েছে। মার্কিনপন্থী এই নোবেল বিজয়ীর সঙ্গে সরকারের বৈরি আচরণ মার্কিন প্রশাসন ভালোভাবে নেয়নি। ফলে দুর্নীতির 'কথিত' অভিযোগে পদ্মা সেতু থেকে বিশ্ব ব্যাংকের ঋণ, পোশাক শিল্পে কর্মের পরিবেশ ও শ্রমিকদের নিরাপত্তার অজুহাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বাতিল করে। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের চেয়ে কম্বোডিয়াসহ বহু দেশে পোশাক শিল্পের কর্মপরিবেশের অবস্থা আরও খারাপ। তবু তারা জিএসপি পাচ্ছে।

দুঃখজনক হল, যখন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা ষড়যন্ত্রে সফল হন, তখন এক-এগারোর মতো পরিবেশ তৈরি হয়। উনারা বিরাজনীতিকরণের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক কাঠামোতে দীর্ঘমেয়াদী শূন্যতা তৈরির অপচেষ্টা করেন। সমাজের ভিতরকার অসংগঠিত বিভিন্ন শক্তিকে সংগঠিত করে রাজনৈতিক দলগুলির বিকল্প হওয়ার জন্য নানাবিধ প্রণোদনা দেন। দেশের অ্যাকটিভ ট্যাংককে 'থিংক ট্যাংক' হিসেবে রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত করার কার্যকলাপ পরিচালনা করেন। বিনিময়ে নাগরিক সমাজ মানসিক সুখ পান, পরমানন্দ উপভোগ করেন।

এমন পরিস্থিতিতে দেশের সুশীল সমাজের ভূমিকা নিয়ে সাধারণ মানুষের সচেতন হওয়া জরুরি।

বিজন সরকার: গবেষক।